প্রথমে সীতেশকে ও বোধ হয় লক্ষ্য করেনি। নাকি দেখেও না দেখার ভান করেছে, কে জানে? পাশের বেঞ্চটায় বসতে যাচ্ছিল রীণা, অভিমান ত্যাগ করে সীতেশই ওকে ডাকল, ‘আরে এদিকে এস এই বেঞ্চে এস।’
রীণা একটু চমকে উঠে সীতেশের দিকে তাকাল। তারপর হেসে বলল, ‘ও তুমি! আমি দেখতেই পাইনি।’
সীতেশ বলল, না পাওয়ারই তো কথা।’
রীণা প্রতিবাদ করে বলল, ‘আহাহা, না পাওয়ার কথা মানে! তুমিই তো কোন সম্পর্ক রাখখানি!’
বাস চলতে শুরু করেছে। মোড় থেকে আরো দু-তিনজন প্যাসেঞ্জার উঠেছে।
সীতেশ বলল, বাসের ঝাঁকুনিতে পড়ে যাবে। কেলেঙ্কারি হবে একটা তাড়াতাড়ি বসে পড়ো।’ নিজে বাইরের দিকে বসে রীণাকে ভেতরের দিকে জানলার ধারে বসতে দিল সীতেশা
রীণা স্মিতমুখে তার পাশে গিয়ে বসল। কিন্তু মৃদু সমালোচনা করতে ছাড়ল না। হেসে বলল, ‘ফ্রন্ট সীট হলেও তোমার এই সীটটি কিন্তু ভাল নয়।’
রীণার হাতে লাল রঙের ভ্যানিটি ব্যাগ দুটি ঠোঁটও গাঢ় রক্তরঙে রঞ্জিতা রীণা চিরদিনই হেভি মেক-আপের পক্ষপাতী গনয়াগাঁটির শখও বেড়েছে। গলায় হারা এক হাতে বালা আর এক হাতে ঘড়ি। কানেও লাল পাথর-বসানো দুলা কপালের টিপটি নীলাভ শাড়ি আর হাতকাটা ব্লাউজের সঙ্গে ম্যাচ করা।
পাশেই বসেছে সীতেশের এককালের অন্তরঙ্গ সহপাঠিনী রীণা। আগেও যেমন বসত আজও তেমনি বসেছে। কিন্তু সীতেশের মনে হচ্ছে এই রীণা যেন আলাদা। শুধু পরস্ত্রীই নয়, যেন একটি ভিন্নগ্রহের অধিবাসিনী। আর সেইজন্যেই কি আকর্ষণ আর বিকর্ষণের এক মিশ্রিত অনুভূতি সীতেশের মন থেকে নড়তে চাইছে না!
এই পাড়ারই মেয়ে রীণা হাউসিং স্টেটে থাকে। মানে থাকত। এখন ওর বাবা মা এই পাইকপাড়াতেই আছেন। ও পাড়া বদল করে চলে গেছে বালিগঞ্জে।
সীতেশ বলল, ‘এখন যেন তোমার কী পদবী হয়েছে!’
রীণা বলল, ‘আহাহা, যেন জানো না!’
সীতেশ বলল, ‘শুনেছিলাম। ভুলে গেছি।‘
রীণা বলল, তাহলে আর মনে করিয়ে দেব না। নামটা মনে রাখলেই যথেষ্টা আর চেহারা–চিনতে পারার জন্যে।’
সীতেশ বলল, ‘নন্দী হয়েছ, তাই না? চাটুয্যে থেকে নন্দী!
রীণা হেসে বলল, ‘সবই তো মনে আছে দেখছি। তবে কেন অত ভান করছিলে?’
সীতেশ হেসে বলল, ‘বামুন থেকে কায়েতই যদি হতে পারলে, বৈদ্য হতে ক্ষতি কি ছিল?’
ভঙ্গিটা তামাশার।
রীণাও তেমনি কৌতুকের ভঙ্গিতে জবাব দিল, ‘হব বলে তো অপেক্ষা করে বসেছিলাম। হতে দিলে কই!’
সবই ঠাট্টা আর তামাশা। দুজনের মধ্যে যে বন্ধুত্ব ছিল তাতে গভীর প্রেম কি বিয়ের কোন প্রতিশ্রুতি ছিল না। না উচ্চারিত, না অনুচ্চারিত
পার্কের পাশ দিয়ে বিশেষ করে অর্কিড উদ্যানের কাছাকাছি এসে রাস্তাটা খুবই খারাপ হয়ে গেছে। জায়গায় জায়গায় গর্তা বাস সেই গর্তের মধ্যে পড়ে আবার ওঠো টাল সামলাতে না পেরে রীণা বার বার তার গায়ে ঢলে পড়ছিল।
একবার বলল, ‘কী রাস্তাই না হয়েছে! তোমরা থাকো না এ পাড়ায়? একটা ব্যবস্থা করতে পার না?’
সীতেশ বলল, ‘আমরা কি ব্যবস্থাপক নাকি?’
এই সময় কন্ডাক্টর এসে টিকিট চাইল।
সীতেশ উঠে দাঁড়াল। ট্রাউজারের হিপপকেটে হাত দিয়ে ছোট একটা ব্যাগ বার করল। তারপর একখানা পাঁচ টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘একখানা এসপ্ল্যানেডা’
হঠাৎ তার খেয়াল হল সঙ্গে রীণাও রয়েছে। তাড়াতাড়ি শুধরে নিয়ে বলল, ‘আরে, তুমি কোথায় যাবে?
কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে। রীণা তার ব্যাগ থেকে দশ টাকার নোটখানি বের করে ফেলেছে। পাঁচ টাকার নোটখানা কেড়ে নিয়ে তার হাতে দশ টাকার নোটখানা গুঁজে দিয়ে বলল, ‘একখানা না, দুখানা এসপ্ল্যানেড’ তারপরে সেই পাঁচ টাকার নোটখানা জোর করে ফেরত দিল সীতেশকে। সঙ্গে সঙ্গে এক টাকা পাঁচ পয়সার টিকিটখানাও।
সীতেশ বলল, ‘এ কী হল! তুমি কেন কাটতে গেলে!’
রীণা বলল, ‘তাতে কী হয়েছে! আগে আগে তুমি তো রোজই বাস ফেয়ার দিতে। ট্যাক্সি ফেয়ারও দিয়েছ দু-একদিন আজ না হয় আমিই দিলাম। সামান্য একখানা টিকিটই তো রেখে দাও।’
তার পর একটু হেসে সীতেশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আধ ঘণ্টার জন্যে থাকুক না হয় একটি সুভেনির।’
সীতেশ গম্ভীর হয়ে রইল। কী বলবে ভেবে পেল না।
কিন্তু সারাটা পথ কথা বলতে বলতে চলল রীণা নিজেদের ঘর-সংসারের কথা স্বামীর কথা শ্বশুর-শাশুড়ীর কথা। তাঁরা চান এখনই নাতি-নাতনীর মুখ দেখতে কিন্তু রীণা আর দিলীপের ইচ্ছা আরও দু-একটা বছর যাক। তাদের ডোভার লেনের বাড়িতে নিমন্ত্রণও করল সীতেশকে।
‘যেয়ো একদিন। তাড়াতাড়ি যেয়ো। কোথায় হঠাৎ বদলি করে দেবে তার তো ঠিক নেই।’
স্টেট ব্যাঙ্কের অফিসার গ্রেডে কাজ করে দিলীপা মোটা মাইনের চাকরি। এক ফাঁকে রীণা সে কথা শুনিয়েছে সীতেশকো।
কিন্তু সেই টিকিট কাটার পর কী যে হয়েছে সীতেশেরা পুরনো বান্ধবীর সঙ্গে কিছুতেই প্রাণ খুলে আলাপ করতে পারছে না।
নিতান্তই ভদ্রতা রক্ষার জন্যে, হ্যাঁ করে যাচ্ছে, কি, দু-একটা কথা জিজ্ঞাসা করছে।
শেষ পর্যন্ত ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে এসে দুজনেই নেমে পড়ল। নিউ মার্কেটে রীণার কি একটু দরকার আছে। সেটা সেরে বালিগঞ্জের বাসে উঠবে। সীতেশ যাবে তার বন্ধুর অফিসে। সেখানে সে সীতেশের জন্যে অপেক্ষা করছে।
হাসিমুখে বিদায় নিল, বিদায় দিল রীণা।