—তারপর?
–তারপর আমার যখন হাসপাতাল থেকে বেরবার সময় হল, তখন ডাক্তারটি এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, আমি বেরিয়ে কি করব? আমি উত্তর করলুম-দাসীগিরি। তিনি বললেন যে—তোমার শরীর যখন একবার ভেঙ্গে পড়েছে, তখন জীবনে ও-রকম পরিশ্রম করা তোমার দ্বারা আর চলবে। আমি বল্লুম—উপায়ান্তর নেই। তিনি প্রস্তাব করলেন যে আমি যদি Nurse হতে রাজি হই ত তার জন্য যা দরকার, সমস্ত খরচা তিনি দেবেন। তাঁর কথা শুনে আমার চোখে জল এল,–কেননা জীবনে এই আমি সব প্রথম একটি সহৃদয় কথা শুনি। আমি সে প্রস্তাবে রাজি হলুম। এত শীগগির রাজি হবার আরও একটি কারণ ছিল।
—কি?
—আমি মনে করলুম Nurse হয়ে আমি কলকাতায় যাব। তাহলে তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে। তোমার অসুখ হলে তোমার শুশ্রুষা করব।
—আমার অসুখ হবে, এমন কথা তোমার মনে হল কেন?
—শুনেছিলুম তোমাদের দেশ বড়ই অস্বাস্থ্যকর, সেখানে নাকি সব সময়েই সকলের অসুখ করে।।
–তারপরে সত্য সত্যই Nurse হলে?
–হাঁ। তারপরে সেই ডাক্তারটি আমাকে বিবাহ করবার প্রস্তাব করলেন। আমি আমার মন ও প্রাণ, আমার অন্তরের গভীর কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ তার হাতে সমর্পণ করলুম।
–তোমার বিবাহিত জীবন সুখের হয়েছে?
–পৃথিবীতে যতদূর সম্ভব ততদূর হয়েছে। আমার স্বামীর কাছে আমি যা পেয়েছি সে হচ্ছে পদ ও সম্পদ, ধন ও মান, অসীম যত্ন এবং অকৃত্রিম স্নেহ; একটি দিনের জন্যও তিনি আমাকে তিলমাত্র অনাদর করেননি, একটি কথাতেও কখন মনে ব্যথা দেননি।
—আর তুমি?
–আমার বিশ্বাস, আমিও তাকে মুহূর্তের জন্যও অসুখী করিনি। তিনি ত আমার কাছে কিছু চাননি, তিনি চেয়েছিলেন শুধু আমাকে ভালবাসতে ও আমার সেবা করতে। বাপ চিররুগ্ন মেয়ের সঙ্গে যেমন ব্যবহার করে, তিনি আমার সঙ্গে ঠিক সেইরকম ব্যবহার করেছিলেন। আমি সেরে উঠলেও আর আগের শরীর ফিরে পাইনি, বরাবর সেই Botticelliর ছবিই থেকে গিয়েছিলুম—আর আমার স্বামী আমার বাপের বয়সীই ছিলেন। তাঁকে আমি আমার সকল মন দিয়ে দেবতার মত পূজো করেছি।
—আশা করি তোমাদের বিবাহিত জীবনের উপর আমার স্মৃতির ছায়া পড়েনি?
–তোমার স্মৃতি আমার জীবন মন কোমল করে রেখেছিল।
–তাহলে তুমি আমাকে ভুলে যাওনি?
–না। সেই কথাটা বলবার জন্যই ত আজ তোমার কাছে এসেছি। তোমার প্রতি আমার মনোভাব বরাবর একই ছিল।
—বলতে চাও, তুমি তোমার স্বামীকে ও আমাকে দুজনকে একসঙ্গে ভালবাসতে?
–অবশ্য। মানুষের মনে অনেক রকম ভালবাসা আছে, যা পরস্পর বিরোধ না করে একসঙ্গে থাকতে পারে। এই দেখ না কেন, লোকে বলে যে শত্রুকে ভালবাসা শুধু অসম্ভব নয়, অনুচিত;–কিন্তু আমি সম্প্রতি আবিষ্কার করেছি যে শত্রু-মিত্র-নির্বিচারে, যে যন্ত্রণা ভোগ করছে, তার প্রতিই লোকের সমান মমতা, সমান ভালবাসা হতে পারে।
—এ সত্য কোথায় আবিষ্কার করেছ?
—ফ্রান্সের যুদ্ধক্ষেত্রে।
—তুমি সেখানে কি করতে গিয়েছিলে?
—বলছি। এই যুদ্ধে আমরা দুজনেই ফ্রান্সের যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েছিলুম, তিনি ডাক্তার হিসেবে, আমি Nurse হিসেবে–সেইখান থেকে এই তোমার কাছে আসছি, যে কথা আগে বলবার সুযোগ পাইনি, সেই কথাটি বলবার জন্য।
—তোমার কথা আমি ভাল বুঝতে পারছিনে।
–এর ভিতর হেঁয়ালি কিছু নেই। এই ঘণ্টাখানেক আগে তোমার সেই Botticelliর ছবি একটি জর্মান গোলার আঘাতে ছিঁড়ে চার-ইয়ারী-কথা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে—অমনি আমি তোমার কাছে চলে এসেছি।
—তাহলে এখন তুমি–?
–পরলোকে।
এর পর টেলিফোন ছেড়ে দিয়ে আমি ঘরে চলে এলুম। মুহূর্তে আমার শরীর মন একটা অস্বাভাবিক তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে এল। আমি শোবামাত্র ঘুমে অজ্ঞান হয়ে পড়লুম। তার পরদিন সকালে চোখ খুলে দেখি বেলা দশটা বেজে গেছে।
*****
কথা শেষ করে বন্ধুদের দিকে চেয়ে দেখি, রূপকথা শোনার সময় ছোট ছেলেদের মুখের যেমন ভাব হয়, সীতেশের মুখে ঠিক সেই ভা। সোমনাথের মুখ কাঠের মত শক্ত হয়ে গেছে। বুঝলুম তিনি নিজের মনের উদ্বেগ জোর করে চেপে রাখছেন। আর সেনের চোখ দুলে আসছে—ঘুমে কি ভাবে, বলা কঠিন। কেউ ‘হুঁ’ ‘না’-ও করলেন না। মিনিট খানেক পরে বাইরে গিঞ্জের ঘণ্টায় বারোটা বাজলে, আমরা সকলে এক সঙ্গে উঠে পড়ে ‘boy boy’ বলে চীৎকার করলুম, কেউ সাড়া দিলে না। ঘরে ঢুকে দেখি, চাকরগুলো সব মেজেতে বসে দেয়ালে ঠেস দিয়ে ঘুমচ্ছে। চাকরগুলোকে টেনে তুলে গাড়ী জুততে বলতে নীচে পাঠিয়ে দিলুম।
হঠাৎ সীতেশ বলে উঠলেন, “দেখ রায়, তুমি একজন লেখক, দেখ, এ সব গল্প যেন কাগজে ছাপিয়ে দিয়ো না, তাহলে আমি আর ভদ্রসমাজে মুখ দেখাতে পারব না।” আমি উত্তর করলুম “সে লোভ আমি সম্বরণ করতে পারব না—তাতে তোমরা আমার উপর খুসিই হও, আর রাগই কর।” সেন বল্লেন, “আমার কোনও আপত্তি নেই। আমি যা বল্লুম তা আগাগোড়া সত্য, কিন্তু সকলে ভাববে যে তা আগাগোড়া বানান।” সোমনাথ বল্লেন, “আমারও কোনও আপত্তি নেই, আমি যা বল্লুম তা আগাগোড়া বানান, কিন্তু লোকে ভাববে যে তা আগাগোড়া সত্যি।” আমি বললুম, “আমি যা বল্লুম তা ঘটেছিল, কি আমি স্বপ্ন দেখেছিলুম, তা আমি নিজেও জানিনে। সেই জন্যই ত এ সব গল্প লিখে ছাপাব। পৃথিবীতে দু’রকম কথা আছে যা বলা অন্যায়,—এক হচ্ছে মিথ্যা, আর এক হচ্ছে সত্য। যা সত্যও নয় মিথ্যাও নয়, আর না হয়ত একই সঙ্গে দুই–তা বলায় বিপদ নেই।