দ্রুম! দ্রুম!! দ্রুম!!! … একটা যন্ত্রণা-কাতর কাতরানি – ‘আম্মা!– মাঃ!! আঃ!’ …
তারপরেই সব শেষ।
* * *
তারপরেই আমি আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়লুম!… ছুটে গিয়ে গুলের এলিয়ে-পড়া দেহলতা আমার চিরতৃষিত অতৃপ্ত বুকে বিপুল বলে চেপে ধরলুম! তারপর তার বেদনাস্ফুরিত ওষ্ঠপুটে আমার পিপাসী ওষ্ঠ নিবিড়ভাবে সংলগ্ন করে আর্তকণ্ঠে ডাকলুম, ‘গুল–গুল–গুল!’ – প্রবল একটা জলো-হাওয়ার নাড়া পেয়ে শিউলি ঝরে পড়ার মতো শুধু একরাশ ঝরা অশ্রু তার আমার মুখে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল!
অবশ অলস তার ভুজলতা দিয়ে বড়ো কষ্টে সে আমার কণ্ঠ বেষ্টন করে ধরলে, তারপর আরও কাছে – আরও কাছে সংলগ্ন হয়ে নিঃসাড় নিস্পন্দ হয়ে পড়ে রইল!…, মেঘের কোলে লুটিয়ে-পড়া চাঁদের পানসে জ্যোৎস্না তার ব্যথা-কাতর মুখে পড়ে সে কী একটা স্নিগ্ধ করুণমহিমশ্রী ফুটিয়ে তুলেছিল!… সেই অকরুণ স্মৃতিটাই বুঝি আমার ভাবী জীবনের সম্বল, বাকি পথের পাথেয়। …অনেকক্ষণ পরে সে আস্তে চোখ খুলে আমার মুখের পানে চেয়েই চোখ বুজে বললে, ‘এই ‘আশেকের’ হাতে ‘মাশুকের’ মরণ বড়ো বাঞ্ছনীয় আর মধুর, নয় হাসিন?’ আমি শুধু পাথরের মতো বসে রইলুম। আর তার মুখে এক টুকরা মলিন হাসি কেঁপে কেঁপে মিলিয়ে গেল। শেষের সে তৃপ্ত হাসি তার ঠোঁটে আর ফুটল না, শুধু একটা ভূমিকম্পের মতো কীসের ব্যাকুল শিহরণ সঞ্চরণ করে গেল! … তার বুকের লোহুতে আর আমার আঁখের আঁশুতে এক হয়ে বয়ে যাচ্ছিল! সে তখনও আমায় নিবিড় নিষ্পেষণে আঁকড়ে ধরে ছিল আর তার চোখে-মুখে চিরবাঞ্ছিত তৃপ্তির স্নিগ্ধ শান্তশ্রী ফুটে উঠেছিল! – এই কি সে চাচ্ছিল? তবে এই কি তার নারী-জীবনের সার্থকতা? … আর একবার – আর একবার – তার মৃত্যু-শীতল ওষ্ঠপুটে আমার শুষ্ক অধরোষ্ঠ প্রাণপণে নিষ্পেষিত করে হুমড়ি পড়ে ডাক দিলুম, – ‘গুল, গুল, গুল!’ বাতাসে আহত একটা কঠোর বিদ্রুপ আমায় মুখ ভেংচিয়ে গেল, ‘ভুল–ভুল–ভুল!’ …
আবার সমস্ত মেঘ ছিন্ন করে চাঁদের আলোর যেন ‘ফিং’ ফুটছিল। গুলের নিঝুম দেহটা সমেত আমি মূর্ছিত হয়ে পড়ছিলুম, এমন সময় বিপুল ঝঞ্ঝার মতো এসে এক প্রৌঢ়া বেদুইন মহিলা আমার বক্ষ হতে গুলকে ছিনিয়ে নিলে এবং উন্মাদিনীর মতো ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল, ‘গুল–আম্মা–গুল!’
* * *
প্রৌঢ়া তার মৃতা কন্যাকে বুকে চেপে ধরে আর একবার আর্তনাদ করে উঠতেই আমি তার কোলে মূর্ছাতুরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ডাকলুম, ‘আম্মা – আম্মা!’ মার মতো গভীর স্নেহে আমার ললাট চুম্বন করে প্রৌঢ়া কেঁদে উঠল, ‘ফর্জন্দ ফর্জন্দ!’ কাবেরীর জলপ্রপাতের চেয়েও উদ্দাম একটা অশ্রুস্রোত আমার মাথায় ঝরে পড়ল। …
আঃ! কত নিদারুণ সে কন্যাহীনা মার কান্না!
* * *
আমি আবার প্রাণপণে গা ঝেড়ে উঠে কাতরে উঠলুম, ‘আম্মা–আম্মা–মা!’ – একটা রুদ্ধ কণ্ঠে চাপা কান্নার প্রতিধ্বনি পাগল হাওয়ায় বয়ে আনলে – ‘ফর্জন্দ’।…
অনেক দূরে … পাহাড়ের ওপর হতে, … সে কোন্ শোকাতুরা মাতার কাঁদনের রেশ, ভেসে আসছিল, ‘আহ – আহ আহ!’ … আরবি ঘোড়ার ঊর্ধ্বশ্বাস ছোটার পাষাণে আহত শব্দ শোনা গেল–খট্ খট্ খট্!!!
* * *
[ ঙ ]
করাচি
(মেঘম্লান সন্ধ্যা, – সাগর বেলা)
আমি আজ কাঙাল না রাজাধিরাজ? বন্দি না মুক্ত? পূর্ণ না রিক্ত?….
একা এই ম্লান মৌন আরব সাগরের বিজন বেলায় বসে তাই ভাবছি আর ভাবছি। আর আমার মাথার ওপর মুক্ত আকাশ বেয়ে মাঝে মাঝে বৃষ্টি ঝরছে – রিম ঝিম ঝিম!
সাঁঝের তারা
সাঁঝের তারার সাথে যেদিন আমার নতুন করে চেনা-শোনা, সে এক বড়ো মজার ঘটনা।
আরব-সাগরের বেলার ওপরে একটি ছোট্ট পাহাড়। তার বুক রংবেরং-এর শাঁখের হাড়ে ভরা। দেখে মনে হয়, এটা বুঝি একটা শঙ্খ-সমাধি। তাদেরই ওপর একলা পা ছড়িয়ে বসে যে কথা ভাবছিলাম সেকথা কখনও বাজে উদাস পথিকের কাঁপা গলায়, কখনও শুনি প্রিয়-হারা ঘুঘুর উদাস ডাকে; আর ব্যথাহত কবির ভাষায় কখনও কখনও তার আচমকা একটি কথা-হারা কথা – উড়ে-চলা পাখির মিলিয়ে-আসা ডাকের মতো শোনায়।
সেদিন পথ-চলার নিবিড় শ্রান্তি যেন আমার অণু-পরমাণুতে আলস-ছোঁওয়া বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। ঘুমের দেশের রাজকুমারী আমার রুখু চুলের গোছাগুলি তার রজনীগন্ধার কুঁড়ির মতো আঙুল দিয়ে চোখের ওপর হতে তুলে দিতে দিতে বললে, ‘লক্ষ্মীটি এবার ঘুমোও!’ বলেই সে তার বুকের কাছটিতে কোলের উপর আমার ক্লান্ত মাথাটি তুলে নিলে। তার সইদের কণ্ঠে আর বীণায় সুর উঠছিল –
অশ্রু-নদীর সুদূর পারে
ঘাট দেখা যায় তোমার দ্বারে।
আমার পরশ-হরষে সদ্য-বিধবার কাঁদনের মতো একটা আহত-ব্যথা টোল খাইয়ে গেল। আমি ঘুম-জড়ানো কণ্ঠে কণ্ঠ-ভরা মিনতি এনে বললাম, ‘আবার ওইটে গাইতে বলো না ভাই!’ গানের সুরের পিছু পিছু আমার পিপাসিত চিত্ত হাওয়ার পারে কোন্ দিশেহারা উত্তরে ছুটে চলল। তারপর… কেউ কোথাও নেই। একা – একা – শুধু একা! ওগো কোথায় আমার অশ্রু-নদী? কোথায় তার সুদূর পার? কোথায় বা তার ঘাট, আর সে কার দ্বারে? দিকহীন দিগন্ত সারা বিশ্বের অশ্রুর অতলতা নিয়ে আরেক সীমাহারার পানে মৌন ইঙ্গিত করতে লাগল, – ‘ওই – ওই দিকে গো ওই দিকে!’… হায়? কোথায় কোন্ দিকে কে কী ইঙ্গিত করে?
অলস-আঁখির উদাস-চাওয়া আমার সারা অঙ্গে বুলিয়ে মলিন কণ্ঠে কে এসে বিদায়-ডাক দিলে, – ‘পথিক ওঠো! আমার যাওয়ার সময় হয়ে এল।’ আমি ঘুমের দেশের বাদশাজাদির পেশোয়াজ-প্রান্ত দু-হাত দিয়ে মুঠি করে ধরে বললাম, ‘না, না, এখনও তো আমার ওঠবার সময় হয়নি।…কে তুমি ভাই? তোমার সব কিছুতে এত উদাস কান্না ফুটে উঠছে কেন?’ তার গলার আওয়াজ একদম জড়িয়ে গেল। ভেজা কণ্ঠে সে বললে, ‘আমার নাম শ্রান্তি, আজ আমি তোমায় বড্ড নিবিড় করে পেয়েছিলাম।… এখন আমি যাই, তুমি ওঠো! আয় সই ঘুম, ওকে ছেড়ে দে!’