তুই তো আজ দশ বছর এ গাঁ ছাড়া, তাই সব কথা জানিস না। সেই ছোট্টটি গিয়েছিলি, আজ একেবারে খোকা কোলে করে বাপের বাড়ি এসেছিস! … আমি পাগল হয়ে গেছি ভেবে সবাই দূর হতে দেখেই পালায়। আচ্ছা তুইতো জানিস ভাই আমায়, আর এখনও তো দেখছিস, সত্যি বলতো আমি পাগল হয়েছি? হাঁ ঠিক বলেছিস, আমি পাগল হইনি, – নয়?
সেবার – ঠিক মনে পড়ে না কতকাল আগে – বিধাতার অভিশাপ যেন কলেরা আর বসন্তের রূপ ধরে আমাদের ছোট্ট শান্ত গ্রামটির উপরে এসে পড়েছিল, আর ওই অভিশাপে পড়ে কত মা, কত ভাই-বোন, কত ছেলেমেয়ে যে গাঁয়ের ভরাবক্ষে শুধু একটা খাঁ খাঁ মহাশূন্যতা রেখে কোন্ সে অচিন মুল্লুকে উধাও হয়ে গেল তা মনে পড়লে – মাগো মা – জানটা যেন সাতপাক খেয়ে মোচড় দিয়ে ওঠে। কত সে ঘর-কে ঘর উজাড় হয়ে তাতে তালাচাবি পড়ল – আর গ্রামে যেমন এক একটি করে ভিটে নাশ হতে লাগল, তেমনই এই গোরস্থানে গোরের সংখ্যা এত বেশি বেড়ে উঠল যে, আর তার দিকে তাকানই যেত না।
আচ্ছা ভাই, এই যে দিঘির গোরস্থান, আর এই যে হাজার হাজার কবর, এগুলো কী তবে আমাদেরই গাঁয়ের একটা নীরব মর্মন্তুদ বেদনা – অন্তঃসলিলা ফল্গুনিঃস্রাব – জমাট বেঁধে অমন গোর হয়ে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়েছে? না কী আমাদের মাটির মা তাঁর এই পাড়াগেঁয়ে চির-দরিদ্র জরাব্যাধিপ্রপীড়িত ছেলেমেয়েগুলোর দুঃখে ব্যথিত হয়ে করুণ প্রগাঢ় স্নেহে বিরামদায়িনী জননীর মতো মাটির আঁচলে ঢেকে বুকের ভিতর লুকিয়ে রেখেছেন? তাঁর এই মাটির রাজ্যে তো দুঃখ-ক্লেশ বা কারুর অত্যাচার আসতে পারে না। এখানে শুধু একটা বিরাট অনন্ত সুপ্ত শান্তি – কর্মক্লান্ত মানবের নিঃসাড় নিস্পন্দ সুষুপ্তি। এ একটা ঘুমের দেশ, নিঝুমের রাজ্যি। আহা, আজ সে কত যুগের কত লোকই যে এই গোরস্থানে ঘুমিয়ে আছে তা এখন গাঁয়ের কেউ বলতে পারবে না। আমি কতজনকেই বা মরতে দেখলুম? এরা যখন মরেছিল, আমি তখন হয়তো এমনই একটা অ-দেখার ‘কোকাফ মুল্লুকে ঘুরতে ছিলুম, তারপর যখন আমায় কে এই দুনিয়ায় এনে ফেলে দিলে – আর দুনিয়ার এই আলোকের জ্বালাময় স্পর্শে আমার চক্ষু ঝলসে গেল, তখন আমি নিশ্চয় অব্যক্ত অপরিচিত ভাষায় কেঁদে উঠেছিলুম, ‘ওগো, এ মাটির – পাথরের দুনিয়ায় কেন আমায় আনলে? কেন, ওগো কেন?’ – তারপর মায়ের কোলে শুয়ে যখন তাঁর দুধ খেলুম, তখন প্রাণে কেমন একটা গভীর সান্ত্বনা নেমে এল। আমি আমার সমস্ত অতীত এক পলকে ভুলে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লুম।
ওই যে বাঁধানো কবরগুলো, ওগুলো অনেক কালের পুরোনো। তখন ছিল বাদশাহি আমল, আর আমাদের এই ছোট্ট গ্রামটাই ছিল, ‘ওলিনগর’ বলে একটা মাঝারি গোছের শহর। ওই যে সামনে ‘রাজার গড়’ আর ‘রানির গড়’ বলে দুটো ছোট্ট পাহাড় দেখতে পাচ্ছ, ওতেই থাকতেন তখনকার রাজা রানি – রাজকুমার আর রাজকুমারীরা। লোকে বলে, তাঁরা শুতেন হিরার পালঙ্কে, আর খেতেন ‘লাল জওয়াহের’ আর, কবরস্থানের পশ্চিম দিকে ওই যে পির সাহেবের ‘দরগা’ ওরই ‘বর্দোয়ায়’ নাকি এমন সোনার শহর পুড়ে ঝাও হয়ে যায়। সেই সঙ্গে রাজার ঘরগুষ্টি সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, আজ তাঁর বংশে বাতি দিতে কেউ নেই! পশ্চিমে-হাওয়ায় তাঁদের সেই ছাই-হওয়া দেহ উড়ে উড়ে হয়তো এই গোরস্থানের উপরই এসে পড়েছে। আচ্ছা ভাই, খোদার কী আশ্চর্য মহিমা! রাজা – যার অত ধন, মালমাত্তা, অত প্রতাপ, সেও মরে মাটি হয়! আর যে ভিখারি খেতে না পেয়ে তালপাতার কুঁড়েতে কুঁকড়ে মরে পড়ে থাকে, সেও মরে মাটি হয়। কী সুন্দর জায়গা এ তবে বোন!
তুই ঠিক বলেছিস ভাই সলিমা, কেঁদে কী হবে, আর ভেবেই বা কী হবে! যা হবার নয় তা হবে না, যা পাওয়ার নয় তা পাব না। তবু পোড়া মন তো মানতে চায় না। এই যে একা কবরস্থানে এসে কত রাত্তির ধরে শুধু কেঁদেছি, কিন্তু এত কান্না এত ব্যাকুল আহ্বানেও তো কই তাঁর একটুকু সাড়া পাওয়া গেল না। তিনি কী এতই ঘুমুচ্ছেন? কী গভীর মহানিদ্রা সে? আমার এত বুকফাটা কান্নার এত আকাশচেরা চিৎকারের এতটুকু কী তাঁর কানে গেল না? সেই কোন্ মায়াবীর মায়াযষ্টিস্পর্শে মোহনিদ্রায় বিভোর তিনি? আমিও কেন অমনি জড়ের মতো নিঃসাড় নিস্পন্দ হয়ে পড়ি না? আমারও প্রাণে কেন মৃত্যুর ওই রকম শান্ত-শীতল ছোঁয়া লাগে না? আমিও কেন দুপুর রাতের গোরস্থানের মতোই নিথর নিঝুম হয়ে পড়ি না? তাহলে তো এ প্রাণপোড়ানো অতীতটা জগদ্দল শিলার মতো এসে বুকটা চেপে ধরে না! সেই সে কোন্-ভুলে-যাওয়া দিনের কুলিশ-কঠোর স্মৃতিটা তপ্ত শলাকার মতো এসে এই ক্ষত বক্ষটায় ছ্যাঁকা দেয় না! ‘জোবেহ্’ করা জানোয়ারের মতো আর কতদিন নিদারুণ জ্বালায় ছটফট করে মরব? কেন মৃত্যুর মাধুরী মায়ের আশিসধারার মতো আমার উপর নেমে আসে না? এ হতভাগিনিকে জ্বালিয়ে কার মঙ্গল সাধন করছেন মঙ্গলময়? তাই ভাবি – আর ভাবি – কোনো কূলকিনারা পাই না, এর যেন আগাও নেই, গোড়াও নেই। কী ছিল – কী হল – এ শুধু একটা বিরাট গোলমাল!
সেদিন সকালে ওই পাশের চারাধানের খেতের আলের উপর দিয়ে কাঁচা আম খেতে খেতে একটি রাখাল বালক কোথা হতে শেখা একটা করুণ গান গেয়ে যাচ্ছিল। গানটা আমার মনে নেই, তবে তার ভাবার্থটা এই রকম, ‘কত নিশিদিন সকাল সন্ধ্যা বয়ে গেল, কত বারোমাস কত যুগ-যুগান্তরের অতীতে ঢলে পড়ল, কত নদনদী সাগরে গিয়ে মিশল, আবার কত সাগর শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেল, কত নদী পথ ভুলে গেল, আর সে কত গিরিই না গলে গেল, তবু ওগো বাঞ্ছিত, তুমি তো এলে না!’ গানটা শুনছিলুম আর ভাবছিলুম, কী করে আমার প্রাণের ব্যাকুল কান্না এমন করে ভাষায় মূর্ত হয়ে আত্মপ্রকাশ করছিল? ওগো, ঠিক এই রকমই যে একটা মস্ত অসীম কাল আমার আঁখির পলকে পলকে যেন কোথা দিয়ে কোথায় চলেছে, আর আমি কাকে পাওয়ার – কী পাওয়ার জন্যে শুধু আকুলি-বিকুলি মিনতি করে ডাকছি, কিন্তু কই তিনি তো এলেন না – একটু সাড়াও দিলেন না। তবে দুপুর রোদ্দুরে ঘুনঘুনে মাছির মুখে ওই যে খুব মিহি করুণ ‘গুন গুন’ সুর শুনি এই গোরস্থানে, ও কি তাঁরই কান্না? দিনরাত ধরে সমস্ত গোরস্থান ব্যেপে প্রবল বায়ুর ওই যে একটানা হু হু শব্দ, ও কি তাঁরই দীর্ঘশ্বাস? রাত্তিরে শিরীষ ফুলের পরাগমাখা ওই যে ভেসে আসে ভারী গন্ধ, ও কি তাঁরই বর-অঙ্গের সুবাস? গোরস্থানের সমস্ত শিরীষ, শেফালি আর হেনার গাছগুলো ভিজিয়ে, সবুজ দুর্বা আর নীল ভুঁই-কদমের গাছগুলোকে আর্দ্র করে ওই যে সন্ধে হতে সকাল পর্যন্ত শিশির ক্ষরে, ও কি তাঁরই গলিত বেদনা? বিজুলির চমকে ওই যে তীব্র আলোকচ্ছটা চোখ ঝলসিয়ে দেয়, ও কি তাঁরই বিচ্ছেদ-উন্মাদ হাসি? সৌদামিনী-স্ফুরণের একটু পরেই ওই যে মেঘের গম্ভীর গুরু গুরু ডাক শুনতে পাই, ও কি তাঁর পাষাণ বক্ষের স্পন্দন? প্রবল ঝঞ্ঝার মতো এসে সময় সময় ওই যে দমকা বাতাস আমাকে ঘিরে তাণ্ডব নৃত্য করতে থাকে, ও কি তাঁরই অশরীরী ব্যাকুল আলিঙ্গন? গোরস্থানের পাশ দিয়ে ওই যে ‘কুনুর’ নদী বয়ে যাচ্ছে, আর তার চরের উপর প্রস্ফুটিত শুভ্র কাশফুলের বনে বনে দোল-দোলা দিয়ে ঘন বাতাস শন শন করে ডেকে যাচ্ছে, ও কি তাঁরই কম্পিত কণ্ঠের আহ্বান? আমি কেন ওঁরই মতো অমনই অসীম, অমনই বিরাট-ব্যাপ্ত হয়ে ওঁকে পাই না? আমি কেন অমনই সবারই মাঝে থেকে ওই অ-পাওয়াকে অন্তরে অন্তরে অনুভব করি না? এ সীমার মাঝে অসীমের সুর বেজে উঠবে সে আর কখন? এখন যে দিন শেষ হয়ে এল, ওই শুন নদীপারের বিদায়-গীত শুনা যাচ্ছে খেয়াপারের ক্লান্ত মাঝির মুখে –