–না, আমরা ত আর মানুষ নই, আমাদের ত আর চোখ নেই! তোমার হয়ত বিশ্বাস যে, তোমরা সুন্দর হও, কুৎসিত হও, তাতেও আমাদের কিছু যায় আসে না।
—আমার ত তাই বিশ্বাস।
-তবে কিসের টানে তুমি আমাকে টেনে নিয়ে বেড়াও?
–রূপের?
—অবশ্য! তুমি হয়ত ভাব, তোমার কথা শুনে আমি মোহিত হয়েছি। স্বীকার করি তোমার কথা শুনতে আমার অত্যন্ত ভাল লাগে, শুধু তা নয়, নেশাও ধরে। কিন্তু তোমার কণ্ঠস্বর শোনবার আগে যে কুক্ষণে আমি তোমাকে দেখি, সেইক্ষণে আমি বুঝেছিলুম যে, আমার জীবনে একটি নূতন জালার সৃষ্টি হল, আমি চাই আর না চাই, তোমার জীবনের সঙ্গে আমার জীবনের চিরসংঘর্ষ থেকেই যাবে।
–এ সব কথা ত এর আগে তুমি কখন বলনি।।
–ও কানে শোনবার কথা নয়, চোখে দেখবার জিনিষ। সাধে কি তোমাকে আমি অন্ধ বলি? এখন শুনলে ত, এস সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসি। আজকে তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।
যে পথ ধরে চল্লুম সে পথটি যেমন সর, দু’পাশের বড় বড় গাছের ছায়ায় তেমনি অন্ধকার। আমি পদে পদে হোঁচট খেতে লাগলুম। “রিণী” বললে “আমি পথ চিনি, তুমি আমার হাত ধর, আমি তোমাকে নিরাপদে সমুদ্রের ধারে পৌঁছে দেব।” আমি তার হাত ধরে নীরবে সেই অন্ধকার পথে অগ্রসর হতে লাগলুম। আমি অনুমানে বুঝলুম যে, এই নির্জন অন্ধকারের প্রভাব তার মনকে শান্ত, বশীভূত করে আনছে। কিছুক্ষণ পর প্রমাণ পেলুম যে আমার অনুমান ঠিক।
মিনিট দশেক পরে “রিণী” বললে—”সু, তুমি জানো যে তোমার হাত তোমার মুখের চাইতে ঢের বেশি সত্যবাদী?”
–তার অর্থ?
—তার অর্থ, তুমি মুখে যা চেপে রাখ, তোমার হাতে তা ধরা পড়ে।
–সে বস্তু কি?
—তোমার হৃদয়।
–তারপর?
তারপর, তোমার রক্তের ভিতর যে বিদ্যুৎ আছে, তোমার আঙ্গুলের মুখ দিয়ে তা ছুটে বেরিয়ে পড়ে। তার স্পর্শে সে বিদ্যুৎ সমস্ত শরীরে চারিয়ে যায়, শিরের ভিতর গিয়ে রি রি করে।
–”রিণী’, তুমি আমাকে আজ এ সব কথা এত করে বলছ কেন? এতে আমার মন ভুলবে না, শুধু অহঙ্কার বাড়বে।—আমার অহঙ্কারের নেশা এমনি যথেষ্ট আছে, তার আর মাত্রা চড়িয়ে তোমার কি লাভ?
—সু, যে রূপ আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছে, তা তোমার দেহের কি মনের, আমি জানিনে। তোমার মন ও চরিত্রের কতক অংশ অতি স্পষ্ট, আর কতক অংশ অতি অস্পষ্ট। তোমার মুখের উপর তোমার ঐ মনের ছাপ আছে। এই আলো ছায়ায় আঁকা ছবিই আমার চোখে এত সুন্দর লাগে, আমার মনকে এত টানে। সে যাই হোক, আজ আমি তোমাকে শুধু সত্যকথা বলছি ও বলব, যদিও তোমার অহঙ্কারের মাত্রা বাড়ানোতে আমার ক্ষতি বই লাভ নেই।
—কি ক্ষতি?
—তুমি জান আর না জান, আমি জানি যে তুমি আমার উপর যত নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছ, তার মূলে তোমার অহং ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
–নিষ্ঠুর ব্যবহার আমি করেছি?
—হাঁ তুমি।—আগের কথা ছেড়ে দাও—এই এক মাস তুমি জান যে আমার কি কষ্টে কেটেছে। প্রতিদিন যখন ডাকপিয়ন এসে দুয়োরে knock করেছে, আমি অমনি ছুটে গিয়েছি— দেখতে তোমার চিঠি এল কি না। দিনের ভিতর দশবার করে তুমি আমার আশা ভঙ্গ করেছ। শেষটা এই অপমান আর সহ্য করতে না পেরে, আমি লণ্ডন থেকে এখানে পালিয়ে আসি।
—যদি সত্যই এত কষ্ট পেয়ে থাক, তবে সে কষ্ট তুমি ইচ্ছে করে ভোগ করেছ—
—কেন?
–আমাকে লিখলেই ত তোমার সঙ্গে দেখা করতুম।
—ঐ কথাতেই ত নিজেকে ধরা দিলে। তুমি তোমার অহঙ্কার ছাড়তে পার না, কিন্তু আমাকে তোমার জন্য তা ছাড়তে হবে! শেষে হলও তাই। আমার অহঙ্কার চূর্ণ করে তোমার পায়ে ধরে দিয়েছি, তাই আজ তুমি অনুগ্রহ করে আমাকে দেখা দিতে এসেছ!
এ কথার উত্তরে আমি বল্লুম—
“কষ্ট তুমি পেয়েছ? তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে অবধি আমার দিন যে কি আরামে কেটেছে, তা ভগবানই জানেন।”
–এ পৃথিবীতে এক জড়পদার্থ ছাড়া আর কারও আরামে পাকবার অধিকার নেই। আমি তোমার জড় হৃদয়কে জীবন্ত করে তুলেছি, এই ত আমার অপরাধ? তোমার বুকের তারে মীড় টেনে কোমল সুর বার করতে হয়। একে যদি তুমি পীড়ন করা বল, তাহলে আমার কিছু বলবার নেই। এই সময় আমরা বনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে দেখি, সুমুখে দিগন্ত বিস্তৃত গোধূলি ধূসর জলের মরুভূমি ধূ ধূ করছে। তখনও আকাশে আলো ছিল। সেই বিমর্ষ আলোয় দেখলুম, “রিণী”র মুখ গভীর চিন্তায় ভারাক্রান্ত হয়ে রয়েছে, সে একদৃষ্টে সমুদ্রের দিকে চেয়ে রয়েছে, কিন্তু সে দৃষ্টির কোনও লক্ষ্য নেই। সে চোখে যা ছিল, তা ঐ সমুদ্রের মতই একটা অসীম উদাস ভাব।
“রিণী” আমার হাত ছেড়ে দিলে, আমরা দুজনে বালির উপরে পাশা পাশি বসে সমুদ্রের দিকে চেয়ে রইলুম। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকবার পর আমি বল্লুম-”রিণী”, তুমি কি আমাকে সত্যই ভালবাসো?”
–বাসি।
–কবে থেকে?
–যে দিন তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়, সেই দিন থেকে। আমার মনের এ প্রকৃতি নয় যে, তা ধুইয়ে ধূইয়ে জ্বলে উঠবে। এ মন এক মুহূর্তে দপ করে জ্বলে ওঠে, কিন্তু এ জীবনে সে আগুন আর নেভে না। আর তুমি?
—তোমার সম্বন্ধে আমার মনোভাব এত বহুরূপী যে, তার কোনও একটি নাম দেওয়া যায় না। যার পরিচয় আমি নিজেই ভাল করে জানিনে, তোমাকে তা কি বলে জানাব?
—তোমার মনের কথা তুমি জান আর না জান, আমি জানতুম।
—আমি যে জানতুম না, সে কথা সত্য—কিন্তু তুমি জানতে কিনা, বলতে পারিনে।