চোখ না ফিরিয়েই ও বলে, বলো।
আর ঘরের মধ্যে গুনগুনিয়ে ওঠে একটা সুর। সুরটা করুণার। ও কিছুই বলেনি, শুধু বলেছে, বলো। আর ছলছল করে উঠেছে একটা সুর। ও করুণা করে আমাকে। আমি অনেক সয়েছি, আমরা অনেক সয়েছি। বাইরের নিষ্করুণ জঙ্গমতা থেকে এক একটা মুহূর্ত আমাদের চাই। করুণায় ভেজা। করুণায় বাঁচা। মৃদু, শান্ত, ম্লান। করুণা নিয়ে আমি ওর দিকে তাকাই চোখ মেলে। ওর দেহের দিকে। একটা স্লান ছায়া পড়েছে ওর শরীরে। গ্রীবার ভঙ্গিতে একটা কারুণ্য। কপালের ঢালুতে চূর্ণ অলক। শাড়ি ব্লাউজ। একটু বেঁকে বসেছে ও, আমার দিকে না তাকিয়ে। একটা বাহু নেমে এসেছে বেঁকে। স্নান আভার গুড়ো লেপে আলো-আলো হয়ে উঠেছে হাতের রোয়াগুলো। শাড়ি ব্লাউজ। ওর একপাশের বুকখানা দেখতে পাচ্ছি আমি। ব্লাউজে ঢাকা ব্লাউজে বাঁকা। ভরা। নিশ্বাগ্রে তালে তালে একটু উঠছে, নামছে, উঠছে। একটা সেপটিপিনের মাথা চোখে পড়ে আমার। বোতাম ছেঁড়া ব্লাউজটাকে ও বিধে রেখেছে সেপটিপিন দিয়ে। ঠিকমতো লাগাতে পারেনি। আমার ইচ্ছে হয়, ঠিক করে লাগিয়ে দিই সেপটিপিনটা।
আমি জানি ও শুধু করুণা। ও অনেক সয়েছে। করুণায় নীল ওর গালের ম্লান শিরাটা দেখতে চাই আমি। কিন্তু দেখি না। তাকিয়ে থাকি, কিন্তু তাকিয়ে থাকতে চাই না। একালের একটা ঘর, কিন্তু একালকে খুঁজে পাই না আমি, খুঁজে পাই না কিছুতেই আর ঘরের ম্লান ছায়াটা মনে হয় অন্ধকারের মতো মাতাল। আর বাইরের নিপ্রাণ নির্ভুল জঙ্গমটাকে মনে হয় মত্ত মদালস শেকলে বাঁধা একটা আদিম বৃষ হরপ্পার অন্ধকার থেকে মুখ তুলে ভাঙা ফাটা আহ্বানে ডাকছে তার সঙ্গিনীকে। কুটির প্রান্তের গণ্ডির বাইরে কোনো এক কামার্ত রাবণের মহাকাব্যিক পদচারণা। ওর নীল শিরাটার দিকে তাকাতে চাই আমি। বলতে চাই, শোনো! কিন্তু কিছুই বলি না আমি, কিছুই ভাবি না। শুধু ঘন, ভারী, আর্দ্র নিশাস টানি আমি। ও বলে, কই বলল। আর কিছু না ভেবে না দেখে তাকিয়ে থাকি আমি। ও অনেক দেখেছে, অনেক সয়েছে। আর তাই একটু আশ্চর্য পরিণতি ও জমিয়ে তুলেছে পরতে পরতে ওর মনে, ওর দেহে। একটা ফুল ফুটে উঠেছে তার সবগুলো দল মেলে—একটা মাংসের ফুল। কিছুই বলি না আমি। শুধু তাকিয়ে দেখি। ও শোভা নয়, সুরভি নয়, স্বেদ। ওর ব্লাউজের বাহুমূলের গোল জায়গাটা ভিজে উঠেছে ঘামে, ঘ্রাণে। ওর শাড়ি তেমনি অলস, তেমনি বাঁকা, ভরা ব্লাউজ। সেপটিপিন। উঠছে, নামছে, উঠছে। ভারী আর্দ্র নিশ্বাস টানি আমি। ডাক, শোনো—আর হরপ্পার বৃষের মতো একটি ভাঙা আওয়াজ বেরুতে চায় আমার গলা দিয়ে। কিন্তু না, বেরোয় না। কোনো শব্দই বেরোয় না আমার গলা দিয়ে। শুধু নিশ্বাস টানি আমি, ভারী, ভেজা, অন্ধকার।
আর সেই মুহূর্তে ও আস্তে করে বলে, শোনো।
আমি জানি ও গলার স্বর কার। ওর। একালের একটি মেয়ের। কান পাতি। একটা সুর গুনগুনিয়ে উঠছে আর কেটে কেটে যাচ্ছে কয়েকটি সাংসারিক আলোচনায়। একটি মামুলী গলার স্বর। যা শুধু কয়েকটা প্রাসঙ্গিক বিষয় জানায়, কয়েকটা প্রাসঙ্গিক বিষয় জানে। আর বানিয়ে তোলে একটা অপ্রাসঙ্গিক সত্যকে। যাদুকর অন্ধকার ঘেঁড়া ভেঁড়া হয়ে হারিয়ে যায়। ঘরের ম্লান আলোয়। আমি জানি এই আলোটাই ছিলো। এই আলোটাই আছে। স্নান। মামুলী। প্রাসঙ্গিক।
আমি বলি, বলো।
তারপর ওর দিকে তাকাই। বাইরের দিকে। একটা নির্ভুল জঙ্গমতা বেগার খেটে চলেছে দিনরাত। তার চিৎকার নেই, মত্ততা নেই, বিভ্রম নেই। মসৃণ, নিষ্করুণ, বৃহৎ। বাইরেটা অনেক অনেক বড়ড়া আমাদের চেয়ে। আমরা ছোটো, তুচ্ছ টুকরো। কোন্ মেশিনের সামনে ক-ঘণ্টা দিতে হবে আমাদের জানা! জঙ্গমটা বদলে যাওয়ার আগে কি করে ক্ষয়ে যেতে হবে আমাদের জানি! ওর দিকে তাকাই। নানা পথ, নানা দায়, নানা মোড় ও ঘুরে এসেছে। কাউকে ভুলিয়েছে, কাউকে ঠকিয়েছে, কাউকে ফিরিয়েছে। অনেক সয়েছে ও। অনেক। কিন্তু কেন? অনেক সয়েছি আমি, কেন? অনেক সয়েছি আমরা লু অপ্রাসঙ্গিক, তুচ্ছ, টুকরো, নিষ্ফল, শূন্য।
আমি বলি, বলো। আর কি বলছি সেটা কিছু নয়। কি সুর বাজছে। সুরটা নিষ্ফলতার, শূন্যতার। আর করুণা করতে চাই নিজেকে। না, করুণা করতে চাই না। একটা কষ্ট আছে আমাদের সকলকে ঘিরে। সেই কষ্টের নাম জীবন। কষ্টটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আমাদের। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকার নাম জীবন। কিন্তু কেন? ঋষিপত্নী বলেছিলো, কি করে মৃত্যুকে অতিক্রম করবো? তার চেয়ে ভালো বুদ্ধের ধ্যান, কি করে জীবন অতিক্রম করে পৌঁছ শূন্যে, কিছুই না এমন একটা কিছুতে। কিছুই না, কোনো কথাই বলি না আর। ও আমার দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকেই চেয়ে আছে এখনো। ও অনেক সয়েছে। কিন্তু কী এসে যায় যদি একটা মেয়ে দৈনিক বরাদ্দ মেহনতের পর দোকান থেকে কিছু কেনাকাটা করে। কাউকে ঠকায়। কাউকে ফেরায়, কাউকে ভোলায়। তারপর আবার হেঁটে যায় ভিড়ের মধ্যে দিয়ে, অনেক পথ অনেক মোড় অনেক দায়ের মাঝখানে। কী এসে যায় যদি কেউ বলে, শোনো, অথবা না বলে। কী এসে যায় যদি আমি বলি বলল, অথবা না বলি। বাইরেটা নিষ্করুণ, মসৃণ। এক মুহূর্তের আত্মরক্ষা আমাদের সাংসারিকতায়, না সাংসারিকতা নয় করুণায়। করুণায় নয়, কামে। না কামে নয় নিষ্করুণ শূন্যতায়। বৃহৎ জঙ্গমটাকে আমরা উত্তীর্ণ হবো শূন্যতায়। কিছু একটা শুনতে চাই ওর কাছ থেকে। আমাদের মাঝখানে একটা নিষ্পাপ, নিপ্রেম শূন্যতা। শূন্যতার ওপার থেকে ও ডেকেছে, শোনো। আমি ওকে ডাকি, বলো। কাছে আসতে চাই আমরা। কিন্তু কাছে আসার মূর্তিটা ফিরে যাওয়ার মতো। শূন্যতার ওপার থেকে ওকে ডাকি। সে ডাকটা ফিরে চলার মতো। শূন্যতার ওপার থেকে আরো ওপারে ওর ফিরে চলা। শূন্যতার এপার থেকে আরো এপারে আমার নিষ্ক্রমণ, এক নিষ্পাপ, নিপ্রেম বিশ্বের শূন্যতায় দুই গাণিতিক নক্ষত্র। গাণিতিক নক্ষত্র। গাণিতিক সেই শূন্যতায় কাছে আসাটা দূরে চলে যাওয়ার মতো সীমাটা অনন্তের মতো।