- বইয়ের নামঃ নবেন্দু ঘোষের গল্প
- লেখকের নামঃ নবেন্দু ঘোষ
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
কান্না
ঢং ঢং করে দুটোর ঘণ্টা বাজল।
কান পেতে শুনল বিপিন রাত দুটোর ঘণ্টা বাজল।
করিডোরে সান্ত্রীর পদচারণা চলছে। নাল বাঁধানো বুটের কঠিন শব্দ উঠছে— খট খট খট খটা একটানা শব্দ।
শেষ রাতের স্তব্ধতা। সারা শহর ঘুমুচ্ছে, স্বপ্ন দেখছে। এই জেলখানার ভেতরেও সেই ঘুমের ঢেউ এসেছে, স্বপ্নের জোয়ার এখানকার উঁচু দেওয়ালকেও অতিক্রম করেছে। শুধু ঘুমোয়নি বিপিন, ঘুমোয়নি ঐ সান্ত্রী এবং আরো দু’তিনজন।
সান্ত্রীর বুটের শব্দটা কাছে এল। করিডোরের দেওয়ালে একটা বাতি জ্বলছিল, তার আলোর একটা ধারা এসে পড়েছিল বিপিনের কামরার সামনে, কিন্তু তাতে ভেতরটা সম্পূর্ণ আলোকিত হয়নি, আবছা অন্ধকার ঘুপটি মেরে ছিল কোণের দিকটায়—যেখানে একটা কম্বলের ওপর চুপচাপ বসে ছিল বিপিন। নিঃসাড় হয়ে বসে ছিল আর প্রহর গুনছিল।
‘ক-টা বাজল চৌবেজী? ক-টা?’ মৃদুকণ্ঠে হঠাৎ সে প্রশ্ন করল।
চৌবেজী তাকাল ভেতরের দিকটাতে, বিপিনের মুখটা ভাল করে দেখা যাচ্ছে না কিন্তু সে বেশ অনুভব করল যে তার গলাটা ধরা-ধরা। বেচারা—
‘কটা আবার দুটো বাজল ভাই’—
চৌবেজীর বুট জুতো আবার শব্দ তুলতে লাগল।
দুটো! তাহলে আরো তিন ঘণ্টা সময় আছে। আরো তিন ঘণ্টা আছে তার জীবনের মেয়াদ! বিপিন হাসল, একটু নড়ে বসল সে, জোরে জোরে বারকয়েক নিঃশ্বাস টানল। আঃ! আরো তিন ঘণ্টা। কতক্ষণ আর? কালসমুদ্রে কত যুগযুগান্ত ভেসে গেছে—খড়কুটোর মত এই তিন ঘণ্টাও তার দুরন্ত স্রোতেবেগে ভেসে যাবে—তারপর যখন পাঁচটা বাজবে তখন ঐ লোহার দরজাটা খুলে যাবে, ফাঁসির দড়ির ডাক শোনা যাবে হ্যাঁ, আজই শেষরাতে তার ফাঁসি হবে।
শেষরাতের ভৌতিক মুহূর্তগুলো। পাথর আর কংক্রীটের তৈরী এই কামরার বাইরে, জেলখানারও বাইরে, নিস্তরঙ্গ মহাসমুদ্রের মত পৃথিবীটা এখন তন্দ্রাচ্ছন্ন ও শান্ত হয়ে আছে। সেখানে গিয়ে একবার দাঁড়াতে ইচ্ছে হয় বিপিনের হাসি কান্না, সুখ দুঃখ, আলো আঁধারের দ্বন্দ্বে। ভরা পৃথিবীকে শেষবারের মত আর একবার দেখতে ইচ্ছে করে। অথচ উপায় কোথায়? রাত্রিশেষে তার ফাঁসি হবে খুনী আসামী সে, কলঙ্কযুক্ত অপরাধীর বহমূল্য জীবন তার, পাথর আর কংক্রীটের গাঁথা কামরায় তাকে রাখা হয়েছে, সদাসতর্ক সান্ত্রীর বুটে আজ পৃথিবীর অস্বীকৃতি ঘোষিত হচ্ছে। সে আর এখন পৃথিবীর জীব নয়—এই সেলের অন্ধকারে, নিঃশব্দে বসে বসে, আসন্ন মৃত্যুরাজ্যের ছাড়পত্রের জন্যই তাকে এখন অপেক্ষা করতে হবে। উপায় নেই।
খুনী আসামী বিপিন। বহাল তবিয়তে সে তার স্ত্রী মালাকে গলা টিপে মেরেছে। প্রমাণ অজস্র, সাক্ষী অসংখ্যা বস্তির নরনারীরা এসে যখন তাকে জোর করে টেনে হিঁচড়ে একপাশে নিয়ে এল তখন দেখা গেল যে মালার জিভ বেরিয়ে এসেছে, নাক দিয়ে, দু-কষ বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। আতঙ্ক বিস্ফারিত দুটো চোখের তারা স্থির হয়ে গেছে সে মারা গেছে। বিচার বেশীদিন চলেনি। প্রমাণ সুস্পষ্ট। দায়রা জজ রায় দিলেন যে একেবারে না মরা পর্যন্ত আসামী বিপিনকে ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হবে। আজ, ৩রা মার্চ, সোমবার, শেষরাতে দায়রা জজের সেই মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা প্রতিপালিত হবে। বিপিন তা গতকাল জানতে পেরেছে।
সত্যিই সে খুন করেছিল। প্রমাণ এবং সাক্ষীর দরকার ছিল না—সে নিজেই তার অপরাধ স্বীকার করেছিল শুধু স্বীকার করেনি যে, কেন সে খুন করেছিল। আসামী পক্ষের উকিল প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে বিপিন উন্মাদ প্রমাণ টেকেনি, ডাক্তারের রিপোর্টে তার মস্তিষ্ক বিকৃতি মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন হল। সাক্ষীরা প্রমাণিত করল যে আসামী নিজে দুশ্চরিত্র ছিল এবং এই নিয়ে তার স্ত্রী তাকে গঞ্জনা দিত বলেই সে ক্রোধোন্মত্ত হয়ে মালাকে খুন করেছে। বিপিন কোন প্রতিবাদ করল না। আসামী পক্ষের উকিল ক্ষীণকণ্ঠে একটু প্রতিবাদ করল। বিচারক সাক্ষীদের কথাই বিশ্বাস করলেন। মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা সহজেই ঘোষিত হয়ে গেল।
বিপিন প্রতিবাদ করেনি। প্রতিবাদ করলে খুন করার কারণ সম্পর্কে যদি সে সত্যি কথা বলত তাকে কি কেউ বিশ্বাস করত? বিপিন হাসল। আর মাত্র তিন ঘণ্টা আর একবার আগাগোড়া এই জীবনটার কথা ভাবা যাক না। আজ, এই মুহূর্তে, নিজের জীবনের অসম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি ব্যতীত আর কী-ই বা অবশিষ্ট আছে?
বিপিনের জীবন! জন্ম আর আসন্ন মৃত্যুর মধ্যবর্তী একটা অবিচ্ছিন্ন দুঃখের জীবন। সে জীবনে। ঘটনা-বৈচিত্র্য নেই, চাকচিক্য নেই, মহাকাব্য কিংবা নাটক তৈরীর উপাদান নেই তাতো দূর বরিশালের কোন গ্রামে সে জন্মেছিল, কেমন করে অশিক্ষায়, অভাবে বড় হয়ে সে একদিন আয়রন ফ্যাক্টরীতে ষোল বছর বয়সে ঢুকেছিল—সে কথা আর ভেবে লাভ কি তার চেয়ে আজ ঠিক সেইখান থেকেই ভাবা যাক— যেখান থেকে ফাঁসির দড়িটা বিপিনকে অদৃশ্যভাবে আকর্ষণ করতে লেগেছিল।
জেলখানার ভেতরেও এখন স্তব্ধতা। শুধু সান্ত্রীর বুট শব্দ তুলছে। কৃষ্ণপক্ষের রাত—আকাশে হয়ত অসংখ্য তারা ছড়ানো রয়েছে। কিন্তু বিপিন তা দেখতে পাচ্ছে না। চোখ বুজে সে ভাবছে। হঠাৎ সে উঠল, চোখ মেললা কে যেন কাঁদছে! বিনিয়ে বিনিয়ে কে যেন কাঁদছে! দূরে, অতি— দূরে বহুদূরে—! ঐ কান্নাই তো রাত্রিশেষে আসন্ন ফাঁসির দড়ির পেছনে। কে কাঁদে!