আমি তখন লণ্ডনে। মাসটি ঠিক মনে নেই; বোধ হয় অক্টোবরের শেষ, কিম্বা নভেম্বরের প্রথম। কেননা এইটুকু মনে আছে যে, তখন চিমনিতে আগুন দেখা দিয়েছে। আমি একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি যে, সন্ধ্যে হয়েছে; যেন সূর্যের আলো নিভে গেছে, অথচ গ্যাসের বাতি জ্বালা হয়নি। ব্যাপারখানা কি বোঝবার জন্য জানালার কাছে গিয়ে দেখি, রাস্তায় যত লোক চলেছে সকলের মুখই ছাতায় ঢাকা। তাদের ভিতর পুরুষ স্ত্রীলোক চেনা যাচ্ছে শুধু কাপড় ও চালের তফাতে। যারা ছাতার ভিতর মাথা গুজে, কোনও দিকে দৃকপাত না করে, হহ করে চলেছেন, বুঝলুম তারা পুরুষ; আর যারা ডানহাতে ছাতা ধরে বাঁহাতে গাউন হাঁটুপর্যন্ত তুলে ধরে কাদাখোচার মত লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছেন, বুঝলুম তারা স্ত্রীলোক। এই থেকে আন্দাজ করলুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে; কেননা এ বৃষ্টির ধারা এত সূক্ষম যে তা চোখে দেখা যায় না, আর এত ক্ষীণ যে কানে শোনা যায় না।
ভাল কথা, এ জিনিষ কখনও নজর করে দেখেছ কি যে, বর্ষার দিনে বিলেতে কখনও মেঘ করে না? আকাশটা শুধু আগাগোড়া ঘুলিয়ে যায়, এবং তার ছোঁয়াচ লেগে গাছপালা সব নেতিয়ে পড়ে, রাস্তাঘাট সব কাদায় প্যাচপ্যাচ, করে। মনে হয় যে, এ বর্ষার আধখানা উপর থেকে নামে, আর আধখানা নীচে থেকেও ওঠে, আর দুইয়ে মিলে আকাশময় একটা বিশ্র৷ অস্পৃশ্য নোঙরা ব্যাপারের সৃষ্টি করে। সকালে উঠেই দিনের এই চেহারা দেখে যে একদম মনমরা হয়ে গেলুম, সে কথা বলা বাহুল্য। এরকম দিনে, ইংরাজরা বলেন তাদের খুন করবার ইচ্ছে যায়; সুতরাং এ অবস্থায় আমাদের যে আত্মহত্যা করবার ইচ্ছে হবে, তাতে আর আশ্চর্য কি?
আমার একজনের সঙ্গে Richmond-এ যাবার কথা ছিল, কিন্তু এমন দিনে ঘর থেকে বেরবার প্রবৃত্তি হল না। কাজেই ব্রেকফাষ্ট খেয়ে Times নিয়ে পড়তে বসলুম। আমি সেদিন ও-কাগজের প্রথম অক্ষর থেকে শেষ অক্ষর পর্যন্ত পড়লুম; এক কথাও বাদ দিই নি। সেদিন আমি প্রথম আবিষ্কার করি যে, Times-এর শাঁসের চাইতে তার খোস, তার প্রবন্ধের চাইতে তার বিজ্ঞাপন ঢের বেশী মুখরোচক! তার আর্টিকেল পড়লে মনে যা হয়, তার নাম রাগ; আর তার অ্যাড্ভার্টিস্মেন্ট পড়লে মনে যা হয়, তার নাম লোভ। সে যাই হোক, কাগজ-পড়া শেষ হতে-না-হতেই, দাসী লাঞ্চ এনে হাজির করলে; যেখানে বসেছিলুম, সেইখানে বসেই তা শেষ করলুম। তখন দুটো বেজেছে। অথচ বাইরের চেহারার কোনও বদল হয়নি, কেননা এই বিলাতী বৃষ্টি ভাল করে পড়তেও জানে না, ছাড়তেও জানে না। তফাতের মধ্যে দেখি যে, আলো ক্রমে এত কমে এসেছে যে, বাতি না জ্বেলে ছাপার অক্ষর আর পড়বার জো নেই।
আমি কি করব ঠিক করতে না পেরে ঘরের ভিতর পায়চারি করতে সুরু করলুম, খানিকক্ষণ পরে তাতেও বিরক্তি ধরে এল। ঘরের গ্যাস জ্বেলে আবার পড়তে বসলুম। প্রথমে নিলুম আইনের বই—Anson এর Contract। এক কথা দশ বার করে পড়লুম, অথচ offer এবং acceptance-এর এক বর্ণও মাথায় ঢুকল না। আমি জিজ্ঞেস করলুম “তুমি এতে রাজি?” তুমি উত্তর করলে “আমি ওতে রাজি।”— এই সোজা জিনিষটেকে মানুষ কি জটিল করে তুলেছে, তা দেখে মানুষের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে হতাশ হয়ে পড়লুম! মানুষে যদি কথা দিয়ে কথা রাখত, তাহলে এই সব পাপের বোঝা আমাদের আর বইতে হত না। তাঁর খুরে দণ্ডবৎ করে Ansonকে সেফের সর্বোচ্চ থাকে তুলে রাখলুম। নজরে পড়ল সুমুখে একখানা পুরনো Punch পড়ে রয়েছে। তাই নিয়ে ফের বসে গেলুম। সত্যি কথা বলতে কি, সেদিন Punch পড়ে হাসি পাওয়া দূরে থাক, রাগ হতে লাগল। এমন কলে-তৈরী রসিকতাও যে মানুষে পয়সা দিয়ে কিনে পড়ে, এই ভেবে অবাক হলুম! দিব্যচক্ষে দেখতে পেলুম যে পৃথিবীর এমন দিনও আসবে, যখন Made in Germany এই ছাপমারা রসিকতাও বাজারে দেদার কাটবে। সে যাই হোক, আমার চৈতন্য হল যে, এ দেশের আকাশের মত এ দেশের মনেও বিদ্যুৎ কালে-ভদ্রে এক-আধবার দেখা দেয়—তাও আবার যেমন ফ্যাকাসে, তেমনি এলো। যেই এই কথা মনে হওয়া, অমনি Punch-খানি চিমনির ভিতর খুঁজে দিলুম,—তার আগুন আনন্দে হেসে উঠল। একটি জড়পদার্থ Punch-এর মান রাখল দেখে খুসি হলুম!
তারপর চিমনির দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে মিনিট দশেক আগুন পোহালুম। তারপর আবার একখানি বই নিয়ে পড়তে বসলুম। এবার নভেল। খুলেই দেখি ডিনারের বর্ণনা। টেবিলের উপর সারি সারি রূপোর বাতিদান, গাদা গাদা রূপোর বাসন, ডজন ডজন হীরের মত পল-কাটা চক্চকে ঝকঝকে কাচের গেলাস। আর সেই সব গেলাসের ভিতর, স্পেনের ফ্রান্সের জর্মানির মদ,—তার কোনটির রঙ চুনির, কোনটির পান্নার, কোনটির পোখরাজের। এ নভেলের নায়কের নাম Algernon, নায়িকার Millicent। একজন Duke-এর ছেলে, আর একজন millionaire-এর মেয়ে; রূপে Algernon বিদ্যাধর, Millicent বিদ্যাধরী। কিছুদিন হল পরস্পর পরস্পরের প্রণয়াসক্ত হয়েছেন, এবং সে প্রণয় অতি পবিত্র, অতি মধুর, অতি গভীর। এই ডিনারে Algernon বিবাহের offer করবেন, Millicent তা accept করবেন—contract পাকা হয়ে যাবে!
সেকালে কোনও বর্ষার দিনে কালিদাসের আত্মা যেমন মেঘে চড়ে অলকায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল, এই দুর্দিনে আমার আত্মাও তেমনি কুয়াসায় ভর করে এই নভেল-বর্ণিত রূপোর রাজ্যে গিয়ে উপস্থিত হল। কল্পনার চক্ষে দেখলুম, সেখানে একটি যুবতী,–বিরহিণী যক্ষ-পত্নীর মত —আমার পথ চেয়ে বসে আছে। আর তার রূপ! তা বর্ণনা করবার ক্ষমতা আমার নেই। সে যেন হীরেমাণিক দিয়ে সাজানো সোণার প্রতিমা। বলা বাহুল্য যে, চারচক্ষুর মিলন হবামাত্রই আমার মনে ভালবাসা উথলে উঠল। আমি বিনা বাক্যব্যয়ে আমার মনপ্রাণ তার হাতে সমর্পণ করলুম। সে সস্নেহে সাদরে তা গ্রহণ করলে। ফলে, যা পেলুম তা শুধু যক্ষকন্যা নয়, সেই সঙ্গে যক্ষের ধন। এমন সময় ঘড়িতে টং টং করে চারটে বাজল,অমনি আমার দিবাস্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। চোখ চেয়ে দেখি, যেখানে আছি সে রূপকথার রাজ্য নয়, কিন্তু একটা সঁতসেঁতে অন্ধকার জল-কাদার দেশ। আর একা ঘরে বসে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠল; আমি টুপি ছাতা ওভারকোট নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লুম।