সে হেসে উত্তর করলে–
“বিয়ে না করলে প্যারিসে Honeymoon করতে এলুম কি করে? তোমার খোঁজ নিয়ে তুমি এখানে আছ জেনে, আমি George-কে বুঝিয়ে পড়িয়ে এখানে এনেছি। আজ তিনি তাঁর একটি বন্ধুর সঙ্গে ডিনার খেতে গিয়েছেন, আর আমি লুকিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।”
সে সন্ধ্যেটা “রিণী” আমার সঙ্গে গল্প করে কাটালে। সে গল্প হচ্ছে তার বিয়ের রিপোর্ট। আমাকে বসে বসে ও ব্যাপারের সব খুঁটিনাটি বর্ণনা শুনতে হল। চলে যাবার সময়ে সে বললে—
“সেদিন তোমার কাছে ভাল করে বিদায় নেওয়া হয়নি। পাছে তুমি আমার উপর রাগ করে থাক, এই মনে করে আজ তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলুম। এই কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার শেষ দেখা।”
সোমনাথের কথা শেষ হতে না হতে, সীতেশ ঈষৎ অধীর ভাবে বললেন,–
“দেখ, এ সব কথা তুমি এইমাত্র বানিয়ে বলছ! তুমি ভুলে গেছ যে খানিক আগে তুমি বলেছ যে, সেই B-তে “রিণীর” সঙ্গে তোমার শেষ দেখা। তোমার মিথ্যে কথা হাতে হাতে ধরা পড়েছে?”
সোমনাথ তিলমাত্র ইতস্ততঃ না করে উত্তর দিলেন “আগে যা বলেছিলুম সেই কথাটাই মিথ্যে—আর এখন যা বলছি তা-ই সত্যি। গল্পের একটা শেষ হওয়া চাই বলে আমি ঐ জায়গায় শেষ করেছিলুম। কিন্তু প্রকৃত জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যা অমন করে শেষ হয় নি। সে প্যারিসের দেখাও শেষ দেখা নয়, তারপর লণ্ডনে “রিণীর” সঙ্গে আমার বহুবার অমন শেষ দেখা হয়েছে।”
সীতেশ বললেন—
“তোমার কথা আমি বুঝতে পারছিনে। এর একটা শেষ হয়েছে, হয়নি?”
–হয়েছে।
—কি করে?
—বিয়ের বছরখানেক পরেই George-এর সঙ্গে “রিণীর” ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আদালতে প্রমাণ হয় যে, George “রিণী”কে প্রহার করতে সুরু করেছিলেন, তাও আবার মদের ঝোঁকে নয়, ভালবাসার বিকারে। তারপর “রিণী” Spain-এর একটি Convent-এ চিরজীবনের মত আশ্রয় নিয়েছে।
সীতেশ মহা উত্তেজিত হয়ে বললেন, “George তার প্রতি ঠিক ব্যবহারই করেছিল। আমি হলেও তাই করতুম।”
সোমনাথ বললেন–
“সম্ভবতঃ ও অবস্থায় আমিও তাই করতুম। ও ধর্মজ্ঞান, ও বলবীর্য আমাদের সকলেরি আছে! এই জন্যই ত দুর্বলের পক্ষে—
‘O crux! ave unica spera’ * এই হচ্ছে মানবমনের শেষ। কথা।”
সীতেশ উত্তর করলেন—
“তোমার বিশ্বাস তোমার ‘রিণী” একটি অবলা— জান সে কি? একসঙ্গে চোর আর পাগল!”
সোমনাথ ইতিমধ্যে একটি সিগরেট ধরিয়ে, আকাশের দিকে চেয়ে অম্লান বদনে বললেন–
“আমি যে বিশেষ অনুকম্পার পাত্র, এমন ত আমার মনে হয় না। কেননা পৃথিবীতে যে ভালবাসা খাটি, তার ভিতর পাগলামি ও প্রবঞ্চনা দুইই থাকে, ঐ টুকুইত ওর রহস্য।”
সীতেশের কাণে এ কথা এতই অদ্ভুত, এতই নিষ্ঠুর ঠেকল যে, তা শুনে তিনি একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। কি উত্তর করবেন ভেবে পেয়ে অবাক হয়ে রইলেন।
সেন বললেন “বাঃ সোমনাথ বাঃ! এতক্ষণ পরে একটা-কথার মত কথা বলেছ—এর মধ্যে যেমন নূতনত্ব আছে, তেমনি বুদ্ধির খেলা আছে। আমাদের মধ্যে তুমিই কেবল, মনোজগতে নিত্য নতুন সত্যের আবিষ্কার করতে পার।”
সীতেশ আর ধৈর্য ধরে থাকতে না পেরে বলে উঠলেন–
“অতিবুদ্ধির গলায় দড়ি—এ কথা যে কতদূর সত্য, তোমাদের এই সব প্রলাপ শুনলে তা বোঝা যায়!”–
সোমনাথ তাঁর কথার প্রতিবাদ সহ্য করতে পারতেন না, অর্থাৎ কেউ তার লেজে পা দিলে তিনি তখনি উল্টে তাকে ছোবল মারতেন, আর সেই সঙ্গে বিষ ঢেলে দিতেন। যে কথা তিনি শানিয়ে বলতেন, সে কথা প্রায়ই বিষদিগ্ধ-বাণের মত লোকের বুকে গিয়ে বিঁধত।
সোমনাথের মতের সঙ্গে তাঁর চরিত্রের যে বিশেষ কোনও মিল ছিল, তার প্রমাণ ত তাঁর প্রণয়কাহিনী থেকেই স্পষ্ট পাওয়া যায়। গরল তাঁর কণ্ঠে থাকলেও, তার হৃদয়ে ছিল না। হাড়ের মত কঠিন ঝিনুকের মধ্যে যেমন জেলির মত কোমল দেহ থাকে, সোমনাথেরও তেমনি অতি কঠিন মতামতের ভিতর অতি কোমল মনোভাব লুকিয়ে থাকত। তাই তাঁর মতামত শুনে আমার হৃৎকম্প উপস্থিত হত না, যা হত তা হচ্ছে ঈষৎ চিত্তচাঞ্চল্য, কেননা তার কথা যতই অপ্রিয় হোক, তার ভিতর থেকে একটি সত্যের চেহারা উকি মারত,–যে সত্য আমরা দেখতে চাইনে বলে দেখতে পাইনে।
এতক্ষণ আমরা গল্প বলতে ও শুনতে এতই নিবিষ্ট ছিলুম যে, বাইরের দিকে চেয়ে দেখবার অবসর আমাদের কারও হয়নি। সকলে যখন চুপ করলেন, সেই ফাঁকে আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি মেঘ কেটে গেছে, আর চাঁদ দেখা দিয়েছে। তার আলোয় চারিদিক ভরে গেছে, আর সে আলো এতই নির্মল, এতই কোমল যে, আমার মনে হল যেন বিশ্ব তার বুক খুলে আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে তার হৃদয় কত মধুর আর কত করুণ। প্রকৃতির এ রূপ আমরা নিত্য দেখতে পাইনে বলেই আমাদের মনে ভয় ও ভরসা, সংশয় ও বিশ্বাস, দিন রাত্তিরের মত পালায় পালায় নিত্য যায় আর আসে।
অতঃপর আমি আমার কথা সুরু করলুম।
৫. আমার কথা
সোমনাথ বলেছেন “Love is both a mystery and a joke।” এ কথা যে এক হিসেবে সত্য, তা আমরা সকলেই স্বীকার করতে বাধ্য; কেননা এই ভালবাসা নিয়ে মানুষে কবিও করে, রসিকতাও করে। সে কবিত্ব যদি অপার্থিব হয়, আর সে রসিকতা যদি অশ্লীল হয়, তাতেও সমাজ কোন আপত্তি করে না। Dante এবং Boccaccio, উভয়েই এক যুগের লেখক,শুধু তাই নয়, এর একজন হচ্ছেন গুরু, আর একজন শিষ্য। Don Juan এবং Epipsychidion, দুই কবিবন্ধুতে এক ঘরে পাশাপাশি বসে লিখেছিলেন। সাহিত্য-সমাজে এই সব পৃথকপন্থী লেখকদের যে সমান আদর আছে, তা ত তোমরা সকলেই জান।