এমনি করেই খুব সুখে দিন যাচ্ছিল আমাদের! আমি মনে করতুম, আর যটা দিন বাঁচি এমনি করে সোয়ামির সেবা করে, ছেলে-মেয়ে চরিয়ে, নাতিপুতি দেখে আমার হাতের নোওয়া অক্ষয় রেখে মরি ; কিন্তু তা আমার পোড়া বিধাতার সইল না। আমার সাধের ঘরকন্না শ্মশানপুরী হয়ে গেল! আর এত আশা-ভরসা সব-তাতে চুলোর ছাই-পাঁশ পড়ল! শুনে যা দিদি, শুনে যা সব, আর যদি দোষ দেখিস তো তোর ওই মুড়ো খ্যাংরা দিয়ে আমার বিষ ঝেড়ে দিয়ে যাস, সাত উনুনের বাসি ছাই আমার পোড়া মুখে দিয়ে দিস! হায় বুন, আমার ‘দুখখুর’ কথা শুনলে পাথর গলে মোম হয়ে যায়, কিন্তু গাঁয়ের এই বে-দিল মানুষগুলো আমায় এতটুকু পেরবোধ তো দেয়ই না, তার উপর রাত্তির-দিন নানান কথা বলে জানটাকে খেপিয়ে তুলেছে! মনে করি আমার সব পেটের কথা কারুর কাছে তন্ন তন্ন করে বলি আর খুব আর খুব একচোট কেঁদে নিয়ে মনটাকে হালকা করি। তা যারই কাছ ঘেঁসতে চাই, সেই মনে করে এই আমায় খেলে রে। আমি যেন ডাইনি কুহকীরও অধম! এই ‘হেনস্থা’ আর ভয় করার দরুনে আমার সমস্ত মগজটা চমচম করে ধরে যায়। কাজেই আমার পাগলামি তখন আরও বেড়ে যায়। সাধে কি আমার মুখ দিয়ে এত গালিগালাজ শাপমন্যি বেরোয়, বুন! তুই সব কথা শুন আর নাথি মেরে আমার থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দিয়ে যা!
[ খ ]
তু তো বরাবরই জানতিস দিদি, আমাদের পাঁচুর বাপ ছিল বরাবরকার সিদেসাদা মানুষ, সে হের-ফের বা কথার প্যাঁচ বুঝত না। নাকটা সোজাসুজি না দেখিয়ে হাতটা পিঠের দিক দিয়ে বাঁকিয়ে এনে দেখানোটা তার মগজে আদৌ ঢুকত না। কত আঁটকুড়ো নদী-ভরাই যে ওকে দিয়ে বিনি পয়সার বেগার খাটিয়ে নেত, হাত হতে পয়সা ভুলিয়ে নেত, তার আর সংখ্যা নাই! ওই নিয়ে বেচারাকে আমি কতদিন গালমন্দ দিয়েছি, কত বুদ্ধি দিতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় নাই। কথায় বলে, ‘স্বভাব যায় না মলে’ – ওর আর একটা বদ-অভ্যেস ছিল, ও বড্ড মদ খেত। কতদিন বলেছি, ‘তুমি মদ খাও ক্ষতি নাই, দেখো তোমায় মদে যেন না খায়!’ কিন্তু সে তা শুনত না; একটু ফাঁক পেলেই যা রোজগার করত তা সব শুঁড়ির পায়ে ঢেলে আসত। যাক, ওরকম দু-চারটে বদ অভ্যাস পুরুষ মানুষের থাকেই থাকে – ওতে তেমন আসত যেত না, কিন্তু অমন শিবের মতো সোয়ামি আমার শেষে এমন কাজ করে ফেললে, যা বুন তুই কেন – আমারও এখন বিশ্বাস হচ্ছে না। তার মতো অমন সোজা লোক পেয়ে কে কী খাইয়ে দিয়ে তাকে যে অমন করে দিয়েছিল, তা আমি নিজেই বুঝতে পারি নাই।
জানিস ওপাড়ার রঘো বাগদির দু-তিনটে ‘স্যাঙ্গা-করা’ কড়ুই রাঁড়ি’ মেয়েটা কিরকম পাড়া মাথায় করে তুলেছিল। ছুঁড়ি কখনও সোয়ামির ঘর তো করেই নাই, মাঝ থেকে পাড়ার ছেলে-ছোকরাদের কাঁচা বুকে ঘুণ ধরিয়ে দিচ্ছিল। আর তার বাপ মাকেই বা কী বলব, – ছি, আমারই মনে হত যে, বিষ খেয়ে মরি! মাগো মা, বাগদি জাতটার উপর ঘেন্না ধরিয়ে দিলে! –
‘তু তো জানিস মাখন-দি, ঝুটমুট আমদের গাঁয়ের লোকের আর আমাদের বাগদিগুলোর বিশ্বাস ছিল যে, আমাদের হাতে অনেক টাকা আছে। আবার সে কত পুতখাগীর বেটিরা লোকের ঘরে ঘরে রটিয়ে এসেছিল, আমরা নাকি যক্ষির টাকা পেয়েছি। বল তো বুন এতে হাসি পায় না?
‘হেঁ,– আমাদের ওই টাকার লোভেই ওই ‘রাঁড় হয়ে ষাঁড় হওয়া’ ছুড়িটা ওই শিবের মতোন সোজা ভোলানাথ সোয়ামিকে আমার পেয়ে বসল। আর সত্যি বলতে কি মিনসের চেহারাও তো আর নেহাত মন্দ ছিল না! ধুতি-চাদর পরিয়ে দিলে মনে হত একটি খাসা ‘ভদ্দরনুক’।
‘ওরে যেদিন আমি পেত্থম এই কথাটি শুনলুম, তখন আমার মনটা যে কেমন হয়ে গেল, তা বুন তোকে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না। মাথায় বাজ পড়লেও বোধ হয় লোকে এত বেথা পায় না। আমি সেদিন তাকে রাতে খুব ঝাঁটাপেটা করলুম! অ বুন! – যে অমন মাটির মানুষ, সাত চড়ে যার রা বেরোত না, সেও কিনা সেদিন আমার এই ঝুঁটি ধরে একটা চেলাকাঠে করে উঃ সে কী মার মারলে! কাঠটার চেয়েও বেশি ফেটে ফেটে আমার পিঠ দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। কিন্তু সত্যি বলতে কী, তখনকার এত যে বাইরের বেথা, তাতো আমি বুঝতে পারছিলুম না, কেননা আমার বুকটা তখন আরও বেশি ফেটে গিয়েছিল! আমি যে সেদিন স্পষ্ট বুঝলুম, আমার নিজের সোয়ামি আজ পর হল! আমি দেখতে পেলুম, আমার কপাল পুড়েছে। তখন ঠিক যেন কেউ তপ্ত লোহা দিয়ে আমার বুকের ভিতরটায় ছ্যাঁকা দিচ্ছিল – আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলুম!
সেই সঙ্গে আমার যত রাগ হল সেই হারামজাদি বেটির উপর। মনে হতে লাগল, এখন যদি তাকে পাই, তো নখে করে ছিঁড়ে ফেলি। কিন্তু কোনোদিনও তার নাগাল পাই নাই। সে আমাকে দেখলেই সরে পড়ত।
[ গ ]
ক্রমেই আমার সোয়ামি বাড়াবাড়ি আরম্ভ করলে। সে আর প্রায়ই ঘরে আসত না! মুনিব-ঘরে খাটত, খেত, আর ওদের ঘরটাতেই গিয়ে শুয়ে থাকত! আমি, আমার ছেলে, পাড়ার সব ভালো লোক মিলে কত বুঝালুম তাকে। কিন্তু হায়, তাকে আর ফিরাতে পারলুম না, ছুঁড়ি যে ওকে যাদু করেছিল! একেবারে ভেড়া বানিয়ে দিয়েছিল! তখন বুঝলুম এতদিনে মিনসের ভীমরতি ধরেছে; ওকে ‘ঊনপঞ্চাশে’ পেয়েছে; তা নইলে কি এমন চোখের মাথা খেয়ে বসে লোকে! একদিন পায়ে ধরে জানালুম, সে কত বড়ো ভুল করতে যাচ্ছে। সে আমার মুখে লাথি মেরে চলে গেল। আমার সারা দেহ দিয়ে আগুনের মতো গরম কী একটা ঠিকরে বেরুতে লাগল। বুঝলুম সে এত বেশি এগিয়ে গিয়েছে নরকের দিকে যে, তাকে ফেরানো যায় না।