কিন্তু তাই কি?
হয়তো তা ভুল। কেননা একদিন যেন সে বলেছিল, ‘প্রিয়তম, এ যে তোমার ভুলের পথ, এ পথ তো মঙ্গলের নয়। আঘাত দিয়ে তোমায় এ পথ হতে ফিরাতেই হবে। তোমায় কল্যাণের পথে না আনতে পারলে তো আমি তোমার লক্ষ্মী হতে পারি নে!’ সেকথা যেন আজকের নয়, কোন্ অজানা নিশীথে আমি ঘুমের কানে শুনেছিলাম। তখন তা কিন্তু বুঝতে পারিনি।
আমি যেমন কিছুতেই তার চিরন্তন ধারাটির একগুঁয়েমি সইতে পারলাম না, সেও তেমনই নীচে নেমে আমার পথে এল না।
বিদায় নেওয়ার দিনও সে তেমনি করে হেসে গেছে। তেমনি করেই তার দুষ্ট চটুল চাউনি দিয়ে সে আমায় বারেবারে মিষ্টি বিদ্রুপ করেছে। শুধু একটি নতুন কথা শুনিয়ে গেছল, ‘আর এ পথে আমাদের দেখা হবে না প্রিয়, এবার নতুন করে নতুন পথে নতুন পরিচয় নিয়ে আমরা আমাদের পূর্ণ করে চিনব।’
তার বিদায়-বেলায় যে দীঘল শ্বাসটি শুনেও শুনিনি, আজ আমি সারা বাতাসে যেন সেই ব্যথিত কাঁপুনিটুকু অনুভব করছি। এখন সে বাতাস নিতেও কষ্ট হয়। … কবে আমার এ নিশ্বাস-প্রশ্বাসে-টেনে-নেওয়া বায়ুর আয়ু চিরদিনের মতো ফুরিয়ে যাবে প্রিয়? … তার বিদায়-চাওয়া যে ভেজা-দৃষ্টিটুকু আমি দেখেও দেখিনি, আজ সারা আকাশের কোটি কোটি তারার চোখের পাতায় সেই অশ্রুকণাই দেখতে পাচ্ছি! এখন তারা হাসলেও মনে হয়, ও শুধু কান্না আর কান্না!
তারপর রোজ আসি রোজ যাই, কিন্তু উদার-পথে আর তার রাঙা চরণের আলতার আলপনা ফুটল না! এখন অরুণ রবি আসে হাসতে হাসতে। তার সে হাসি আমার অসহ্য। পাখির কণ্ঠের বিভাস সুর আমার কানে যেন পুরবির মতো করুণ হয়ে বাজে।…
আমি বললাম, ‘হায় প্রিয়তম, তোমায় আমি হারিয়েছি!’ দেখলাম, আকাশ-বাতাস আমার সে কান্নায় যোগ দিয়ে বলছে, ‘তোমায় হারিয়েছি!’ তখন সন্ধ্যা – ওই সিন্ধুবেলায়।
হঠাৎ ও কার চেনা-কণ্ঠ শুনি? ও কার চেনা-চাওয়া দেখি? ও কে রে, কে?
বললাম, ‘আজ এ বধূর বেশে কোথায় তুমি প্রিয়?’ সে বললে, ‘অস্ত-পথে!’
সে আরও বলে গেছে যে, সে রোজই তার ম্লানমূর্তি নিয়ে এই অস্ত-গাঁয়ের আকাশ-আঙিনায় সন্ধ্যা-প্রদীপ দেখাতে আসবে। আমি যেন আর তার দৃষ্টির সীমানায় না আসি।
বুঝলাম সে যতদিন অস্ত-পারের দেশে বধূ হয়ে থাকবে, ততদিন তার দিকে তাকাবারও আমার অধিকার নেই। আজও সে তার জগতের সেই চিরন্তন সহজ ধারাটুকুকে বজায় রেখে চলছে। সে তো বিদ্রোহী হতে পারে না। সে যে নারী – কল্যাণী। সে-ই না বিশ্বকে সহজ করে রেখেছে, তার অনন্ত ধারাটিকে অক্ষুণ্ন সামঞ্জস্য দিয়ে ঘিরে রেখেছে।
শুধোলাম, ‘আবার কবে দেখা হবে তবে? আবার কখন পাব তোমায়?’ সে বললে, ‘প্রভাত বেলায় ওই উদয়-পথেই।’
আজ সে বধূ, তাই তার সাঁঝের-পথে আর তাকাইনি।
জানিনে, কবে কোন্ উদয়-পথে কোন্ নিশিভোরে কেমন করে আমাদের আবার দেখাশোনা হবে। তবু আমার আজও আশা আছে, দেখা হবেই, তাকে পাবই!
* * *
সিন্ধু পেরিয়ে ঘরের আঙিনায় যখন একা এসে ক্লান্ত চরণে দাঁড়ালাম, তখন ভাবিজি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হাঁ ভাই, তুমি নাকি বে করেছ?’ আমি মলিন হাসি হেসে বললাম ‘হাঁ।’ তিনি হেসে শুধোলেন, ‘তা বেশ করেছ। বধু কোথায়? নাম কী তার?’
অনেকক্ষণ নিঃশব্দে বসে রইলাম। শ্রী-রাগের সুরে সুর-মূর্ছিতা মলিনা সন্ধ্যার ঘোমটায় কালো আবছায়া যেন সিয়াহ্ কাফনের মতো পশ্চিম-মুখী ধরণির মুখ ঢেকে ফেলতে লাগল। আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম।
তারপর অতিকষ্টে ওই পশ্চিম-পারের পানে আঙুল বাড়িয়ে বললাম, ‘অস্তপারের সন্ধ্যা-লক্ষ্মী!’
ভাবিজানের ডাগর আঁখিপল্লব সিক্ত হয়ে উঠল; দৃষ্টিটুকু অব্যক্ত ব্যথায় নত হয়ে এল। কালো সন্ধ্যা নিবিড় হয়ে নেমে এল।
সালেক
[ ক ]
আজকার প্রভাতের সঙ্গে শহরে আবির্ভূত হয়েছেন এক অচেনা দরবেশ। সাগরমন্থনের মতো হুজুগে লোকের কোলাহল উঠেছে পথে, ঘাটে, মাঠে, – বাইরের সব জায়গায়। অন্তঃপুরচারিণী অসূর্যম্পশ্যা জেনানাদের হেরেম তেমনই, নিস্তব্ধ নীরব, – যেমন রোজই থাকে দুনিয়ার সব কলরব ‘হ-য-ব-র-ল’র একটেরে! বাইরে উঠছে কোলাহল, – ভিতরে ছুটছে স্পন্দন।
সবারই মুখে এক কথা, ‘ইনি কে? যাঁর এই আচমকা আগমনে নূতন করে আজ নিশিভোরে উষার পাখির বৈতালিক গানে মোচড় খেয়ে কেঁপে উঠল আগমনির আনন্দভৈরবী আর বিভাস’?
ছুটছে ছেলে মেয়ে বুড়ো সব একই পথে ঘেঁষাঘেঁষি করে দরবেশকে দেখতে। তবুও দেখার বিরাম নাই। দুঃশাসন টেনেই চলেছে কোন্ দ্রৌপদীর লজ্জাভরণ, এক মুখ বিস্ময়-বিস্ফারিত-অক্ষি বিশ্বের চোখের সুমুখে, আর তা বেড়েই চলেছে। তার আদিও নেই, অন্তও নেই। ওগো, অলক্ষ্যে যে এমন একটি দেবতা রয়েছেন, যিনি গোপনের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেন না।
দরবেশ কথাই কয় না, – একেবারে চুপ।
অনেকে বায়না ধরলে দীক্ষা নেবে; দরবেশ ধরা-ছোঁয়াই দেয় না। যে নিতান্তই ছাড়ে না, তাকে বলে, ‘কাপড় ছেড়ে আয়!’ সে ময়লা কাপড় ছেড়ে খুব ‘আমিরানাশানের’ জামা জোড়া পরে আসে। দরবেশ শুধু হাসে আর হাসে, কিছুই বলে না।
শহরের কাজি শুনলেন সব কথা। তিনিও ধন্না দিতে শুরু করলেন দরবেশের কাছে। দরবেশ যতই আমল দিতে চায় না, কাজি সাহেব ততই নাছোড়বান্দা হয়ে লেগে থাকেন । দরবেশ বুঝলেন, এ ক্রমে ‘কমলিই ছোড়তা নেই’ গোছের হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাঁর মুখে ফুটে উঠল ক্লান্ত সদয় হাসির ঈষৎ রেখা।