ট্রেন B স্টেসনে বোধ হয় মিনিটখানেকের বেশি থামেনি, কিন্তু সেই এক মিনিট আমার কাছে অনন্তকাল হয়েছিল। তার মিনিট পাঁচেক পরে ট্রেন W স্টেশনে পৌঁছল। আমি সমুদ্রের ধারে একটি বড় হোটেলে গিয়ে উঠলুম। কেন জানিনে, হোটেলে পৌছেই আমার অগাধ শ্রান্তি বোধ হতে লাগল। আমি কাপড় ছেড়ে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লুম। এই একটি মাত্র দিন যখন আমি বিলেতে দিবানিদ্রা দিয়েছি, আর এমন ঘুম আমি জীবনে কখনও ঘুমোইনি। জেগে উঠে দেখি পাঁচটা বেজে গেছে। তাড়াতাড়ি কাপড় পরে নাচে এসে চা খেয়ে পদব্রজে B-র অভিমুখে যাত্রা করলুম। যখন সে গ্রামের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছলুম, তখন প্রায় সাতটা বাজে; তখনও আকাশে যথেষ্ট আলো ছিল। বিলেতে জানইত গ্রীষ্মকালের রাত্তির দিনের জের টেনে নিয়ে আসে; সূর্য অস্ত গেলেও, তার পশ্চিম আলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাত্তিরের গায়ে জড়িয়ে থাকে। “রিণী” কোন পাড়ায় কোন বাড়ীতে থাকে, তা আমি জানতুম না, কিন্তু আমি এটা জানতুম যে, W থেকে B যাবার রাস্তায় কোথায়ও না কোথায়ও তার দেখা পাব।
B-র সীমাতে পা দেবামাত্রই দেখি, একটি স্ত্রীলোক একটু উতলা ভাবে রাস্তায় পায়চারি করছে। দূর থেকে তাকে চিনতে পারিনি, কেননা ইতিমধ্যে “রিণী” তার পোষাক বদলে ফেলেছিল। সে কাপড়ের রংয়ের নাম জানিনে, এই পর্যন্ত বলতে পারি যে সেই সন্ধ্যের আলোর সঙ্গে সে এক হয়ে গিয়েছিল—সে রং যেন গোধূলিতে ছাপানো।
আমাকে দেখবামাত্র “রিণী” আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে ছুটে পালিয়ে গেল। আমি আস্তে আস্তে সেই দিকে এগোতে লাগলুম। আমি জানতুম যে, সে এই গাছপালার ভিতর নিশ্চয়ই কোথাও লুকিয়ে আছে–সহজে ধরা দেবে না—একটু খুজে পেতে তাকে বার করতে হবে। আমি অবশ্য তার এ ব্যবহারে আশ্চর্য হয়ে যাইনি, কেননা এতদিনে আমার শিক্ষা হয়েছিল যে, “রিণী” যে কখন কি ব্যবহার করবে, তা অপরের জানা দূরে থাক, সে নিজেই জানত না। আমি একটু এগিয়ে দেখি, ডান দিকে বনের ভিতর একটি গলি রাস্তার ধারে একটি oak গাছের আড়ালে “রিণী” দাঁড়িয়ে আছে, এমন ভাবে যাতে পাতার ফাঁক দিয়ে ঝরা আলো তার মুখের উপর এসে পড়ে। আমি অতি সন্তর্পণে তার দিকে এগোতে লাগলুম, সে চিত্র-পুত্তলিকার মত দাঁড়িয়েই রইল। তার মুখের আধখানা ছায়ায় ঢাকা পড়াতে, বাকি অংশটুকু স্বর্ণমুদ্রার উপর অঙ্কিত গ্রীকরমণীমূর্তির মত দেখাচ্ছিল,—সে মূর্তি যেমন সুন্দর, তেমনি কঠিন। আমি কাছে যাবামাত্র, সে দু’হাত দিয়ে তার মুখ ঢাকলে। আমি তার সুমুখে গিয়ে দাঁড়ালুম। দুজনের কারও মুখে কথা নেই।।
কতক্ষণ এ ভাবে গেল জানিনে। তারপর প্রথমে কথা অবশ্য “রিণী”ই কইলে—কেননা সে বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারত না। বিশেষতঃ আমার কাছে। তার কথার স্বরে ঝগড়ার পূর্বাভাস ছিল। প্রথম সম্ভাষণ হল এই “তুমি এখান থেকে চলে যাও! আমি তোমার সঙ্গে কথা কইতে চাইনে, তোমার মুখ দেখতে চাইনে।”
—আমার অপরাধ?
-তুমি এখানে কেন এলে?
—তুমি আসতে লিখেছ বলে।
—সেদিন আমার বড় মন খারাপ ছিল। বড় একা একা মনে হচ্ছিল বলে ঐ চিঠি লিখি। কিন্তু কখনও মনে করিনি, তুমি চিঠি পাবামাত্র ছুটে এখানে চলে আসবে। তুমি জান যে, মা যদি টের পান যে আমি একটি কালো লোকের সঙ্গে ইয়ারকি দিই, তাহলে আমাকে বাড়ী ছাড়তে হবে?
ইয়ারকি শব্দটি আমার কানে খট্ করে লাগল, আমি ঈষৎ বিরক্তভাবে বললুম—”তোমার মুখেই তা শুনেছি। তার সত্যি মিথ্যে ভগবান জানেন। কিন্তু তুমি কি বলতে চাও তুমি ভাবনি যে আমি আসব?”
—স্বপ্নেও না।
—তাহলে ট্রেন আসবার সময় কার খোঁজে স্টেসনে গিয়েছিলে?
—কারও খোঁজে নয়। চিঠি ডাকে দিতে।
–তাহলে ওরকম কাপড় পরেছিলে কেন, যা আধক্রোশ দূর থেকে কাণ লোকেরও চোখে পড়ে?
–তোমার সুনজরে পড়বার জন্য।
—সু হোক, কু হোক, আমার নজরেই পড়বার জন্য।
–তোমার বিশ্বাস তোমাকে না দেখে আমি থাকতে পারিনে?
—তা কি করে বলব! এইত এতক্ষণ হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রেখেছ।
—সে চোখে আলো সইছে না বলে। আমার চোখে অসুখ করেছে। “দেখি কি হয়েছে”, এই বলে আমি আমার হাত দিয়ে তার মুখ থেকে তার হাত দুখানি তুলে নেবার চেষ্টা করলুম। “রিণী” বল্লে, “তুমি হাত সরিয়ে নেও, নইলে আমি চোখ খুলব না। আর তুমি জান যে, জোরে তুমি আমার সঙ্গে পারবে না।”
—আমি জানি যে আমি George নই। গায়ের জোরে আমি কারও চোখ খোলাতে পারব না। এ কথা শুনে “রিণী” মুখ থেকে হাত নামিয়ে নিয়ে, মহা উত্তেজিত ভাবে বললে, “আমার চোখ খোেলাবার জন্য কারও ব্যস্ত হবার দরকার নেই। আমি আর তোমার মত অন্ধ নই! তোমার যদি কারও ভিতরটা দেখবার শক্তি থাকত, তাহলে তুমি আমাকে যখন-তখন এত অস্থির করে তুলতে না। জান আমি কেন রাগ করেছিলুম? তোমার ঐ কাপড় দেখে! তোমাকে ও-কাপড়ে আজ দেখব না বলে আমি চোখ বন্ধ করেছিলুম।”
–কেন, এ কাপড়ের কি দোষ হয়েছে? এটি ত আমার সব চাইতে সুন্দর পোষাক।
—দোষ এই যে, এ সে কাপড় নয়, যে কাপড়ে আমি তোমাকে প্রথম দেখি।
এ কথা শোনবামাত্র আমার মনে পড়ে গেল যে, “রিণী” সেই কাপড় পরে আছে, যে কাপড়ে আমি প্রথম তাকে Ilfracombe-য়ে দেখি। আমি ঈষৎ অপ্রতিভ ভাবে বললুম, “এ কথা আমার মনে হয়নি যে আমরা পুরুষমানুষ, কি পরি না পরি তাতে তোমাদের কিছু যায় আসে।”—