তোমার পবিত্র নামের শপথ করে এই যে তরবারি ধরলুম খোদা, এ আর আমার হাত হতে খসবে না! তুমি বাহুতে শক্তি দাও! – এই তরবারির তৃষ্ণা মিটাব – প্রথমে দেশদ্রোহী শয়তানদের জিগরের খুনে, তারপর দেশ-শত্রুর কলুষরক্তে। – আমিন!!!
* * *
হাঁ, আমার মনে হচ্ছে হয়তো আমার দেশের ভাই-ই আমায় হত্যা করবে জল্লাদ হয়ে! … তা হোক, তবু তো সুখে মরতে পারব, কেননা আমার এ ক্ষুদ্র প্রাণ দেশের পায়েই উৎসর্গীকৃত হবে! – ‘খোদা! আমার এ দান যেন তুমি কবুল করো।’
* * *
বেশ হয়েছে! খুব হয়েছে!! আচ্ছা হয়েছে!!!
আমার এই চিরবিদায়ের সময় কেন কাল মনে হল, সে অভাগিকে একবার দেখে যাই। কেন সে ইচ্ছাকে কিছুতেই দমন করতে পারলুম না। … গিয়ে দেখলুম তার ত্যক্ত বাড়িটা ধূলি আর জঙ্গলময় হয়ে সদ্যবিধবা নারীর মতো হাহাকার করছে! … আর – আর ও কি? … ঘরের আঙিনায় ও কার কবর? যেন কার এক বুক বেদনা উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে। কার পাহাড়পারা ব্যথা জমাট হয়ে যেন মূর্ছিত হয়ে মাটি আঁকড়ে রয়েছে!… কবরের শিরানে কার বুকের রক্ত দিয়ে মর্মর ফলকে লেখা, ‘অপবিত্র জঠরে জন্ম নিলেও ওগো পথিক, আমায় ঘৃণা করো না! একবিন্দু অশ্রু ফেলো, আমার কল্যাণ কামনা করে – আমি অপবিত্র কি-না জানি না, কিন্তু পবিত্র ভালোবাসা আমার এই বুকে তার পরশ দিয়েছিল! … আর ওগো স্বামিন্! তুমি যদি কখনও এখানে আস, – আঃ, তা আসবেই – তবে আমায় মনে করে কেঁদো না। যেখানেই থাকি প্রিয়তম, আমাদের মিলন হবেই। এমন আকুল প্রতীক্ষার শেষ অবসান এই দুনিয়াতেই হতে পারে না। খোদা নিজে যে প্রেমময়! – অভাগিনি – গুলশন!’
আমার এক বুক অশ্রু ঝরে মর্মর-ফলকের মলিন রক্ত লেখাগুলিকে আরও অরুণোজ্জ্বল করে দিলে!…
ঝিলমের ওপার হতে কার আর্ত আর্দ্র সুর এপারে এসে আছাড় খাচ্ছিল,
আগর মেয় বাগবাঁ হোতে তো গুলশন কো
লুটা দেতে।
পাকড় কর দস্তে বুলবুল কো চমন সে জাঁ
মেলা দেতে॥
হায়রে অবোধ গায়ক! তুই যদি মালি হতিস, তা হলে বুলবুলের হাত ধরে ফুলের সঙ্গে মিলন করিয়ে দিতিস – অসম্ভব রে, তা অসম্ভব। খোদা হয়তো তোকে সে শক্তি দেননি, কিন্তু যাদের সে শক্তি আছে ভাই, তাঁরা তো কই এমন করা তো দূরের কথা, একবার তোর এই কথা মুখেও আনতে পারে না! তোরই এই ক্ষমতা থাকলে হয়তো তুই এ গান গাইতে পারতি নে!….
* * *
তবু আমার চিরবিদায়ের দিনে ওই গানটা বড্ড মর্মস্পর্শী মধুর লেগেছিল।
রাক্ষুসি
রাক্ষুসি
(বীরভূমের বাগদিদের ভাষায়)
[ ক ]
আজ এই পুরো দুটো বছর ধরে, ভাবছি, শুধু ভাবছি, – আর সবচেয়ে আশ্চয্যি হচ্ছি, লোকে আমাকে দেখলেই এমন করে ছুটে পালায় কেন! পুরুষেরা, যাঁরা সব পর্দার-আড়ালে গিয়ে মেয়ে-মহলে খুব জাঁদরেলি রকমের শোরগোল আর হল্লা করেন, আর যাঁদের সেই বিদঘুটে চেঁচানির চোটে ছেলেমেয়েরা ভয়ে ‘নফ্সি নফ্সি’ করে, সেই মদ্দরাই আবার আমায় দেখলে হুঁকো হাতে দাওয়া হতে আস্তে আস্তে সরে পড়েন, তখন নাকি তাঁদের অন্দর-মহলে যাওয়ার ভয়ানক ‘হাজত’ । মেয়েরা আমাকে দেখলেই কাঁখ হতে দুম করে কলসি ফেলে সে কী লম্বা ছুট দেয়! ছেলেমেয়েরা তো নাকমুখ সিঁটকে ভয়ে একেবারে আঁতকে উঠে। হাজার গজ দূর থেকে বলে, ‘ওরে বাপরে, ওই এল পাগলি রাক্ষুসি মাগি, পালা – পালা! খেলে, খেলে!’ – কেনে! আমি কোন্ উনোনমুখো সুঁটকোর পাকা ধানে মই দিয়েছি? কোন্ খালভরা ড্যাকরার মুখে আগুন দিয়েছি? কোন্ চোখখাগী আবাগির বেটির বুকে বসে তপ্ত খোলা ভেঙেছি? কার গতর আমকাঠ না কুল-কাঠের আখায় চড়িয়েছি? কোন্ ছেলেমেয়ের কাঁচা মাথাটা চিবিয়ে খেয়েছি? বল তো বুন, তাদের কি ‘সরোকার’ আছে আমায় যা তা বলবার? কে তারা আমার? – মেরেছি? – বেশ করেছি, নিজের ‘সোয়ামিকে’ মেরেছি! … শুধু মেরেছি? দা দিয়ে কেটেছি! তাতে ওদের এত বুক চড় চড় করবে কেন? ওদের কারুর বুক থেকে তো সোয়ামিকে কেড়ে লি নাই, আর হত্যেও করি নাই, তাতে ওদের কথা বলবার আর সাওখুড়ি করবার কী আছে? ওরা কি আমার সাতপুরুষের কুটুম না গিয়াঁত? যদি এই রকমই করতে থাকে, তবে আমি সত্যিকারের রাক্ষুসিই হয়ে দাঁড়াব বলে রাখছি তখন। এক এক দায়ের কোপে ওদের সোয়ামির মাথাগুলো ধড় থেকে আলাদা করে দিব, মেয়েগুলোর বুক ফেঁড়ে কলজেগুলো ধরে পিষে পিষে দিব, তবে না সে আমার নাম সত্যসত্যিই রাক্ষুসি হয়ে দাঁড়াবে!
আমায় পাগল করলে কে? এই মানুষগুলোই তো – আমি তো ফের তেমনি করেই – যেন কিছু হয় নাই – ঘর পেতেছিলুম। রাত্তির দিন আমার কানের গোড়ায় আনাচে-কানাচে, পথে-ঘাটে, কাজেকর্মে, মজলিসে-জৌলুসে আমার নামে রাক্ষুসি রাক্ষুসি বলে কুৎসা, ঘেন্না, মুখ ব্যাঁকানি, চোখ রাঙানি, – এই সব মিলেই তো আমার মাথার মগজ বিগড়ে দিল? যে ব্যথাটাকে আমি আমার মনের মাঝেই চেপে রেখেচিলুম সেটাকে আবার জাগিয়ে তুলে চোখের সামনে সোজা করে ধরলে তো এরাই! আচ্ছা তুই-ই বল তো বুন, এ পাগল হওয়ার দোষটা কার? একটা ভালো মানুষকে খোঁচা মেরে মেরে ক্ষেপিয়ে তুললে সে দোষটা কি সেই ভালোমানুষের, না যে ভালোমানুষেরা তাকে খেপিয়ে তোলে, তাদের? –
আমার সোয়ামি ছিল সিদেসাধা মানুষ, সে তো সোজা ছাড়া বাঁকা কিছু জানত না। সে চাষ করত, কিরষাণি করত, আমি সারাটি দিন মাছ ধরে চাল কেঁড়ে, ধান ভেনে আনতুম। তা না হলে চলবে কী করে দিদি? তখন আমাদের তিনটি পুষ্যি, – বড়ো ছেলে সোমত্থ হয়ে উঠেছে, বে-থা না দিলে ‘উপর-নজর’ হবে, মেয়েটাও ঢ্যাং-ঢেঙিয়ে বেড়ে উঠেছিল, আর আমার ‘কোলাপুঁছা’ ছোটো মেয়েটিও তখন হাঁক্কো হাঁক্কো করে দু-একটি কথা ফুটছিল। ছা-পোষা মানুষ হলেও দিদি আমাদের সংসারে তো অভাব ছিল না কোনো কিছুর, তোমাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে। এই বিন্দিই তখন নাই নাই করে দিনের শেষে তিনটি সের চাল-তরকারির জন্যে মাছ রে, শামুক রে, গুগলি রে পিত্থিমির জিনিস জোগাড় করে আনত। তাছাড়া বড়ো ছেলেটাও তোমাদের শীচরণের আশীর্বাদে করে কর্মে দু-পয়সা ঘরে আনছিল। মেয়েটাও পাড়ার বউ-ঝিদের সঙ্গে যা দু-চারটে শাগ-মাছ আনত, তাতেও নেহাৎ কম পয়সা হত না। লুন-তেলের খরচটা ও দিয়েই বেশ দিব্যি চলে যেত। এ সবের উপর সোয়ামি বছরের শেষে চাষবাস আর কিরষাণি করে যা ধান-চাল আনত তাতে সারা বছর খুব ‘সচল বচল’ করে খেয়েও ফুরাত না। সংসারে তখন কি ছিরিই ছিল! লক্ষ্মী যেন মুখ তুলে চেয়েছিলেন। এত সব কার জন্যে – ওই ছেলে-মেয়েগুলির জন্যেই তো? সারাদিন রেতে একটি সেরের বেশি চাল রাঁধতাম না। বলি আহা, শেষে আমার ছেলেরা কষ্ট পাবে! সোয়ামি আর ছেলেগুলোকে দিতুম ভাত, আর নিজে খেতুম মাড় – শুধু ভাতের ফেন! মেয়ে মানুষের আবার সুখ কী, ছেলেমেয়ে যদি ঠান্ডা রইল তাতেই আমাদের জান ঠান্ডা! নাইবা হলুম জমিদার। আমরা তো কারুর কাছে ভিক্ষে করতুম না, চুরি-দারিও করতুম না। নিজের মেহনতের পয়সা নেড়ে-চেড়ে খেতাম। নিজে খেতুম, আর পালে রে পার্বণে রে যেমন অবস্থা দু-দশটা অতিথ-ফকিরকেও খাওয়াতুম। আহা, ওতেই তো আমার বুক ভরে ছিল দিদি! লোকে বলত আমি নাকি বড্ডো ‘কিরপণ’; কারণ আমি একটি পয়সা বাজে খরচ করতুম না। তা বললে আর কী করব, তাতে আমার বয়ে যেত। তারা তো জানতো না, আমার মাথায় কী বোঝা চাপানো রয়েছে। দু দুটো মেয়ে আর একটি ছেলের বিয়ে দিতে হবে, বাড়িতে বউ আসবে, জামাই আসবে, আমার এই মাটির ঘরই আনন্দে ইন্দিরপুরি হয়ে উঠবে, দুটো সাদ-আরমান আছে – তাতে কত খরচ বল দিকিনি বুন? দায়ে ঠেকলে কেউ একটা পয়সা কর্জ দিয়ে চালাবে? বাপরে বাপ এই বিন্দির অজানা নেই গো, গলায় সাপ বেঁধে পড়লেও কোনো বেটি একটি ক্ষুদ্রকণা দিয়ে শুধোয় না। তার আবার গুমোর! আমার কাছে ও-সব শুধু কথায় চিঁড়ে ভিজে না বাপু! তবে বুঝতুম, অনেক কড়ুই রাঁড়ির বুক চচ্চড় করত হিংসেয় আমাদের এই এতটুকু সুখ দেখে।