ধর্মঘটের ইতিহাস ওদিকে বদলায় না। মুখোমুখি দু’দল দাঁড়িয়ে আছে। দু’দলই সুযোগ খুঁজছে। কিন্তু কেউই হার মানছে না একদল শুকিয়ে মেরে জিততে চায়—আর একদল শুকিয়ে মরেও জিততে চায়।
সেদিন সন্ধ্যেবেলায় বিপিন বাড়ী ফিরে দেখল যে ছেলেটার প্রবল জ্বর এসেছে। চোখ বুজে জ্বরের ধমকে নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে ছেলেটা, আর শিয়রের কাছে প্রস্তরমূর্তির মত বসে আছে। মালা।
ছেলেকে দেখে বিপিনের মুখ দিয়ে কথা সরল না। হাতে পয়সা নেই, ওষুধ পথ্য কি করে আসবে ছেলের? এমন অসময়ে হঠাৎ ছেলেটার অসুখ হল কেন?
কোন কারণ খুঁজে না পেয়ে হঠাৎ জ্বলে উঠল বিপিন, বলল, ‘বুড়ী—ঐ বুড়ীর শাপেই চ্যাংড়ার জ্বর এসেছে–’
মালা জবাব দিল না, শুধু তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে আসতে লাগল।
‘কাঁদছ! দূর ছাই’—
আবার সেই কান্না! বিপিন ছিটকে বাইরে চলে গেল।
পরদিন সকালে একটা কাণ্ড ঘটল।
ছেলেটার জ্বর সকালের দিকে কম দেখা দিল। সেই সুযোগে মালা গেল বড় রাস্তার ওদিককার একটা বাড়ীতে সেখানে নাকি ঝি রাখা হবে বিপিন বাড়ীতে রইলা ছেলের কাছে বসে চুপচাপ সে ভাবছিল আর কতদিন ধর্মঘট চলবে, আর কতদিন?
ঠিক এমনি সময়ে ক্ষীণকণ্ঠে কে যেন বাইরে থেকে ডাকল, ‘মালা—অ-মা’—ডাকতে ডাকতে কে যেন একেবারে ঘরের ভেতর এসে পড়ল। বিপিন তাকাল। তার বুড়ী শাশুড়ী।
‘তুমি!’ বিপিন উচ্চারণ করল।
বুড়ীর মুখটা কালো হয়ে গেল ভয়ে, অপ্রত্যাশিত বিভীষিকার মত জামাইকে দেখো বুড়ীর ছেড়া শাড়ীটা আরো ছিঁড়ে গেছে, ময়লা হয়ে গেছে। তার চোখে মুখে আরো বলিরেখা স্পষ্ট ও ঘন হয়ে হয়ে উঠেছে, পিঠটা যেন আরো ভেঙে গেছে।
অর্থহীন হাসি হেসে, শুষ্ক ও অস্পষ্ট ভাবে সে বলল, ‘মালা নেই, না?–’
‘না’—বিপিন মাথা নাড়ল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে বলল, ‘কিন্তু তুমি ফিরে এলে যে!’
বুড়ী ফোগলা দাঁত মেলে আবার হাসল, ‘এলাম কোথায় আর যাব বাবা’ বলেই হঠাৎ কেঁদে ফেলল বুড়ী, ‘সাতদিন কিছু খাইনি—’।
বুড়ীর কান্না দেখে হঠাৎ কঠিন হয়ে উঠল বিপিন। কান্না! এরা শুধু কাঁদে খায় আর কাঁদে। কিন্তু খাবার নেই, খাবার অত সস্তা নয়।
কঠিন কণ্ঠে সে বলল, ‘তুমি বেরোও এখান থেকে—‘
‘কোথায় যাব বাবা?’
‘যেখানে খুশি কাজ করে খাওগে যাও—‘
বুড়ী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, বলল, ‘সাতদিন ধরে কিছু খাইনি সোনা—ও আমার বিপিন—ও মানিক—’
হঠাৎ এগিয়ে এল বিপিন, দুলে উঠে বজ্রকঠিন কণ্ঠে বলল, ‘ভাল ভাবে যদি না বেরোস বুড়ী, আমি গলা টিপে তোকে মেরে ফেলব—‘
সভয়ে, সত্রাসে বুড়ী কান্না বন্ধ করল, মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে ক্ষীণকণ্ঠে বলল, ‘আচ্ছা আর আমি আসব না গোপাল–তোমরা সুখে থাকো’–যাওয়ার সময় বুড়ীর পিঠটা যেন আরো ভেঙে গেল। কাঠের পায়ের মত পা দুটোকে টেনে টেনে সে ধীরে ধীরে চলে গেল সেখান থেকে।
বিপিন হাঁফ ছাড়ল। বাঁচা গেল বাবা, নীচতা, নিষ্ঠুরতা যাই বলুক লোকেরা, সে ভালভাবে বাঁচতে চায়।
পরদিন।
ছেলেটার অসুখ আরো বাড়ল। অতিকষ্টে এক জায়গা থেকে চার টাকা ধার করল বিপিন, দু টাকা ভিজিট দিয়ে ডাক্তার ডেকে দেখাল।
অনেকক্ষণ ধরে দেখল ডাক্তার, দেখে বলল, ‘জ্বরটা ভাল নয় হে, ওকে হাসপাতালে ভর্তি করে দাও—’
‘আজ্ঞে আচ্ছা—’
কিন্তু হাসপাতালে বেড নেই। সব হাসপাতালেই অতিরিক্ত ভীড়। তবু একটা প্রেসক্রিপসন নিয়ে ওষুধ পাবার সুযোগ করে দিল তারা।
ইতিমধ্যে ধর্মঘটের অবস্থা জটিল হল। ভেতরে ভেতরে ফ্যাক্টরীর মালিকেরা বিভেদ-সৃষ্টির কাজে খানিকটা সফল হল। পেটের দায়ে দুটো শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেল শ্রমিকেরা। দালালেরা এবং ক্ষুকাতর শ্রমিকেরা একদিকে, অন্যদিকে সেই সব শ্রমিকেরা যারা ক্ষুধার জ্বালাকেও অস্বীকার করে নিজেদের অবস্থা ভাল করতে চাইছিল। একদল চাইল মিটমাট করে কাজে যোগ দিতে, অন্যদল চাইল ধর্মঘট চালিয়ে যেতে একদল স্থির করল যে পরদিনই তারা যোগ দেবে, অন্যদল স্থির করল যে সহকর্মীদের তারা বাধা দেবো।
তাই হল। পরদিন দুদলই গিয়ে ফ্যাক্টরীর দরজার সামনে ঠেলাঠেলি আরম্ভ করল। চীঙ্কার, কোলাহল, মারামারি। ফলে পুলিস এল, গুলি চলল, কিছু লোক গ্রেপ্তার হল। যারা বাধা দিচ্ছিল, তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, অন্যদল কাজে যোগ দিল দিনের শেষে আরো অনেকেই গিয়ে যোগ দিল। ধর্মঘট ভেস্তে গেল। নামেই যারা চালু রাখল তা, বিপিন তাদের অন্যতম।
অথচ বাড়ীতে আর একদানাও চাল নাই, ছেলেটাও অসুস্থ। আহত অবস্থায় এই সব কথা ভাবতে ভাবতেই বাড়ী ফিরল বিপিন।
সব শুনে মালা গুম হয়ে রইল, পরে বলল, ‘তুমিও গেলে না কেন কাজ করতে, অ্যাঁ?’
‘আমি! আমি যাব কেন, আমি কি কুত্তার বাচ্চা?’
মালা ঝংকার দিয়ে উঠল, ‘হয়েছে হয়েছে, ওসব বড় বড় কথা থামাও—মুরোদ নেই তার। আবার—‘
রক্তটা তখনও টগবগ করে ফুটছিল বিপিন কাছে এগিয়ে এল, বলল, ‘কি বললি?’
‘যা বললাম তা শোননি, কানে কি নোম ঢেলেছ নাকি?’ ক্ষুধার জ্বালায় মালাও আজ হিংস্র হয়ে উঠেছে।
একটা কিছু করে বসত বিপিন, নিশ্চয়ই করে বসত। এমনি সময়ে ছেলেটা কেঁদে উঠল, ক্ষীণকণ্ঠে কাঁদতে কাঁদতে সে বলল, ‘ভাত খাব—অমা—মা—‘
কুঁকড়ে গেল বিপিন, অবসন্নের মত একপাশে বসে পড়ল সে, বসে বসে ছেলের কান্না শুনতে লাগল। কি বিশ্রী এই কান্না! শুনতে শুনতে কেমন যেন অসহায় বোধ করে সে, দুর্নিবার একটা আক্রোশে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করে, কাউকে দায়ী করতে ইচ্ছে হয় এই কান্নার জন্য।