আমি বললুম, ‘দেখ, তুমি বড্ড দুষ্টু!’ সে বললে, ‘আচ্ছা, আমি আর হাসব না! তুমি কীসের কবিতা লেখ?’ আমি বললুম, ‘ভালোবাসার!’
সে ভিজা কাপড়ের একটা কোণ নিংড়াতে নিংড়াতে বললে, ‘ও তাই, – তা কাকে উদ্দেশ করে?’
আমি সেইখানেই সবুজ ঘাসে বসে পড়ে বললুম, ‘তোমাকে – মেহের-নেগার! তোমাকে উদ্দেশ করে।’ আবার তার মুখে যেন কে এক থাবা আবির ছড়িয়ে দিলে। সে কলসিটা কাঁখে আর একবার সামলে নিয়ে বললে, ‘তুমি কদ্দিন হতে এরকম কবিতা লিখছ?’ আমি বললুম, ‘যেদিন হতে তোমায় খোওয়াবে দেখেছি।’ সে বিস্ময়-পুলকিত নেত্রে আমার দিকে একবার চাইলে, তার পর বললে, ‘তুমি এখানে কী কর?’ আমি বললুম, ‘গান-বাজনা শিখি।’ সে বললে, ‘কোথায়?’ আমি বললুম, ‘খাঁ সাহেবের কাছে।’ সে খুব উৎসাহের সঙ্গে বললে, ‘একদিন তোমার গান শুনবখন। – শুনাবে?’ তারপর চলে যেতে যেতে পিছন ফিরে বললে, ‘আচ্ছা, তোমার ঘর কোন্খানে?’ আমি বললুম, ‘ওয়াজিরিস্তানের পাহাড়।’ সে অবাক বিস্ময়ে ডাগর চক্ষু দিয়ে অনেকক্ষণ আমার দিকে চাইলে; তারপর স্নিগ্ধকণ্ঠে বললে, ‘তুমি তাহলে এদেশের নও? এখানে নূতন এসেছ?’ – আমি তার চোখে রেখে বললুম, ‘হুঁ,– আমি পরদেশি।’ … সে চুপি চুপি চলে গেল আর একটিও কথা কইলে না। … আমার গলার তখন বড্ড বেদনা, কে যেন টুঁটি চেপে ধরেছিল। পেছন হতে ঘাসের শ্যামল বুকে লুটিয়ে পড়ে, আবার ডাকলুম তাকে। কাঁখের কলসি তার ঢিপ করে পড়ে ভেঙ্গে গেল। সে আমার দিকে একটা আর্তদৃষ্টি হেনে বললে, ‘আর ডেকো না অমন করে।’ দেখলুম তার দুই কপোল দিয়ে বেয়ে চলেছে দুইটি দীর্ঘ অশ্রু-রেখা।
[ খ ]
প্রাণপণে চেষ্টা করেও সেদিন সুর-বাহারটার সুর বাঁধতে পারলুম না। আদুরে মেয়ের জেদ-নেওয়ার মতো তার ঝংকারে শুধু একরোখা বেখাপ্পা কান্না ডুকরে উঠছিল। আমার হাতে আমার এই প্রিয় যন্ত্রটি আর কখনও এমন অশান্ত অবাধ্য হয়নি, এমন একজিদে কান্নাও কাঁদেনি। আদর-আবদার দিয়ে অনেক করেও মেয়ের কান্না থামাতে না পারলে মা যেমন সেই কাঁদুনে মেয়ের গালে আরও দু-তিন থাপ্পড় বসিয়ে দেয়, আমিও তেমনই করে সুর-বাহারের তারগুলোতে অত্যাচারের মতো হাত চালাতে লাগলুম। সে নানান রকমের মিশ্রসুরে গোঙানি আরম্ভ করে দিলে!
ওস্তাদজী আঙ্গুর-গালা মদিরার প্রসাদে খুব খোশ-মেজাজে ঘোর দৃষ্টিতে আমার কাণ্ড দেখছিলেন। শেষে হাসতে হাসতে বললেন, ‘কি বাচ্চা, তোর তবিয়ত আজ ঠিক নেই, – না? মনের তার ঠিক না থাকলে বীণার তারও ঠিক থাকে না। মন যদি তোর বেসুরা বাজে, তবে যন্ত্রও বেসুরা বাজবে, এ হচ্ছে খুব সাচ্চা আর সহজ কথা। – দে আমি সুর বেঁধে দিই!’ ওস্তাদজি বেয়াদব সুর-বাহারটার কান ধরে বার কতক মোলায়েম ধরনের কানুটি দিতেই সে শান্তশিষ্ট ছেলের মতো দিব্যি সুরে এল। সেটা আমার হাতে দিয়ে, সামনের প্লেট হতে দুটো গরম গরম শিক কাবাব ছুরি দিয়ে ছাড়াতে ছাড়াতে তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, একবার বাগেশ্রী রাগিণীটা আলাপ কর তো বাচ্চা! হাঁ, – আর ও সুরটা ভাঁজবারও সময় হয়ে এসেছে। এখন কত রাত হবে? হাঁ, আর দেখ বাচ্চা, তুই গলায় আর একটু গমক খেলাতে চেষ্টা কর তাহলেই সুন্দর হবে।’ কিন্তু সেদিন যেন কণ্ঠভরা বেদনা! সুরকে আমার গোর দিয়ে এসেছিলুম ওই ঝিলম দরিয়ার তীরের বালুকার তলে। তাই কষ্টে যখন অতি-তারের কোমল গান্ধারে উঠলুম তখন আমার কণ্ঠ যেন দীর্ণ হয়ে গেল, আর তা ফেটে বেরুল শুধু কণ্ঠভরা কান্না! ওস্তাদজি দ্রাক্ষারসের নেশায় ‘চড় বাচ্চা আর দু-পরদা পঞ্চমে–‘ বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে সান্ত্বনাভরা স্বরে কইলেন, ‘কী হয়েছে আজ তোর বাচ্চা? দে আমায় ওটা।’ বাগেশ্রীর ফোঁপিয়ে-ফোঁপিয়ে-কান্না ওস্তাদজির গভীর কণ্ঠ সঞ্চরণ করতে লাগল অনুলোমে বিলোমে – সাধা গলার গমকে মিড়ে! তিনি গাইলেন, ‘বীণা-বাদিনীর বীণ আজ আর রোয়ে রোয়ে বনের বুকে মুহুর্মুহু স্পন্দন জাগিয়ে তুলছে না। আঁশু এসে তার কণ্ঠ চেপে ধরেছে। তাই সুর পূর্ণ হয়ে বেরোচ্ছে না। ওগো, তার যে খাদের আর অতি-তারের দুইটি তারই ছিন্ন হয়ে গেছে!’ আমার তখন ওদিকে মন ছিল না। আমার মন পড়েছিল সেই আমার স্বপ্নে-পাওয়া তরুণিটির কাছে।
ওঃ, সে স্বপ্নের চিন্তাটা এত বেশি তীব্র মধুর, তাতে এত বেশি মিঠা উন্মাদনা যে দিনে হাজার বার মনে করেও আমার আর তৃপ্তি হচ্ছে না। সে কী অতৃপ্তির কন্টকে বিঁধে গেল আমার মর্মতলে, ওগো আমার স্বপ্ন-দেবী! ওই কাঁটা যে হৃদয়ে বিঁধেছে, সেইটেই এখন পেকে সারা বুক বেদনায় টনটন করছে! ওগো আমার স্বপ্নলোকের ঘুমের দেশের রানি! তোমার সে আকাশ-ঘেঁষা ফুল, আর পরাগ-পরিমলে-ভরা দেশ কোথায়? সে জ্যোৎস্না-দীপ্ত কুটির যেখানে পায়ের আলতা তোমার রক্তরাগে পাতার বুকে ছোপ দিয়ে যায়, সে কুটির কোন্ নিকুঞ্জের আড়ালে, কোন্ তড়াগের তরঙ্গ-মর্মরিত তীরে?
সে স্বপ্নচিত্রটা কী সুন্দর!–
সেদিন সাঁঝে অনেকক্ষণ কুস্তি করে খুব ক্লান্ত হয়ে যেমনি বিছানায় গা দিয়েছি, অমনি যেন রাজ্যের ঘুম এসে, আমার সারা দেহটাকে নিষ্কম্প অলস করে ফেললে, আমার চোখের পাতায় পাতায় তার সোহাগ-ভরা ছোঁয়ার আবেশ দিয়ে। শীঘ্রই আমার চেতনা লুপ্ত করে দিলে সে যেন কার শিউরে-উঠা কোমল অধরের উন্মাদনা-ভরা চুম্বন-মদিরা! …. হঠাৎ আমি চমকে উঠলুম! …. কে এসে আমার দুইটি চোখেই স্নিগ্ধ কাজল বুলিয়ে দিলে! দেখলুম, যেখানে আশমান আর দরিয়া চুমোচুমি করছে, সেইখানে একটি কিশোরী বীণা বাজাচ্ছে; বরফের ওপর পূর্ণ-চাঁদের চাঁদনি পড়লে যেমন সুন্দর দেখায়, তাকে তেমনি দেখাচ্ছিল, সূক্ষ্ম রেশমি নীল পেশোয়াজের শাসন টুটে বীণাবাদিনীর কৈশোর-মাধুর্য ফুটে বেরুচ্ছিল – আশমানের গোলাবি নীলিমায় জড়িত প্রভাত অরুণশ্রীর মতো মহিমশ্রী হয়ে! সে আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকলে। আমার চোখের ঘুমের রঙিন কুয়াশা মসলিনের মতো একটা ফিনফিনে পরদা টেনে দিলে। বীণার চেয়েও মধুর বীণাবাদিনীর মঞ্জু গুঞ্জন প্রেয়সীর কানে-কানে-কওয়া গোপন কথার মতো আমায় কয়ে গেল, ‘ওই যে চাঁদের আলোয় ঝিলমিল করছে দরিয়ার কিনার, ওইখানেই আমার ঘর। ওইখানেই আমি বীণ বাজাই। তোমার ওই সরল বাঁশির সহজ সুর আমার বুকে বেদনার মতো বেজেছে, তাই এসেছি! আবার আমাদের দেখা হবে সূর্যাস্তের বিদায়-ম্লান শেষ-আলোকতলে। আর মিলন হবে এই উদার আকাশের কোলে এমনই এক অরুণ-অরুণিমা-রক্ত নিশিভোরে – যখন বিদায় বাঁশির ললিত বিভাসের কান্না তরল হয়ে ঝরে পড়বে।’ আমি আবিষ্টের মতো তার আঁচল ধরে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘কে তুমি, স্বপ্নরানি?’ সে বললে, ‘আমায় চিনতে পারলে না য়ুসোফ? আমি তোমারই মেহের-নেগার।’ অচিন্ত্য অপূর্ব অনেক কিছু পাওয়ার আনন্দে আমার বুক ভরে উঠেছিল। আমি রুদ্ধ কণ্ঠে কইলুম, ‘আমায় কী করে চিনলে? – হাঁ, আমি তোমাকেই চাইছিলুম – তবে তোমার নাম জানতুম না। আর তোমায় নাকি অনেকেই জীবনের এমনি ফাগুন-দিনে ডাকে? তবে শুধু কি আমায়ই দেখা দিলে, আর কাউকে না?’ সে তার তাম্বূলরাগ-রক্ত পাপড়ির মতো পাতলা ঠোঁট উলটিয়ে বললে, ‘না – আমি তোমায় কী করে চিনব? – এই হালকা হাওয়ায় ভেসে আমি সব জায়গাতেই বেড়াই; কাল সাঁঝে তাই এদিক দিয়ে পেরিয়ে যেতে যেতে শুনলুম তুমি আমায় বাঁশির সুরে কামনা করছ! তাই তোমায় দেখা দিলুম। …. আর, হাঁ – যারা তোমার মতো এমনি বয়সে এমনি করে তাদের অজানা অচেনা প্রেয়সীর জন্য কেঁদে মরে, কেবল তাকেই দেখা দিয়ে যাই। … তবু আমি তোমারই!’ … মেঘের কোলে সে কিশোরীর কম-মূর্তি ঝাপসা হয়ে এল।