নির্দিষ্ট অনন্তের ওপার থেকে আমি ওকে কিছু একটা বলতে চাই। ডাকি, শোনো। আর চমকে উঠি। কি বলছি সেটা কিছু নয়, কি সুর লাগছে। আর নিপ্রেম, নিপ্রাণ শূন্যের এপার থেকে চমকে চমকে উঠি আমি। এ কী! এ কোন কান্নার সুর! নিপ্রেম, নিপ্রাণ এ কার অসহ্য কান্না। আর্তনাদের মতো করে আমি ডাকতে চাই, শোনো!
কিন্তু কিছুই বলি না আমি। কোনো শব্দই বেরোয় না আমার গলা দিয়ে। শুধু ওর দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকি। একালের মান একটা মেয়ে। অনেক সয়েছে ও, অনেক দেখেছে। অনেক পথ, অনেক মোড়, অনেক লোক। তাই কাঁদতে চাই আমি। কিন্তু কাঁদতে পারি না। শিউরে শিউরে উঠি আশঙ্কায়। পরতে পরতে পরিণতি জানিয়ে ফুটে ওঠা ঐ একটা মাংসের ফুল—কিন্তু অন্য কেউ নেবে ওকে। কেননা অনেক পথ, অনেক মোড়, অনেক লোক পেরিয়ে আসছে ও। অনেক মোড় অনেক লোক পেরিয়ে ও যাবে। দৈনিক বরাদ্দ রুজি রোজগারের মেহনতের পর কিছু কেনাকাটা করবে দোকান থেকে। কাউকে ফেরাবে, কাউকে ভোলাবে। তারপর আবার হেঁটে যাবে ও অনেক অনেক ভিড়ের মধ্যে।
স্নান ঘরের বাইরে একটা অন্তহীন উদ্ভট জঙ্গম শেকল বাঁধা এক সার মধ্যযুগীয় কয়েদীর মতো বেগার খেটে চলেছে ঝম্ ঝম্ শেকল বাজিয়ে। তাদের কদাকার কানা। নিষ্ঠুর চোখের কোণে কোণে ধূর্ত হাসি। আর ঝম ঝম্ করে পায়ের বেড়ি বাজছে দিনরাত। আমি জানি, অন্য কেউ ওকে পাবে। অনেক মোড়, অনেক ভিড়, অনেক দায়ের মধ্যে অন্য কেউ। ভিড়ের মধ্যে একদিন ও চোখ তুলে আমার দিকে চেয়েছে। দরজা খুলে দিয়ে বলেছে, শোনো। কিন্তু আর কিছু বলিনি আমরা। আর কিছু বলা হবে না আমাদের। আমি চোখ মেলে ওকে দেখতে চাই। ওর যা দেখেছি, সেটা নয়। যা দেখিনি সেইটে! ও যা বলেছে তা শুনতে চাই না আমি, ও যা বলেনি সেইটে। আর অসহ্য ঈর্ষায় অস্থির হয়ে উঠি। অন্য কেউ ওকে পাবে, কে, কে? অনেক। ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ও এসেছে। ভিড়ের মধ্যে কে সে, যে ওকে নেবে? কে? তাহলে আমাকেও নিক অন্য কেউ। ভিড়ের মধ্যেকার অন্য কেউ? কিন্তু তু ঈর্ষায় কালো হয়ে উঠি আমি। আর আমি জানি, আমিও অনেক ভিড়ের মধ্যে দিয়ে এসেছি। অনেক মোড়, অনেক দায়, অনেক পরিচিতা। ঈর্ষায় জ্বলি আমি আর ইচ্ছে করে ওকে বলি, শোনো সেদিন যাকে নিয়ে সিনেমায় গিয়েছিলাম। কিন্তু না, কিছুই বলি না আমি। আর একালের এই ঘরখানার ম্লান আলো অন্ধকার হয়ে ওঠে ক্রমে। অন্ধকার নয়, কালো। অসহ্য একটা কান্না গলা ঠেলে আসে আমার, আর কান্নাকে পায়ে মাড়িয়ে প্রেতের মতো স্তব্ধ হয়ে উঠি আমি। কালো একটা ষড়যন্ত্র নিশ্বাস চেপে ঘিরে দাঁড়ায় আমাদের চারিদিকে। নিপ্রেম নিপ্রাণ শূন্যতার চারপাশে ফিস্ ফিস্ সংকেত। বাক্যহীন একপাল। কদাকার কয়েদীর মতো বেগার খাটছে বাইরের উদভ্রান্ত জঙ্গম। আমি জানি না। আমি জানি। আমি যা জানি তা জানতে চাই না। যা জানি না, সেইটে। আর বিকৃত গলায় চিৎকার করে বলি শোনো! কিন্তু কিছুই বলি না আমি। কিছুই বলতে পারি না। একটা অসহ্য কান্না, না কান্না নয় ঈর্ষায় গলা বন্ধ হয়ে আসে আমার! গলা চেপে ধরে আমার! একটা ঈর্ষা আমাকে অস্থির করে তোলে।
ও ইতস্তত করে আবার বলে, শোনো।