আমি যে শত চেষ্টাতেও “রিণী”র মনকে আমার করায়ত্ত করতে পারি নি, তার জন্য আমি লজ্জিত নই—কেন না আকাশ বাতাসকে কেউ আর মুঠোর ভিতরে চেপে ধরতে পারে না। তার মনের স্বভাবটা অনেকটা এই আকাশের মতই ছিল, দিনে দিনে তার চেহারা বদলাত। আজ ঝড়-জল বজ-বিদ্যুৎ,কাল আবার চাঁদের আলো, বসন্তের হাওয়া। একদিন গোধূলি, আর একদিন কড়া রোদ্দর। তা ছাড়া সে ছিল একাধারে শিশু, বালিকা, যুবতী আর বৃদ্ধা। যখন তার স্মৃর্তি মন তার আমোদ চড়ত, তখন সে ছোট ছেলের মত ব্যবহার করত; আমার নাক ধরে টানত, চুল ধরে টানত, মুখ ভেংচাত, জিভ বার করে দেখাত। আবার কখনও বা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে, যেন আপন মনে, নিজের ছেলেবেলাকার গল্প করে যেত। তাকে কে কবে বকেছে, কে কবে আদর করেছে, সে কবে কি পড়েছে, কবে কি প্রাইজ পেয়েছে, কবে বনভোজন করেছে, কবে ঘোড়া থেকে পড়েছে; যখন সে এই সকলের খুটিয়ে বর্ণনা করত, তখন একটি বালিকা-মনের স্পষ্ট ছবি দেখতে পেতুম। সে ছবির রেখাগুলি যেমন সরল, তার বর্ণও তেমনি উজ্জ্বল। তারপর সে ছিল গোঁড়া রোমান ক্যাথলিক। একটি অল্পস কাঠের ক্রুশে-আঁটা রূপোর ক্রাইস্ট তার বুকের উপর অষ্টপ্রহর ঝুত, এক মুহূর্তের জন্যও সে তা স্থানান্তরিত করে নি। সে যখন তার ধর্মের বিষয়ে বক্তৃতা আরম্ভ করত, তখন মনে হত তার বয়েস আশী বৎসর। সে সময়ে তার সরল বিশ্বাসের সুমুখে আমার দার্শনিক বুদ্ধি মাথা হেঁট করে থাকত। কিন্তু আসলে সে ছিল পূর্ণ যুবতী,—যদি যৌবনের অর্থ হয় প্রাণের উদ্দাম উচ্ছাস। তার সকল মনোভাব, সকল ব্যবহার, সকল কথার ভিতর এমন একটি প্রাণের জোয়ার বইত, যার তোড়ে আমার অন্তরাত্মা অবিশ্রান্ত তোলপাড় করত। আমরা মাসে দশবার করে ঝগড়া করতুম, আর ঈশ্বরসাক্ষী করে প্রতিজ্ঞা করতুম যে, জীবনে আর কখনও পরস্পরের মুখ দেখব না। কিন্তু দু’দিন না যেতেই, হয় আমি তার কাছে ছুটে যেতুম, নয় সে আমার কাছে ছুটে আসত। তখন আমরা আগের কথা সব ভুলে যেতুম—সেই পুনর্মিলন আবার আমাদের প্রথম মিলন হয়ে উঠত। এই ভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কেটে গিয়েছিল। আমাদের শেষ ঝগড়াটা অনেকদিন স্থায়ী হয়েছিল। আমি বলতে ভুলে গিয়েছিলুম যে, সে আমার মনের সর্বপ্রধান দুর্বলতাটি আবিষ্কার করেছিল তার নাম jealousy।—যে মনের আগুনে মানুষ জলে পুড়ে মরে, “রিণী” সে আগুন জ্বালাবার মন্ত্র জানত। আমি পৃথিবীতে বহুলোককে অবজ্ঞা করে এসেছি—কিন্তু ইতিপূর্বে কাউকে কখনও হিংসা করিনি। বিশেষতঃ George-এর মত লোককে হিংসা করার চাইতে আমার মত লোকের পক্ষে বেশি কি হীনতা হতে পারে? কারণ, আমার যা ছিল, তা হচ্ছে টাকার জোর আর গায়ের জোর। কিন্তু “রিণী” আমাকে এ হীনতাও স্বীকার করতে বাধ্য করেছিল। তার শেষবারের ব্যবহার আমার কাছে যেমন নিষ্ঠুর তেমনি অপমানজনক মনে হয়েছিল। নিজের মনের দুর্বলতার স্পষ্ট পরিচয় পাবার মত কষ্টকর জিনিষ মানুষের পক্ষে আর কিছু হতে পারে না।
ভয় যেমন মানুষকে দুঃসাহসিক করে তোলে, আমার ঐ দুর্বলতাই তেমনি আমার মনকে এত শক্ত করে তুলেছিল যে, আমি আর কখনও তার মুখ-দর্শন করতুম না—যদি না সে আমাকে চিঠি লিখত। সে চিঠির প্রতি অক্ষর আমার মনে আছে,—সে চিঠি এই :–
“তোমার সঙ্গে যখন শেষ দেখা হয়, তখন দেখেছিলুম যে তোমার শরীর ভেঙ্গে পড়ছে—আমার মনে হয় তোমার পক্ষে একটা change নিতান্ত আবশ্যক। আমি যেখানে আছি, সেখানকার হাওয়া মরা মানুষকে বাঁচিয়ে তোলে। এ জায়গাটা একটি অতি ছোট পল্লীগ্রাম। এখানে তোমার থাকবার মত কোনও স্থান নেই। কিন্তু এর ঠিক পরের স্টেসনটিতে অনেক ভাল ভাল হোটেল আছে। আমার ইচ্ছে তুমি কালই লণ্ডন ছেড়ে সেখানে যাও। এখন এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি —আর দেরি করলে এমন চমৎকার সময় আর পাবে না। যদি হাতে, টাকা না থাকে, আমাকে টেলিগ্রাম করো, আমি পাঠিয়ে দেব। পরে সুদসুদ্ধ তা শুধে দিয়ো।”
আমি চিঠির কোন উত্তর দিলুম না, কিন্তু পরদিন সকালের ট্রেনেই লণ্ডন ছাড়লুম। আমি কোন কারণে তোমাদের কাছে সে জায়গার নাম করব না। এই পর্যন্ত বলে রাখি, “রিণী” যেখানে ছিল তার নামের প্রথম অক্ষর B, এবং তার পরের স্টেসনের নামের প্রথম অক্ষর W.
ট্রেন যখন B স্টেশনে গিয়ে পৌঁছল, তখন বেলা প্রায় দু’টো। আমি জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলুম “রিণী” প্ল্যাটফরমে নেই। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি, প্ল্যাটফরমের রেলিংয়ের ওপরে রাস্তার ধারে একটি গাছে হেলান দিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে যে কেন আমি তাকে দেখতে পাইনি, তাই ভেবে আশ্চর্য হয়ে গেলুম, কেননা সে যে রংঙের কাপড় পরেছিল তা আধক্রোশ দূর থেকে মানুষের চোখে পড়ে—একটি মিমিসে কালো গাউনের উপর একটি ডগন্ডগে হলদে জ্যাকেট। সেদিনকে “রিণী” এক অপ্রত্যাশিত নতুন মূর্তিতে, আমাদের দেশের নববধূর মূর্তিতে দেখা দিয়েছিল। এই বজ্রবিদ্যুৎ দিয়ে গড়া রমণীর মুখে আমি পূর্বে কখন লজ্জার চিহ্নমাত্রও দেখতে পাইনি। কিন্তু সেদিন তার মুখে যে হাসি ঈষৎ ফুটে উঠেছিল, সে লজ্জার রক্তিম হাসি। সে চোখ তুলে আমার দিকে ভাল করে চাইতে পারছিল না। তার মুখখানি এত মিষ্টি দেখাচ্ছিল যে, আমি চোখ ভরে প্রাণভরে তাই দেখতে লাগলুম। আমি যদি কখনও তাকে ভালবেসে থাকি, ত সেই দিন সেই মুহূর্তে! মানুষের সমস্ত মনটা যে এক মুহূর্তে এমন রং ধরে উঠতে পারে, এ সত্যের পরিচয় আমি সেই দিন প্রথম পাই।