তারপর কোথা থেকে কি যেন সব হয়ে গেল। ছেলেটাকে পোড়ান হল, রাতটা কাটল, তারও পরের দিন কাটল। একসঙ্গে এতগুলো দুর্ঘটনা, এতগুলো আঘাত সব সহ্য করে চুপ করে বসেছিল বিপিন কিন্তু মালা চুপ ছিল না। বিনিয়ে বিনিয়ে, ক্লান্তকণ্ঠে কাঁদছিল সো জীবন্ত মানুষের কান্না নয় তো। পাতালের ভেতরকার অন্ধকার কোন প্রকোষ্ঠে বসে যেন সে কাঁদছে— ছেলেটা যেন তার কাঁদবার শক্তি খানিকটা চুরি করে মারা গেছে, তাই সে চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে কাঁদছে না।
বিপিন চুপ করে বসেছিল। বসে বসে মালার এই কান্না শুনছিল। বুড়ীটা শেয়াল কুকুরের মত মারা গেল, চাকরি গেল, ছেলেটা মারা গেল। এবার ঘরের মধ্যে যেন একটা অশুভ ছায়া ঘনিয়ে উঠছে। আর এই কান্না অসহ্য এই কান্না শুনলে মন হয় যেন সে ভারী অসহায়, যেন সে একটা অদৃশ্য মানুষের হাতের পুতুল। তার মাথাটা গরম হয়ে উঠল, সব চিন্তা তালগোল পাকিয়ে গেল। বুকের ভেতর আশার যে স্ফটিকের প্রাসাদটা ছিল তা যেন হঠাৎ রেণু রেণু হয়ে উড়ে গেল আর সৃষ্টি করল একটা দিকচিহ্নহীন মরুভূমিকে। চোখের সামনে আকাশের গায়ে যত সোনার রেখা ছিল, সব যেন অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
দাঁতে দাঁত চেপে সে উঠে দাঁড়াল, মালার কাছে গেল, বলল, ‘থামো’—
মালা থামল না।
‘থামো মালা—কেঁদো না—ছিঃ—’
তবু মালা থামল না।
‘কেঁদোনা—শুনছ’—ধমকে উঠল বিপিন।
আরো জোরে কেঁদে উঠল মালা, ‘ওরে বাবা, বাবা রে, না খেয়ে অচিকিচ্ছেয় যে তুই মারা গেলি রে বাবা–’
গর্জন করে উঠল বিপিন, ‘মালা–থামো—’
মালা এবার তাকাল, তার জলভরা চোখে বিদ্যুতের শিখা, তার ক্রন্দনাকুল মুখে চোখে মণিহারা সাপের ক্রুরতা।
সে কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘না, থামব না—‘
বিপিনের সমস্ত রক্ত যেন মস্তিষ্কের কোটরে গিয়ে জমা হল, কানের কাছে এসে সশব্দে তা যেন আছড়ে পড়তে লাগল। তার চোখ লালচে হয়ে উঠল, কপালের শিরাগুলো মোটা হয়ে উঠল না, মালার কান্নাকে থামাতেই হবে সে অসহায় নয়, সে হার মানবে না, তার পেশীর মধ্যে যে শক্তি লুকানো আছে তাই দিয়ে আবার সব কিছু সে জয় করবো
‘থামবি না মালা!’
‘না’—মালা গর্জে উঠল, কাঁদতে কাঁদতে সে বলল, ‘কেন থামব? তুমি থামতে বলার কে? তুমিই তো আমার দশার জন্য দায়ী—‘
‘মানে? তার মানে?’
‘আমার বুড়ী মাকে—আর কোলের ছেলেটাকে তো তুমিই খুন করেছ’—
‘আমি!’
‘হ্যাঁ–’
‘চুপ কর হারামজাদী—‘
সশব্দে, কান্না অজস্রতায় ভেঙে পড়ল মালা–মাথা নেড়ে বলল, ‘না, চুপ করব না—কি করবে তুমি? কি করবে আমার—‘
মালা আর কথা বলতে পারেনি, আর কাঁদতে পারেনি। তার কান্নায় বিকৃত, বীভৎস মুখটার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল বিপিন, লোহা-পিটানো শক্ত দুটো হাত দিয়ে হঠাৎ সে মালার গলাটা টিপে ধরেছিল। মালার মাথা খারাপ হয়েছে, এমনি ভাবে ঘা না মারলে ও থামবে না। মালার নরম গলার ওপর তার আঙুলগুলো বসে গেল। মালা বাধা দিল, মুক্ত হতে চাইলা মাঝে মাঝে দু একটা উল্কট চিকারের টুকরো ছিটকে বেরোল তার গলা থেকে বাধ্য হয়ে বিপিন তার গলাটা একটু জোরে টিপল। এখনো থামবে না মালা? বটে! বটে!
ঢং ঢং ঢং–। চমক ভাঙল বিপিনের, কান পাতল সে। জেলখানার বাইরে প্রহর ঘোষণা হল। ঢং ঢং—পাঁচটা বাজল পাঁচটা সময় শেষ। হঠাৎ কাদের পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।
খট খট–খট খট। তিন চার জোড়া বুটের শব্দ।
ঝনন ঝনন—লোহার গেটটা সশব্দে খুলে গেল। ভেতরে এসে দাঁড়ালেন জেলার সাহেব, পেছনে বন্দুকধারী দুজন সেপাই ও একজন হাবিলদার।
‘বিপিন দাস’—
‘আজ্ঞে’—
উঠে দাঁড়াল বিপিন। হঠাৎ তার মাথাটা পরিষ্কার ও হালকা মনে হচ্ছে। পাঁচটা বেজেছে। বাইরে পৃথিবী এখনো শান্ত। কিন্তু কোথায় যেন কে এখনো কাঁদছে? একটানা কান্না। অনেকটা মালার কান্নার মত, ছেলেটার কান্নার মত, তাঁর শাশুড়ীর কান্নার মত।
‘জেলার সাহেব, কে যেন কাঁদছে, তাই না?’
জেলার সাহেব কান পাতলেন, মৃদু হেসে বললেন, ‘কৈ না তো’ একটু থেমে আবার তিনি বললেন, ‘বিপিন—এবার তোমাকে যেতে হবে।’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ—চলুন—‘
‘তোমার কিছু বলবার আছে বিপিন?’
‘বলবার?’ বিপিন একটু ভেবে মাথা নাড়ল, ‘আছে হুজুর’
‘কি?’
‘ওদের বলবেন যে আমি ভুল করেছি, আমার মাথার ঠিক ছিল না। গলা টিপে তো কান্না থামান যায় না।’—
‘কি বলছ তুমি বিপিন?’
‘ঠিকই বলছি হুজুর’—কেশে, গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বিপিন বলল, ‘ওদের বলবেন যেন আমার মত ওরা ভুল না করে, ওরা যেন না থামে’—
‘কাদের বলব এ কথা?’
‘ওদের হুজুর—ওদের—যারা ছেলেবৌয়ের কান্না থামাবার জন্য এখনো লড়াই করছে—‘
বুটের শব্দ তুলে করিডোর দিয়ে বেরোল ওরা। আগে জেলার সাহেব। পেছনে বিপিন, তার দু পাশে দুই বন্দুকধারী সেপাই। আর সবার পেছন হাবিলদার কোন শব্দ নেই কারো মুখে শুধু তিন জোড়া বুটের ছন্দোময় শব্দ উঠতে লাগল—খট খট–খট খট–লেফট রাইট লেফট—। তিন জোড়া পা যেন কথা বলছে, সদর্পে আত্ম-ঘোষণা করছে। আর তাদের মাঝে একজোড়া পা একেবারে নগ্ন, নিঃশব্দ। মৃত্যুর মত।
আকাশের আলোক-তোরণটা তখন একটু একটু করে খুলবার উপক্রম করেছে, জেল কম্পাউন্ডের বড় বড় আম গাছের ডালে তখন পাখীরা প্রভাতী গান গাইছে, অন্ধকার তরল হয়ে এসেছে। আলো আঁধারে মেশানো বিস্তৃত উঠোনে হঠাৎ ফাঁসির মঞ্চটাকে দেখা গেল।