মালা এসে ডাকল, ‘ভাত খেতে এস—’
ভাত! লাফিয়ে উঠে রান্নাঘরে গিয়ে বসল বিপিন। গিয়ে দেখল যে ছেলেটা আর বুড়ী আগেভাগেই বসে আছে সেখানে ভাত খেতে আরম্ভ করল সবাই। শুধু ভাত আর আলুসেদ্ধ, আর কিছু নয়। খাওয়া শেষ করেও বিপিন উঠল না, বসে বসে বুড়ীর খাওয়া দেখতে লাগল। কেমন যেন নীচ হয়ে গেছে সে, কিন্তু টের পেয়েও নিজেকে সংশোধন করতে পারে না বিপিন।
বুড়ী পাতের ভাত শেষ করে মেয়ের দিকে তাকাল—’মালা, অ-মা!’
‘কি?’
‘আর চারডি ভাত দে তো মা—এই এত কটি দে—’
মালা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শীর্ণ হাসি হাসল, তারপর এক হাতা ভাত দিল তার পাতে।
বুড়ী খুশী হয়ে বলল, ‘থাক থাক, ওতেই হবে মা, ওতেই হবে—’
দিদিমাকে ভাত খেতে দেখে ছেলেটাও হঠাৎ দাবি জানাল, ‘আমাকেও ভাত দে—এই মা—’
মালা ধমক দিল, ‘আগে ঐ কটি খা দেখি রাক্কস—তারপরে চাস–’
ছেলেটা অসহিষ্ণু হয়ে মাথা নাড়ল, ‘না, আমায় আরো ভাত দে, দে বলছি।’
‘না।’
ফস করে প্রশ্ন করল বিপিন, ‘কেন, দেবে না কেন?’
‘বা রে, আমি খাব না?’
বিপিনের মুখ কুৎসিত হয়ে উঠল, ‘মা চাইলে দিতে পার আর ছেলে চাইলে দিতে পার না কেন?’
‘কি বললে!’ মালা চেঁচিয়ে উঠল।
‘মা—অ-মা—আরো ভাত দে না’—
দুম করে ছেলের পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিল মালা। তারস্বরে কেঁদে উঠল ছেলেটা। বুড়ী খাওয়া বন্ধ করে মাথা নীচু করে স্তব্ধ হয়ে রইল।
বিপিন একবার নড়ে উঠলা। ক্রন্দনরত ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার মাথায় রক্ত চড়ে গেল, সারা শরীর গরম হয়ে উঠল। কি বিশ্রী দেখাচ্ছে ছেলেটাকে! আর কী বিশ্রী এই বলে, কি বিশ্রী! অসহ্য মনে হল তার।
কর্কশ কণ্ঠে সে মালাকে প্রশ্ন করে, ‘ওকে মারলে যে?’
‘বেশ করেছি’—উদ্ধত ভঙ্গিতে জবাব দিল মালা।
লোহা পিটানো হাতের মধ্যে এঁটো ভাত শুকিয়ে খড়খড় করছিল, সেই হাত দিয়েই বিপিন মালার গালে একটা চড় কষিয়ে দিল। ঠাস করে একটা শব্দ হল।
মালা কাঁদল না। কিন্তু আরো জোরে কেঁদে উঠল ছেলেটা আর কেঁদে উঠল বুড়ী হাউমাউ করে।
বিপিন উঠে দাঁড়াল আর টেকা যাচ্ছে না কুৎসিত কান্নায় রান্নাঘরটা ভরে উঠেছে। কাঁচা কয়লার ধোঁয়ায় ভরাট ঘরে যেমন নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয় তেমনি কষ্ট হচ্ছে তারা বুড়ী কাঁদছে। বলি-রেখাঙ্কিত মুখের চামড়ায় তার কান্নার প্রাবল্যে আরও ভাঁজ পড়েছে। গুমরে গুমরে কাঁদছে বুড়ী।
বিপিন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। রাস্তায় এলোমেলো ভাবে বেড়াতে লাগল সে, ভাঁটিখানায় যাবার মত রসদ তো আর নেই।
ভোরবেলায় পরদিন উঠে দেখা গেল বুড়ী ঘরে নেই। মালা ছটফট করতে লাগল, বিপিন গিয়ে বস্তির এদিক-ওদিক খোঁজ নিল, কোত্থাও পাওয়া গেল না বুড়ীকে। বেলা বাড়তে লাগল, দিন কাটল, বুড়ী আর ফিরল না। মালা অনবরত চোখের জল মুছতে লাগল কিন্তু বিপিন একটুও বিচলিত হল না। ভালই হয়েছে। আপদটা বিদেয় হয়েছে, এখন থেকে তবু দু-মুঠো বেশী খাওয়া যাবে।
তিন-চারদিন কেটে গেল আরো ধর্মঘটের অবস্থা ওদিকে একই রকম। কর্তৃপক্ষেরা মাঝে দালাল দিয়ে বিভেদ-সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল, ফল হয়নি—শ্রমিকদের দৃঢ়তা তাতে আরো বেড়ে গেল।
কিন্তু আর যে চলে না।
মালা বলল, ‘কোনমতে আরো দু-দিন চলবে, বুঝলে? আমার মা হতভাগী তো নিষ্কৃতি দিয়ে গেছে, তাই কোনমতে আরো দু-দিন তোমার পেট ভরাতে পারব—’
বিপিন ক্ষেপে গেল, ‘শুধু আমার পেট ভরাবে? আর তোমরা?’
মালা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘আমাদের কথা ভেবে তোমার দরকার কি গো—আমরা হাওয়া খেয়ে থাকবে।’
মালার চুলের গোছা টেনে, খারাপ একটা গাল দিয়ে বিপিন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘তোর বড় বাড় বেড়েছে মালা, সাবধান—’
বিপিনের চোখমুখের চেহারা দেখে কেমন যেন ভয় পেল মালা। সে চুপ করল কিন্তু তার অন্তরের জ্বালা জল হয়ে বেরোল চোখ দিয়ে, আর তাই দেখে তাকে ছেড়ে দিয়ে পালাল বিপিন। কান্না—এই কান্না সে সহ্য করতে পারে না।
কিন্তু কান্নার হাত এড়াবে কি করে বিপিন? বাচ্চা ছেলেটা সকালে বিকেলে খেতে চায়, অনবরত কাঁদে।
‘ভাত খাব মা-–ভাত—’
‘মাগো, খেতে দে মা—’
তীক্ষ্ণ, একটানা সুরে কাঁদে ছেলেটা। একটা আহত জন্তুর মত। সে কান্না শুনে বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে বিপিনের।
ছেলের কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলায় সে, ‘কাঁদছিস কেন বাবা, অ্যাঁ? কাঁদিস না, থাম থাম—’
কিন্তু ছেলেটা বোঝে না, শোনে না, অন্ধ আবেগে, শূন্য-জঠরের নিষ্ঠুর তাড়নায় সে সমানে কেঁদে চলে আর বলে, ‘ভাত খাবো মা—মাগো—মা—’
বুঝিয়েও কান্না থামাতে না পেরে ক্ষেপে ওঠে বিপিন, হঠাৎ ছেলেটার কান ধরে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘চুপ কর শুয়ারকা বাচ্চা–
চুপ’ ছেলেটার কান্না তাতে আরো সশব্দ হয়ে ওঠে, বিকট হয়ে ওঠো বিপিন তখন পাগলের মত ঘর থেকে ছুটে বেরোয়।
মালার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে পেছন পেছন, ‘ছেড়ে দিয়ো না গো, মেরে ফেল, তুমি ওর জন্ম দিয়েছ, তুমিই ওকে শেষ করো, বুঝলে?’
বস্তির আঁকাবাঁকা, নোগ্রা রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় বিপিন। সামনে যা পড়ে তাতেই পরম আক্রোশে লাথি মারে সো হাঁস মুরগী কুকুর—কেউই রেহাই পায় না। কান্না সইতে পারে না সে। কেন কাঁদে বাচ্চাটা, কেন কাঁদে মালা আর কেনই বা কাঁদত সেই বুড়ীটা? বস্তির ঘরে ঘরে আরো কত লোক যে এমনি কাঁদে, কত অসংখ্য লোক কাঁদে সারা পৃথিবীতে!