শুধু তেমনি অচল অটল হয়ে একটা বিরাট পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়েছিলেন মা!
শুধু তাঁর শেষ সময় বলেছিলেন, ‘বাপ রে, আমাকে তো কাঁদতে নেই, তুই তো আর আমার নস, তোকে খোদার কাছে কোরবানি দিয়েছি! খোদার নামে উৎসর্গীকৃত জিনিসে তো আমার অধিকার নেই! – তবে চল বাপ, তুই তো আমায় ছেড়ে এক মুহূর্তও থাকতে পারিসনে, আমিও তোকে কখনও চোখের আড়াল করিনি। তোর কাজ ফুরিয়েছে, আমারও কাজ ফুরাল আজ।’
কতকগুলো লোকের মগজ নাকি এমনই খারাপ হয়ে যায় যে, তারা এক একটা ছোট্ট মুহূর্তকেই একটা অখণ্ড কাল বলে ভাবে। তবে কী আমারও মাথা সেই রকম খারাপ হয়ে গেছে, তা না হলে আমার বোধ হচ্ছে কেন যে, এসব ঘটনা যেন বাবা আদমের কালে ঘটে গেছে, আর আমি এমনি করে গোরস্থানে বসেই আছি। তুই কিন্তু বলছিস, এই সেদিন তাঁরা মারা গেছেন। তবে তো আমি সত্যিই পাগল হয়ে গেছি।
কী বলছিস, এ গোরস্থানে এলুম কেন? – আহা, কথার ছিরি দেখ! এই গোরস্থানে যেখানে সব সত্যিকারের মানুষ শুয়ে রয়েছেন, সেখানে না এসে, যাব কী তবে বনে-জঙ্গলে যেখানে এক রকম জন্তু আছে, যাদের শুধু মানুষের মতো হাত পা আর অন্তরটা শয়তানের চেয়েও কুৎসিত কালো? – আমার বেশ মনে পড়ে, যখন তাঁর লাশ কাঁধে করে বাইরে আনা হল, তখন ওদের কে একজন আত্মীয় আমার চুল ধরে বললে, ‘যা শয়তানি, বেরো ঘর থেকে এখনি। তখনই বলেছিলুম, বুনিয়াদি খানদানের উপর নাল চড়ান, এ সইবে কেন? তোকে ঘরে এনে শেষে বংশে বাতি দিতে পর্যন্ত রইল না কেউ; বেরো রাক্ষুসি, আর গাঁয়ের লোকের সামনে মুখ দেখাস না। আর ইচ্ছা হয় চল, তোর আর একটা নেকা দিয়ে দি?’ – অত মার গাল কিছুই বাজে নাই আমার প্রাণে, যত বেজেছিল ওই একটা নেকার কথায়। ওই বিশ্রী কথাটা একটা মস্ত আঘাতের মতো বেজেছিল আমার চূর্ণ বক্ষে। – ওগো নেকা কী? সে কী দুবার অন্যের গলায় মালা দেওয়া? শাস্ত্রে নেকার কথা আছে, সে কাদের জন্যে? আচ্ছা ভাই, যারা বাধ্য হয়ে অন্নবস্ত্রাভাবে বা আকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়ে ও রকম করে ভালোবাসার অপমান করে, তাদের কী হৃদয় বলে কোনো একটা জিনিস নাই? তা হলেও তাদিগকে ক্ষমা করা যেতে পারে, কিন্তু যারা শুধু কামনার বশবর্তী হয়ে পবিত্রতাকে, নারীত্বকে ওরকম মাড়িয়ে চলে যায়, তাদের কোথাও ক্ষমা নাই। ভালোবাসা – স্বর্গের এমন পবিত্র ফুলকে কামনার শ্বাসে যে কলঙ্কিত করে, তার উপযুক্ত বোধ হয় এখনও কোনো নরকের সৃষ্টি হয় নাই।
‘মউলবি সাহেবরা হয়তো খুব চটে আমার ‘জানাজার নামাজ’ই পড়বেন না, কিন্তু মানুষ আর মউলবিতে অনেক তফাত – শাস্ত্র আর হৃদয়, অনেকটা তফাত।
[ চ ]
যেখানে শুধু এই রকম অবমাননা, সেখান থেকে সরে এসে মরার দেশে থাকাই ভালো।
* * *
ওকি, তুমি এমন করে আঁতকে উঠলে কেন? আমি মূর্ছা গেছলুম বলে? – কী বলচ, আমি বিষ খেয়েছি? – তা হলে তুমিও পাগল হয়েছ! আমার চেহারা এমন নীল হয়ে গেছে দেখে তুমি হয়তো মনে করেছ, আমি বিষ খেয়েছি। না গো না, আমি পাগল হই আর যা-ই হই ওরকম দুর্বলতা আমার মধ্যে নেই। কেরোসিনে পোড়া, জলে ডোবা, গলায় দড়ি দেওয়া, বিষ খাওয়া মেয়েদের জাতটার যেন রোগের মধ্যে দাঁড়িয়েছে। আমার কপাল পুড়লেও আমি ওরকম ‘হারামি মওতকে’ প্রাণ থেকে ঘৃণা করি। এ মরায় যে এ-দুনিয়া ও আখের উভয়ের খারাবি, বোন।
কাল রাত্রে ভয় পেয়ে যখন তুই আমার কাছ হতে চলে গেলি, তার একটু পর থেকেই আমার ভেদবমি আরম্ভ হয়েছে। এই একটু আগে আমার জ্ঞান হল।
আমি বুঝতে পেরেছি বোন, আমার আর সময় নাই। আর কারুর চোখের জলের বাধা আমায় বেঁধে রাখতে পারবে না। ওঃ এত দিনে ওই নদীর পারের অলস-ঘুমে ভরা সুরটা আমার প্রাণে গভীর স্পর্শ করে গেল। সে কত গভীর দুঃখ ভরা। পানি আমার চোখের কোল ছেয়ে ফেলেছে দিদি। তার কোমল স্পর্শ আমার চোখের পাতায় পাতায় অনুভব করছি। কী শিহরন আমার প্রতি লোমকূপে খেলে বেড়াচ্ছে।
কী পিপাসা, কী বুক-ফাটা তৃষ্ণা। একটু পানি দে তো বোন! – না না, আর চাই না। ওই দেখতে পাচ্ছি ‘শারাবান তহুরা’ -ভরা পেয়ালা হাতে আমার স্বামী হৃদয়-সর্বস্ব দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কী সহানুভূতি-আর্দ্র করুণ স্নেহময় গভীর দৃষ্টি তাঁর। আঃ মাগো! আঃ!’