“বারোটা” শুনে সে লাফিয়ে উঠে বললে—
“উঃ! এত রাত হয়ে গেছে? তুমি মানুষকে এই বকাতেও পার! যাই, শুতে যাই। কাল আবার সকাল সকাল উঠতে হবে। অনেক দূর যেতে হবে, তাও আবার দশটার ভিতর পৌঁছিতে হবে।”
—কোথায় যেতে হবে?
–একটা শীকারে। কেন, তুমি কি জান না? তোমার সুমুখেই ত George-এর সঙ্গে কথা হল।।
—তাহলে সে কথা তুমি রাখবে?
–তোমার কিসে মনে হল যে রাখব না?
—তুমি যে ভাবে তার উত্তর দিলে।
—সে শুধু George-কে একটু নিগ্রহ করার জন্য। আজ রাত্তিরে ওর ঘুম হবে না, আর জানই ত ওদের পক্ষে জেগে থাকা কত কষ্ট!
—তোমার দেখছি বন্ধুবান্ধবদের প্রতি অনুগ্রহ অতি বেশি।
—অবশ্য! George-এর মত পুরুষমানুষের মনকে মাঝে মাঝে একটু উস্কে না দিলে তা সহজেই নিভে যায়। আর তা ছাড়া ওদের মনে খোঁচা মারার ভিতর বেশি কিছু নিষ্ঠুরতাও নেই। ওদের মনে কেউ বেশি কষ্ট দিতে পারে না, ওরাও এক প্রহার দেওয়া ছাড়া স্ত্রীলোককে অন্য কোনও কষ্ট দিতে পারে না। সেই জন্যই ত ওরা আদর্শ স্বামী হয়। মন নিয়ে কাড়াকাড়ি ছেঁড়াছিঁড়ি, সে তোমার মত লোকেই করে।
—তোমার কথা আমার হেঁয়ালির মত লাগছে—
—যদি হেঁয়ালি হয় ত তাই হোক। তোমার জন্যে আমি আর তার ব্যাখ্যা করতে পারিনে। আমার যেমন শ্রান্ত মনে হচ্ছে, তেমনি ঘুম পাচ্চে। তোমার ঘর উপরে?
-হাঁ।
–তবে এখন ওঠ, উপরে যাওয়া যাক।
আমরা দুজনে আবার ঘরে ফিরে এলুম।
করিডরে পৌঁছবামাত্র সে বল্লে—-”ভাল কথা, তোমার একখানা কার্ড আমাকে দেও—”
আমি কার্ডখানি দিলুম। সে আমার নাম পড়ে বললে—
“তোমাকে আমি ‘সু” বলে ডাকব।”
আমি জিজ্ঞাসা করলুম “তোমাকে কি বলে সম্বোধন করব?”
উত্তর—যা-খুসি-একটা-কিছু বানিয়ে নেও না। ভাল কথা, আজ তোমাকে যে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছি, তাতে তোমার আমাকে saviour বলে ডাকা উচিত!
—তথাস্তু।
—তোমার ভাষায় ওর নাম কি?
—আমার দেশে বিপন্নকে যিনি উদ্ধার করেন, তিনি দেব নন–দেবী,—তার নাম “তারিণী”।
“বাঃ, দিব্যি নাম ত! ওর তা-টি বাদ দিয়ে আমাকে “রিণী” বলে ডেকো।” এই কথাবার্তা কইতে কইতে আমরা সিড়িতে উঠছিলুম। একটা গ্যাসের বাতির কাছে আসবামাত্র সে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে, আমার হাতের দিকে চেয়ে বললে, “দেখি দেখি তোমার হাতে কি হয়েছে?” অমনি নিজের হাতের দিকে আমার চোখ পড়ল, দেখি হাতটি লাল টক্ টক্ করছে, যেন কে তাতে সিদুর মাখিয়ে দিয়েছে। সে আমার ডান হাতখানি নিজের বাঁ হাতের উপরে রেখে জিজ্ঞাসা করলে—
“কার বুকের রক্তে হাত ছুপিয়েছ– অবশ্য Venus de Miloর নয়?”
—না, নিজের।
—এতক্ষণ পরে একটি সত্য কথা বলেছ! আশা করি এ রং পাকা। কেননা যে দিন এ রং ছুটে যাবে, সেদিন জেনো তোমার সঙ্গে আমার ভাবও চটে যাবে। যাও, এখন শোওগে। ভাল করে ঘুমিও, আর আমার বিষয় স্বপ্ন দেখে।–
এই কথা বলে সে দু’লাফে অন্তর্ধান হল।
আমি শোবার ঘরে ঢুকে আরসিতে নিজের চেহারা দেখে চমকে গেলুম। এক বোতল শ্যাম্পেন খেলে মানুষের যেরকম চেহারা হয়, আমার ঠিক সেই রকম হয়েছিল। দেখি দুই গালে রক্ত দেখা দিয়েছে, আর চোখের তারা দুটি শুধু জ্বল জ্বল করছে। বাকি অংশ ছল্ ছল্ করছে। সে সময় আমার নিজের চেহারা আমার চোখে বড় সুন্দর লেগেছিল। আমি অবশ্য তাকে স্বপ্নে দেখিনি,কেননা, সে রাত্তিরে আমার ঘুম হয়নি।
.
(২)
সে রাত্তিরে আমরা দুজনে যে জীবন-নাটকের অভিনয় শুরু করি, বছরখানেক পরে আর এক রাত্তিরে তার শেষ হয়। আমি প্রথম দিনের সব ঘটনা তোমাদের বলেছি, আর শেষ দিনের বলব, কেননা এ দু’ দিনের সকল কথা আমার মনে আজও গাঁথা রয়েছে। তা ছাড়া ইতিমধ্যে যা ঘটেছিল, সে সব আমার মনের ভিতর-বাইরে নয়। যে ব্যাপারে বাহ্যঘটনার বৈচিত্র্য নেই, তার কাহিনী বলা যায় না। আমার মনের সে বৎসরের ডাক্তারি-ডায়রি যখন আমি নিজেই পড়তে ভয় পাই, তখন তোমাদের তা পরে শোনাবার আমার তিলমাত্রও অভিপ্রায় নেই।
এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, আমার মনের অদৃশ্য তারগুলি “রিণী” তার দশ আঙ্গুলে এমনি করে ধরে, সে-মনকে পুতুল নাচিয়েছিল। আমার অন্তরে সে যে-প্রবৃত্তি জাগিয়ে তুলেছিল, তাকে ভালবাসা বলে কি না জানি নে; এইমাত্র জানি যে, সে মনোভাবের ভিতর অহঙ্কার ছিল, অভিমান ছিল, রাগ ছিল, জেদ ছিল, আর সেই সঙ্গে ছিল করুণ, মধুর, দাস্য ও সখ্য এই চারটি হৃদয়রস।–এর মধ্যে যা লেশমাত্রও ছিল, সে হচ্ছে দেহের নাম কি গন্ধ। আমার মনের এই কড়িকোমল পর্দাগুলির উপর সে তার আঙ্গুল চালিয়ে যখন-যেমন ইচ্ছে তখন-তেমনি সুর বার করতে পারত। তার আঙ্গুলের টিপে সে সুর কখনও বা অতি কোমল, কখনও বা অতি-তীয়র হত।
একটি ফরাসী কবি বলেছেন যে, রমণী হচ্ছে আমাদের দেহের ছায়া। তাকে ধরতে যাও সে পালিয়ে যাবে, আর তার কাছ থেকে পালাতে চেষ্টা কর, সে তোমার পিছু পিছু ছুটে আসবে। আমি বারমাস ধরে এই ছায়ার সঙ্গে অহর্নিশি লুকোচুরি খেলেছিলুম। এ খেলার ভিতর কোনও সুখ ছিল না। অথচ এ খেলা সাঙ্গ করবার শক্তিও আমার ছিল না। অনিদ্রাগ্রস্ত লোক যেমন যত বেশি ঘুমতে চেষ্টা করে, তত বেশি জেগে ওঠে,আমিও তেমনি যত বেশি এই খেলা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করতুম, তত বেশি জড়িয়ে পড়তুম। সত্য কথা বলতে গেলে, এ খেলা বন্ধ করবার জন্য আমার আগ্রহও ছিল না,– কেন না আমার মনের এই নব অশান্তির মধ্যে নব জীবনের তীব্র স্বাদ ছিল।