–তোমাকে ও কথা বলা যে আমার পক্ষে অভদ্রতা হত। তা ছাড়া ও জিনিষ ত ব্যবহারে, চেহারায় ধরা পড়ে। ও কথা অন্ততঃ স্ত্রীলোকে মুখ ফুটে বলে না।
—কই, আমি ত কখনও কিছু লক্ষ্য করিনি।
–কি করে করবে, তুমি কি কখনও মুখ তুলে আমার দিকে চেয়ে দেখেছ? আমি প্রতিদিন আধ ঘণ্টা ধরে তোমার সবার ঘরে টেবিল সাজিয়েছি, তুমি সে সময় হয় খবরের কাগজ দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতে, নয় মাথা নীচু করে ছুরি দিয়ে নখ চাচতে।
—এ কথা ঠিক,—তার কারণ, তোমার দিকে বিশেষ করে নজর দেওয়াটাও আমার পক্ষে অভদ্রতা হত। তবে সময়ে সময়ে এটুকু অবশ্য লক্ষ্য করেছি যে, আমার ঘরে এলে তোমার মুখ লাল হয়ে উঠত, আর তুমি একটু ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তে। আমি ভাবতুম, সে ভয়ে।
—সে ভয়ে নয়, লজ্জায়। কিন্তু তুমি যে কিছু লক্ষ্য করনি, সেইটেই আমার পক্ষে অতি সুখের হয়েছিল।
—কেন?
—তুমি যদি আমার মনের কথা জানতে পারতে, তাহলে আমি আর লজ্জায় তোমাকে মুখ দেখাতে পারতুম। ও-বাড়ী থেকে পালিয়ে যেতুম। তাহলে আমিও আর তোমাকে নিত্য দেখতে পেতুম না, তোমার জন্যে কিছু করতেও পারতুম না।
–আমার জন্য তুমি কি করেছ?
—সেই শেষ বৎসর মোর একদিনও কোনও জিনিষের অভাব হয়েছে,-একদিনও কোন অসুবিধেয় পড়তে হয়েছে?
–না।
–তার কারণ, আমি প্রাণপণে তোমার সেবা করেছি। জান, তোমাকে যে ভাল না বাসে, সে কখন তোমার সেবা করতে পারে না?
–কেন বল দেখি?
—এই জন্যে যে, তুমি নিজের জন্য কিছু করতে পার না, অথচ তোমার জন্য কাউকে কিছু করতেও বল না!
–তুমি যে আমার জন্যে সব করে দিতে, আমি ত তা জানতুম না। আমি ভাবতুম Mrs. Smith। তাইতে আসবার সময় তোমাকে কিছু না বলে, Mrs. Smithকে ধন্যবাদ দিয়ে আসি।
—আমি তোমার ধন্যবাদ চাইনি। তুমি যে আমাকে কখনও ধমকাওনি, সে-ই আমার পক্ষে ছিল যথেষ্ট পুরস্কার।
—সে কি কথা! স্ত্রীলোককে কোনও ভদ্রলোক কি কখনও ধমকায়?
–স্ত্রীলোককে কেউ না ধমকালেও, দাসীকে অনেকেই ধমকায়।
—দাসী কি স্ত্রীলোক নয়?
–দাসীরা জানে তারা স্ত্রীলোক, কিন্তু ভদ্রলোকে সে কথা দু’বেলা ভুলে যায়। কথাটা এতই সত্য যে, আমি তার কোন জবাব দিলুম না। একটু পরে সে বললে—
—কিন্তু একদিন তুমি একটি অতি নিষ্ঠুর কথা বলেছিলে।
—তোমাকে?
-আমাকে নয়, তোমার একটি বন্ধুকে, কিন্তু সে আমার সম্বন্ধে।
—তোমার সম্বন্ধে আমার কোনও বন্ধুকে কখন কিছু বলেছি বলে ত মনে পড়ছে না।
–তোমার কাছে সে এত তুচ্ছ কথা যে, তোমার তা মনে থাকবার কথা নয়,–কিন্তু আমার মনে তা চিরদিন কাটার মত বিঁধে ছিল।
-শুনলে হয়ত মনে পড়বে।
—তুমি একদিন একটি মুক্তোর Tie-pin নিয়ে এস, তার পর দিন সেটি আর পাওয়া গেল না।
–হতে পারে।
—আমি সেটি সারা রাজি খুঁজে বেড়াচ্ছি, এমন সময় তোমার একটি বন্ধু তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন; তুমি তাকে হেসে বললে যে, “আনি” ওটি চুরি করে ঠকেছে, কেননা মুক্তোটি হচ্ছে ঝুটো, আর পিনটি পিতলের; “আনি” বেচতে গিয়ে দেখতে পাবে যে ওর দাম এক পেনি। তারপর তোমরা দু’জনেই হাসতে লাগলে। কিন্তু ঐ কথায় তুমি ঐ পিতলের পিনটি আমার বুকের ভিতর ফুটিয়ে দিয়েছিলে।
—আমরা না ভেবে চিন্তে অমন অন্যায় কথা অনেক সময় বলি।
–তা আমি জানতুম, তাই তোমার উপর আমার রাগ হয়নি,—যা হয়েছিল সে শুধু যন্ত্রণা। দারিদ্র্যের কষ্টের চাইতে তার অপমান যে বেশি, সেদিন আমি মর্মে মর্মে তা অনুভব করেছিলুম। তুমি কি করে জানবে যে, আমি তোমার এক ফোঁটা ল্যাভেণ্ডারও কখনও চুরি করি নি।
–এর উত্তরে আমার আর কিছুই বলবার নেই। না জেনে হয়ত . ঐরকম কথায় কত লোকের মনে কষ্ট দিয়েছি।
—তোমার মুক্তোর পিন কে চুরি করেছিল, পরে আমি তা আবিষ্কার করি।
–কে বল ত?
—তোমার ল্যাণ্ডলেডি Mrs. Smith।
–বল কি! সে ত আমাকে মায়ের মত ভালবাসত! আমি চলে আসবার দিন তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।
—সে তার ব্যাঙ্ক ফেল হল বলে তোমাকে সে এক টাকার জিনিষ দিয়ে দু’টাকা নিত।
–আমি কি তাহলে অতদিন চোখ বুজে ছিলুম?
–তোমাদের চোখ তোমাদের দলের বাইরে যায় না, তাই বাইরের ভালমন্দ কিছুই দেখতে পায় না। সে যাই হোক, আমি তোমার একটি জিনিষ না বলে নিতুম,-বই,—আবার তা পড়ে ফিরে দিতুম।।
-তুমি কি পড়তে জানতে?
-–ভুলে যাচ্ছ, আমরা সকলেই Board School-এ লেখাপড়া শিখি।
–হাঁ, তা ত সত্যি।
–জান কেন চুরি করে বই পড়তুম?
–না।
–ভগবান আমাকে রূপ দিয়েছিলেন, আমি তা যত্ন করে মেজে ঘষে রাখতুম। -তা আমি জানি। তোমার মত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দাসী আমি বিলেতে দেখিনি।
–তুমি যা জানতে না, তা হচ্ছে এই,–ভগবান আমাকে বুদ্ধিও দিয়েছিলেন, তাও আমি মেজে ঘষে রাখতে চেষ্টা করতুম, এবং এ দুই-ই করতুম তোমারই জন্যে।
—আমার জন্যে?
-–পরিষ্কার থাকতুম এই জন্যে, যাতে তুমি আমাকে দেখে নাক না সেঁটকাও; আর বই পড়তুম এই জন্যে, যাতে তোমার কথা ভাল করে বুঝতে পারি।
–আমি ত তোমার সঙ্গে কখনও কথা কইতুম না।
–আমার সঙ্গে নয়। খাবার টেবিলে তোমার বন্ধুদের সঙ্গে তুমি যখন কথা কইতে, তখন আমার তা শুনতে বড় ভাল লাগত। সে ত কথা নয়, সে যেন ভাষার আতসবাজি! আমি অবাক হয়ে শুনতুম, কিন্তু সব ভাল বুঝতে পারতুম না। কেননা তোমরা যে ভাষা বলতে, তা বইয়ের ইংরাজি। সেই ইংরাজি ভাল করে শেখবার জন্য আমি চুরি করে বই পড়তুম।