তারপর একদিন রাত্তিরে ডিনার খেতে যাচ্ছি, এমন সময় বারাণ্ডায় কে একজন আমাকে Good evening বলে সম্বোধন করলে। আমি তাকিয়ে দেখি সুমুখে একটি ভদ্রমহিলা পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বয়েস পঞ্চাশের কম নয়, তার উপর তিনি যেমন লম্বা, তেমনি চওড়া। সেই সঙ্গে নজরে পড়ল যে, তার পরণে ঢক্চকে কালো সাটিনের পোষাক, আঙ্গুলে রঙ-বেরঙের নানা আকারের পাথরের আংটি। বুঝলুম যে এর আর যে-বস্তুরই অভাব থাক, পয়সার অভাব নেই। ঘোটলোকী বড়মানুষীর এমন চোখে-আঙ্গুল-দেওয়া চেহারা বিলেতে বড় একটা দেখা যায় না। তিনি দু’কথায় আমার পরিচয় নিয়ে আমাকে তার সঙ্গে ডিনার খেতে অনুরোধ করলেন, আমি ভদ্রতার খাতিরে স্বীকৃত হলুম।
আমরা খানা-কামরায় ঢুকে সবে টেবিলে বসেছি, এমন সময়ে একটি যুবতী গজেন্দ্রগমনে আমাদের কাছে এসে উপস্থিত হলেন। আমি অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলুম, কেননা হাতে-বহরে স্ত্রীজাতির এ-হেন নমুনা সে দেশেও অতি বিরল। মাথায় তিনি সীতেশের সমান উঁচু, শুধু বর্ণে সীতেশ যেমন শ্যাম, তিনি তেমনি শ্বেত,—সে সাদার ভিতরে অন্য কোন রঙের চিহ্নও ছিল না,না গালে, না ঠোটে, না চুলে, না ভুরুতে। তাঁর পরণের সাদা কাপড়ের সঙ্গে তার চামড়ার কোন তফাৎ করবার জো ছিল না। এই চুনকাম-করা মূর্তিটির গলায় যে একটি মোটা সোণার শিকলি-হার আর দু’হাতে তদনুরূপ chain-bracelet ছিল, আমার চোখ ঈষৎ ইতস্ততঃ করে তার উপরে গিয়েই বসে পড়ল। মনে হল যেন ব্ৰহ্ম-দেশের কোন রাজ-অন্তঃপুর থেকে একটি শ্বেত হস্তিনী তার স্বর্ণ-শৃঙ্খল ছিঁড়ে পালিয়ে এসেছে। আমি এই ব্যাপার দেখে এতটা ভেড়ে গিয়েছিলুম যে, তার অভ্যর্থনা করবার জন্য দাঁড়িয়ে উঠতে ভুলে গিয়ে, যেমন বসেছিলুম তেমনি বসে রইলুম। কিন্তু বেশিক্ষণ এ ভাবে থাকতে হল না। আমার নবপরিচিতা প্রৌঢ়া সঙ্গিনীটি চেয়ার ছেড়ে উঠে, সেই রক্তমাংসের মনুমেন্টের সঙ্গে এই বলে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন
“আমার কন্যা Miss Hildesheimer—মিস্টার?”
“সোমনাথ গঙ্গোপাধ্যায়”
“মিস্টার গ্যাঁগো—গাঁগো–গাগো—”
আমার নামের উচ্চারণ ওর চাইতে আর বেশী এগোলো না। আমি শ্ৰীমতীর করমর্দন করে বসে পড়লুম। এক তাল “জেলির” উপর হাত পড়লে গা যেমন করে ওঠে, আমার তেমনি করতে লাগল। তারপর ম্যাডাম আমার সঙ্গে কথাবার্তা আরম্ভ করলেন, মিস্ চুপ করেই রইলেন। তাঁর কথা বন্ধ ছিল বলে যে তার মুখ বন্ধ ছিল, অবশ্য তা নয়। চর্বণ চোষণ লেহন পান প্রভৃতি দন্ত ওষ্ঠ রসনা কণ্ঠ তালুর আসল কাজ সব সজোরেই চলছিল। মাছ মাংস, ফল মিষ্টান্ন, সব জিনিষেই দেখি তার সমান রুচি। যে বিষয়ে আলাপ শুরু হল তাতে যোগদান করবার আশা করি, তার অধিকার ছিল না।
এই অবসরে আমি যুবতীটিকে একবার ভাল করে দেখে নিলুম। তার মত বড় চোখ ইউরোপে লাখে একটি স্ত্রীলোকের মুখে দেখা যায় না—সে চোখ যেমন বড়, তেমনি জলো, যেমন নিশ্চল, তেমনি নিস্তেজ। এ চোখ দেখলে সীতেশ ভালবাসায় পড়ে যেত, আর সেন কবিতা লিখতে বসত। তোমাদের ভাষায় এ নয়ন বিশাল, তরল, করুণ, প্রশান্ত। তোমরা এরকম চোখে মায়া, মমতা, স্নেহ, প্রেম প্রভৃতি কত কি মনের ভাব দেখতে পাও—কিন্তু তাতে আমি যা দেখতে পাই, সে হচ্চে পোষা জানোয়ারের ভাব; গরু ছাগল ভেড়া প্রভৃতির সব ঐ জাতের চোখ,–তাতে অন্তরের দীপ্তিও নেই, প্রাণের স্ফুর্তিও নেই। এর পাশে বসে আমার সমস্ত শরীরের ভিতরে যে অসোয়াস্তি করছিল,তার মা’রকথা শুনে আমার মনের ভিতর তার চাইতেও বেশী অসোয়াস্তি করতে লাগল। জান তিনি আমাকে কেন পাকড়াও করেছিলেন?—সংস্কৃত শাস্ত্র ও বেদান্ত দর্শন আলোচনা করবার জন্য! আমার অপরাধের মধ্যে, আমি যে সংস্কৃত খুব কম জানি, আর বেদান্তের বে দূরে থাক, আলেফ পর্যন্ত জানিনে, এ কথা একটি ইউরোপীয় স্ত্রীলোকের কাছে স্বীকার করতে কুষ্ঠিত হয়েছিলুম। ফলে তিনি যখন আমাকে জেরা করতে সুরু করলেন, তখন আমি মিথ্যে সাক্ষ্য দিতে আরম্ভ করলুম। “শ্বেতাশ্বতর” উপনিষদ শ্রুতি কিনা, গীতার “ব্ৰহ্মনির্বাণ” ও বৌদ্ধ নির্বাণ এ দুই এক জিনিষ কিনা,–এ সব প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি নিতান্তই বিপন্ন হয়ে পড়েছিলুম। এ সব বিষয়ে আমাদের পণ্ডিত-সমাজে যে বহু এবং বিষম মতভেদ আছে, আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার সেই কথাটাই বলছিলুম। আমি যে কি মুস্কিলে পড়েছি, তা আমার প্রশ্নকর্তী বুঝুন আর নাই বুঝুন, আমি দেখতে পাচ্ছিলুম যে আমার পাশের টেবিলের একটি রমণী তা বিলক্ষণ বুঝছিলেন।
সে টেবিলে এই স্ত্রীলোকটি একটি জাঁদরেলি-চেহারার পুরুষের সঙ্গে ডিনার খাচ্ছিলেন। সে ভদ্রলোকের মুখের রং এত লাল যে, দেখলে মনে হয় কে যেন তার সদ্য ছাল ছাড়িয়ে নিয়েছে। পুরুষটি যা বলছিলেন, সে সব কথা তার গোঁফেই আটকে যাচ্ছিল, আমাদের কানে পৌঁছচ্ছিল না। তার সঙ্গিনীও তা কানে তুলছিলেন কিনা, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। কেননা, স্ত্রীলোকটি যদিচ আমাদের দিকে একবারও মুখ ফেরাননি, তবু তার মুখের ভাব থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে, তিনি আমাদের কথাই কান পেতে শুনছিলেন। যখন আমি কোন প্রশ্ন শুনে, কি উত্তর দেব ভাবছি, তখন দেখি তিনি আহার বন্ধ করে, তার সুমুখের প্লেটের দিকে অন্যমনস্ক ভাবে চেয়ে রয়েছেন,—আর যেই আমি একটু গুছিয়ে উত্তর দিচ্ছি, তখনি দেখি তার চোখের কোণে একটু সকৌতুক হাসি দেখা দিচ্ছে। আসলে আমাদের এই আলোচনা শুনে তার খুব মজা লাগছিল। কিন্তু আমি শুধু ভাবছিলুম এই ডিনার ভোগরূপ কর্মভোগ থেকে কখন উদ্ধার পাব! অতঃপর যখন টেবিল ছেড়ে সকলেই উঠলেন, সেই সঙ্গে আমিও উঠে পালাবার চেষ্টা করছি, এমন সময়ে এই বিলাতি ব্ৰহ্মবাদিনী গার্গী আমাকে বললেন—”তোমার সঙ্গে হিন্দুদর্শনের আলোচনা করে আমি এত আনন্দ আর এত শিক্ষা লাভ করেছি যে, তোমাকে আর আমি ছাড়ছিনে। জান, উপনিষদই হচ্ছে আমার মনের ওষুধ ও পথ্য।” আমি মনে মনে বল্লুম—”তোমার যে কোন ওষুধ পথ্যির দরকার আছে, তাত তোমার চেহারা দেখে মনে হয় না! সে যাই হোক, তোমার যত খুসি তুমি তত জর্মনীর লেবরেটরিতে তৈরী বেদান্ত-ভস্ম সেবন কর, কিন্তু আমাকে যে কেন তার অনুপান যোগাতে হবে, তা বুঝতে পারছিনে?” তার মুখ চলতেই লাগল। তিনি বললেন—”আমি জর্মনীতে Duessen-এর কাছে বেদান্ত পড়েছি, কিন্তু তুমি যত পণ্ডিতের নাম জান, ও যত বিভিন্ন মতের সন্ধান জান, আমার গুরু তার সিকির সিকিও জানেন না। বেদান্ত পড়া ত চিন্তা রাজ্যের হিমালয়ে চড়া, শঙ্কর ত জ্ঞানের গৌরীশঙ্কর! সেখানে কি শান্তি, কি শৈত্য, কি শুভ্রতা, কি উচ্চতা,—মনে করতে গেলেও মাথা ঘরে যায়। হিন্দুদর্শন যে যেমন উচ্চ তেমনি বিস্তৃত, এ কথা আমি জানতুম না। চল, তোমার কাছ থেকে আমি এই সব অচেনা পণ্ডিত অজানা বইয়ের নাম লিখে নেব।”