আদরিনী অভিমানী বধূর মতো সন্ধ্যা তার মুখটাকে ক্রমশই কালিপানা আঁধার করে তুলছিল। এমন সময় কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয়া তিথির এক-আকাশ তারা তাকে ঘিরে বললে, ‘সন্ধ্যারানি! বলি এত মুখভার কীসের? এত ব্যস্ত হসনে লো, ওই চন্দ্রদেব এল বলে!’ অপ্রতিভ বেচারি সন্ধ্যার মুখে জোর করে হাসার সলজ্জ-মলিন ঈষৎ আলো ফুটে উঠল। চাঁদ এল মদখোর মাতালের মতো টলতে টলতে, চোখ মুখ লাল করে। এসেই সে জোর করে সন্ধ্যা বধূর আবরু ঘোমটা খুলে দিলে। সন্ধ্যা হেসে ফেললে। লুকিয়ে-দেখা বউ-ঝির মতো একটা পাখি বকুল গাছের থেকে লজ্জারাঙা হয়ে টিটকারি দিয়ে উঠল, ‘ছি-ছি’। তারপর চাঁদে আর সন্ধ্যায় অনেক ঝগড়াঝাঁটি হয়ে সন্ধ্যার চিবুক আর গাল বেয়ে খুব খানিক শিশির ঝরবার পর সে বেশ খুশি মনেই আবার হাসি-খেলা করতে লাগল। কতকগুলো বেহায়া তারা ছাড়া অধিকাংশকেই আর দেখা গেল না।
আমার বিজন কুটিরে ফিরে এলুম। চাঁদ উঠেছে, তাই আর প্রদীপ জ্বাললুম না। আর, জ্বালালেও দীপশিখার ওই ম্লান ধোঁয়ার রাশটা আমার ঘরের বুকভরা অন্ধকারকে একেবারে তাড়াতে পারবে না। সে থাকবে লুকিয়ে পাতার আড়ালে, ঘরের কোণে, সব জিনিসেরই আড়ালে; ছায়া হয়ে আমাকে মধ্যে রেখে ঘুরবে আমারই চারপাশে! চোখের পাতা পড়তে না পড়তে হড়পা বানের মতো হুপ করে আবার সে এসে পড়বে – যেই একটু সরে যাবে এই দীপশিখাটি! – ওগো আমার অন্ধকার! আর তোমায় তাড়াব না। – আজ হতে তুমি আমার সাথি, আমার বন্ধু, আমার ভাই!– বুঝলে ভাই আঁধার, এই আলোটার পেছনে খামখা এতগুলো বছর ঘুরে মরলুম!
আমি বললুম, ‘ওগো মেহের-নেগার! আমার তোমাকে চাই-ই। নইলে যে আমি বাঁচব না! তুমি আমার। নইলে এত লোকের মাঝে তোমাকে আমি নিতান্ত আপনার বলে চিনলুম কী করে? – তুমিই তো আমার স্বপ্নে পাওয়া সাথি! – তুমি আমার, নিশ্চয়ই আমার!’ – চলতে চলতে থমকে দাঁড়িয়ে সে আমার পানে চাইলে, পলাশ ফুলের মতো ডাগর টানাটানা কাজল-কালো চোখ দুটির গভীর দৃষ্টি দিয়ে আমার পানে চাইলে! কলসিটি-কাঁখে ওই পথের বাঁকেই অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল সে। তারপর বললে, ‘আচ্ছা,– তুমি পাগল?’ – আমি ঢোক গিলে, একরাশ অশ্রু ভিতর দিকে ঠেলে দিয়ে মাথা দুলিয়ে বললুম, ‘হুঁ’! তার আঁখির ঘনকৃষ্ণ পল্লবগুলোতে আঁশু উথলে এল! তারপর সে তাড়াতাড়ি চলে যেতে যেতে বললে, ‘আচ্ছা, আমি তোমারই!’
একটা অসম্ভব আনন্দের জোর ধাক্কায় আমি অনেকক্ষণ মুষড়ে পড়েছিলুম। চমকে উঠে চেয়ে দেখলুম, সে পথের বাঁক ফিরে অনেক দূর চলে যাচ্ছে।
আমি দৌড়ুতে দৌড়ুতে ডাকলুম, ‘মেহের-নেগার’! সে উত্তর দিল না। কলসিটাকে কাঁখে জড়িয়ে ধরে ডান হাতটাকে তেমনি ঘন ঘন দুলিয়ে সে যাচ্ছিল। তারপর তাদের বাড়ির সিঁড়িতে একটা পা থুয়ে দিয়ে আমার দিকে তিরস্কার-ভরা মলিন চাওয়া চেয়ে গেল। আর বলে গেল, ‘ছি! পথে-ঘাটে এমন করে নাম ধরে ডেকো না! – কী মনে করবে লোকে!’ পথ না দেখে দৌড়ুতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে একবার পড়ে গেছিলুম, তাতে আমার নাক দিয়ে তখনও ঝরঝর করে খুন ঝরছিল! আমি সেটা বাঁ-হাত দিয়ে লুকিয়ে বললুম, ‘আঃ, তাইতো। – আর অমন করে ডাকব না।’
বুঝলে সখা আঁধার! যে জন্মান্ধ, তার তত বেশি যাতনা নেই, যত বেশি যাতনা আর দুঃখ হয় – একটা আঘাত পেয়ে যার চোখ দুটো অন্ধ হয়ে যায়। কেননা, জন্মান্ধ তো কখনও আলোক দেখেনি। কাজেই এ জিনিসটা সে বুঝতে পারে না,আর যে জিনিস সে বুঝতে পারে না তা নিয়ে তার তত মর্মাহত হওয়ারও কোনও কারণ নেই। আর, এই একবার আলো দেখে তারপর তা হতে বঞ্চিত হওয়া, – ওঃ কত বেশি নির্মম নিদারুণ!
তোমায় ছেড়ে চলে যাওয়ার যে প্রতিশোধ নিলে তুমি, তাতে ভাই আঁধার, আর যেন তোমায় ছেড়ে না যাই। তোমায় ছোটো ভেবে এই যে দাগা পেলাম বুকে ওঃ তা, –
সেদিন ভোরে ঝিলম নদীর কূলে তার সঙ্গে আবার দেখা হল। সে আসছিল একা নদীতে স্নান করে। কালো কশকশে ভেজা চুলগুলো আর ফিরোজা রঙের পাতলা উড়ানিটা ব্যাকুল আবেগে তার দেহ-লতাকে জড়িয়ে ধরেছিল। আকুল কেশের মাঝে সদ্যস্নাত সুন্দর মুখটি তার দিঘির কালোজলে টাটকা ফোটা পদ্মফুলের মতো দেখাচ্ছিল। দূরে একটা জলপাই গাছের তলায় বসে সরল রাখাল বালক গাচ্ছিল, –
গৌরী ধীরে চলো, গাগরি ছলক নাহি যায় –
শিরোপরি গাগরি, কমর মে ঘড়া,
পাতরি মকরিয়া তেরি বলখ না যায়, আহা টুট না যায়; –
গৌরী ধীরে চলো।
আমিও সেই গানের প্রতিধ্বনি তুলে বললুম, ‘ওগো গৌরবর্ণা কিশোরী, একটু ধীরে চলো, – ধীরে। – তোমার ভরা কুম্ভ হতে জল ছলকে পড়বে যে। অত সূক্ষ্ম তোমার কটিদেশ ভরা গাগরি আর ঘড়ার ভারে মুচকে ভেঙে যাবে যে! ওগো তন্বী গৌরী, ধীরে একটু ধীরে চলো!’ আমায় দেখে তার কানের গোড়াটা সিঁদুরের মতো লাল হয়ে উঠল। আমার দিকে শরম-অনুযোগভরা কটাক্ষ হেনে সে বললে, ছি, ছি, সরে যাও। একী পাগলামি করছ?’ – আমি ব্যথিত-কণ্ঠে ডাকলুম, ‘মেহের-নেগার!’ সে একবার আমার রুক্ষ কেশ, ব্যথাতুর মুখ ধুলিলিপ্ত দেহ আর ছিন্ন মলিন বসন দেখে কী মনে করে চুপটি করে দাঁড়াল। তারপর ম্লান হেসে বললে ‘ও হল! আমার নাম “মেহের-নেগার” কে বললে? – আচ্ছা, তুমি আমায় ও নামে ডাক কেন? সে তোমার কে?’ আমি দেখলুম, কী একটা ভীতি আর বিস্ময় তার স্বরটাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়ে গেল। তার শঙ্কাকুল বুকে ঘন স্পন্দন মূর্ত হয়ে ফুটল। আমারও মনে অমনি বিস্ময় ঘনিয়ে এল। দৃষ্টি ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছিল। তাই তার গায়ে হেলান দিয়ে বললুম, ‘আহ! তুমি তবে সে নও? না-না, তুমি তো সেই আমার – আমার মেহের-নেগার! অমনই হুবহু মুখ, চোখ, – অমনই ভুরু, অমনই চাউনি, অমনই কথা! – না গো-না, আর আমায় প্রতারণা কোরো না। তুমি সেই! তুমি –‘! সে বললে, আচ্ছা, মেহের-নেগারকে কোথায় দেখেছিলে?’ আমি বললুম, ‘কেন, খোওয়াবে!’ তার মুখটা এক নিমিষে যেন দপ করে জ্বলে উঠল। তার সাদা মুখে আবার রক্ত দেখা গেল। সে ঝরনার মতো ঝরঝর করে হাসির ঝরা ঝরিয়ে বললে, ‘আচ্ছা, তুমি কবি, না চিত্রকর?’ আমি অপ্রতিভ হয়ে বললুম, ‘চিত্র ভালোবাসি, তবে চিত্রকর নই। আমি কবিতাও লিখি, কিন্তু কবি নই।’ সে এবার হেসে যেন লুটোপুটি খেতে লাগল।