‘চৌবেজী, কে যেন কাঁদছে’—
চৌবেজী থমকে কান পাতল, মাথা নেড়ে বলল ‘দূর’—
বিপিন চুপ করল। সে ছাড়া কেউ শুনতে পাবে না এ কান্না। এ কান্নার সঙ্গে পরিচিত হতে হলে তার বস্তির ঘরে ফিরে যেতে হবে কাঠ মাটি আর টিনের একখানা ঘর, পেছনে ছোট একটা উঠোন পেরিয়ে খড়ের ছাউনি-দেওয়া রান্নাঘর। তাতেই থাকত সে, মালা, পাঁচ বছরের ছেলেটা আর জরাজীর্ণ শাশুড়ীকে নিয়ে।
লোহালক্কড় পিটিয়ে সে মাইনে পেত মোট আটত্রিশটি টাকা। লম্বা চওড়া জোয়ান মানুষ সে, লোহার মত শক্ত তার পেশী, স্বাস্থ্যবতী স্ত্রী মালা, বাচ্চাটাও জীর্ণ-শীর্ণ নয় আর শাশুড়ী বুড়ী হলেও কম খেত না। আটত্রিশ টাকায় কুলোবে কেন, তাই ভাতেও কুলোত না। অথচ বয়লারের আগুন, গলানো লোহার উত্তাপ আর ভারী হাতুড়ী মানুষকে রাক্ষসের মত ক্ষুধার্ত করে তোলে। প্রতিদিন বাড়ী ফিরত বিপিন আর খাবার সময় হাড়ির ভেতরটা দেখে হাত গুটিয়ে নিত। আক্রোশে জ্বলতে জ্বলতে শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে সে হিংস্র হয়ে উঠত। কোত্থেকে যে এই আপদটা এসে জুটল— উঃ—
বুড়ীর দোষ নেই। জামাই ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ নেই, সে যাবে কোথায়? সে জানে যে তার পরমায়ু ফুরিয়ে এসেছে, তাই পরিপূর্ণ ভাবে জীবনের স্বাদটা পেতে চায় বুড়ী লোভীর মত। খেতে বসে জেঁকে বসত, ভাত দেখে গভীর তৃপ্তির আবেশে তার চোখ দুটো বুজে আসতা মুখে চার-পাঁচটা মাত্র নড়বড়ে দাঁত আছে, তাই দিয়ে ধীরে ধীরে, রসিয়ে রসিয়ে ভাত চিবোত সে, আর অনেকক্ষণ ধরে খেতা
বিপিনের খাওয়া হয়ে যেত, বাচ্চাটারও শেষ হত, বুড়ী তবু বসে থাকত বসে বসে ভাত কটা শেষ করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বলত, ‘তোর ডাঁটাচচ্চড়িটা বড় ভাল হয়েছে মালা দে তো আর চাট্টি ভাত মা—’
মালা মৃদু হেসে হাঁড়ি থেকে ভাত দিত আর প্রায় শূন্য হাঁড়ির চেহারাটা দেখে বিপিন বারুদের মত জ্বলতা দাঁতে দাঁত চেপে ধরে ক্রোধের উচ্ছ্বাসটাকে দমন করতে গিয়ে সে বিড় বিড় করে বলত, ‘হারামজাদি রাক্ষুসী—মরেও না, বজ্জাত মাগী কোথাকার—
মালা একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করত, ‘কি হল! তুমি কিছু বলছ নাকি?’
বাচ্চা ছেলেটা ঠিক সেই সময়েই হঠাৎ আবদার করে উঠত, ‘আমুও খাব দিদিমা—হ্যাঁ—’
ছেলেটার পিঠে লোহার বলের মত শক্ত মুষ্টির এক ঘা বসিয়ে বিপিন সজোরে বলত, ‘কিচ্ছু বলছি না—তুমি খাও—’
ছেলেটা আচমকা কিল খেয়ে কান্নায় ফেটে পড়ত, সে শব্দে সমস্ত ঘরটা ভেঙে পড়তে চাইত আর বিপিনের হিংস্রতা বেড়ে উঠত ক্রমশা ছেলেটার দিকে তর্জনী নাচিয়ে সে আদেশ করত, ‘চোপ—চোপ বলছি।’
ছেলেটা থামত না। কেঁদেই চলত।
মালা তখন চেঁচিয়ে উঠত, ‘কথা নেই বাত্তা নেই, ওকে মারলে যে! তার চেয়ে একেবারে মেরেই ফেল না ওকে—‘
‘চোপ—‘
‘কেন, চুপ করব কেন, কি দোষ করলাম?’ মালা কেঁদে উঠত।
ধাঁ করে মালাকে একটা লাথি মেরে বিপিন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেত। বাইরে দাঁড়িয়ে ছেলে আর বৌয়ের কান্নার বিশ্রী শব্দটা দু-চার সেকেন্ড চুপ করে শুনে বিপিন ভাটিখানার দিকে পা চালিয়ে দিত। সে কান্না সইতে পারে না। চলতে চলতে আফসোস হত তারা কাকে মারতে কাকে মারলাম বাবা, ওদের না মেরে বুড়ীকে এক ঘা মারলেই তো হতা।
এমনিভাবে দিন কাটছিল। ছেলে বউয়ের কান্না শুনে আর পেট ভরে খেতে না পাওয়ায় শুধু বিপিনের মনের মধ্যেই যে হিংস্রতার ঝড় উঠেছিল তা নয়, বিপিনের সহকর্মীদের মনেও তেমনি ঝড় উঠেছিল। ধীরে ধীরে দলবদ্ধ হচ্ছিল তারা, সংগঠিত হচ্ছিল। ফাঁকা বুলির দমকে তারা এক হচ্ছিল না, পেটের দায় তাদের পাশাপাশি দাঁড়াতে শেখাচ্ছিল যুদ্ধের বাজারে কোটি টাকা আয় হয়েছে ফ্যাক্টরীর কিন্তু তাদের আয়ের অঙ্ক বদলায়নি। যুদ্ধের দেবতারা বাজারে আগুন ছড়িয়েছে, চাল ডাল আর নুন তেল হয়েছে দুষ্প্রাপ্য, দুমূর্ল—অথচ তাদের শ্রমের দাম বাড়েনি। হাড়ভাঙা খাটুনির পর পেটে যে রাক্ষসের ক্ষুধা জন্মায় তার সামনে অল্প আহার্য দেওয়ায় এবার বিপর্যয় ঘটল ফ্যাক্টরীর শ্রমিকেরা বিদ্রোহের পতাকা তুলে হাওয়ায় ধরল। বেতনবৃদ্ধির দাবী নিয়ে তারা কর্তৃপক্ষের সামনে দাঁড়াল, দাবীর খসড়াটা সিগারেটের ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিয়ে রক্তচক্ষু করল মালিকেরা। শ্রমিকেরা পালটা ঘা মারল স্ট্রাইক। বিপিনও সোৎসাহে এতে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
এক দিন—দু দিন—দশ দিন— তবু মীমাংসা হল না। এ লড়াইয়ের নিয়মই যে এমনি। মালিকেরা ভাবে যে ক্ষুধার তাড়নায় হয়ত ধর্মঘট ভেঙে যাবে। যাই ভাবুক—এখানে তা হল না। ধর্মঘট চলল।
ওদিকে শ্রমিকের কোষাগার শূন্য হয়ে গেল। মাসের মাঝামাঝি তারা বিদ্রোহ করেছে, ভেবেছিল কয়েক দিনেই তা শেষ হবে। অথচ তা হল না, অবস্থা খারাপ হয়ে উঠল।
বিপিন চিন্তায় পড়ল। চারটে পেটের জোগান, এখন সে দেবে কোত্থেকে? কি করে চালাবে সে? চালালে চলবেই বা কি করে? বুদ্ধিতে কুলিয়ে উঠতে পারে না, চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে আসে সব কিছু। অথচ হার মনলেও চলবে না। কি করা যায় তবে? ধার? কার কাছে, কোন মুখে সে তা চাইবে?
এমনি অভাবের সময় বুড়ি শাশুড়ী যেন আরও ক্ষেপিয়ে তুলল বিপিনকো পকেটে পয়সা নেই, শিগগীর টাকা পাবার কোন আশাই নেই, অতি কষ্টে নুন ভাত জুটছে এক মুঠো করে—তবু বুড়ীর নির্লজ্জ ক্ষুধা এত তিলও কমেনি। সন্ধ্যার পর সেদিন বিপিন চুপ করে বসে ছিলা ক্ষুধার জ্বালায় ঝিমোতে ঝিমোতে সে ফ্যাক্টরীর কর্তৃপক্ষের অনমনীয় দৃঢ় মনোভাবের কথা ভাবছিল। আর কতদিন, আর কতদিন চলবে এমনি ধারা?