এ কথা শুনে সেন বল্লেন “Byron এবং Shelley ও-দুটি কাব্য যে এক সময়ে এক সঙ্গে বসে লিখেছিলেন, এ কথা আমি তাজ এই প্রথম শুনলুম।”
আমি উত্তর করলুম “যদি না করে থাকেন, তাহলে তাদের তা করা উচিত ছিল।”
সে যাই হোক, তোমরা যে সব ঘটনা বললে, তা নিয়ে আমি তিনটি দিব্যি হাসির গল্প রচনা করতে পারতুম, যা পড়ে মানুষ খুসি হত। সেন কবিতায় যা পড়েছেন, জীবনে তাই পেতে চেয়েছিলেন। সীতেশ জীবন যা পেয়েছিলেন, তাই নিয়ে কবিত্ব করতে চেয়েছিলেন। আর সোমনাথ মানব জীবন থেকে তার কাব্যাংশটুকু বাদ দিয়ে জীবন যাপন করতে চেয়েছিলেন। ফলে তিন জনই সমান আহাম্মক বনে গেছেন। কোনও বৈষ্ণব কবি বলেছেন যে, জীবনের পথ “প্রেমে পিচ্ছিল,”—কিন্তু সেই পথে কাউকে পা পিছলে পড়তে দেখলে মানুষের যেমন আমোদ হয়, এমন আর কিছুতেই হয় না। কিন্তু তোমরা, যে-ভালবাসা আসলে হাস্যরসের জিনিষ, তার ভিতর দু’চার ফোঁটা চোখের জল মিশিয়ে তাকে করুণরসে পরিণত করতে গিয়ে, ও-বস্তুকে এমনি ঘুলিয়ে দিয়েছ যে, সমাজের চোখে তা কলুষিত ঠেকতে পারে। কেননা সমাজের চোখ, মানুষের মনকে হয় সূর্যের আলোয় নয় চাদের আলোয় দেখে। তোমরা আজ নিজের নিজের মনের চেহারা যে আলোয় দেখেছ, সে হচ্ছে আজকের রাত্তিরের ঐ দুষ্ট ক্লিষ্ট আলো। সে আলোর মায়া এখন আমাদের চোখের সুমুখ থেকে সরে গিয়েছে। সুতরাং আমি যে গল্প বলতে যাচ্ছি, তার ভিতর আর যাই থাক আর না থাক, কোনও হাস্যকর কিম্বা লজ্জাকর পদার্থ নেই।
এ গল্পের ভূমিকাস্বরূপে আমার নিজের প্রকৃতির পরিচয় দেবার কোন দরকার নেই, কেননা তোমাদের যা বলতে যাচ্ছি, তা আমার মনের কথা নয়—আর একজনের,-একটি স্ত্রীলোকের। এবং সে রমণী আর যাই হোক—চোরও নয়, পাগলও নয়।
গত জুন মাসে আমি কলকাতায় একা ছিলুম। আমার বাড়ী ত তোমরা সকলেই জান; ঐ প্রকাণ্ড পুরীতে রাত্তিরে খালি দু’টি লোক শুত,—আমি আর আমার চাকর। বহুকাল থেকে একা থাকবার অভ্যেস নেই, তাই রাত্তিরে ভাল ঘুম হত না। একটু কিছু শব্দ শুনলে মনে হত যেন ঘরের ভিতর কে আসছে, অমনি গা ছম্ ছম্ করে উঠত; আর রাত্তিরে জানইত কত রকম শব্দ হয়,কখনও ছাদের উপর, কখনও দরজা জানালায়, কখনও রাস্তায়, কখনও বা গাছপালায়। একদিন এই সব নিশাচর ধ্বনির উপদ্রবে রাত একটা পর্যন্ত জেগেছিলুম, তারপর ঘুমিয়ে পড়লুম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলুম যেন কে টেলিফোনে ঘণ্টা দিচ্ছে। অমনি ঘুম ভেঙ্গে গেল। সেই সঙ্গে ঘড়িতে দুটো বাজল। তারপর শুনি যে, টেলিফোনের ঘণ্টা একটানা বেজে চলেছে। আমি ধড়ফড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়লুম। মনে হল যে আমার আত্মীয় স্বজনের মধ্যে কারও হয়ত হঠাৎ কোন বিশেষ বিপদ ঘটেছে, তাই এত রাত্তিরে আমাকে খবর দিচ্ছে। আমি ভয়ে ভয়ে বারান্দায় এসে দেখি আমার ভৃত্যটি অকাতরে নিদ্রা দিচ্ছে। তার ঘুম না ভাঙ্গিয়ে টেলিফোনের মুখ-নলটি নিজেই তুলে নিয়ে কাণে ধরে বল্লুম-Hallo!
উত্তরে পাওয়া গেল শুধু ঘণ্টার সেই ভোঁ ভোঁ আওয়াজ। তারপর দু’চার বার “হালো” “হ্যালো” করবার পর একটি অতি মৃদু, অতি মিষ্ট কণ্ঠস্বর আমার কানে এল। জান সে কি রকম স্বর? গির্জার অরগানের সুর যখন আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়, আর মনে হয় যে সে সুর লক্ষ যোজন দূর থেকে আসছে,–ঠিক সেই রকম।।
ক্রমে সেই স্বর স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠল। আমি শুনলুম কে ইংরাজীতে জিজ্ঞেস করছে—
“তুমি কি মিস্টার রায়?”
–আমি একজন মিস্টার রায়।
—S. D.?
–হাঁ–কাকে চাও?
—তোমাকেই।
গলার স্বর ও কথার উচ্চারণে বুঝলুম, যিনি কথা কচ্ছেন, তিনি একটি ইংরাজ রমণী।
আমি প্রত্যুত্তরে জিজ্ঞেস করলুম, “তুমি কে?”
—চিনতে পারছ না?
—না।
–একটু মনোযোগ দিয়ে শোন ত, এ কণ্ঠস্বর তোমার পরিচিত কিনা।
—মনে হচ্ছে এ স্বর পূর্বে শুনেছি, তবে কোথায় আর কবে, তা কিছুতেই মনে করতে পারছিনে।
—আমি যদি আমার নাম বলি, তাহলে কি মনে পড়বে?
—খুব সম্ভব পড়বে।
–আমি “আনি”।
–কোন্ “আনি”?
–বিলেতে যাকে চিনতে।
—বিলেতে ত আমি অনেক “আনি”-কে চিনতুম। সে দেশে অধিকাংশ স্ত্রীলোকের ত ঐ একই নাম।
–মনে পড়ে তুমি Gordon Square-এ একটি বাড়ীতে দু’টি ঘর ভাড়া করে ছিলে?
—তা আর মনে নেই? আমি যে একাদিক্রমে দুই বৎসর সেই বাড়ীতে থাকি।
—শেষ বৎসরের কথা মনে পড়ে?
—অবশ্য। সেত সে-দিনকের কথা; বছর দশেক হল সেখান থেকে চলে এসেছি।
—সেই বৎসর সে-বাড়ীতে “আনি” বলে একটি দাসী ছিল, মনে আছে?
এই কথা বলবামাত্র আমার মনে পূর্বস্মৃতি সব ফিরে এল। “আনি”র ছবি আমার চোখের সুমুখে ফুটে উঠল।
আমি বললুম “খুব মনে আছে। দাসীর মধ্যে তোমার মত সুন্দরী বিলেতে কখনও দেখিনি।”
—আমি সুন্দরী ছিলুম তা জানি, কিন্তু আমার রূপ তোমার চোখে যে কখনও পড়েছে, তা জানতুম না।
—কি করে জানবে? আমার পক্ষে ও কথা তোমাকে বলা অভদ্রতা হত।
—সে কথা ঠিক। তোমার আমার ভিতর সামাজিক অবস্থার অলঙ্ঘ্য ব্যবধান ছিল।
আমি এ কথার কোনও উত্তর দিলুম না। একটু পরে সে আবার বললে—
—আমি আজ তোমাকে এমন একটি কথা বলব, যা তুমি জানতে না।
–কি বল ত?
–আমি তোমাকে ভালবাসতুম।
–সত্যি?
—এমন সত্য যে, দশ বৎসরের পরীক্ষাতেও তা উত্তীর্ণ হয়েছে।
—এ কথা কি করে জানব? তুমি ত আমাকে কখনও বলে নি।