বিছার কামড়ের মতো কেমন একটা দংশন-জ্বালা বুকের অন্তরতম কোণে অনুভব করলুম। ভাবলুম স্বভাব-দুর্গন্ধ যে ফুল, সে দোষ তো সে ফুলের নয়। সে দোষ যদি দোষ হয়, তবে তা স্রষ্টার। অথচ তার বুকেও যে সুবাস আছে, তা বিশ্লেষণ করে দেখতে পারে অসাধারণ যে সে-ই; সাধারণে কিন্তু তার নিকটে গেলেই মুখে কাপড় দেয়, নাক সিঁটকায়। …আমি ছিন্নকণ্ঠ বিহগের মতো আহত স্বরে বললুম, ‘তা – তা হোক মেহের-নেগার! সে দোষ তো তোমার নয়। তুমি ইচ্ছা করলে কি পবিত্র পথে চলতে পার না? স্রষ্টার সৃষ্টিতে তো তেমন অবিচার নেই। আর বোধ হয় এমনই ভাগ্যহত যারা তাদের প্রতিই তাঁর করুণা, অন্তত সহানুভূতি একটু বেশি পরিমাণেই পড়ে, এ যে, আমরা না ভেবেই পারি নে!… আর তুমি তো আমায় সত্য করে ভালোবেসেছ! এ ভালোবাসায় যে কৃত্রিমতা নেই, তা আমি যে আমার হৃদয় দিয়ে বুঝতে পারছি। আর এ প্রেমের আসল নকল দুটি হৃদয় ছাড়া সারা বিশ্বের কেউ বুঝতে পারবে না।…হাঁ, আর ভালোবাসায় জীব যখন কাঁদতে পারে, তখন সে অনেক উঁচুতে উঠে যায়। নীচের লোকেরা ভাবে, ‘এ লোকটার অধঃপতন নিশ্চিত’। অবশ্য একটু পা পিছলে গেলেই যে সে অত উঁচু হতে একেবারে পাতালে এসে পড়বে, তা সেও বোঝে। তাই সে কারুর কথা না শুনে সাবধানে অমনি উঁচুতে উঠতে থাকে। …না মেহের-নেগার, তোমাকে আমার হতেই হবে।’ … সে স্থির হয়ে বসল, তারপর মূর্ছাতুরের মতো অস্পষ্ট কণ্ঠে কইলে, ‘ঠিক বলেছ য়ুসোফ, আমার সামনে অনেকেই এল, অনেকেই ডাকল; কিন্তু আমি কোনোদিন তো এমন করে কাঁদিনি। যে আমার সামনে এসে তার ভরা অর্ঘ্য নিয়ে দাঁড়িয়েছে, মনে হত আহা, একেই ভালোবাসি। এখন দেখছি, তা ভুল। সময় সময় যে অমন হয়, আজ বুঝেছি তা ক্ষণিকের মোহ আর প্রবৃত্তির বাইরের উত্তেজনা। কিন্তু যেদিন তুমি এসে বললে, তুমি আমারই, সে দিন আমার প্রাণমন সব কেন একযোগে সাড়া দিয়ে উঠল, ‘হ্যাঁগো হ্যাঁ, আমার সব তোমারই। ওঃ, সে কি অনাবিল গভীর প্রশান্ত প্রীতির জোয়ার ছুটে গেল ধমনীর প্রতি রক্ত-কণিকায়! সে এমন একটা মধুর সুন্দর ভাব, যা মানুষে জীবনে একবার মাত্র পেয়ে থাকে, – সেটা আমি ঠিক বুঝতে পারছি নে! আমাদের এই ভালোবাসায় আর দরবেশের প্রেমের সমান গভীরতা, এ আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি, যদি সেই ভালোবাসা চিরন্তন হয়!’ …ক্লান্ত কান্তার মতো সে আমার স্কন্ধে মাথাটা ভর করে আস্তে আস্তে কইলে, ‘তোমাকে পেয়েও যে এই আমি তোমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছি, এ তোমাকে ভালোবাসতে, – প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে পেরেছি বলেই! … আমার – আমার বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে য়ুসোফ, তবে তোমাকে পাওয়ার আশা আমাকে জোর করে ত্যাগ করতেই হবে। যাকে ভালোবাসি তারই অপমান তো করতে পারি নে আমি! এইটুকু ত্যাগ, এ আমি খুব সইতে পারব। অভাগিনী নারী জাতি, আমাদের এর চেয়েও যে অনেক বড়ো ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। তোমরা যাই-ই ভাব, আমাদের কাছে এ কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয়, আর কঠিনও নয়।… ওঃ, কেন তুমি আমার পথে এলে? কেন তোমার শুভ্র শুচি প্রেমের সোনার পরশ দিয়ে আমার অ-জাগন্ত ভালোবাসা জাগিয়ে দিলে? – না তোমাকে না পেলেও তুমি থাকবে আমারই। তবু আমাদের দুজনকে দুদিকে সরে যেতে হবে। – যে বুকে প্রেম আছে, সেই বুকেই কামনা ওত পেতে বসে আছে। আমাদের নারীর মনকে বিশ্বাস নেই য়ুসোফ, সে যে বড়োই কোমল, সময়ে একটু তাপেই গলে পড়ে। কে জানে এমন করে থাকলে কোনো দিন আমাদের এই উঁচু জায়গা হতে অধঃপতন হবে। … না, না প্রিয়তম, আর এই কলুষবাষ্পে তোমার স্বচ্ছ দর্পণ ঝাপসা করে তুলব না। … আর হয়তো আমাদের দেখা হবে না। যদি হয়, তবে আমাদের মিলন হবে ওই – ওইখানে যেখানে আকাশ আর দরিয়া দুই উদার অসীমে কোলাকুলি করছে! … বিদায় প্রিয়তম! বিদায়!!’ বলেই সে আমার হস্ত চুম্বন করে উন্মাদিনীর মতো ছুটে বেরিয়ে গেল।
ঝড় বইছিল শন – শন – শন। আর অদূরের বেণুবনে আহত হয়ে তারই কান্না শোনা যাচ্ছিল আহ্ – উহ্ – আহ্! স্নায়ুছিন্ন হওয়ার মতো কট কট করে বেদনার্ত বাঁশগুলোর গিঁটে গিঁটে শব্দ হচ্ছিল।
এক বুক ব্যথা নিয়ে ফিরে এলুম! ফিরতে ফিরতে চোখের জলে আমার মনে পড়ল – সেই আমার স্বপ্নরানির শেষ কথা! সেও তো এর মতোই বলেছিল, ‘আমাদের মিলন হবে এই উদার আকাশের কোলে এমনই এক তরুণ অরুণিমা-রক্ত-নিশিভোরে যখন বিদায় বাঁশির সুরে সুরে ললিত বিভাসের কান্না তরল হয়ে ক্ষরবে।’
[ ঘ ]
সেদিন যখন আমায় একেবারে বিস্ময়-পুলকিত আর চকিত করে সহসা আমার জন্মভূমি-জননী আমার বুকের রক্ত চাইলে, তখন আমার প্রাণ যে কেমন ছটফট করে উঠল তা কইতে পারব না! … শুনলুম আমাদের স্বাধীন পাহাড়িয়া জাতিটার উপর ইংরেজ আর কাবুলের আমির দুজনারই লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে। আর কয়েকজন দেশদ্রোহী শয়তান দুভাগে বিভক্ত হয়ে দেশটাকে অন্যের হাতে তুলে দিতে যাচ্ছে। তারা ভুলে যাচ্ছে যে, আমাদের এই ঘরবাড়িহীন পাঠানদের বশে আনতে কেউ কখনও পারবে না। আমরা স্বাধীন – মুক্ত। সে যেই হোক না কেন, আমরা কেন তার অধীনতা স্বীকার করতে যাব? শিকল সোনার হলেও তা শিকল। – না, না, যতক্ষণ এই য়ুসোফ খাঁর এক বিন্দু রক্ত থাকবে গায়ে আর মাথাটা ধড়ের সঙ্গে লাগা থাকবে, ততক্ষণ কেউ, কোনো অত্যাচারী সম্রাট আমার জন্মভূমির এক কণা বালুকাও স্পর্শ করতে পারবে না! ওঃ একি দুনিয়াভরা অবিচার আর অত্যাচার, খোদা তোমার এই মুক্ত সাম্রাজ্যে? এই সব ছোটো মনের লোকই আবার নিজেদের ‘উচ্চ’ ‘মহান’ ‘বড়ো’বলে নিজেদের ঢাক পিটায়। – ওঃ যদি তাই হয়, তাহলে আমাদের অবস্থা কেমন হবে, যেমন আকাশের অনেকগুলো পাখিকে ধরে এনে চারিদিকে লোহার শিক দেওয়া একটা খাঁচার ভিতর পুরে দিলে হয়। ওঃ আমার সমস্ত স্নায়ু আর মাংসপেশীগুলো ফুলে ফুলে উঠছে! আরও শুনছি দুইপক্ষেই আমাদিগকে রীতিমত ভয় দেখান হচ্ছে। – হাঃ হাঃ হাঃ! গাছের পাখিগুলোকে বন্দুক দেখিয়ে শিকারি যদি বলে, ‘সব এসে আমার হাতে ধরা দেও, নইলে গুলি ছাড়লুম!’ তাহলে পাখিরা এসে তার হাতে ধরা দেবে? কখনই না, তারা মরবে, তবুও ধরা দেবে না – দেবে না! শিকারিদের বুকে যে ছুরি লুকানো আছে, তা পাখিরা আপনিই বোঝে। এ তাদের শিখিয়ে দিতে হয় না। হাঁ, আর যদিই যোগ দিতে হয়, তবে নিজের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রেখে যেখানে অন্যায় দেখব সেইখানেই আমাদর বজ্রমুষ্টির ভীম তরবারির আঘাত পড়বে! আমার জন্মভূমি কোনো বিজয়ীর চরণ স্পর্শে কখনও কলঙ্কিত হয়নি, আর হবেও না। ‘শির দিব, তবু স্বাধীনতা দিব না’।