—আমি যে জানতুম, তা প্রমাণ করে দিচ্ছি। তুমি ভাবতে যে আমার সঙ্গে তুমি শুধু মন নিয়ে খেলা করছ।
–তা ঠিক।
—আর এ খেলায় তোমার জেতবার এতটা জেদ ছিল যে, তার জন্য তুমি প্রাণপণ করেছিলে।
—এ কথাও ঠিক।
—কবে বুঝলে যে এ শুধু খেলা নয়?
—আজ। –কি করে?
—যখন তোমাকে স্টেসনে দেখলুম, তখন তোমার মুখে আমি নিজের মনের চেহারা দেখতে পেলুম।
–এতদিন তা দেখতে পাওনি কেন?
—তোমার মন আর আমার মনের ভিতর, তোমার অহঙ্কার আর আমার অহঙ্কারের জোড়া পর্দা ছিল। তোমার মনের পর্দার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনের পর্দাও উঠে গেছে।
—তুমি যে আমাকে কত ভালবাস, সে কথাও আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করব না।
–কেন?
—তাও আমি জানি।
—কতটা?
—জীবনের চাইতে বেশি। যখন তোমার মনে হয় যে আমি তোমাকে ভালবাসিনে, তখন তোমার কাছে বিশ্ব খালি হয়ে যায়, জীবনের কোনও অর্থ থাকে না।
—এ সত্য কি করে জানলে?
—নিজের মন থেকে।
এই কথার পর “রিণী” উঠে দাঁড়িয়ে বললে, “রাত হয়ে গেছে, আমার বাড়ী যেতে হবে; চল তোমাকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসি।”—”রিণী” পথ দেখাবার জন্য আগে আগে চলতে লাগল, আমি নীরবে তার অনুসরণ করতে আরম্ভ করলুম।
মিনিট দশেক পরে “রিণী” বললে—”আমরা এতদিন ধরে যে নাটকের অভিনয় করছি, আজ তার শেষ হওয়া উচিত।”
—মিলনান্ত না বিয়োগান্ত?
—সে তোমার হাতে। আমি বল্লুম—”যারা এক মাস পরস্পরকে ছেড়ে থাকতে পারে না, তাদের পক্ষে সমস্ত জীবন পরস্পরকে ছেড়ে থাকা কি সম্ভব?”
–তাহলে একত্র থাকবার জন্য তাদের কি করতে হবে?
–বিবাহ।
—তুমি কি সকল দিক ভেবে চিন্তে এ প্রস্তাব করছ?
—আমার আর কোন দিক ভাববার চিন্তবার ক্ষমতা নেই। এই মাত্র আমি জানি যে, তোমাকে ছেড়ে আমি আর একদিনও থাকতে পারব না।
—তুমি রোমান ক্যাথলিক হতে রাজি আছ?
এ কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। আমি নিরুত্তর রইলুম।
—এর উত্তর ভেবে তুমি কাল দিয়ো। এখন আর সময় নেই, ওই দেখ তোমার ট্রেন আসছে—শিগগির টিকেট কিনে নিয়ে এস, আমি তোমার জন্য প্ল্যাটফরমে অপেক্ষা করব।
আমি তাড়াতাড়ি টিকেট কিনে নিয়ে এসে দেখি “রিণী” অদৃশ্য হয়েছে। আমি একটি ফাস্ট ক্লাস গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, এমন সময় সেখান থেকে George নামলেন। আমি ট্রেনে চড়তে না চড়তে গাড়ি ছেড়ে দিলে।
আমি জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখি “রিণী” আর George পাশাপাশি হেঁটে চলেছে।
সে রাত্তিরে বিকারের রোগীর মাথার যে অবস্থা হয়, আমার তাই হয়েছিল,–অর্থাৎ আমি ঘুমোইওনি, জেগেও ছিলুম না।
পরদিন সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে আসবামাত্র চাকরে আমার হাতে একখানি চিঠি দিলে। শিরোনামায় দেখি “রিণীর” হস্তাক্ষর।
খুলে যা পড়লুম তা এই–
“এখন রাত বারোটা। কিন্তু এমন একটা সুখবর আছে, যা তোমাকে এখনই না দিয়ে থাকতে পারছিনে। আমি এক বৎসর ধরে যা চেয়ে ছিলুম, আজ তা হয়েছে। George আজ আমাকে বিবাহ করবার প্রস্তাব করেছে, আমি অবশ্য তাতে রাজি হয়েছি। এর জন্য ধন্যবাদটা বিশেষ করে তোমারই প্রাপ্য। কারণ George-এর মত পুরুষমানুষের মনে আমার মত রমণীকে পেতেও যেমন লোভ হয়, নিতেও তেমনি ভয় হয়। তাতেই ওদের মন স্থির করতে এত দেরি লাগে যে আমরা একটু সাহায্য না করলে সে মন আর কখনই স্থির হয় না। ওদের কাছে ভালবাসার অর্থ হচ্ছে jealousy; ওদের মনে যত jealousy বাড়ে, ওরা ভাবে ওরা তত বেশি ভালবাসে। স্টেসনে তোমাকে দেখেই George উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল, তারপর যখন শুনলে যে তোমার একটা কথার উত্তর আমাকে কাল দিতে হবে, তখন সে আর কালবিলম্ব না করে আমাদের বিয়ে ঠিক করে ফেললে। এর জন্য আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ রইব, এবং তুমিও আমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থেকো। কেননা, তুমি যে কি পাগলামি করতে বসেছিলে, তা পরে বুঝবে। আমি বাস্তবিকই আজ তোমার Saviour হয়েছি।
তোমার কাছে আমার শেষ অনুরোধ এই যে, তুমি আমার সঙ্গে আর দেখা করবার চেষ্টা করো না। আমি জানি যে, আমি আমার নতুন জীবন আরম্ভ করলে দু’দিনেই তোমাকে ভুলে যাব, আর তুমি যদি আমাকে শীগগির ভুলতে চাও, তাহলে Miss Hildesheimer-কে খুঁজে বার করে তাকে বিবাহ কর। সে যে আদর্শ স্ত্রী হবে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তা ছাড়া আমি যদি George-কে বিয়ে করে সুখে থাকতে পারি, তাহলে তুমি যে Miss Hildeslheimer-কে নিয়ে কেন সুখে থাকতে পারবে না, তা বুঝতে পারিনে। ভয়ানক মাথা ধরেছে, আর লিখতে পারিনে। Adieu।”
এ ব্যাপারে আমি কি George, কে বেশি কুপার পাত্র, তা আমি আজও বুঝতে পারিনি।
এ কথা শুনে সেন হেসে বললেন “দেখ সোমনাথ, তোমার অহঙ্কারই এ বিষয়ে তোমাকে নির্বোধ করে রেখেছে। এর ভিতর আর বোঝবার কি আছে? স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তোমার “রিণী” তোমাকে বাঁদর নাচিয়েছে এবং ঠকিয়েছে—সীতেশের তিনি যেমন তাকে করেছিলেন। সীতেশের মোহ ছিল শুধু এক ঘণ্টা, তোমার তা আজও কাটেনি। যে কথা স্বীকার করবার সাহস সীতেশের আছে, তোমার তা নেই। ও তোমার অহঙ্কারে বাধে।”
সোমনাথ উত্তর করলেন—
“ব্যাপারটা যত সহজ মনে করছ, তত নয়। তাহলে আর একটু বলি। আমি “রিণীর” পত্রপাঠে প্যারিসে যাই। মনস্থির করেছিলুম যে, যতদিন না আমার প্রবাসের মেয়াদ ফুরোয়, ততদিন সেখানেই থাকব, এবং লণ্ডনে শুধু Innএর term রাখতে বছরে চারবার করে যাব, এবং প্রতি ক্ষেপে ছ’দিন করে থাকব। মাসখানেক পরে, একদিন সন্ধ্যাবেলা হোটেলে বসে আছি—এমন সময়ে হঠাৎ দেখি “রিণী” এসে উপস্থিত? আমি তাকে দেখে চমকে উঠে বললুম যে, “তবে তুমি George-কে বিয়ে করনি, আমাকে শুধু ভোগা দেবার জন্য চিঠি লিখেছিলে?”