বিড়বিড় করে সে মাঝে মাঝে বলতে লাগল, ‘কাঁদিস না, ওরে–কাঁদিস না বাবা—’
দু পয়সার বার্লি দু-দিন ধরে চলছে। শুধু জলই বলা যায়। তাই খেয়ে ছেলেটা একসময় চুপ করল, আচ্ছন্নের মত পড়ে রইল। জ্বর বাড়ছে তার।
‘বিপিন—ওহে বিপিন—‘
‘কে?’
দরজার গোড়ায় বন্ধু সাধুচরণ এসে দাঁড়াল, ‘আমি। একবার বাইরে এস তো। বাজারের বুড়ো বটগাছটার নীচে তোমাদের বুড়ী বোধহয় মরে পড়ে আছে—‘
‘কি বললে?’
বিপিন উঠে দাঁড়াল, যেন বিদ্যুতের চাবুক এসে পড়ল তার গায়ে।
‘হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে। খুব রোগা, চিনতে কষ্ট হয়—তবু ভুল করিনি আমরা—’
বিপিন ঘর থেকে বেরোল তাড়াতাড়ি। বাইরে এসে সে শুনতে পেল যে ঘরের মধ্যে মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়ে মালা কাঁদছে আর মায়ের কান্না শুনে ছেলেটাও ভয় পেয়ে কাঁদছে। বিপিনের শরীর শিউরে উঠল। কি বিশ্রী এই কান্না! শুধু মৃত্যুশোকের কান্না তো এত কুৎসিত নয়। বার্ধক্যে, অনাহারে, পথের ওপর মা মারা গেছে বলেই বোধ হয় মালার কান্না এত ভয়াবহ।
সেইদিন থেকে যে তার কি আরম্ভ হল তা বিপিন বোঝাতে পারে না। যখন তখন ইনিয়ে। বিনিয়ে কাঁদে মালা, নিঃশব্দে কাঁদে আর কাঁদে ছেলেটা জ্বর যখন কম থাকে তখনও ঘোলাটে দৃষ্টি মেলে চারদিকে তাকায় আর নাকী সুরে কাঁদতে থাকে জানাতে থাকে তার অসংখ্য চাহিদাকে। ভাত খাবে, মাছ খাবে, এটা খাবে, ওটা খাবে সো। রোগা হয়ে গেছে ছেলেটা, চোখ বসে গেছে, গাল ভেঙে গেছে, জিরজির করছে হাড়গুলো দেখে চোখে জল আসে আর কী বিশ্রী তার কান্না! সে কান্না শুনে বিপিনের ভেতরটা মুচড়ে মুচড়ে ওঠে, সেখানকার যন্ত্রপাতি যেন উলটে পালটে ভেঙে চুরে যাবার উপক্রম করে। গগনভেদী মনে হয় ছেলেটার কান্না। ছেলেটা যেন একা কাঁদছে না, তার সঙ্গে যেন আরো অসংখ্য ছেলেরা কাঁদছে। সেই সব ছেলেরা—যাদের বাপেরা মাটি কাটে, ফসল কাটে, যন্ত্র-দানবকে পরিচালিত করে, লোহা পিটোয় আর পাথর ভাঙো অসহ্য মনে হয় তা দুকানে আঙুল পুরে তার হাত থেকে মুক্তি পেতে চায় বিপিন।
ধর্মঘটকারী যে ক-জন তখনও লড়াইটা জিইয়ে রেখেছিল তারা হঠাৎ দু-দিন বাদে আবিষ্কার করল যে ফ্যাক্টরী তাদের বাদ দিয়েই চলতে আরম্ভ করেছে—তাদের কথা যেন কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য শ্রমিকেরা ভুলেই গেছে। বস্তিতে অবসর সময়ে তারা সহকর্মীদের বোঝাতে গিয়েও ব্যর্থ হল। সবাই কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে গেছে। তাই আরো দু-দিন অপেক্ষা করে তারা শেষে এক পা এক পা করে ফ্যাক্টরীর গেটের সামনে হাজির হল। ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হল না সবাইকে। কয়েকজনকে মাত্র ডেকে নেওয়া হল। আধ ঘণ্টা বাদে বুড়ো দারোয়ান এসে একটা বড় কাগজ টাঙিয়ে দিয়ে গেল ফটকের সামনে সবাই গিয়ে ভিড় করল সেখানে কি ব্যাপার, কি লিখে জানাল মালিকেরা? দুরু দুরু বুকে পড়তে আরম্ভ করল সবাই, পড়ে তাদের হৃদস্পন্দন যেন থেমে যাবার উপক্রম হল, দু-চোখের তারায় ঝিকমিক করে আগুন জ্বলে উঠল। তিন-চারজন ছাড়া বাকী বাইশজন লোক ফ্যাক্টরী থেকে বরখাস্ত হয়ে গেছে, তারা যেন পাঁচদিন বাদে তাদের প্রাপ্য টাকাকড়ি নিয়ে যায়।
বিপিনও খড়গের ঘা থেকে রেহাই পেল না। ক্লান্তপদে যখন সে বাড়ী ফিরল তখন তার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে, চোখের সামনে ঝিলমিল করে দুলছে সব কিছু, চিন্তাশক্তি মাঝে মাঝে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। টাকা নেই, পয়সা নেই, আগুনের মত বাজার—চাকরিটা গেল! ছেলেটার অসুখ, মরে বাঁচে ঠিক নেই, ওষুধ পথ্য কেনার সঙ্গতি নেই। তবু চাকরিটা গেল! সুবিচার চেয়েছিল যারা, তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল, চুরি করতে চায়নি, খুন করতে যায়নি—তবু বরখাস্ত হল সে! তাহলে? সব মিথ্যা নীতি, ন্যায়, ধর্ম—সব বাজে কথা! মানুষের জীবনটা তাহলে অদৃশ্য এক অন্ধ নিয়তির ইঙ্গিতে চলে! তাই বিপদগ্রস্ত আরো বিপদাপন্ন হয়, মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা পড়ে, অসংখ্যের রক্তমাংস দিয়ে মুষ্টিমেয়র প্রাসাদ রচিত হয়। বিপিনের মাথা যেন ফেটে পড়বার উপক্রম হল।
কিন্তু বাড়ী ফিরেই আর একটা বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়াল সে আগ্নেয়গিরির এক মুখ থেকে আর একটা মুখে গিয়ে পড়ল সো ছেলেটা জ্বরের ঘোরে অচৈতন্য হয়ে পড়েছে। মালা কাঁদছে।
হাত পেতে, ভিক্ষুকের মত কথা বলে অনেক সময় ধার পাওয়া যায় তা দিয়ে ডাক্তার ডাকাও হল কিন্তু ডাক্তার মাথা নাড়ল। দেরী হয়ে গেছে, টাইফয়েডের জটিলতম রূপ।
মালা বিনিয়ে বিনিয়ে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বসে বসে বিপিন তাই দেখো আর জ্বলে ওঠে তার সারা দেহ। তার ছেলেটা মারা যাচ্ছে। ব্যাধি কিন্তু তার মূলে কি? কাকে বলবে একথা বিপিন? এসব নিরর্থক। পৃথিবীতে এই হয়—নিঃশব্দে তা মেনে নেওয়াই ভাল।
অভিভুতের মত বসে বসে দেখতে লাগল বিপিন। মুহূর্তের পর মুহূর্ত কেটে গেল মালার মৃদু কান্না শুনতে শুনতে বুকের ভেতর কোথায় যেন হাড়গোড় চুরমার হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ চমক ভাঙল তার, সে লাফিয়ে উঠল।
‘বাবা–ও বাবা-মাণিক আমার’—মালা চিৎকার করে উঠল।
ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল বিপিন, ফিসফিস করে, ‘কি হল? মরে গেল নাকি? অ্যাঁ?’
মালা তার কথা শুনতেই পেল না, একই ভাবে সে চিৎকার করে কেঁদে বলল, ‘আমাকে ছেড়ে কোথায় গেলি বাবা?—বাবারে—‘
সে কান্না ভয়াবহ। পাঁচ বছরের মরা ছেলে কোলে করে মা কাঁদছে। মরে ছেলেটার মুখ গম্ভীর ও ভারিক্কী হয়ে গেছে। আর মালাকে যেন চেনাই যায় না। ও যেন মানুষ নয়, পুঞ্জীভূত বেদনার একটা স্কুপা যে অসহায় বেদনা, অন্যায় আর বঞ্চনাতে জাগে বিপ্লব—ও যেন সেই বেদনার একটা বহু-যুগ-সঞ্চিত পাহাড়। বিপিন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।