ওরে মুক্ত! ওরে রিক্ত! তোর ভয় নেই, ভয় নেই! এই যে হৃদয়টাকে শুষ্ক করে ফেলেছিস, হাজার বছরের বৃষ্টিপাতেও এতে ঘাস জন্মাবে না, ফুল ফুটবে না! এ বালি-ভরা নীরস সাহারায় ভালোবাসা নেই।
যে ভালোবাসবে না, তাকে ভালোবাসায় কে? যে বাঁধা দেবে না, তাকে বাঁধবে কে? – “আমাকে যে বাঁধবে ধরে, এই হবে যার সাধন, সে কি অমনি হবে?” …
কারবালা
এই সেই বিয়োগান্ত নিষ্করুণ নাটকের রঙ্গমঞ্চ, – যার নামে জগতের সারা মোসলেম নরনারীর আঁখি-পল্লব বড়ো বেদনায় সিক্ত হয়ে ওঠে! এখানে এসেই মনে পড়ে সেই হাজার বছর আগের ধর্ম আর দেশ রক্ষার জন্যে লক্ষ লক্ষ তরুণ বীরের হাসতে হাসতে ‘শহিদ’ হওয়ার কথা! তেমনই বয়ে যাচ্ছে সেই ফোরাত নদী, যার একবিন্দু জলের জন্য দুধের ছেলে, ‘আসগর’ কচি বুকে জহর-মাখা তিরের আঘাত খেয়ে বাবার কোলে তৃষ্ণার্ত চোখ দুটি চিরতরে মুদেছিল! ফোরাতের এই মরুময় কূলে কূলে না জানি সে কত পবিত্র বীরের খুন বালির সঙ্গে মাখানো রয়েছে। আঃ, এ বালির পরশেও যেন আমার অন্তর পবিত্র হয়ে গেল।
কয়েকটা পাষাণময় নিস্তব্ধ গৃহ খাড়া রয়েছে জমাট হয়ে, – উদার অসীম আকাশেরই মতো বিব্রত মরুভূমি তার বালুভরা আঁচল পেতে চলেই গিয়েছে, – ছোট্ট দুটি তৃষ্ণাতুর দুম্বা-শিশু ‘মা’ ‘মা’ করে চিৎকার করতে করতে ফোরাতের দিকে ছুটে আসছে, – শিশির-বিন্দুর মতো সুন্দর কয়েকটি বুভুক্ষু বালিকা ফোরাতের এক হাঁটু জলে নেমে আঁজলা জল পান করে ক্ষুন্নিবৃত্তির চেষ্টা করছে, – বালিতে আর বাতাসে মাতামাতি, – এইসব মিলে কারবালার একটি করুণ চিত্র চোখের সামনে ফুটে উঠছে!
কারবালা! কারবালা!! আজ তোমারই আকাশ, তোমারই বাতাস, তোমারই বক্ষের মতো আমার আকাশ বাতাস বক্ষ সব একটা বিপুল রিক্ততায় পূর্ণ!…
সেদিনও সেই বেদুইন যুবতিগুলোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। – এই অবাধ্য অবুঝ তরুণী সে কী উদ্দাম উচ্ছৃঙ্খল আমার পিছু পিছু ছুটছে। আমি বাইরে বেরোলেই দেখতে পাই, সে একটা মস্ত আরবি ঘোড়ায় চড়ে ফোরাতের কিনারে কিনারে আরবি গজল গেয়ে বেড়াচ্ছে! সে সুরের গিটকারি কত তীব্র – কী তীক্ষ্ণ। প্রাণে যেন খেদং তিরের মতো এসে বিঁধে!
আমি বললুম, ‘ছিঃ গুল, এ কী পাগলামি করছ? – আমার প্রাণে যে ভালোবাসাই নেই, তা ভালোবাসব কী করে?’ সে তো হেসেই অস্থির। মানুষের প্রাণে যে ভালোবাসাই নেই, তা সে নতুন শুনলে। – আমি বিরক্ত হয়ে বললুম, ‘আমায় ভালোবাসবার তোমার তো কোনো অধিকার নেই গুল!’ – সে আমার হাতটা তার কচি কিশলয়ের মতো কম্পিত ওষ্ঠপুটে ছুঁইয়ে আর মুখটা পাকা বেদানার চেয়েও লাল করে বললে, ‘অধিকার না থাকলে আমি ভালোবাসছি কি করে হাসিন? – এ সরল যুক্তির পরে কি আর কোনো কথা খাটে?
[ ঘ ]
আজিজিয়া
কী মুশকিল! কোথায় করবালা আর কোথায় আজিজিয়া! আর সে কতদিন পরেই না এখানে এসেছি! … তবু গুল এখানে এল কী করে?
শুনেছি এদেশের সুন্দরীরা এমনই মুক্ত স্বাধীন আবার এমনই একগুঁয়ে। একবার যাকে ভালোবাসে, তাকে আর চিরজীবনেও ভোলে না। এদের এ সত্যিকারের ভালোবাসা। এ উদ্দাম ভালোবাসায় মিথ্যে নেই, প্রতারণা নেই! – কিন্তু আমি তো এ ‘সাপে-নেঙুলে’ ভালোবাসায় বিলকুল রাজি নই। তা হলে আমার এ রিক্ততার অহংকারের মাথা কাটা যাবে যে।….
কাল যখন গুল আমার পাশ দিয়ে ঘোড়াটা ছুটিয়ে চলে গেল. তখন তার ‘নরগেস’ ফুলের মতো টানা চোখ দুটোয় কী একটা ব্যথা-কাতর মিনতি কেঁপে কেঁপে উঠছিল। তার সেই চকিত চাওয়া, মৌনভাষা যেন কেঁদে কেঁদে কয়ে গেল, ‘বহুত দাগা দিয়া তু বেরহম!’ …
আমি আবার বললুম, ‘আমি যে মুক্ত আমায় বাঁধতে পারবে না! … আমি যে রিক্ত, আমি তোমায় কি দিব?’ সে তার ফিরোজা রং-এর উড়ানিটা দিয়ে আমার হাতদুটো এক নিমেষে বেঁধে ফেলে বললে, ‘এই তো বেঁধেছি! … আর তুমি রিক্ত বলছ হাসিন? তা হোক, আমার কুম্ভভরা ভালোবাসা হতে না হয় খানিক ঢেলে দিয়ে তোমার রিক্ত চিত্ত পূর্ণ করে দেব!’
আমি বলছি, ‘না – না’, সে তত হাসছে আর বলছে, ‘মিথ্যুক, মিথ্যুক, বেরহম!’
সত্যিই তো, এ কী নতুন উন্মাদনা জাগিয়ে দিচ্ছে প্রাণে গুল? কেন আমার শুষ্ক প্রাণকে মুঞ্জরিত করে তুলছ – নাঃ, এখান হতেও সরে পড়তে হবে দেখছি, – আমার কী একটা কথা মনে পড়ছে, ‘সকল গরব হায়, নিমেষে টুটে যায়, সলিল বয়ে যায় নয়নে।’
ওরে আকাশের মুক্ত পাখি, ওরে মুগ্ধ বিহগী! এ কী শিকলি পরতে চাচ্ছিস তা তুই এখন কিছুতেই বুঝতে পারছিসনে। – এড়িয়ে চল – এড়িয়ে চল সোনার শিকল! ‘মানুষ মরে মিঠাতে, পাখি মরে আঠাতে!’
* * *
কুতল-আমারা
(শেষ বসন্তের নিশীথ রাত্রি)
আঃ, খোদা! কেমন করে তুমি এমন দু দুটো আসন্ন বন্ধন হতে আমায় মুক্তি দিলে, তাই ভাবছি আর অবিশ্রান্ত অশ্রু এসে আমাকে বিচলিত করে তুলছে! এ মুক্তির আনন্দটা বড়ো নিবিড় বেদনায় ভরা! রিক্তের বেদন আমার মতো এমনই বাঁধা আর ছাড়ার দোটানার মধ্যে না পড়লে কেউ বুঝতে পারবে না। … হাঁ, এই সঙ্গে একটা নীরস হাসির বেগ কিছুতেই যেন সামলাতে পারছিনে এই দুটো ব্যর্থ-বন্ধনের নিষ্ঠুর কঠিন পরিণাম দেখে। তাই এই নিশীথে একটা পৈশাচিক হাসি হেসে গাইছি, ‘নিঠুর এই করেছ ভালো! এমনি করে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো! এই করেছ ভালো!’ কী হয়েছে, তাই বলছি।–