নব পরিণীতা সখিনার এসব গুণ থাকা সত্ত্বেও আমি তাকে ভালোবাসতে পারলুম না। অনেক ‘রিহার্স্যাল’ দিলুম, কিছুতেই কিছু হল না। হৃদয় নিয়ে এ ছিনিমিনি খেলার অভিনয় যেন আর ভালো লাগছিল না। তাছাড়া তুমি বললে হয়তো বিশ্বাস করবে না, রাবেয়া যেন আমার হৃদয় জুড়ে রানির মতো সিংহাসন পেতে বসেছিল, সেখানে অন্য কারুর প্রবেশাধিকার ছিল না। একনিষ্ঠ প্রেমে মানুষকে এতটা আত্মহারা যদি না করে ফেলত তবে ‘কায়েস’ ‘মজনু’ হয়ে লায়লীর জন্য এমন করে বনে-পাহাড়ে ছুটে বেড়াত না, ফরহাদের ও-রকম পরিণাম হত না। সখিনা কত ব্যথা পাচ্ছে বুঝতে পারতুম, কিন্তু হায়, বুঝেও কিছু করতে পারতুম না। বিবাহিতা পত্নীর প্রতি কর্তব্যের অবহেলা আমার বুকে কাঁটার মতো বিঁধছিল। মা ক্ষুণ্ন হলেন, বোনেরা বউকেই দোষী সাব্যস্ত করে তালিম করতে লাগল। কিন্তু কোথায় কী ফাঁক রয়ে গেল জানি না, কিছুতেই তার হৃদয়ের সঙ্গে আমার হৃদয়ের মিশ খেল না। সে কেঁদে মাটি ভিজিয়ে দিলে, তবু মন ভিজল না। অনুশোচনার ও বাক্যজ্বালার যন্ত্রণায় বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এলুম। রাবেয়া আমার বুকে যে আঘাত করে গিয়েছিল তাই সইতে পারছিলুম না, তার উপর – হা খোদা, এ কী করলুম নিতান্ত অর্বাচীনের মতো? এ হতভাগিনির জীবন কেন আমার সঙ্গে এমন করে জড়িয়ে ফেললুম? অসহ্য এই বৃশ্চিক যন্ত্রণা কাঁটার মতো আমার আগেকার আঘাতটায় খোঁচা মারতে লাগল। আমি পাগল হয়ে যাওয়ার মতো হলুম। এরই মধ্যে রানিগঞ্জে এসে ‘টেস্ট একজামিনেশন’ দিলুম। সমস্ত বছর হট্টগোলে কাটিয়েছি। পাশ করব কোত্থেকে? আগেকার সে চুরি বিদ্যায়ও প্রবৃত্তি ছিল না – অর্থাৎ এখন সাফ বুঝতে পাচ্ছ যে, টেস্টে এলাউ হইনি; সুতরাং ওটা উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন। এই শুভ সংবাদ বাবার কর্ণগোচর হবা মাত্র তিনি কিঞ্চিদধিক এক দিস্তা কাগজ খরচ করে আমায় বিচিত্র সম্ভাষণের উপসংহারে জানিয়ে দিলেন যে, আমার মতো কুপুত্তুরের লেখাপড়া ওইখানেই খতম হবে তা তিনি বহু পূর্বেই আন্দাজ করে রেখেছিলেন, – অনর্থক এক রাশ টাকা জলে ফেলে দিলেন ইত্যাদি। আমার জানটা তেতবেরক্ত হয়ে উঠল। ‘দুত্তোর’ বলে দফতর গুটালুম। পরে, যা মনে আসতে লাগল তাই করতে লাগলুম। লোকে আমায় বহরমপুর যাওয়ার জন্য বিনা ফি-তে যেচে উপদেশ দিতে লাগল। আমি তাদের কথায় ‘ড্যামকেয়ার’ করে দিনরাত বোঁ হয়ে রইলুম। দু-চারদিন সইতে সইতে শেষে একদিন বোর্ডিং সুপারিনটেন্ডেন্ট মশাই শুভক্ষণে আমায় অর্ধচন্দ্র দিয়ে বিদায় দিলেন। আমি ফের বর্ধমানে চলে এলুম। আমাদের ছত্রভঙ্গদলের ভূতপূর্ব গুণ্ডাগণ আমায় সাদরে বরণ করে নিল। পিতা সব শুনে আমায় ত্যাজ্যপুত্র করলেন। এক বৎসর পরে খবর এল সখিনা আমায় নিষ্ঠুর উপহাস করে অজানার রাজ্যে চলে গেছে। মরবার সময়ও নাকি হতভাগিনি আমার মতো পাপিষ্ঠের চরণ-ধুলোর জন্য কেঁদেছে, আমার ছেঁড়া পুরোনো একটা ফটো বুকে ধরে মরেছে। ক্রমেই আমার রাস্তা ফরসা হতে লাগল। আরও ছয় মাস পর মা-ও চলে গেলেন। আমি তখন অট্টহাসি হেসে বোতলের পর বোতল উড়াতে লাগলুম। তারপর শুভক্ষণে পলটনে এসে সেঁদিয়ে পড়লুম বোম কেদারনাথ বলে। আর এক গ্লাস জল দিতে পারো ভাই?
মেহের-নেগার
ঝিলম্
বাঁশি বাজছে, আর এক বুক কান্না আমার গুমরে উঠছে। আমাদের ছাড়াছাড়ি হল তখন, যখন বৈশাখের গুমোটভরা উদাস-মদির সন্ধ্যায় বেদনাতুর পিলু-বারোঁয়া রাগিণীর ক্লান্ত কান্না হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বেরুচ্ছিল। আমাদের দুজনারই যে এক-বুক করে ব্যথা, তার অনেকটা প্রকাশ পাচ্ছিল ওই সরল-বাঁশের বাঁশির সুরে। উপুড়-হয়ে-পড়ে-থাকা সমস্ত স্তব্ধ ময়দানটার আশে-পাশে পথ হারিয়ে গিয়ে তারই উদাস প্রতিধ্বনি ঘুরে মরছিল! দুষ্ট দয়িতকে খুঁজে খুঁজে বেচারা কোকিল যখন হয়রান পেরেশান হয়ে গিয়েছে, আর অশান্ত অশ্রুগুলো আটকে রাখবার ব্যর্থ চেষ্টায় বারংবার চোখ দুটোকে ঘষে ঘষে কলিজার মতো রক্ত-লোহিত করে ফেলেছে, তখন তরুণী কোয়েলিটা তার প্রণয়ীকে এই ব্যথা দেওয়ায় বোধ হয় বাস্তবিকই ব্যথিত হয়ে উঠেছিল, – কেননা, তখনই কলামোচার আমগাছটার আগডালে কচি আমের থোকার আড়ালে থেকে মুখ বাড়িয়ে সকৌতুকে সে কুক দিয়ে উঠল ‘কু-কু-কু’। বেচারা শ্রান্ত কোকিল তখন রুদ্ধকণ্ঠে তার এই পাওয়ার আনন্দটা জানাতে আকুলি বিকুলি করে চেঁচিয়ে উঠল, কিন্তু ডেকে ডেকে তখন তার গলা বসে গিয়েছে, তবু অশোক গাছ থেকে ওই ভাঙা গলাতেই তার যে চাপা বেদনা আটকে যাচ্ছিল, তারই আঘাত খেয়ে সাঁঝের বাতাস ঝিলমতীরের কাশের বনে মুহুর্মুহু কাঁপন দিয়ে গেল।
আমি ডাক দিলুম, ‘মেহের-নেগার’! কাশের বনটা তার হাজার শুভ্রশিষ দুলিয়ে বিদ্রুপ করলে, ‘…আ…র’! ঝিলমের ওপারের উঁচু চরে আহত হয়ে আমারই আহ্বান কেঁদে ফেললে, আর সে রুদ্ধশ্বাসে ফিরে এসে এইটুকু বলতে পারলে, ‘মেহের-নেই-আর’!
পশ্চিমে সূর্যের চিতা জ্বলল এবং নিবে এল। বাঁশির কাঁদন থামল। মলয়-মারুত পারুল বনে নামল বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে। পারুল বললে, ‘উ-হু’ –মলয় বললে, ‘আ-হা–আঃ’।
আমি বুক ফুলিয়ে চুল দুলিয়ে মনটাকে খুব একচোট বকুনি দিয়ে আনন্দভৈরবী আলাপ করতে করতে ফিরলুম – আমার মতো অনেক হতভাগারই ওই ব্যথাবিজড়িত চলার পথ ধরে। এমন সাধা গলাতেও আমার সুরটার কলতান শুধু হোঁচট খেয়ে লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। আমার কিন্তু লজ্জা হচ্ছিল না। আমার বন্ধু তানপুরাটা কোলে করে তখন শ্রীরাগ ভাঁজছেন দেখলুম। তিনি হেসে বললেন, ‘কি য়ুসোফ! এ-আসন্ন সন্ধ্যা বুঝি তোমার আনন্দ-ভৈরবী আলাপের সময়? তুমি যে দেখছি অপরূপ বিপরীত!’ আমার তখন কান্না আসছিল। হেসে বললুম, ‘ভাই তোমার শ্রীরাগেরও তো সময় পেরিয়ে গেছে। সে বললে তাই তো! কিন্তু তোমার হাসি আজ এত করুণ কেন, –ঠিক পাথর-খোদা মূর্তির হাসির মতো হিম-শীতল আর জমাট? আমি উলটো দিকে মুখ ফিরিয়ে খুব তাড়াতাড়ি চলতে লাগলুম।