[ গ ]
খুব ধুমধামে আমাদের বে হয়ে গেল। ধুমধাম মানে ‘আতস-বাজি’, ‘বাজনা’, ‘বাইনাচ’, ‘থিয়েটার’ প্রভৃতি যে-সকল অসাধু কলুষ আনন্দের কথা বুঝ তোমরা, তার কিছুই হয়নি। আর যদি ধুমধাম মানে নির্দোষ পবিত্র আনন্দের বিনিময় বুঝায়, তা হলে তার কোথায়ও এতটুকু ত্রুটি ছিল না। গ্রামের সমস্ত গরীব দুঃখীকে সাতদিন ধরে সুন্দররূপে ভালো ভালো খাবার খাওয়ানো হয়েছিল। অনেকের পুরোনো ঘর নূতন করে দেওয়া হয়েছিল। যাদের হালের গরু না থাকায় সমস্ত জমিজমা পতিত হয়েছিল, তাদিগকে গোরু কিনে দেওয়া হয়েছিল। গ্রামের তাঁতি দু ঘরকে দুটি তাঁতের কল কিনে দিয়ে তাদিগকে দেশি কাপড় বুনায় উৎসাহ দেওয়া হয়েছিল। কলকাতার এতিমখানায় পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল। সেসব আরও কত জায়গায় কত টাকা দিয়েছিলেন যে মা, তা আমার এখন সব মনে নেই!
সই মা আমায় বধূ করে যত খুশি হয়েছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি দুঃখিত হয়েছিল গ্রামের লোকেরা, আর ওঁর আত্মীয় কুটুম্বেরা। ওঁদের অনেক আত্মীয় ছোটো ঘরে বে দেওয়ার জন্যে বে-র নিমন্ত্রণে একেবারেই আসেনি। এমনকি এই নিয়ে অনেকের সঙ্গে চিরদিনের জন্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছিল। অনেক হিতৈষী মিত্রও শত্রু হয়ে দাঁড়াল। তবে পয়সার খাতির সব জায়গাতেই, তাই অনেক চতুর মাতব্বর লোক এঁদের সঙ্গে মৌখিক সদ্ভাব রেখে ভিতরে ভিতরে অনিষ্ট করতে লাগল! সমাজে পতিত না হলেও বিশেষ কাজ বনাম স্বার্থ ছাড়া আর কেউ এ-বাড়ি আসত না। কিন্তু যেসব সহায়হীন গরিব বেচারারা জন্মাবধি এ বাড়ির সাহায্যে প্রতিপালিত হয়ে এসেছে, তারা সমাজের এ চোখ রাঙানি দেখে শুধু উপরে উপরে ভয় করে চলত। তারা জানত, সমাজ শুধু চোখ রাঙাতেই জানে। যে যত দুর্বল তার তত জোরে টুটি চেপে ধরতেই সমাজ ওস্তাদ। যেখানে উলটো সমাজকেই চোখ রাঙিয়ে চলবার মতো শক্তিসামর্থ্যওয়ালা লোক বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে সমাজ নিতান্ত শান্ত শিষ্টের মতোই তার সকল অনাচার আবদার বলে সয়ে নিয়ে থাকে। তাই উনি আর ওঁর মা বললেন, ‘আমাদের সমাজই নাই তো সমাজচ্যুত করবে কে?’ – সমাজ তবুও সুবোধ শিশুর মতো কোনো সাড়াই দিলে না, কিন্তু ওঁদের বাড়িতে যে সব গরিব বেচারারা আসত তাদিগকে খুব কড়াভাবেই শাসন করা হল,যেন কেউ ওঁদের বাড়ির ছায়াও না মাড়ায়।
লোকের এরূপ ব্যবহারে আদৌ দুঃখিত না হয়ে ওঁরা বরং হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তা ছাড়া গ্রামের দরিদ্রের সেই আনন্দোদ্ভাসিত মুখে, অশ্রু ছলছল চোখে যে একটা মধুর স্নিগ্ধ হাসি ফুটে উঠেছিল, তারই জ্যোতি ওঁদের হৃদয় আলোয় আলোময় করে দিয়েছিল; উলটোদিকে পরশ্রীকাতর লোকদের চোখ মুখ ভয়ানকভাবে ঝলসে দিয়েছিল!
ওঃ, সে কী অমানুষিক শক্তি ছেয়ে ফেলেছিল মায়ের ওই ঝাঁঝরা বুক আমার বিদায়ের দিনে। মায়ের আনন্দের আকুল ধারা যেন কোথায় ধরছিল না সেদিন! হাজার কাজের ভিতর হাসির মাঝে অকারণে অশ্রু উথলে পড়ছিল তাঁর!
আমার জীবন কিন্তু সার্থকতায় সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল সেইদিন – যেদিন বুঝলুম আমার হৃদয়-দেবতাও তাঁর মাতৃদত্ত আশীর্বাদ সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করেছেন, আমার প্রাণের গোপন পূজা আরাধ্য দেবতার পায়ে বৃথা নিবেদিত হয় নাই!
আমার শুধু ইচ্ছা হত আমি তাঁর পায়ে মাথা কুটি আর বলি, ‘ওগো স্বামিন! ওগো দেবতা! এত আনন্দ দিয়ো না এ ক্ষুধিতাকে, প্রেমের এত আকাশ-ভাঙা ঘন বৃষ্টি ঢেলে দিয়ো না এ চিরমরুময় হৃদয়ে, – সকল মন দেহ প্রাণ ছেয়ে ফেলো না তোমার ও ব্যাকুল ভালোবাসার ব্যগ্র নিবিড় আলিঙ্গনে! আমার ছোট্ট বুক যে এত আনন্দ, এত ভালোবাসা সইতে পারবে না! – কিন্তু হায়, তাঁর ও ভুজবন্ধনে ধরা দিয়ে আমার আর কিছুই থাকত না, আমি আমার বর্তমান ভূত ভবিষ্যৎ ভুলে যেতুম! এ যেন স্বপ্নে পরিস্থানে গিয়ে প্রিয়তমের অধীর বক্ষে মাথা রেখে সুপ্ত বধির হয়ে যাওয়া, প্রাণের সকল স্পন্দন, দেহের সমস্ত রুধির অবাক স্তব্ধ হয়ে থেমে যাওয়া, শুধু তুমি আর আমি – অনুভব করা, সে-কোন্ অসীম সিন্ধুতে বিন্দুর মতো মিশে যাওয়া।
তাঁর ওই বিশ্বগ্রাসী ভালোবাসা যখন চোখের কালোয় জ্যোতির মতো হয়ে ফুটে উঠত, তখন শুধু ভাবতুম প্রেমে মানুষ কত উচ্চ হতে পারে! এর এতটুকু ছোঁয়ায় সে কী কোমলতার স্নিগ্ধপূত সুরধুনী বয়ে যায় সারা বিশ্বের অন্তরের অন্তর দিয়ে। দেবতা বলে কি কোনো কথা আছে? কক্ষণো না। মানুষই যখন এই রকম উচ্চ হতে পারে, অতল ভালোবাসায় নিজকে সম্পূর্ণরূপে তলিয়ে দিতে পারে, নিজের অস্তিত্ব বলে কোনো কিছু একটা মনে থাকে না – সে দেখে, সব সুন্দর আর আনন্দ, তখনই মানুষ দেবতা হয়। দেবতা বলে কোনো আলাদা জীব নাই।
* * *
যাক ও-সব কথা এখন – কী বলছিলুম? – হ্যাঁ, আমার বিয়ের মতো এত বড়ো একটা অস্বাভাবিক কাণ্ডে গ্রামময় মহা হুলুস্থুল পড়ে গেল। বংশে নিকৃষ্ট, সহায়সম্বলহীন আমাদের ঘরে সৈয়দ-বংশের বি.এ. পাশ করা সোনার চাঁদ ছেলের বিয়ে হওয়া ঠিক যেন রূপকথায় ঘুঁটে-কুড়োনির বেটির সাথে বাদশাজাদার বিয়ের মতোই ভয়ানক আশ্চর্য ঠেকছিল সকলের চোখে। গ্রামের মেয়েরা তো অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে চেয়েছিল, – ‘বাপরে বাপ, মেয়েটার কী পাঁচপুয়া কপাল!’ তারা এও বলতে কসুর করেনি যে, আমি আবাগি নাকি রূপের ফাঁদ পেতে অমন নিষ্কলঙ্ক চাঁদকে বেমালুম কয়েদ করে ফেলেছিলুম? এত বলেও যখন তারা একটুও ক্লান্ত হল না, তখন সবাই একবাক্যে বলে বেড়াতে লাগল যে, বুনিয়াদি খান্দানে এমন একটা খটকা, এও কি কখনো সয়? এত বাড়াবাড়ি সইবে না, সইবে না। কখন আমাদের কপাল পুড়ে আর তাদের দশজনের ওই মহাবাক্যটা দৈব-বাণীর মতো ফলে যায়, তাই আলোচনা করে করে তাদের আর পেটের ভাত হজম হত না। আমার কিন্তু তখন কিছুই শুনবার আগ্রহ ছিল না – যে-দেবতা এমন করে তাঁর পরশমণির স্পর্শে আমার সকল ভুবন এমন সোনা করে দিয়েছিলেন, যাঁর মাঝে আমার সকল সত্তা, সব আকাঙ্ক্ষা চাওয়া-পাওয়া একাকার হয়ে মিশে গিয়েছিল, আমি সব ভুলে গিয়ে শুধু সেই দেবতাকেই নিত্য নূতন করে দেখছিলুম। তখন যে আমার ভাববার আর বলবার কিছুই ছিল না। তখন যে ‘সব পেয়েছি’র আসরে আনন্দময় হয়ে যাওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণ! কিন্তু হায়, কালের অত্যাচারে সে মাহেন্দ্রক্ষণ আসবার আগেই এই সুন্দর বিশ্বের সে কী শক্ত দিকটা চোখে পড়ে গেল। প্রাণে বিরাট শান্তি নেমে আসবার আগেই সে কী গোলমাল হয়ে গেল সব। আগে হতেই আমার প্রাণের নিভৃততম দেশে সে কী এক আশঙ্কা যেন শিউরে শিউরে উঠত! মনে হত যেন এত সুখের পিছনে সে কী বজ্র ওত পেতে রয়েছে। কখন আমার এ আকাশ-কুসুম ভেঙে যাবে! – মনে হত এ ক্ষণিকের পাওয়া যেন একটি রজনীর স্বপ্নে পাওয়া ছোট্ট এক টুকরো আনন্দ, স্বপ্ন ভেঙে গেলেই তেমনি ঘুটঘুটে অন্ধকার!