এ কথা শুনে আমার আতঙ্ক উপস্থিত হল, কেননা শাস্ত্রে বলে, মিথ্যে কথা——”শতং বদ মা লিখ”! বলা বাহুল্য যে আমি যত বইয়ের নাম করি তার একটিও নেই, আর যত পণ্ডিতের নাম করি তারা সবাই সশরীরে বর্তমান থাকলেও, তার একজনও শাস্ত্রী নন। আমার পরিচিত যত গুরু, পুরোহিত, দৈবজ্ঞ, কুলজ্ঞ, আচার্য, অগ্রদানী-—এমন কি বঁধুনে-বামন পর্যন্ত আমার প্রসাদে সব মহামহোপাধ্যায় হয়ে উঠে। ছিলেন। এ অবস্থায় আমি কি করব না ভেবে পেয়ে, ন যযৌ ন তস্থে ভাবে অবস্থিতি করছি, এমন সময় পাশের টেবিল থেকে সেই স্ত্রীলোকটি উঠে, এক মুখ হাসি নিয়ে আমার মুখে এসে দাঁড়িয়ে বল্লেন—”বা! তুমি এখানে? ভাল আছ ত? অনেক দিন তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি। চল আমার সঙ্গে ড্রয়িংরুমে, তোমার সঙ্গে একরাশ কথা আছে।”
আমি বিনা বাক্যব্যয়ে তার পদানুসরণ করলুম। প্রথমেই আমার চোখে পড়ল যে, এই রমণীটির শরীরের গড়ন ও চলবার ভঙ্গীতে, শিকারী-চিতার মত একটা লিকলিকে ভাব আছে। ইতিমধ্যে আড় চোখে একবার দেখে নিলুম যে, গার্গী এবং তার কন্যা হাঁ করে আমাদের দিকে চেয়ে রয়েছেন, যেন তাদের মুখের গ্রাস কে কেড়ে নিয়েছে–এবং সে এত ক্ষিপ্রহস্তে যে তারা মুখ বন্ধ করবার অবসর পাননি!
ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করবামাত্র, আমার এই বিপদ-তারিণী আর দিকে ঈষৎ ঘাড় বাঁকিয়ে বললেন, “ঘণ্টাখানেক ধরে তোমার উপর যে উৎপীড়ন হচ্ছিল আমার আর তা সহ্য হল না, তাই তোমাকে ঐ জর্মণ পশু দুটির হাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছি। তোমার যে কি বিপদ কেটে গেছে, তা তুমি জান না। মা’র দর্শনের পালা শেষ হলেই, মেয়ের কবিত্বের পালা আরম্ভ হত। তুমি ওই সব নেকড়ার পুতুলদের চেন না। ওই সব স্ত্রীরত্নদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে, যেন তেন প্রকারেণ পুরুষের গললগ্ন হওয়া। পুরুষমানুষ দেখলে ওদের মুখে জল আসে, চোখে তেল আসে, বিশেষত সে যদি দেখতে সুন্দর হয়।”
আমি বল্লুম—”অনেক অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু তুমি শেষে যে বিপদের কথা বললে, এ ক্ষেত্রে তার কোনও আশঙ্কা ছিল না।”
-কেন?
—শুধু ও জাতি নয়, আমি সমগ্র স্ত্রীজাতির হাতের বাইরে।
—তোমার বয়স কত?
—চব্বিশ।
—তুমি বলতে চাও যে, আজ পর্যন্ত কোনও স্ত্রীলোক তোমার চোখে পড়েনি, তোমার মনে ধরেনি?
–তাই।
—মিথ্যে কথা বলাটা যে তুমি একটা আর্ট করে তুলেছ, তার প্রমাণ ত এতক্ষণ ধরে পেয়েছি।
—সে বিপদে পড়ে।
–তবে এ-ই সত্যি যে, একদিনের জন্যেও কেউ তোমার নয়ন মন আকর্ষণ করতে পারেনি?
—হাঁ, এ-ই সত্যি। কেননা, সে নয়ন, সে মন একজন চিরদিনের জন্য মুগ্ধ করে রেখেছে।
–সুন্দরী?
—জগতে তার আর তুলনা নেই।
—তোমার চোখে?
—না, যার চোখ আছে, তারই চোখে।
—তুমি তাকে ভালবাসো?
–বাসি।
–সে তোমাকে ভালবাসে?
–না।
—কি করে জানলে?
–তার ভালবাসবার ক্ষমতা নাই।
-কেন?
—তার হৃদয় নেই।
–এ সত্ত্বেও তুমি তাকে ভালবাসো?
—”এ সত্ত্বেও” নয়, এই জন্যেই আমি তাকে ভালবাসি। অন্যের ভালবাসাটা একটা উপদ্রব বিশেষ—
—তার নাম ধাম জানতে পারি?
—অবশ্য। তার ধাম প্যারিস, আর নাম Venus de Milo.
এই উত্তর শুনে আমার নবসখী মুহূর্তের জন্য অবাক হয়ে রইল, তার পরেই হেসে বললে,
—তোমাকে কথা কইতে কে শিখিয়েছে?
—আমার মন।
–এ মন কোথা থেকে পেলে?
–জন্ম থেকে।
–এবং তোমার বিশ্বাস, এ মনের আর কোনও বদল হবে না?
–এ বিশ্বাস ত্যাগ করবার আজ পর্যন্ত ত কোনও কারণ ঘটেনি।
—যদি Venus de Milo বেঁচে ওঠে?
—তাহলে আমার মোহ ভেঙ্গে যাবে।
–আর আমাদের কারও ভিতরটা যদি পাথর হয়ে যায়?
এ কথা শুনে আমি তার মুখের দিকে একবার ভাল করে চেয়ে দেখলুম। আমার statue-দেখা চোখ তাতে পীড়িত বা ব্যথিত হল না। আমি তার মুখ থেকে আমার চোখ তুলে নিয়ে উত্তর করলুম—
–তাহলে হয়ত তার পূজা করব।
–পূজা নয়, দাসত্ব?
—আচ্ছা তাই।
–আগে যদি জানতুম যে তুমি এত বাজেও বকতে পার, তাহলে আমি তোমাকে ওদের হাত থেকে উদ্ধার করে আনতুম না। যার জীবনের কোনও জ্ঞান নেই, তার দর্শন বকাই উচিত। এখন এস, মুখ বন্ধ করে, আমার সঙ্গে লক্ষী ছেলেটির মত বসে দাবা খেল।
এ প্রস্তাব শুনে আমি একটু ইতস্ততঃ করছি দেখে সে বললে–“আমি যে পথের মধ্যে থেকে তোমাকে লুফে নিয়ে এসেছি, সে মোটেই তোমার উপকারের জন্য নয়। ওর ভিতর আমার স্বার্থ আছে। দাবা খেলা হচ্ছে আমার বাতিক। ও যখন তোমার দেশের খেলা, তখন তুমি নিশ্চয়ই ভাল খেলতে জান, এই মনে করে তোমাকে গ্রেপ্তার করে আনবার লোভ সম্বরণ করতে পারলুম না।”
আমি উত্তর করলুম—
“এর পরেই হয়ত আর একজন আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে বলবে ‘এস আমাকে ভানুমতীর বাজি দেখাও, তুমি যখন ভারতবর্ষের লোক তখন অবশ্য যাদু জান’!”
সে এ কথার উত্তরে একটু হেসে বললে,–
“তুমি এমন কিছু লোভনীয় বস্তু নও যে তোমাকে হস্তগত করবার জন্য হোটেল-সুদ্ধ স্ত্রীলোক উতলা হয়ে উঠেছে! সে যাই হোক, আমার হাত থেকে তোমাকে যে কেউ ছিনিয়ে নিয়ে যাবে, সে ভয় তোমার পাবার দরকার নেই। আর যদি তুমি যাদু জান তাহলে ভয় ত আমাদেরি পাবার কথা।”
একবার হিন্দুদর্শন জানি বলে বিষম বিপদে পড়েছিলুম, তাই এবার স্পষ্ট করে বললুম—
“দাবা খেলতে আমি জানিনে।”
“শুধু দাবা কেন?—দেখছি পৃথিবীর অনেক খেলাই তুমি জান না। আমি যখন তোমাকে হাতে নিয়েছি, তখন আমি তোমাকে ও-সব শেখাব ও খেলাব।”