সমস্ত শাল আর পিয়াল বন কাঁপিয়ে যেন একটা পুত্রশোকাতুরা দৈত্য-জননী ডুকরে ডুকরে কাঁদছে ‘ওই – ওই – ওই!’ আর মাতৃহারা দৈত্যশিশুর মতো এই খ্যাপা গাড়িটাও এপার থেকে কাতরে কাতরে উঠচে উ – উ – উঃ!
[ গ ]
নৌশেরা
এসো আমার বোবা সাথি, এসো! আজ কতদিন পরে তোমায় আমায় দেখা! তোমার বুকে এমনি করে আমার প্রাণের বোঝা নামিয়ে না রাখতে পারলে এতদিন আমার ঘাড় দুমড়ে পড়ত!
আহ্ কী জ্বালা! এতো হাড়ভাঙা পরিশ্রম, এত গাধাখাটুনির মাঝেও সেই একান্ত অন্ধস্মৃতিটার ব্যথা যেন বুকের উপর চেপে বসে আছে!… আজ তাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে! হৃদয়, শক্ত হও – বাঁধন ছিঁড়তে হবে। যে তোমার কখনও হয়নি, যাকে কখ্খনো পাও নি, যে তোমার হয়ত কখ্খনো হবে না, যাকে কখ্খনো পাবে না, যার অজানা ভালোবাসার স্মৃতিটাই ছিল – তোমার সারা বক্ষ বেদনায় ভরে, সেই শাহিদার স্মৃতিটাকেও ধুয়ে মুছে ফেলতে হবে! উঃ! তা … পারবে? সাহস আছে? ‘না’ বললে চলবে না, এ যে পারতেই হবে! মনে পড়ে কি আমাদের দেশের মা ভাই-বোনের দেওয়া উপহার? বুঝেছিলে কী যে, ওগুলি তাঁদের দেওয়া দায়িত্বের, কর্তব্যের গুরুভার? আমাদের কাজের উপর আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। কষ্টিপাথরের মতো সহ্যগুণ আমাদের থাকা চাই, তবে না জগতের লোকে যাচাই করে নেবে যে, বাঙালিরাও বীরের জাতি। এ সময় একটা গোপন স্মৃতি-ব্যথা বুকে পুষে মুষড়ে পড়লে চলবে না। তাকে চাপা দিতেও পারবে না নিঃশেষে বিসর্জন দিতে হবে! একেবারে বাইরের ভিতরের সব কিছু উজাড় করে বিলিয়ে দিতে হবে, তবে না রিক্ততার – বিজয়ের পূর্ণরূপ ফুটে উঠবে প্রাণে! অনেকে জীবন দিয়েছে, তবু এই প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে থাকা মধু-স্মৃতিটুকু বিসর্জন দিতে পারেনি। তোমাকে সেই অসাধ্য সাধন করতে হবে! পারবে? সাধনার সে জোর আছে? – যদি না পার, তবে কেন নিজেকে ‘মুক্ত’, ‘রিক্ত’, ‘বীর’ বলে চেঁচিয়ে আকাশ ফাটাচ্ছ? যার প্রাণের গোপনতলে এখনও কামনা জেগে রয়েছে, সে ভোগী-মিথ্যুক আবার ত্যাগের দাবি করে কোন্ লজ্জায়? সে কাপুরুষের আবার বীরের পবিত্র শিরস্ত্রাণের অবমাননা করবার কী অধিকার আছে? দেশের জন্য প্রাণ দিবে যারা, তারা প্রথমে হবে ব্রহ্মচারী, ইন্দ্রিয়জিৎ! –
মাথার ওপর মা আমার ভাবী-বিজয়ী বীর-সন্তানের মুখের দিকে আসা-উৎসুক নয়নে চেয়ে রয়েছেন, আর পায়ের নীচে এক তরুণী তার অশ্রুমিনতি-ভরা ভাষায় সাধছে, ‘যেয়ো না গো প্রিয়, যেয়ো না।’ কী করবে? … নিশ্চয়ই পারবে! তুমি যে মায়ামমতাহীন কঠোর সৈনিক। …. শক্ত হয় হৃদয় আমার, শক্ত হও! আজ তোমার বিসর্জনের দিন! আজ ওই কাবুল নদীর ধারে ঊষর প্রান্তরটার মতোই বুকটাকে রিক্ত শূন্য করে ফেলতে হবে। তবে না তোমার সমস্ত তৃষ্ণা, সমস্ত সুখ-দুঃখ বৈরাগ্যের যজ্ঞকুণ্ডে আহুতি দিতে পূর্ণ রিক্ততার গান ধরবে, –
‘ওগো কাঙাল, আমারে কাঙাল করেছ
আরো কি তোমার চাই?
ওগো ভিখারি, আমার ভিখারি, –
পলকে সকলই সঁপেছি চরণে আর তো কিছুই নাই। –
আরও কি তোমার চাই?’
* * *
কুর্দিস্তান
পেয়েছি, – পেয়েছি! ওঃ, আজ দীর্ঘ এক বৎসর পরে আমার প্রাণ কেন পূর্ণ-রিক্ততায় ভরে উঠেছে বলে বোধ হচ্ছে! … এই এক বৎসর ধরে সে কী ভয়ানক যুদ্ধ মনের সাথে! এ সমরে কত কিছুই না মারা গেল!… বাইরের যুদ্ধের চেয়ে ভিতরের যুদ্ধ কত দুরন্ত দুর্বার! রণজিৎ অনেকেই হতে পারে, কিন্তু মনজিৎ ক-জন হয়? – সে কেমন একটা প্রদীপ্ত কাঠিন্য আমাকে ক্রমেই ছেয়ে ফেলেছে! সে কী সীমাহীন বিরাট শূন্য হয়ে গেছে হৃদয়টা আমার! – এই কি রিক্ততা? … ভোগও নেই – ত্যাগও নেই; তৃষ্ণাও নেই – তৃপ্তিও নেই; প্রেমও নেই – বিচ্ছেদও নেই; – এ যেন কেমন একটা নির্বিকার ভাব! না ভাই, না এমন রিক্ততা-ভরা তিক্ততা দিয়ে জীবন শুধু দুর্বিষহই হয়ে পড়ে! এমন কঠিন অকরুণ মুক্তি তো আমি চাইনি! এ যেন প্রাণহীন মর্মর-মন্দির! …
তবু কিন্তু রয়ে রয়ে মর্মরের শক্ত বুকে শুক্লা চাঁদিনীর মতো করুণ মধুর হয়ে সে কার স্নিগ্ধশান্ত আলো হৃদয় ছুঁয়ে যায়? – হায় ছুঁয়ে যায় বটে, কিন্তু আর তো নুয়ে যায় না! … দেখেছ? আমার অহংকারী মন তবু বলতে চায় যে, ওটি নিজেকে নিঃশেষ করে বিলিয়ে দেওয়ার একটা অখণ্ড আনন্দের এক কণা শুভ্র জ্যোতি! – তবু সে বলবে না যে ওটা একটি বিসর্জিতা প্রতিমার প্রীতির কিরণ! …
আঃ, আজ এই আরবের উলঙ্গ প্রকৃতির বুকে-মুখে মেঘমুক্ত শুভ্রজ্যোৎস্না পড়ে তাকে এক শুক্লবসনা সন্ন্যাসিনীর মতো দেখাচ্ছে! এদেশের এই জ্যোৎস্না এক উপভোগ করবার জিনিস। পৃথিবীর আর কোথাও বুঝি জ্যোৎস্না এত তীব্র আর প্রখর নয়। জ্যোৎস্না রাত্রিতে তোলা আমার ফটোগুলো দেখে কেউ বিশ্বাস করবে না যে, এগুলো জ্যোৎস্নালোকে তোলা ফটো। ঠিক যেন শরৎ প্রভাতের সোনালি রোদ্দুর।
হাঁ, – এতে মস্ত আর এক মুশকিলে পড়লুম দেখছি। … ডালিম ফুলের মতোই সুন্দর রাঙা টুকটুকে একটি বেদুইন যুবতি পাকড়ে বসেছে যে, তাকে বিয়ে করতেই হবে! সে কী ভয়ানক জোর-জবরদস্তি। আমি যত বলছি ‘না’, সে তত একরোখা ঝোঁকে বলে, ‘হাঁ, নিশ্চয়ই হাঁ!’ সে বলেছে যে, সে আমাকে বড্ডো ভালোবেসে ফেলেছে, আমি বলছি যে, আমি তাকে একদম ভালোবাসিনি। সে বলছে, তাতে কিছু আসে যায় না, – আমাকে ভালোবেসেছে, আমাকেই তার জীবনের চিরসাথি বলে চিনে নিয়েছে – বাস! এই যথেষ্ট! আমার ওজর-আপত্তির মানেই বোঝে না সে! আমি যতই তাকে মিনতি করে বারণ করি, সে ততই হাসির ফোয়ারা ছুটিয়ে বলে, ‘বাঃ – রে, আমি যে ভালোবেসেছি, তা তুমি বাসবে না কেন?’ – হায়, একী জুলুম!