সেদিন পূর্ণিমা। আমি একলা বেড়াতে বেড়াতে যখন গঙ্গার ধারে গিয়ে পেঁছিলুম, তখন রাত প্রায় এগারটা। রাস্তায় জনমানব ছিল না, তবু আমার বাড়ী ফিরতে মন সরছিল না, কেননা সেদিন যেরকম জ্যোৎস্না ফুটেছিল, সেরকম জ্যোৎস্না কলকাতায় বোধ হয় দু-দশবৎসরে এক-আধ দিন দেখা যায়। চাঁদের আলোর ভিতর প্রায়ই দেখা যায় একটা ঘুমন্ত ভাব আছে; সে আলো মাটীতে, জলেতে, ছাদের উপর, গাছের উপর, যেখানে পড়ে সেইখানেই মনে হয় ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু সে রাত্তিরে আকাশে আলোর বান ডেকেছিল। চন্দ্রলোক হতে অসংখ্য, অবিরত, অবিরল, ও অবিচ্ছিন্ন একটির-পর-একটি, তারপর-আর-একটি জ্যোৎস্নার ঢেউ পৃথিবীর উপর এসে ভেঙ্গে পড়ছিল। এই ঢেউ-খেলানো জ্যোৎস্নায় দিগদিগন্ত ফেনিল হয়ে উঠেছিল—সে ফেনা শ্যাম্পেনের ফেনার মত আপন হৃদয়ের আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে, তারপরে হাসির আকারে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। আমার মনে এ আলোর নেশা ধরেছিল, আমি তাই নিরুদ্দেশ-ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম, মনের ভিতর একটি অস্পষ্ট আনন্দ ছাড়া আর কোনও ভাব, কোনও চিন্তা ছিল না।
হঠাৎ নদীর দিকে আমার চোখ পড়ল। দেখি, সারি-সারি জাহাজ এই আলোয় ভাসছে। জাহাজের গড়ন যে এমন সুন্দর, তা আমি পূর্বে কখনও লক্ষ্য করিনি। তাদের ঐ লম্বা ছিপছিপে দেহের প্রতি রেখায় একটি একটানা গতির চেহারা সাকার হয়ে উঠেছিল,—যে গতির মুখ অসীমের দিকে, আর যার শক্তি অদম্য এবং অপ্রতিহত। মনে হল, যেন কোনও সাগর-পারের রূপকথার রাজ্যের বিহঙ্গম-বিহঙ্গমীরা উড়ে এসে, এখন পাখা গুটিয়ে জলের উপর শুয়ে আছে—এই জ্যোৎস্নার সঙ্গে-সঙ্গে তারা আবার পাখা মেলিয়ে নিজের দেশে ফিরে যাবে। সে দেশ ইউরোপ—যে ইউরোপ তুমি-আমি চোখে দেখে এসেছি সে ইউরোপ নয়, কিন্তু সেই কবি-কল্পিত রাজ্য, যার পরিচয় আমি ইউরোপীয় সাহিত্যে লাভ করেছিলুম। এই জাহাজের ইঙ্গিতে সেই রূপকথার রাজ্য, সেই রূপের রাজ্য আমার কাছে প্রত্যক্ষ হয়ে এল। আমি উপরের দিকে চেয়ে দেখি, আকাশ জুড়ে হাজার-হাজার জ্যামিন্ হথরণ, প্রভৃতি স্তবকে স্তবকে ফুটে উঠছে, ঝরে পড়ছে, চারিদিকে সাদা ফুলের বৃষ্টি হচ্ছে। সে ফুল, গাছপালা সব ঢেকে ফেলেছে, পাতার ফাঁক দিয়ে ঘাসের উপরে পড়েছে, রাস্তাঘাট সব ছেয়ে ফেলেছে। তারপর আমার মনে হল যে, আমি আজ রাত্তিরে কোন মিরাণ্ডা কি ডেস্ডিমনা, বিয়াট্রিস কি টেসার দেখা পাব,-এবং তার স্পর্শে আমি বেঁচে উঠব, জেগে উঠব, অমর হব। আমি কল্পনার চক্ষে স্পষ্ট দেখতে পেলুম যে, আমার সেই চিরকাঙ্ক্ষিত eternal feminine সশরীরে দূরে দাঁড়িয়ে আমার জন্য প্রতীক্ষা করছে।
ঘুমের ঘোরে মানুষ যেমন সোজা একদিকে চলে যায়, আমি তেমনি ভাবে চলতে চলতে যখন লাল রাস্তার পাশে এসে পড়লুম, তখন দেখি দূরে যেন একটি ছায়া পায়চারি করছে। আমি সেইদিকে এগোতে লাগলুম। ক্রমে সেই ছায়া শরীরী হয়ে উঠতে লাগল; সে যে মানুষ, সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ রইল না। যখন অনেকটা কাছে এসে পড়েছি, তখন সে পথের ধারে একটি বেঞ্চিতে বসল। আরও কাছে এসে দেখি, বেঞ্চিতে যে বসে আছে সে একটি ইংরাজ-রমণী—পূর্ণযৌবন —অপূর্বসুন্দরী! এমন রূপ মানুষের হয় না;—সে যেন মূর্তিমতী পূর্ণিমা! আমি তার সমুখে থমকে দাঁড়িয়ে, নির্নিমেষে তার দিকে চেয়ে রইলুম। দেখি সেও একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। যখন তার চোখের উপর আমার চোখ পড়ল, তখন দেখি তার চোখদুটি আলোয় জুজু করছে; মানুষের চোখে এমন জ্যোতি আমি জীবনে আর কখনও দেখি নি! সে আলো তারার নয়, চন্দ্রের নয়, সূর্যের নয়,—বিদ্যুতের। সে আলো জ্যোৎস্নাকে আরও উজ্জ্বল করে তুললে, চন্দ্রালোকের বুকের ভিতর যেন তাড়িত সঞ্চারিত হল। বিশ্বের সূক্ষমশরীর সেদিন একমুহূর্তের জন্য আমার কাছে প্রত্যক্ষ হয়েছিল। এ জড়জগৎ সেই মুহূর্তে প্রাণময়, মনোময় হয়ে উঠেছিল। আমি সেদিন ঈথরের স্পন্দন চর্মচক্ষে দেখেছি; আর দিব্যচক্ষে দেখতে পেয়েছি যে, আমার আত্মা ঈশ্বরের একসুরে, একতানে স্পন্দিত হচ্ছে। এ সবই সেই রাত্তিরের সেই আলোর মায়া। এই মায়ার প্রভাবে শুধু বহির্জগতের নয়,—আমার অন্তর-জগতেরও সম্পূর্ণ রূপান্তর ঘটেছিল। আমার দেহ-মন মিলেমিশে এক হয়ে একটি মূর্তিমতী বাসনার আকার ধারণ করেছিল, এবং সে হচ্ছে ভালবাসবার ও ভালবাসা পাবার বাসনা। আমার মন্ত্রমুগ্ধ মনে জ্ঞান, বুদ্ধি, এমন কি চৈতন্য পর্যন্ত লোপ পেয়েছিল।
কতক্ষণ পরে স্ত্রীলোকটি আমার দিকে চেয়ে, আমি অচেতন পদার্থের মত দাঁড়িয়ে আছি দেখে, একটু হাসলে। সেই হাসি দেখে আমার মনে সাহস এল, আমি সেই বেঞ্চিতে তার পাশে বসলুম—গা ঘেঁষে নয়, একটু দূরে। আমরা দুজনেই চুপ করে ছিলুম। বলা বাহুল্য, তখন আমি চোখ-চেয়ে স্বপ্ন দেখছিলুম; সে স্বপ্ন যে-রাজ্যের, সে-রাজ্যে শব্দ নেই;—যা আছে, তা শুধু নীরব অনুভূতি। আমি যে স্বপ্ন দেখছিলুম, তার প্রধান প্রমাণ এই যে, সে সময় আমার কাছে সকল অসম্ভব সম্ভব হয়ে উঠেছিল। এই কলকাতা সহরে কোন বাঙ্গালী রোমিয়োর ভাগ্যে কোনও বিলাতি জুলিয়েট যে জুটতে পারে না–এ জ্ঞান তখন সম্পূর্ণ হারিয়ে বসেছিলুম।
আমার মনে হচ্ছিল যে, এ স্ত্রীলোকেরও হয়ত আমারই মত মনে সুখ ছিল না—এবং সে একই কারণে। এর মনও হয়ত এর চারপাশের বণিক-সমাজ হতে আলগা হয়ে পড়েছিল, এবং এও সেই অপরিচিতের আশায়, প্রতীক্ষায়, দিনের পর দিন বিষাদে অবসাদে কাটাচ্ছিল, যার কাছে আত্মসমর্পণ করে এর জীবন-মন স-রাগ সতেজ হয়ে উঠবে। আর আজকের এই কুহকী পূর্ণিমার অপূর্ব সৌন্দর্যের ডাকে আমরা দুজনেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছি। আমাদের মিলনের মধ্যে বিধাতার হাত আছে। অনাদিকালে এ মিলনের সূচনা হয়েছিল, এবং অনন্তকালেও তার সমাধা হবে না। এই সত্য আবিষ্কার করবামাত্র আমি আমার সঙ্গিনীর দিকে মুখ ফেরালুম। দেখি, কিছুক্ষণ আগে যে চোখ হীরার মত জ্বলছিল, এখন তা নীলার মত সুকোমল হয়ে গেছে;-একটি গভীর বিষাদের রঙে তা স্তরে স্তরে রঞ্জিত হয়ে উঠেছে;—এমন কাতর, এমন করুণ দৃষ্টি আমি মানুষের চোখে আর কখনও দেখিনি। সে চাহনিতে আমার হৃদয়-মন একেবারে গলে উথলে উঠল; আমি আস্তে তার একখানি জ্যোৎস্নামাখা হাত আমার হাতের কোলে টেনে নিলুম; সে হাতের স্পর্শে আমার সকল শরীর শিহরিত হয়ে উঠল, সকল মনের মধ্য দিয়ে একটি আনন্দের জোয়ার বইতে লাগল। আমি চোখ বুজে আমার অন্তরে এই নব-উচ্ছ্বসিত প্রাণের বেদনা অনুভব করতে লাগলুম।