মা আমায় সম্প্রদান করেই আবার শয্যা আশ্রয় করেছিলেন, তাঁর যে তখন আর চাইবার বা করবার কিছুই ছিল না, তখন যে মা মুক্ত। তাই তিনিও আমায় সইমার হাতে দিয়ে যে দেশের কেউ খবর দিতে পারে না সেই কোন্ অজানার দেশে চলে গেলেন। বোধ হয় সেখানে আমার বাবা খোকাখুকিদের নিয়ে অশ্রুসজল নয়নে পথের দিকে চেয়েছিলেন। যাওয়ার সময় সে কী তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠেছিল মার পাণ্ডুর ওষ্ঠপুটে! আমি যখন মার বুকে আছাড় খেয়ে কেঁদে উঠলুম, ‘মা গো যেয়ো না – আমার যে আর দুনিয়ায় কেউ নেই মা’, তখন মা আমার মুখে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘বলিসনে বলিসনে রে অমন কথা বেগম, তোর অভাব কীসের? এমন মায়ের চেয়েও স্নেহময়ী শাশুড়ি, দেবতার চেয়েও উচ্চ স্বামী, এত পেয়েও রাক্ষুসি বলছিস কিছু নেই তোর? ছি মা, বলিসনে অমন অপয়া কথা।’
মাকে বাবার পাশেই গোর দেওয়া হল। আজ তাহেরার আর আবুলের কবর যেমন ধুলার সঙ্গে মিশে গিয়েছে, দু-দিন বাদে মারও কবর অমনই সমান হয়ে মিশে যাবে, কিন্তু আমার বুকে পুঞ্জীভূত বেদনার এই যে একটা শক্ত গেরো বেঁধে গেল, সে কি মিশবে কখনও?
এর পর হতে এই উপর্যুপরি চোখের আঘাতে আমায় মারাত্মক মূর্ছারোগে ধরলে! প্রায়ই আমি অচেতন হয়ে পড়তুম, আর যখনই চেতন হত তখনই দেখতুম আমার ধূলিধূসরিত শির রয়েছে তাঁর – আমার স্বামীর ঘনস্পন্দিত বিশাল বক্ষে – তাঁর সব-ভুলানো ব্যাকুল বাহু-বন্ধনের মাঝে! ওঃ, সে কী ভীত করুণাঘন দৃষ্টি তাঁর চোখে ফুটে উঠত! সহানুভূতির সে কী কোমল স্নিগ্ধছায়া ছেয়ে ফেলত তাঁর স্বভাবসুন্দর মুখখানি। – আমার তখন মনে হত এর চেয়ে মেয়েদের কী আর সুখ থাকতে পারে? এর চেয়ে আকাঙ্ক্ষিত ঈপ্সিত কী সে অপার্থিব জিনিস চাইতে পারে আমাদের মন্দভাগিনী স্ত্রী জাতিরা? হায়, সে সময়ে স্বামীর কোলে অমনি করে মাথা রেখে কেন আমার শেষ নিশ্বাসটুকু বাতাসের সঙ্গে মিশে যায়নি?
[ ঘ ]
এখন বলছি বোন তোকে আমার কাহিনিটা, এও যে একটা ‘কেসসা’। কে আমার এ কথা বিশ্বাস করবে আর কেই বা শুনবে? তার উপর নাকি আমার মগজ বিগড়ে গিয়েছে, আর তাই মাঝে মাঝে আমি খুব শক্ত ‘বক্তিমা’ ঝেড়ে আমার বিদ্যা জাহির করি। আমার এই বকর বকর করাটা কেউ পছন্দ করে না, তাই একটু শুনেই বিরক্ত হয়ে চলে যায়। আচ্ছা বোন, বল তো, মেয়েমানুষ আবার কবে কথা গুছিয়ে বলতে পেরেছে, আর খুব বেশি বলাই মেয়েদের স্বভাব কি না। আমি কম কথায় কী করে আমার সকল কথা জানাব? তাই হয়তো বলবি, কে তোকে মাথার দিব্যি দিয়েছে তোর কথা বলবার জন্যে? তাও বটে, তবে পেটের কথা, বুকের ব্যথা লোককে না জানালেও যে জানটা কেমন শুধু আনচান করে, বুকটা ভারী হয়ে ওঠে, এও তো একটা মস্ত জইর ‘গজব’ ।
* * *
সইমা এত বড়ো রাশভারি লোক ছিলেন যে সবাই তাঁকে ভয় করে চলত। তিনিই ছিলেন ঘরের মালিক। কেউ তাঁর কথায় ‘টু’টি করতে পারত না। তাই এত বড়ো একটা অঘটন, – আমার মতো পাতাকুড়ুনির বেটিকে রাজবধূ করা সত্ত্বেও মুখ ফুটে কেউ আর কিছু বলতে পারল না তেমন। মেয়েরা প্রকারান্তরে আমার নিচু ঘরের কথা জানতে এলে তিনি জোর গলায় বলতেন, ‘জাত নিয়ে কি ধুয়ে খাই? আর জাত লোকের গায়ে লেখা থাকে? যার চলাচলন শরিফের মতো সেই তো আশরাফ । খোদা কিয়ামতের দিনে কখ্খনো এমন বলবেন না যে, তুমি সৈয়দ সাহেব, তোমার আবার পাপ পুণ্যি কী, তোমার নিঘ্ঘাত বেহেশত আর তুমি ‘হালগজ্জ’ শেখ, অতএব তোমার সব ‘সওয়াব’ (পুণ্য) বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে, কাজেই তোমার কপালে তো জাহান্নাম ধরাবাঁধা! আমি চাই শুধু গুণ, তা সে যে জাতই হোক না কেন? দেখুক তো এসে আমার বউকে – ঘর আলো করা রূপ, আশরাফের চেয়েও আদব তমিজ লেখাপড়া জানা, কাজকর্মে পাকা এমন লক্ষ্মী বউ আর কার আছে! আর কী জন্যেই বা বড়ো ঘরের বেটিকে ঘরে আনব, সে যত না আনবে রূপ-গুণ, তার চেয়ে বেশি আনবে বাপমায়ের গরব আর অশান্তি। আমার এই সোনার চাঁদ ছেলে বেঁচে থাক, ওর ঘরে ছেলেপিলে দেখি, তা হলেই আমি হাসতে হাসতে মরব।’ মায়ের সেই স্নেহভিজা কথায় যে কতই আনন্দে বুক ভরে উঠত। আমার চোখ দিয়ে টস টস করে জল পড়ত। কৃতজ্ঞতা আর ভক্তির ভাষা বুঝি মর্মের অশ্রু।
স্বামীর সত্যিকারের ভালোবাসা আর সইমার মেয়ের চেয়েও নিবিড় স্নেহ আমার তো আর কিছুই অপূর্ণ রাখেনি। দুনিয়ায় যখন যা দেখতুম তাই সব যেন সুন্দর হয়ে ফুটে! কই, ওর আগে তো এই মাটির দুনিয়াকে এত সুন্দর করে দেখিনি। ভালোবাসার অঞ্জন কী মহিমা জানে, যাতে সব অত সুন্দর হয়ে ফুটে ওঠে!
‘এত সুখ, তবুও পোড়া মন কেন আপনা আপনিই সঙ্কুচিত হয়ে পড়ত! পাড়াপড়শি লোকের ওই একটা কথাই যেন শাখচিল্লির মতো কানের কাছে এসে বাজত, ‘সইবে না, সইবে না, সইবে না!’ চোরের মন বোঁচকার দিকে, তাই আমার মতো হতভাগির মনে যে শুধুই অমঙ্গলের বাঁশি বাজবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! – ওই অত গভীর ভালোবাসার আঘাতই যে আমাকে বিব্রত করে তুলেছিল! মধু খুবই মিষ্টি, কিন্তু বেশি খাওয়ালেই গা জ্বালা করে। তাই আমার মনে হত ওঁদের পায়ে মাথা কুটে বলি, ‘ওগো দেবতা, ওগো স্বর্গের দেবী, তোমরা এত স্নেহ এত ভালোবাসা দিয়ে ছেয়ে ফেলো না আমায়, আমি যে আর সইতে পারছি না। স্নেহের ঘায়ে যে আমার হৃদয় ভেঙে পড়ল! একটু ঘৃণা করো, খারাপ বলো, আমায় খুব ব্যথা দাও, তা নইলে আমার বক্ষ নুয়ে যাবে যে।’ আর অমনি আবার সেই ভীষণ মূর্তি চোখের সামনে ভেসে উঠত ‘সইবে না।’