হঠাৎ সে তার হাত আমার হাত থেকে সজোরে ছিনিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল! চেয়ে দেখি সে দাঁড়িয়ে কঁপছে, তার মুখ ভয়ে ব্বির্ণ হয়ে গেছে। একটু এদিক-ওদিক চেয়ে সে দক্ষিণদিকে দ্রুতবেগে চলতে আরম্ভ করলে। আমি পিছনদিকে তাকিয়ে দেখি ছ-ফুট-এক-ইঞ্চি লম্বা একটি ইংরেজ, চার-পাঁচজন চাকর সঙ্গে করে মেয়েটির দিকে জোরে হেঁটে চলছে। মেয়েটি দু-পা এগোচ্ছে, আবার মুখ ফিরিয়ে দেখছে, আবার এগোচ্ছে, আবার দাঁড়াচ্ছে। এমনি করতে করতে ইংরেজটি যখন তার কাছাকাছি গিয়ে উপস্থিত হল, অমনি সে দৌড়তে আরম্ভ করলে। পিছনে পিছনে এরা সকলেও দৌড়তে লাগল। খানিকক্ষণ পরে একটি চীৎকার শুনতে পেলুম! সে চৎকার-ধ্বনি যেমন অস্বাভাবিক, তেমনি বিকট! সে চীৎকার শুনে আমার গায়ের রক্ত জল হয়ে গেল; আমি যেন ভয়ে কাঠ হয়ে গেলুম, আমার নড়বার-চড়বার শক্তি রইল না। তারপর দেখি চার-পাঁচ জনে চেপে ধরে তাকে আমার দিকে টেনে আনছে; ইংরেজটি সঙ্গে সঙ্গে আসছে। মনে হল, এ অত্যাচারের হাত থেকে একে উদ্ধার করতেই হবে—এই পশুদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতেই হবে। এই মনে করে আমি যেমন সেইদিকে এগোতে যাচ্ছি, অমনি মেয়েটি হো হো করে হাসতে আরম্ভ করলে। সে অট্টহাস্য চারিদিকে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল; সে হাসি তার কান্নার চাইতে দশগুণ বেশী বিকট, দশগুণ বেশী মর্মভেদী। আমি বুঝলুম যে মেয়েটি পাগল,—একেবারে উন্মাদ পাগল,—পাগলাগারদ থেকে কোনও সুযোগে পালিয়ে এসেছিল, রক্ষকেরা তাকে ফের ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
এই আমার প্রথম ভালবাসা, আর এই আমার শেষ ভালবাসা। এর পরে ইউরোপে কত ফুলের-মত কোমল, কত তারার-মত উজ্জ্বল স্ত্রীলোক দেখেছি,ক্ষণিকের জন্য আকৃষ্টও হয়েছি,কিন্তু সে-মুহূর্তে আমার মন নরম হবার উপক্রম হয়েছে, সেই মুহূর্তে ঐ অট্টহাসি আমার কানে বেজেছে, অমনি আমার মন পাথর হয়ে গেছে। আমি সেইদিন থেকে চিরদিনের জন্য eternal feminineকে হারিয়েছি, কিন্তু তার বদলে নিজেকে ফিরে পেয়েছি। এই বলে সেন তাঁর কথা শেষ করলেন। আমরা সকলে চুপ করে রইলুম। এতক্ষণ সীতেশ চোখ বুজে একখানি আরামচৌকির উপর তার ছ-ফুট দেহটি বিস্তার করে লম্বা হয়ে শুয়েছিলেন; তার হস্তচ্যুত আধহাত লম্বা ম্যানিলা চুরুটটি মেজের উপর পড়ে সধূম দুর্গন্ধ প্রচার করে তার অন্তরের প্রচ্ছন্ন আগুনের অস্তিত্বের প্রমাণ দিচ্ছিল; আমি মনে করেছিলুম সীতেশ ঘুমিয়ে পড়ছেন। হঠাৎ জলের ভিতর থেকে একটা বড় মাছ যেমন ঘাই মেরে ওঠে, তেমনি সীতেশ এই নিস্তব্ধতার ভিতর থেকে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে খাড়া হয়ে বসলেন। সেদিনকার সেই রাত্তিরের ছায়ায় তার প্রকাও দেহ অষ্টধাতুতে গড়া একটি বিরাট বৌদ্ধ মূর্তির মত দেখাচ্ছিল। তারপর সেই মূর্তি অতি মিহি মেয়েলি গলায় কথা কইতে আরম্ভ করলেন। ভগবান বুদ্ধদেব তার প্রিয় শিষ্য আনন্দকে স্ত্রীজাতিসম্বন্ধে কিংকর্তব্যের যে উপদেশ দিয়েছিলেন, সীতেশের কথা ঠিক তার পুনরাবৃত্তি নয়!
৩. সীতেশের কথা
তোমরা সকলেই জান, আমার প্রকৃতি সেনের ঠিক উল্টো। স্ত্রীলোক দেখলে আমার মন আপনিই নরম হয়ে আসে। কত সাল শরীরের ভিতর কত দুর্বল মন থাকতে পারে, তোমাদের মতে আমি তার একটি জজ্যান্ত উদাহরণ। বিলেতে আমি মাসে একবার করে নূতন করে ভালবাসায় পড়তুম; তার জন্য তোমরা আমাকে কত-না ঠাট্টা করেছ, এবং তার জন্য আমি তোমাদের সঙ্গে কত-না তর্ক করেছি। কিন্তু এখন আমি আমার নিজের মন বুঝে দেখেছি যে, তোমরা যা বলতে তা ঠিক। আমি যে সেকালে, দিনে একবার করে ভালবাসায় পড়িনি, এতেই আমি আশ্চর্য হয়ে যাই! স্ত্রীজাতির দেহ এবং মনের ভিতর এমন একটি শক্তি আছে, যা আমার দেহ-মনকে নিত্য টানে। সে আকর্ষণী শক্তি কারও বা চোখের চাহনিতে থাকে, কারও বা মুখের হাসিতে, কারও বা গলার স্বরে, কারও বা দেহের গঠনে। এমন কি, শ্ৰীঅঙ্গের কাপড়ের রঙে, গহনার ঝঙ্কারেও আমার বিশ্বাস যাদু আছে। মনে আছে, একদিন একজনকে দেখে আমি কাতর হয়ে পড়ি, সেদিন সে ফলসাই-রঙের কাপড় পরেছিল—তারপরে তাকে আর একদিন অশমানি-রঙের কাপড় পরা দেখে আমি প্রকৃতিস্থ হয়ে উঠলুম! এ রোগ আমার আজও সম্পূর্ণ সারেনি। আজও আমি মলের শব্দ শুনলে কান খাড়া করি, রাস্তায় কোন বন্ধ গাড়িতে খড়খড়ি তোলা রয়েছে দেখলে আমার চোখ আপনিই সেদিকে যায়; গ্রীক Statueর মত গড়নের কোনও হিন্দুস্থানী রমণীকে পথে ঘাটে পিছন থেকে দেখলে আমি ঘাড় বাঁকিয়ে একবার, তার মুখটি দেখে নেবার চেষ্টা করি। তা ছাড়া, সেকালে আমার মনে এই দৃঢ়বিশ্বাস ছিল যে, আমি হচ্ছি সেইজতের পুরুষমানুষ, যাদের প্রতি স্ত্রীজাতি স্বভাবতঃই অনুরক্ত হয়। এ সত্ত্বেও যে আমি নিজের কিম্বা পরের সর্বনাশ করিনি, তার কারণ Don Juan হবার মত সাহস ও শক্তি আমার শরীরে আজও নেই, কখন ছিলও না। দুনিয়ার যত সুন্দরী আজও রীতিনীতির কাঁচের আলমারির ভিতর পোরা রয়েছে, অর্থাৎ তাদের দেখা যায়, ছোঁয়া যায় না। আমি যে ইহজীবনে এই আলমারির একখানা কঁাচও ভাঙিনি, তার কারণ ও-বস্তু ভাঙলে প্রথমতঃ বড় আওয়াজ হয়—তার ঝন্ঝনানি পাড়া মাথায় করে তোলে; দ্বিতীয়তঃ তাতে হাত পা কাটবার ভয়ও আছে। আসল কথা, সেন eternal feminine একের ভিতর পেতে চেয়েছিলেন—আর আমি অনেকের ভিতর। ফল সমানই হয়েছে। তিনিও তা পাননি, আমিও পাইনি। তবে দুজনের ভিতর তফাৎ এই যে, সেনের মত কঠিন মন কোনও স্ত্রীলোকের হাতে পড়লে, সে তাতে বাটালি দিয়ে নিজের নাম খুদে রেখে যায়; কিন্তু আমার মত তরল মনে, স্ত্রীলোকমাত্রেই তার আঙ্গুল ডুবিয়ে যা-খুসি হিজিবিজি করে দাড়ি টানতে পারে, সেই সঙ্গে সে-মনকে ক্ষণিকের তরে ঈষৎ চঞ্চল করেও তুলতে পারে—কিন্তু কোনও দাগ রেখে যেতে পারে না; সে অঙ্গুলিও সরে যায়—তার রেখাও মিলিয়ে যায়। তাই আজ দেখতে পাই আমার স্মৃতিপটে একটি ছাড়া অপর কোন স্ত্রীলোকের স্পষ্ট ছবি নেই। একটি দিনের একটি ঘটনা আজও ভুলতে পারিনি, কেননা এক জীবনে এমন ঘটনা দু’বার ঘটে না।