—শুনতে চাও তোমার সঙ্গে George-এর আসল তফাৎটা কোথায়?
—পরের মনের আয়নায় নিজের মনের ছবি কি রকম দেখায়, তা বোধ হয় মানুষমাত্রেই জানতে চায়।
-একটি উপমার সাহায্যে বুঝিয়ে দিচ্ছি। George হচ্ছে দাবার নৌকা, আর তুমি গজ। ও একরোখে সিধে পথেই চলতে চায়, আর তুমি কোণাকুণি।
—এ দুয়ের মধ্যে কোটি তোমাদের হাতে খেলে ভাল?
—আমাদের কাছে ও-দুইই সমান। আমরা স্কন্ধে ভর করলে দুয়েরই চাল বদলে যায়। উভয়েই একে বেঁকে আড়াই পায়ে চলতে বাধ্য হয়!
—পুরুষমানুষকে ওরকম ব্যতিব্যস্ত করে তোমরা কি সুখ পাও? এ কথা শুনে সে হঠাৎ বিরক্ত হয়ে বল্লে—
“তুমি ত আমার Father Confessor নও যে মন খুলে তোমার কাছে আমার সব সুখদুঃখের কথা বলতে হবে! তুমি যদি আমাকে ওভাবে জেরা করতে সুরু কর, তাহলে এখনই
আমি উঠে চলে যাব।”
এই বলে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে। আমার রূঢ় কথা শোনা অভ্যাস ছিল না, তাই আমি অতি গম্ভীরভাবে উত্তর করলুম “তুমি যদি চলে যেতে চাও ত আমি তোমাকে থাকতে অনুরোধ করব না। ভুলে যেও না যে আমি তোমাকে ধরে রাখিনি।”—এ কথার পর মিনিটখানেক চুপ করে থেকে, সে অতি বিনীত ও নম্রভাবে জিজ্ঞাসা করলে–
“আমার উপর রাগ করেছ?”
আমি একটু লজ্জিতভাবে উত্তর করলুম—
“না। রাগ করবার ত কোনও কারণ নেই।”
–তবে অত গম্ভীর হয়ে গেলে কেন?
—”এতক্ষণ এই বন্ধ ঘরে গ্যাসের বাতির নীচে বসে বসে আমার মাথা ধরেছে”—এই মিথ্যে কথা আমার মুখ দিয়ে অবলীলাক্রমে বেরিয়ে গেল। এর উত্তরে “দেখি তোমার জ্বর হয়েছে কিনা” এই কথা বলে সে আমার কপালে হাত দিলে। সে স্পর্শের ভিতর তার আঙ্গুলের ডগার একটু সসঙ্কোচ আদরের ইসারা ছিল। মিনিটখানেক পরে সে তার হাত তুলে নিয়ে বললে—”তোমার মাথা একটু গরম হয়েছে, কিন্তু ও জুর নয়। চল বাইরে গিয়ে বসবে, তাহলেই ভাল হয়ে যাবে।”
আমি বিনা বাক্যব্যয়ে তার পদানুসরণ করলুম। তোমরা যদি বল যে সে আমাকে mesmerise করেছিল, তাহলে আমি সে কথার প্রতিবাদ করব না।
বাইরে গিয়ে দেখি সেখানে জনমানব নেই–যদিও রাত তখন সাড়ে এগারটা, তবু সকলে শুতে গিয়েছে। বুঝলুম Ilfracombe সত্য সত্যই ঘুমের রাজ্য। আমরা দুজনে দুখানি বেতের চেয়ারে বসে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলুম। দেখি আকাশ আর সমুদ্র দুই এক হয়ে গেছে—দুইই শ্লেটের রঙ। আর আকাশে যেমন তারা জ্বলছে, সমুদ্রের গায়ে তেমনি যেখানে যেখানে আলো পড়ছে সেখানেই তারা ফুটে উঠছে,–এখানে ওখানে সব জলের টুকরো টাকার মত চকচক করছে, পারার মত টম করছে। গাছপালার চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে যেন স্থানে স্থানে অন্ধকার জমাট হয়ে গিয়েছে। তখন সসাগরা বসুন্ধরা মৌনব্রত অবলম্বন করেছিল। এই নিস্তব্ধ নিশীথের নিবিড় শান্তি আমার সঙ্গিনীটির হৃদয়ান স্পর্শ করেছিল— কেননা সে কতক্ষণ ধরে ধ্যানমগ্নভাবে বসে রইল। আমিও চুপ করে রইলুম। তারপর সে চোখ বুজে অতি মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করলে
“তোমার দেশে যোগী বলে একদল লোক আছে, যারা কামিনী কাঞ্চন স্পর্শ করে না, আর সংসার ত্যাগ করে বনে চলে যায়?”
–বনে যায়, এ কথা সত্য।
—আর সেখানে আহারনিদ্রা ত্যাগ করে অহর্নিশি জপতপ করে?
—এইরকম ত শুনতে পাই।
—আর তার ফলে যত তাদের দেহের ক্ষয় হয়, তত তাদের মনের শক্তি বাড়ে,—যত তাদের বাইরেটা স্থিরশান্ত হয়ে আসে, তত তাদের অন্তরের তেজ ফুটে ওঠে?
–তা হলেও হতে পারে।
–”হতে পারে” বলছ কেন? শুনেছি তোমরা বিশ্বাস কর যে, এদের দেহমনে এমন অলৌকিক শক্তি জন্মায় যে, এই সব মুক্ত জীবের স্পর্শে এবং কথায় মানুষের শরীরমনের সকল অসুখ সেরে যায়।
–ও সব মেয়েলি বিশ্বাস।
—তোমার নয় কেন?
—আমি যা জানিনে তা বিশ্বাস করিনে। আমি এর সত্যি মিথ্যে কি করে জানব? আমি ত আর যোগ অভ্যাস করিনি।
—আমি ভেবেছিলুম তুমি করেছ।
-এ অদ্ভুত ধারণা তোমার কিসের থেকে হল?
—ঐ জিতেন্দ্রিয় পুরুষদের মত তোমার মুখে একটা শীর্ণ, ও চোখে একটা তীক্ষ্ণ ভাব আছে।
—তার কারণ অনিদ্রা।
-আর অনাহার। তোমার চোখে মনের অনিদ্রা ও হৃদয়ের উপবাস,—এ দুয়েরি লক্ষণ আছে। তোমার মুখের ঐ ছাইচাপা আগুনের চেহারা প্রথমেই আমার চোখে পড়ে। একটা অদ্ভুত কিছু দেখলে মানুষের চোখ সহজেই তার দিকে যায়, তার বিষয় সবিশেষ জানবার জন্য মন লালায়িত হয়ে ওঠে। George-এর হাত থেকে অব্যাহতি লাভ করবার জন্য যে তোমার আশ্রয় নিই, এ কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা; তোমাকে একবার নেড়েচেড়ে দেখবার জন্যই আমি তোমার কাছে আসি।
—আমার তপোভঙ্গ করবার জন্য?
—তুমি যেদিন St. Anthony হয়ে উঠবে, আমিও সেদিন স্বর্গের অপ্সরা হয়ে দাঁড়াব। ইতিমধ্যে তোমার ঐ গেরুয়া রঙের মিনে-করা মুখের পিছনে কি ধাতু আছে, তাই জানবার জন্য আমার কৌতূহল হয়েছিল।
—কি ধাতু আবিষ্কার করলে শুনতে পারি?
—আমি জানি তুমি কি শুনতে চাও।
—তাহলে তুমি আমার মনের সেই কথা জান, যা আমি জানিনে।
—অবশ্য! তুমি চাও আমি বলি—চুম্বক।
কথাটি শোনবামাত্র আমার জ্ঞান হল যে, এ উত্তর শুনলে আমি খুসি হতুম, যদি তা বিশ্বাস করতুম। এই নব আকাঙ্ক্ষা সে আমার মনের ভিতর আবিষ্কার করলে, কি নির্মাণ করলে, তা আমি আজও জানিনে। আমি মনে মনে উত্তর খুঁজছি, এমন সময়ে সে জিজ্ঞাসা করলে “কটা বেজেছে?” আমি ঘড়ি দেখে বল্লুম- “বারোটা।”