এর পর আমরা দুজনে দাবা নিয়ে বসে গেলুম। আমার শিক্ষয়িত্রী কোন্ বলের কি নাম, কার কি চাল, এ সব বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে উপদেশ দিতে সুরু করলেন। আমি অবশ্য সে সবই জানতুম, তবু অজ্ঞতার ভাণ করছিলুম, কেননা তাঁর সঙ্গে কথা কইতে আমার মন্দ লাগছিল না। আমি ইতিপূর্বে এমন একটি রমণীও দেখিনি, যিনি পুরুষমানুষের সঙ্গে নিঃসঙ্কোচে কথাবার্তা কইতে পারেন, যার সকল কথা সকল ব্যবহারের ভিতর কতকটা কৃত্রিমতার আবরণ না থাকে। সাধারণতঃ স্ত্রীলোক—সে যে দেশেরই হোক—আমাদের জাতের সুমুখে মন বে-আব্রু করতে পারে না। এই আমি প্রথম স্ত্রীলোক দেখলুম, যে পুরুষ-বন্ধুর মত সহজ ও খোলাখুলি ভাবে কথা কইতে পারে। এর সঙ্গে যে পর্দার আড়াল থেকে আলাপ করতে হচ্ছে না, এতেই আমি খুসি হয়েছিলুম। সুতরাং এই শিক্ষা ব্যাপারটি একটু লম্বা হওয়াতে আমার কোনও আপত্তি ছিল না।
মাথা নীচু করে অনর্গল বকে গেলেও, আমার সঙ্গিনীটি যে ক্রমান্বয়ে বারান্দার দিকে কটাক্ষ নিক্ষেপ করছিল, তা আমার নজর এড়িয়ে যায়নি। আমি সেই দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখলুম যে, তার ডিনারের সাথীটি ঘন ঘন পায়চারি করছেন এবং তার মুখে জ্বলছে চুরেট, আর চোখে রাগ। আমার বন্ধুটিও যে তা লক্ষ্য করছিল, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, কেননা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল যে, ঐ ভদ্রলোকটি তার মনের উপর একটি চাপের মত বিরাজ করছেন। সকল বলের গতিবিধির পরিচয় দিতে তার বোধ হয় আধ ঘণ্টা লেগেছিল। তারপরে খেলা শুরু হল। পাঁচ মিনিট না যেতেই বুঝলুম যে, দাবার বিদ্যে আমাদের দুজনের সমান,—এক বাজি উঠতে রাত কেটে যাবে। প্রতি চাল দেবার আগে। যদি পাঁচ মিনিট করে ভাবতে হয়, তারপর আবার চাল ফিরিয়ে নিতে হয়, তাহলে খেলা যে কতটা এগোয় তা ত বুঝতেই পার। সে যাই হোক, ঘণ্টা আধেক বাদে সেই জাদরেলি-চেহারার সাহেবটি হঠাৎ ঘরে ঢুকে, আমাদের খেলার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়িয়ে, অতি বিরক্তির স্বরে আমার খেলার সাথীকে সম্বোধন করে বল্লেন–
“তাহলে আমি এখন চল্লুম!”
সে কথা শুনে স্ত্রীলোকটি দাবার ছকের দিকে চেয়ে, নিতান্ত অন্যমনস্কভাবে উত্তর করলেন—”এত শীগগির?”
–শীগগির কি রকম? রাত এগারটা বেজে গেছে।
-তাই নাকি? তবে যাও আর দেরী করো না—তোমাকে ছ’মাইল ঘোড়ায় যেতে হবে।
-কাল আসছ?
—অবশ্য। সে ত কথাই আছে। বেলা দশটার ভিতর গিয়ে পৌঁছব।
-কথা ঠিক রাখবে ত?
–আমি বাইবেল হাতে করে তোমার কথার জবাব দিতে পারিনে!
–Good-night.
–Good-night.
পুরুষটি চলে গেলেন, আবার কি মনে করে ফিরে এলেন। একটু থমকে দাঁড়িয়ে বললেন-“কবে থেকে তুমি দাবা খেলার এত ভক্ত হলে?” উত্তর এল “আজ থেকে।” এর পরে সেই সাহেবপুঙ্গটি “হুঁ” এইমাত্র শব্দ উচ্চারণ করে ঘর থেকে হন্ হন্ করে বেরিয়ে গেলেন।
আমার সঙ্গিনী অমনি দাবার ঘরটি উল্টে ফেলে খিল্ খিল্ করে হেসে উঠলেন! মনে হল পিয়ানোর সব চাইতে উঁচু সপ্তকের উপর কে যেন অতি হালকাভাবে আঙ্গুল বুলিয়ে গেল। সেই সঙ্গে তার মুখ চোখ সব উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার ভিতর থেকে যেন একটি প্রাণের ফোয়ারা উছলে পড়ে আকাশে বাতাসে চারিয়ে গেল। দেখতে দেখতে বাতির আলো সব হেসে উঠল। ফুলদানের কাটা-ফুল সব টাটকা হয়ে উঠল। সেই সঙ্গে আমার মনের যন্ত্রও এক সুর চড়ে গেল।
–তোমার সঙ্গে দাবা খেলবার অর্থ এখন বুঝলে?
-না।
—ঐ ব্যক্তির হাত এড়াবার জন্য। নইলে আমি দাবা খেলতে বসি? ওর মত নিবুদ্ধির খেলা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই। George-এর মত লোকের সঙ্গে সকাল সন্ধ্যে একত্র থাকলে শরীর মন একদম ঝিমিয়ে পড়ে। ওদের কথা শোনা আর আফিং খাওয়া, একই কথা। -কেন?
—ওদের সব বিষয়ে মত আছে, অথচ কোনও বিষয়ে মন নেই। ও জাতের লোকের ভিতরে সার আছে, কিন্তু রস নেই। ওরা স্ত্রীলোকের স্বামী হবার যেমন উপযুক্ত, সঙ্গী হবার তেমনি অনুপযুক্ত।
—কথাটা ঠিক বুঝলুম না। স্বামীই ত স্ত্রীর চিরদিনের সঙ্গী।
—চিরদিনের হলেও একদিনেরও নয়–এমন হতে পারে, এবং হয়েও থাকে।
—তবে কি গুণে তারা স্বামী হিসেবে সর্বশ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠে?
–ওদের শরীর ও চরিত্র দুয়েরই ভিতর এতটা জোর আছে যে, ওরা জীবনের ভার অবলীলাক্রমে বহন করতে পারে। ওদের প্রকৃতি ঠিক তোমাদের উল্টো। ওরা ভাবে না–কাজ করে। এক কথায়—ওরা হচ্ছে সমাজের ব্যস্ত, তোমাদের মত ঘর সাজাবার ছবি কি পুতুল নয়।
—হতে পারে এক দলের লোকের বাইরেটা পাথর আর ভিতরটা শীশে দিয়ে গড়া, আর তারাই হচ্ছে আসল মানুষ, কিন্তু তুমি এই দুদণ্ডের পরিচয়ে আমার স্বভাব চিনে নিয়েছ?
—অবশ্য! আমার চোখের দিকে একবার ভাল করে তাকিয়ে দেখ ত, দেখতে পাবে যে তার ভিতর এমন একটি আলো আছে, যাতে মানুষের ভিতর পর্যন্ত দেখা যায়।
আমি নিরীক্ষণ করে দেখলুম যে, সে চোখ দুটি “লউসনিয়া” দিয়ে গড়া। লউসনিয়া কি পদার্থ জান? একরকম রত্ন–ইংরাজীতে যাকে বলে cats-eye–তার উপর আলোর “সূত” পড়ে, আর প্রতিমুহূর্তে তার রং বদলে যায়।–আমি একটু পরেই চোখ ফিরিয়ে নিলুম, ভয় হল সে আলো পাছে সত্যি সত্যিই আমার চোখের ভিতর দিয়ে বুকের ভিতর প্রবেশ করে।
—এখন বিশ্বাস করছ যে আমার দৃষ্টি মর্মভেদী? —বিশ্বাস করি আর না করি, স্বীকার করতে আমার আপত্তি নেই।