Site icon BnBoi.Com

ব্যথার দান – কাজী নজরুল ইসলাম

ব্যথার দান - কাজী নজরুল ইসলাম

০১. দারার কথা

গোলেস্তান
গোলেস্তান! অনেক দিন পরে তোমার বুকে ফিরে এসেছি। আঃ মাটির মা আমার, কত ঠান্ডা তোমার কোল! আজ শূন্য আঙিনায় দাঁড়িয়ে প্রথমেই আমার মনে পড়ছে জননীর সেই স্নেহবিজড়িত চুম্বন আর অফুরন্ত অমূলক আশঙ্কা, আমায় নিয়ে তাঁর সেই ক্ষুধিত স্নেহের ব্যাকুল বেদনা,… সেই ঘুম-পাড়ানোর সরল ছড়া, –

ঘুম-পাড়ানি, মাসি-পিসি ঘুম দিয়ে যেয়ো,
বাটা ভরে পান দেব গাল ভরে খেয়ো!

আরও মনে পড়ছে আমাদের মা-ছেলের শত অকারণ আদর-আবদার! সে মা আজ কোথায়?

দু-এক দিন ভাবি, হয়তো মায়ের এই অন্ধ স্নেহটাই আমাকে আমার এই বড়ো-মা দেশটাকে চিনতে দেয়নি। বেহেশ্‌ত হতে আবদেরে ছেলের কান্না মা শুনতে পাচ্ছেন কিনা জানিনে, কিন্তু এ আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি যে, মাকে হারিয়েছি বলেই – মাতৃ-স্নেহের ওই মস্ত শিকলটা আপনা হতে ছিঁড়ে গিয়েছে বলেই আজ মার চেয়েও মহীয়সী আমার জন্মভূমিকে চিনতে পেরেছি। তবে এও আমাকে স্বীকার করতে হবে, – মাকে আগে আমার প্রাণ-ভরা শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালোবাসা অন্তরের অন্তর থেকে দিয়েই আজ মার চেয়েও বড়ো জন্মভূমিকে ভালোবাসতে শিখেছি। মাকে আমি ছোটো করচি নে। ধরতে গেলে মা-ই বড়ো। ভালবাসতে শিখিয়েছেন তো মা। আমার প্রাণে স্নেহের সুরধুনী বইয়েছেন তো মা। আমাকে কাজ-অকাজে এমন করে সাড়া দিতে শিখিয়েছেন যে মা! মা পথ দেখিয়েছেন, আর আমি চলেছি সেই পথ ধরে। লোকে ভাবছে, কী খামখেয়ালি পাগল আমি! কী কাঁটা-ভরা ধ্বংসের পথে চলেছি আমি! কিন্তু আমার চলার খবর মা জানতেন, আর সে-কথা শুধু আমি জানি।

আমায় লোকে ঘৃণা করছে? আহা, আমি ওই তো চাই। তবে একটা দিন আসবেই যেদিন লোকে আমার সঠিক খবর জানতে পেরে দু-ফোঁটা সমবেদনার অশ্রু ফেলবেই ফেলবে। কিন্তু আমি হয়তো তা আর দেখতে পাব না। আর তা দেখে অভিমানী স্নেহ-বঞ্চিতের মতো আমার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না আসবে না। সেদিন হয়তো আমি থাকব দুঃখ-কান্নার সুদূর পারে।

চমন
আচ্ছা মা! তুমি তো মরে শান্তি পেয়েছ, কিন্তু এ কী অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে গেলে আমার প্রাণে? আমি চিরদিনই বলেছি, না – না – না, আমি এ পাপের বোঝা বইতে পারব না, কিন্তু তা তুমি শুনলে কই? সেকথা শুধু হেসেই উড়িয়ে দিলে, যেন আমার মনের কথা সব জান আর কী! … এই যে বেদৌরাকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেলে, এর জন্যে দায়ী কে? এখন যে আমার সকল কাজেই বাধা! কোথাও পালিয়েও যে টিকতে পারছিনে! … আমি আজ বুঝতে পারছি মা, যে, আমার এই ঘর-ছাড়া উদাস মনটার স্থিতির জন্যেই এই পুষ্প-শিকলটা তোমার চির-বিদায়ের দিনে নিজের হাতে আমায় পরিয়ে গিয়েছ। ওই মালাই তো হয়েছে আমার জ্বালা! লোহার শিকল ছিন্ন করবার ক্ষমতা আমার আছে, কিন্তু ফুলের শিকল দলে যাওয়ার মতো নির্মম শক্তি তো নেই আমার। … যা কঠোর, তার উপর কঠোরতা সহজেই আসে; কিন্তু যা কোমল পেলব নমনীয়, তাকে আঘাত করবে কে? তারই আঘাত যে আর সইতে পারছিনে!

হতভাগিনি বেদৌরা! সে কথা কি মনে পড়ে – সেই মায়ের শেষ দিন? – সেই নিদারুণ দিনটা? – মায়ের শিয়রে মরণের দূত ম্লান মুখে অপেক্ষা করছে – বেদনাপ্লুত তাঁর মুখে একটা নির্বিকার তৃপ্তির আবছায়া ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে, – জীবনের শেষ রুধিরটুকু অশ্রু হয়ে তোমার আর আমার মঙ্গলেচ্ছায় আমাদেরই আনত শিরে চুঁইয়ে পড়ছে। মার পূত সে শেষের অশ্রু বেদনায় যেমন উত্তপ্ত, শান্ত স্নেহভরা আশিসে তেমনই স্নিগ্ধ-শীতল! তোমার অযতনে-থোওয়া কালো কোঁকড়ান কেশের রাশ আমাকে সুদ্ধ ঝেঁপে দিয়েছে, আর তার অনেকগুলো আমাদেরই অশ্রু-জলে সিক্ত হয়ে আমার হাতে-গলায় জড়িয়ে গিয়েছে – আমার হাতের উপর কচি পাতার মতো তোমার কোমল হাত দুটি থুয়ে মা অশ্রু-জড়িত কণ্ঠে আদেশ করছেন, – ‘দারা, প্রতিজ্ঞা কর, বেদৌরাকে কখনো ছাড়বিনে।’

তারপর তাঁর শেষের কথাগুলো আরও জড়িয়ে ভারী হয়ে এল, – ‘এর আর কেউ নেই যে বাপ, এই অনাথা মেয়েটাকে যে আমিই এত আদুরে আর অভিমানী করে ফেলেছি!’

সে কী ব্যথিত-ব্যাকুল আদেশ, গভীর স্নেহের সে কী নিশ্চিত নির্ভরতা!

তারপরে মনে পড়ে বেদৌরা, আমাদের সেই কিশোর মর্মতলে একটু একটু করে ভালোবাসার গভীর দাগ, গাঢ় অরুণিমা। … মুখোমুখি বসে থেকেও হৃদয়ের সেই আকুল কান্না, মনে পড়ে কি সে সব বেদৌরা? তখন আপনি মনে হত, এই পাওয়ার ব্যথাটাই হচ্চে সব চেয়ে অরুন্তুদ! তা না হলে সাঁঝের মৌন আকাশতলে দুজনে যখন গোলেস্তানের আঙুর-বাগিচায় গিয়ে হাসতে হাসতে বসতাম তখন কেন আমাদের মুখের হাসি এক নিমেষে শুকিয়ে গিয়ে দুইটি প্রাণ গভীর পবিত্র নীরবতায় ভরে উঠত? তখনও কেন অবুঝ বেদনায় আমাদের বুক মুহুর্মুহু কেঁপে উঠত? আঁখির পাতায় পাতায় অশ্রু-শীকর ঘনিয়ে আসত? …

আজ সেটা খুব বেশি করেই বুঝতে পেরেছি বেদৌরা। কেননা এই যে জীবনের অনেকগুলো দিন তোমার বিরহে কেটে গেল, তাতে তোমাকে না হারিয়ে আরও বড়ো করে পেয়েছি। তোমায় যে আমি হারিয়েছিলাম সে তোমাকে এত সহজে পেয়েছিলাম বলেই। বিরহের ব্যথায় জানটা যখন ‘পিয়া পিয়া’ বলে ‘ফরিয়াদ’ করে মরে, তখনকার আনন্দটা এত তীব্র যে, তা একমাত্র বিরহীর বুকই বোঝে, তা প্রকাশ করতে আর কেউ কক্ষনো পারবে না। দুনিয়ায় যত রকম আনন্দ আছে, তার মধ্যে এই বিচ্ছেদের ব্যথাটাই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি আনন্দময়।

আর সেই দিনের কথাটা? – সেদিন বাস্তবিক সেটা বড়ো আঘাতের মতোই প্রাণে বেজেছিল! আমার আজও মনে পড়ছে, সেদিন ফাগুন আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে আকাশে বাতাসে ফলে ফুলে পাতায় … আর সবচেয়ে বেশি করে তরুণ-তরুণীদের বুকে!

আঙুরের ডাঁশা থোকাগুলো রসে আর লাবণ্যে ঢল-ঢল করছে পরিস্তানের নিটোল-স্বাস্থ্য ষোড়শী বাদশাজাদিদের মতো! নাশপাতিগুলো রাঙিয়ে উঠেছে সুন্দরীদের শরম-রঞ্জিত হিঙুল গালের মতো! রস-প্রাচুর্যের প্রভাবে ডালিমের দানাগুলো ফেটে ফেটে বেরিয়েছে কিশোরীদের অভিমানে-স্ফূরিত টুকটুকে অরুণ অধরের মতো। পেস্তার পুষ্পিত খেতে বুলবুলদের নওরোজের মেলা বসেছে। আড়ালে আগডালে বসে কোয়েল আর দোয়েল-বধূর গলা-সাধার ধুম পড়ে গিয়েছে, কী করে তারা ঝংকারে ঝংকারে তাদের তরুণ স্বামীদের মশগুল করে রাখবে। উদ্দাম দখিন হাওয়ার সাথে ভেসে-আসা একরাশ খোশবুর মাদকতায় আর নেশায় আমার বুকে তুমি ঢলে পড়েছিলে। শিরাজ বুলবুলের ‘দিওয়ান’ পাশে থুয়ে আমি তোমার অবাধ্য দুষ্টু এলো চুলগুলি সংযত করে দিচ্ছিলাম, আর আমাদের দুজনারই চোখ ছেপে অশ্রু বয়েই চলেছিল।

মিলনের মধুর অতৃপ্তি এই রকমে বড়ো সুন্দর হয়েই আমাদের জীবনের প্রথম অধ্যায়ের পাতাগুলো উলটে দিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় সব উলট-পালট হয়ে গেল, ঠিক যেমন বিরাট বিপুল এক ঝঞ্ঝার অত্যাচারে একটা খোলা বই-এর পাতা বিশৃঙ্খল হয়ে যায়। … সে এলোমেলো পাতাগুলি আবার গুছিয়ে নিতে কী বেগই না পেতে হয়েছে আমায় বেদৌরা! … তা হোক, তবু তো এই ‘চমনে’ এসে তোমায় ফের পেয়েছি। তুমি যে আমারই। বাঙালি কবির গানের একটা চরণ মনে পড়ছে –

তুমি আমারই যে তুমি আমারই,
মম বিজন জীবন-বিহারী।

তারপর সেই ছাড়াছাড়ির ক্ষণটা বেদৌরা, তা কি মনে পড়ছে? আমি শিরাজের বুলবুলের সেই গানটা আবৃত্তি করছিলাম, –

দেখনু সেদিন ফুল-বাগিচায় ফাগুন মাসের উষায়,
সদ্য-ফোটা পদ্মফুলের লুটিয়ে পরাগ-ভূষায়,
কাঁদচে ভ্রমর আপন মনে অঝোর নয়নে সে,
হঠাৎ আমার পড়ল বাধা কুসুম চয়নে যে!
কইনু, – ‘হাঁ ভাই ভ্রমর! তুমি কাঁদচ সে কোন্ দুখে
পেয়েও আজি তোমার প্রিয়া কমল-কলির বুকে?’
রাঙিয়ে তুলে কমল-বালায় অশ্রু-ভরা চুমোয়
বললে ভ্রমর, –‘ওগো কবি, এই তো কাঁদার সময়!
বাঞ্ছিতারে পেয়েই তো আজ এত দিনের পরে,
ব্যথা-ভরা মিলন-সুখে অঝোর ঝরা ঝরে।’

এমন সময় তোমার মামা এসে তোমায় জোর করে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল; আমার একটা কথাও বিশ্বাস করলে না। শুধু একটা উপেক্ষার হাসি হেসে জানিয়ে দিলে যে, সে থাকতে আমার মতো একটা ঘর-বাড়ি ছাড়া বয়াটে ছোকরার সঙ্গে বেদৌরার মিলন হতেই পারে না।…

আমার কান্না দেখে সে বললে যে, ইরানের পাগলা কবিদের ‘দিওয়ান’ পড়ে পড়ে আমিও পাগল হয়ে গিয়েছি। তোমার মিনতি দেখে সে বললে যে, আমি তোমাকে জাদু করেছি।

তারপর অনেক দিন ঘুরে ঘুরে কেটে গেল ওই ব্যাকুল-গতি ঝরনাটার ধারে। যখন চেতন হল তখনও বসন্ত-উৎসব তেমনই চলেছে, শুধু তুমিই নেই! দেখলুম, ক্রমেই তোমার আলতা-ছোবানো পায়ের পাতার পাতলা দাগগুলি নির্ঝরের কূলে কূলে মিলিয়ে আসছে, আর রেশমি চুড়ির ভাঙা টুকরোগুলি বালি-ঢাকা পড়ছে।

আমি কখনও মনের ভুলে এপারে দাঁড়িয়ে ডাকতুম, – বেদৌরা! – অনেকক্ষণ পরে পাথরের পাহাড়টা ডিঙিয়ে ওপার হতে কার একটা কান্না আসতে আসতে মাঝপথেই মিলিয়ে যেত – ‘রা – আঃ – আঃ!’ সারা বেলুচিস্তান আর আফগানিস্তানের পাহাড় জঙ্গলগুলোকে খুঁজে পেলুম, কিন্তু তোমার ঝরনা-পারের কুটিরটির খোঁজ পেলুম না।…

একদিন সকালে দেখলুম, খুব উন্মুক্ত একটা ময়দানে একা একজন পাগলা আশমান-মুখো হয়ে শুধু লাফ মারছে, আর সেই সঙ্গে হাত দুটো মুঠো করে কিছু ধরবার চেষ্টা করছে। আমার বড্ড হাসি পেল। শেষে বললুম – ‘হ্যাঁ ভাই উৎরিঙ্গে! তুমি কি তিড়িং তিড়িং করে লাফিয়ে আকাশ-ফড়িং ধরছ?’

সে আরও লাফাতে লাফাতে সুর করে বলতে লাগল –

এ-পার থেকে মারলাম ছুরি লাগল কলা গাছে,
হাঁটু বেয়ে রক্ত পড়ে চোখ গেল রে বাবাঃ।

এতে যে মরা মানুষেরও হাসি পায়। অত দুঃখেও আমি হোহো করে হেসে বললুম, – ‘তুমি কি কবি?’ সে খুব খুশি হয়ে চুল দুলিয়ে বললে – ‘হাঁ হাঁ, তাই!’ আমি বললুম, – ‘তা তোমার কবিতার মিল হল কই?’ সে বললে, – ‘তা নাই বা হল, হাঁটু দিয়ে তোর রক্ত পড়ল তো।’ এই বলেই সে আমার নবোদ্ভিন্ন শ্মশ্রুমণ্ডিত গালে চুম্বনের চোটে আমায় বিব্রত করে তুলে বললে, – ‘অনিলের নীল রংটাকে সুনীল আকাশ ভেবে ধরতে গেলে সে দূরে সরে গিয়ে বলে, – “ওগো, আমি আকাশ নই, আমি বাতাস, আমি শূন্য, আমায় ধরা যায় না। আমায় তোমরা পেয়েছ। তবুও যে পাইনি বলে ধরতে আস, সেটা তোমার জবর ভুল।”

এক নিমেষে আমার মুখের মুখর হাসি মূক হয়ে মিলিয়ে গেল। ভাবলাম, হাঁ ঠিকই তো। যাকে ভিতরে, অন্তরের অন্তরে পেয়েছি, তাকে খামখা বাইরের-পাওয়া পেতে এত বাড়াবাড়ি কেন? তাই সেদিন আমার পোড়ো-বাড়িতে শেষ কান্না কেঁদে বললুম, – ‘বেদৌরা! তোমায় আমি পেয়েছি আমার হৃদয়ে – আমার বুকের প্রতি রক্ত-কণিকায়।’ তারপর এই যে হিন্দুস্থানের অলিতে গলিতে ‘কমলিওয়ালে’ সেজে ফিরে এলুম, সে তো শুধু ওই এক ব্যথার সান্ত্বনাটা বুকে চেপেই। ভাবতুম, এমনি করে ঘুরে ঘুরেই আমার জনম কাটবে, কিন্তু তা আর হল কই? আবার সেই গোলেস্তানে ফিরে এলুম! সেখানে আমার মাটির কুঁড়ে মাটিতে মিশিয়ে গিয়েছে, কিন্তু তারই আর্দ্র বুকে যে তোমার ওই পদচিহ্ন আঁকা রয়েছে, তাই আমায় জানিয়ে দিল, যে, তুমি এখানে আমায় খুঁজতে এসে না পেয়ে শুধু কেঁদে ফিরেছ!

সেই পাগলটা আবার এসে জানিয়ে দিলে গেল যে, তুমি চমনে ফুটে শুকিয়ে যাচ্ছ।…

আমি এসেই তোমায় দূর হতে দেখে চিনেছি। তবে তুমি আমায় দেখে অমন করে ছুটে পালালে কেন? সে কী মাতালের মতো টলতে টলতে দৌড়ে লুকিয়ে পড়লে ওই খোর্মা গাছগুলোর আড়ালে! সে কী অসংবৃত অশ্রু ঝরে পড়ছিল তোমার! আর কতই যে ব্যথিত অনুযোগ ভরে উঠেছিল সে করুণ দৃষ্টিতে!

কিন্তু কোথা গেলে তুমি? – বেদৌরা, তুমি কোথায়?…

কেন আমি মূর্ছিত হয়ে পড়লুম?

– ওঃ!

০২. বেদৌরার কথা

বোস্তান

আঃ মাগো কী ব্যথিত পাণ্ডুর আকাশ! এই যে এত বৃষ্টি হয়ে গেল, ও অসীম আকাশের কান্না নয় তো? – না, না, এত উদার যে, সে কাঁদবে কেন? আর কাঁদলেও তার অশ্রু আমাদের সংকীর্ণ পাপ-পঙ্কিল চোখের জলের মতো বিস্বাদ আর উষ্ণ নয় তো! দেখছ, সে কত ঠান্ডা! …

ওঃ কিন্তু আমি কী স্বপ্ন দেখছি? একেবারে এক দৌড়ে চমন থেকে এই বোস্তানে এসেছি! তা হোক, এতক্ষণে যেন জানটা ধড়ে এল। – আ মলো‌! এত হুঁকরে হুঁকরে বুক ফেটে কান্না আসছে কীসের? – মানুষের মনের মতো আর বালাই নেই। ওই জ্বালাতেই তো আমায় জ্বালিয়ে খেলে গো! – কী? তার দেখা পেয়েছি বলে এ-কান্না? – তাতে আর হয়েছে কী?

তিনি যে ফিরে আসবেনই, সে তো জানা কথা। কিন্তু এত দিনে কেন? এ অসময়ে কেন নাথ? এখন যে আমার মালতীর লতা রিক্তকুসুম! ওগো, এ মরণের তটে এ দুর্দিনে কী দিয়ে বাসর সাজাব? যদি এলেই তবে কেন দুদিন আগেই এলে না? তা হলে তো তোমায় এমন করে এড়িয়ে চলতে হত না‌ !সেই দিনই – যেদিন আবার ওই চমনের শুকনো বাগানের ধারে তোমায় দেখতে পেয়েছিলাম – সেই দিনই তোমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতাম, – ‘এসো প্রিয়, ফিরে এসো!’ ওগো! হতভাগিনি – আমি যে হৃদয়ের সে পবিত্রতা রক্ষা করতে পারিনি! ওই শোনো দূরে আমার সমবেদনায় কী একটা জানোয়ার কাতরে উঠেছে – উঃ উঃ উঃ।

আমরা নারী, একটুতেই যত কেঁদে ভাসিয়ে দিতে পারি, পুরুষরা তা তো পারে না। তাদের বুকে যেন সব সময়েই কীসের পাথর চাপা। তাই যখন অনেক বেদনায় এই সংযমী পুরুষদের দুটি ফোঁটা অসংবরণীয় অশ্রু গড়িয়ে পড়ে, তখন তা দেখে না কেঁদে থাকতে পারে, এমন নারী তো আমি দেখি না! –

সেদিন যখন কত বছর পরে আমাদের চোখাচোখি হল, তখন কত মিনতি-অনুযোগ আর অভিমান মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছিল আমাদের চারটি চোখেরই সজল চাউনিতে! – হাঁ, আর কেমন ‘বেদৌরা’ বলে মাথা ঘুরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে সে ওই খেজুরের কাঁটা-ঝোপটায় পড়ে গেল! আঃ আঃ, তা দেখে পাষাণী-আমি কী করেই সে চোখ দুটো জোর করে দুই হাত দিয়ে চেপে এত দূর যেন কোনো অন্ধ অমানুষিক শক্তির বলে ছুটে এলাম?

পুরোনো কত স্মৃতিই আজ আমার বুকে ছেপে উঠছে! সেই গোলেস্তানে এক জোড়া বুলবুলেরই মতো মিলনেই অভিমান, মিলনেই বিচ্ছেদ-ব্যথা আর তারই প্রগাঢ় আনন্দে অজস্র অশ্রুপাত! তার চিন্তাটাও কত ব্যথিত-বিধুর! – তারপর সেই জুয়াচোরের জোর করে আমায় ছিনিয়ে নেওয়া দয়িতের বুক থেকে, – অনেক কষ্টে তার হাত এড়িয়ে প্রিয়ের অন্বেষণ! – ওঃ কি-ই না করেছি তাকে আবার পেতে! কই তখনও তো তিনি এলেন না!

তার পর ভিতরে-বাইরে সে কী দ্বন্দ্ব লেগে গেল! ভিতরে ওই এক তুসের আগুন ধিকিধিকি জ্বলতে লাগল, আর বাইরে? – বাইরে ফাগুনের উদাস বাতাস প্রাণে কামনার তীব্র আগুন জ্বালিয়ে দিলে! ঠিক সেই সময় কোথা থেকে ধূমকেতুর মতো সয়ফুল-মুলক এসে আমায় কান-ভাঙানি দিলে। – ভালোবাসায় কী বিরাট শান্ত স্নিগ্ধতা আর করুণ গাম্ভীর্য, ঠিক ভৈরবী রাগিণীর কড়ি-মধ্যমের মতো! আর এই বিশ্রী কামনাটা কত তীব্র – তীক্ষ্ণ – নির্মম! এই বাসনার ভোগে যে সুখ, সে হচ্ছে পৈশাচিক সুখ। এতে শুধু দীপক রাগিণীর মতো পুড়িয়েই দিয়ে যায় আমাদের! অথচ এই দীপকের আগুন একবার জ্বলে উঠবেই আমাদের জীবনের নব-ফাল্গুনে। সেই সময় স্নিগ্ধ মেঘ-মল্লারের মতো সান্ত্বনার একটা-কিছু পাশে না থাকলে সে যে জ্বলবেই – দীপক যে তাকে জ্বালাবেই!

তাই তো যেদিন পুষ্পিত যৌবনের ভারে আমি ঢলে পড়ছিলাম, আর একজন এসে আমায় যাচ্ঞা করলে, তখন আমার এই বাহিরের প্রবৃত্তিটা দমন করবার ক্ষমতাই যে রইল না! তখন যে আমি অন্ধ। – ওগো দেবতা, সেদিন তুমি কোথায় ছিলে? কেউ যে এল না শাসন করতে তখন! হায়, সেই দিনই আমার মৃত্যু হল। সেই দিনই আমি ভিখারিনি হয়ে পথে বসলাম। ওগো, আমার সেই অধঃপতনের দিনে চোখে যে পুঞ্জীভূত অন্ধকারের নিবিড় কালিমা একেবারে ঘন-জমাট হয়ে বসেছিল, তখন, এখনকার মতো এতটুকুও আলোক যে সে-অন্ধকারটাকে তাড়াতে চেষ্টা করেনি। হয়তো একটি রশ্মিরেখার ঈষৎপাতে সব অন্ধকার সেদিন ছুটে পালাত। তা হলে দেখতে গো, কে আমার সমস্ত হৃদয়-আসন জুড়ে রাজাধিরাজ একচ্ছত্র সম্রাটের মতো বসে আছে।

তবু যে আমার এ অধঃপতন হল? তা সেদিনও বুঝতে পারিনি, আজও বুঝতে পারছিনে, কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে! – কিন্তু আমি যদি বলি, আমার প্রেম – বক্ষের গভীর গোপন-তলে-নিহিত মহান প্রেম, যা সর্বদাই পবিত্র, তা তেমনই পূত অনবদ্য আছে আর চিরকালই থাকবে, তার গায়ে আঁচড় কাটে বাইরের কোনো অত্যাচার-অনাচারের এমন ক্ষমতা নেই, – তা হলে কে বুঝবে? কেই বা আমায় ক্ষমা করবে? – তবু আমি বলব, প্রেম চিরকালই পবিত্র, দুর্জয়, অমর; পাপ চিরকালই কলুষ, দুর্বল আর ক্ষণস্থায়ী।

আঃ – মা, কী অসহ্য বেদনা এই সারা বুকের পাঁজরে পাঁজরে!…উঃ… হাঁ কীসব ভুল বকছিলাম এতক্ষণ? ঠিক যেন খোওয়াব দেখছিলাম, না? … পাপ ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু নদীর বান-ভাসির পর যেমন বান রেখে যায় একটা পলির আবরণ সারা নদীটার বুকে, তেমনই পাপ রেখে যায় সংকোচের পুরু একটা পর্দা; সেটা কিন্তু ক্ষণস্থায়ী নয়, সেটা হয়তো অনেকেরই সারা জীবন ধরে থাকে। পাপী নিজেকে সামলে নিয়ে হাজার ভালো করে চললেও ভাবে, আমার এ দুর্নাম তো সারাজীবন কাদা-লেপটা হয়ে লেগেই থাকবে! চাঁদের কলঙ্ক পূর্ণিমার জ্যোৎস্নাও যে ঢাকতে পারে না! এই পাপে অনুশোচনাটা কত বিষাক্ত – তীক্ষ্ম! ঠিক যেন একসঙ্গে হাজার হাজার ছুঁচ বিঁধছে বুকের প্রতি কোমল জায়গায়। …

আবার আমার মনে পড়ছে সেই আমার বিপথে-টেনে-নেওয়া শয়তান সয়ফুল-মুলকের কথা। সে-ই তো যত ‘নষ্টগুড়ের খাজা’। এখন তাকে পেলে নখ দিয়ে ছিঁড়ে ফেলতাম!

আমারা নারী – মনে করি, এতটুকুতেই আমাদের হৃদয় অপবিত্র হয়ে গেল, আর অনুশোচনায় মনে মনে পুড়ে মরি। আমরা আরও ভাবি যে, হয়তো পুরুষদের অত সামান্যতে পাপ স্পর্শে না। আর তাদের মনে এত তীব্র অনুশোচনাও জাগে না। কিন্তু সেই যে সেদিন, যেদিন আমার বাসনার পিয়াস শুকিয়ে গিয়েছে, আর মধু ভেবে আকণ্ঠ হলাহল পানের তীব্র জ্বালায় ছটফট করচি, আর ঠিক সেই সময় সহসা বিরাট বিপুল হয়ে আমার ভিতরের প্রেমের পবিত্রতা অপ্রতিহত তেজে জেগে উঠেছে – সে-তেজ চোখ দিয়ে ঠিকরে বেরুচ্চে, – সেদিন – ঠিক সেইদিন – সয়ফুল-মুলক সহসা কীরকম ছোটো হয়ে গেল! একটা দুর্বার ঘৃণামিশ্রিত লজ্জার কালিমা তার মুখটাকে কেমন বিকৃত করে দিলে! সে দূর থেকে কেমন আমার দিকে একটা ভীত-চকিত দৃষ্টি ফেলে উপর দিকে দুহাত তুলে আর্তনাদ করে উঠল, – ‘খোদা! আমি জীবন দিয়ে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করব। তবে যেন সে-জীবন মঙ্গলার্থেই দিতে পারি, শুধু এইটুকু করো খোদা।’ তারপর কেমন সে উন্মাদের মতো ছুটে এসে আমার পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে বললে, – ‘দেবী, ক্ষমা করো এ শয়তানকে! দেবীর দেবীত্ব চিরকালই অটুট থাকে, বাইরের কলঙ্কে তা কলঙ্কিত হয় না, বরং সংঘর্ষের ফলে তা আরও মহান উজ্জ্বল হয়ে যায়! কিন্তু আমি? – আমি? – ওঃ, ওঃ, ওঃ!’ সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল। তার সে-ছোটা থেমেছে কিনা জানিনে।

কিন্তু এ কী? আবার আমার মনটা কেন আমাকে যেন ভাঙানি দিচ্ছে শুধু একবার দেখে আসতে যে, তিনি তেমনি করে সেই খেজুর-কাঁটার ঝোপে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছেন কি না। … না, না, – এ প্রাণ-পোড়ানি আর সইতে পারিনে গো – আর সইতে পারিনে! হাঁ, তাঁর সঙ্গে দেখা করবই করব, একবার শেষ দেখা; তার পর বলব তাঁকে, – ‘ওগো, তোমার সে বেদৌরা আর নেই, – সে মরেছে, মরেছে। তার প্রাণ তোমারই সন্ধানে বেরিয়ে গিয়েছে! – তুমি তাকে বৃথা এমন করে খুঁজে বেড়াচ্ছ! বেদৌরা নেই – নেই – নেই।’

তার পর – তার পর? তার পরেও যদি তিনি আমায় চান, তা হলে কী বলব তাঁকে, কী করব তখন? – না, তখনও এমনই শক্ত কাঠ হয়ে বলব, – ‘ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না গো দেবতা, ছুঁয়ো না। আমার এ অপবিত্র দেহ ছুঁয়ে তোমার পবিত্রতার অবমাননা কোরো না!’

আঃ! মা গো! কী ব্যথা! বুকের ভিতরটা কে যেন ছুরি হেনে খান খান করে কেটে দিচ্ছে। …

 ০৩. দারার কথা

গোলেস্তান

তুমি কি সেই গোলেস্তান? তবে আজ তুমি এত বিশ্রী কেন? তোমার ফুলে সে সৌন্দর্য নেই, শুধু তাতে নরকের নাড়ি-উঠে আসা পূতিগন্ধ! তোমার আকাশ আর তেমন উদার নয়, কে যেন তাকে পঙ্কিল ঘোলাটে করে দিয়েছে! তোমার মলয় বাতাসে যেন লক্ষ হাজার কাচের টুকরো লুকিয়ে রয়েছে! তোমার সারা গায়ে যেন বেদনা! …

কী করলে বেদৌরা তুমি? – বেদৌরা! – নাঃ, এই যে ব্যথা দিলে তুমি, – এই যে প্রাণ-প্রিয়তমের কাছ থেকে পাওয়া নিদারুণ আঘাত, এতেও নিশ্চয়ই খোদার মঙ্গলেচ্ছা নিহিত আছে! আমি কখনই ভুলব না খোদা, যে, ‘তুমি নিশ্চয় মহান আর তোমার-দেওয়া সুখ-দুঃখ সব সমান ও মঙ্গলময়! তোমার কাজে অমঙ্গল থাকতে পারে না, আর তুমি ছাড়া ভবিষ্যতের খবর কেউ জানে না!’ ব্যথিতের বুকে এই সান্ত্বনা কী শান্তিময়! …

আচ্ছা, তবু মন মানছে কই? কেন ভাবছি, এ নিশ্চয়ই আঘাত? – তৃষাতুর চাতক যখন ‘ফটিক জল ফটিক জল’ করে কেঁদে কেঁদে মেঘের কাছে এসে পৌঁছে, আর নিদারুণ মেঘ তার বুকে বজ্র হেনে দিয়ে বিদ্যুৎ-হাসি হাসে, তখন কেন মনে করি, এ মেঘের বড়োই নিষ্ঠুরতা? – কেন?

কিন্তু এত দিনেও নিজের স্বরূপ জানতে পারলুম না! আগে মনে করতুম, আমি কতো বড়ো – কতো উচ্চ! আজ দেখছি, সাধারণ মানুষের চেয়ে আমি এক রত্তিও বড়ো নই! আমারও মন তাদের মতো অমনই সংকীর্ণতা আর নীচতায় ভরা। নইলে আমি বেদৌরার এ দোষ সরল মনে ক্ষমা করতে পারলুম না কেন? হোক না কেন যতই বড়ো সে দোষ! বাহিরটা তার নষ্ট হয়েছে বটে, কিন্তু ভিতরটা যে তেমনই পবিত্র আর শুভ্র রয়েছে! অনেকে যে ভিতরটা অপবিত্র করে বাহিরটা পবিত্র রাখবার চেষ্টা করে, সেইটাই হচ্ছে বড়ো দোষ। কিন্তু এই যে বেদৌরার সহজ সরলতায় তার ভিতরটা পবিত্র রয়েছে জেনেও তাকে প্রাণ খুলে ক্ষমা করতে পারলুম না, সে দোষ তো আমারই; কেননা আমি এখনও অনেক ছোটো। জোর করে বড়ো হওয়ার জন্যে একবার ক্ষমা করতে ইচ্ছে হয়েছিল বটে, কিন্তু তা তো হতে পারে না। সে যে হৃদয় হতে নয়! নাঃ, আমাকে পুড়ে খাঁটি হতে হবে। খুব দূরে থেকে যদি মনটাকে ঠিক করতে পারি, তবেই আবার ফিরব, নইলে নয়। – ওঃ কী নীচ আমি! প্রথমে বেদৌরার মুখ থেকে তার এই পতনের কথা শুনে আমিও তো একেবারে নরক-কুণ্ডে গিয়ে পৌঁছেছিলুম। মনে করেছিলুম আমিও এমনি করে আমার সুপ্ত কামনায় ঘৃতাহুতি দিয়ে বেদৌরার উপর শোধ নেব। তারপর নরকের দ্বার থেকে কেমন করে হাত ধরে অশ্রু মুছিয়ে আমায় কে যেন ফিরিয়ে আনলে! সে বেশ শান্ত স্বরেই বললে, – ‘এ প্রতিশোধ তো বেদৌরার উপর নয় ভাই, এ প্রতিশোধ তোমার নিজের উপর!’ ভাবলুম, তাই তো, অভিমানের ব্যথায় ব্যথিত হয়ে এ কী, আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলুম! আমি আবার ফিরলুম। তার পর বেদৌরাকে বলে এলুম, – ‘বেদৌরা! যদি কোনো দিন হৃদয় হতে ক্ষমা করবার ক্ষমতা হয়, তবেই আবার দেখা হবে, নইলে এই আমাদের চির-বিদায়! মুখে জোর করে ক্ষমা করলুম বলে তোমায় গ্রহণ করে আমি তো একটা মিথ্যাকে বরণ করে নিতে পারিনে। আমি চাই, প্রেমের অঞ্জন আমার এই মনের কালিমা মুছিয়ে দিক।’ বেদৌরা অশ্রু-ভরা হাসি হেসে বললে, – ‘ফিরতেই হবে প্রিয়তম, ফিরতেই যে হবে তোমায়! এ সংশয় দু-দিনেই কেটে যাবে। তখন দেখবে, আমাদের সেই ভালোবাসা কেমন ধৌত শুভ্র বেশে আরও গাঢ় পূত হয়ে দেখা দিয়েছে! আমি তোমারই প্রতীক্ষায় গোলেস্তানের এই ক্ষীণ ঝরনাটার ধারে বসে গান আর মালা গাঁথব। আর তা যে তোমায় পরতেই হবে। ব্যথার পূজা ব্যর্থ হওয়ার নয় প্রিয়! … কোথায় যাই এখন, আর সে কোন্ পথে? ওগো আমার পথের চিরসাথি, কোথায় তুমি? –

০৪. সয়ফুল-মুলকের কথা

আমি সেই শয়তান, আমি সেই পাপী, যে এক দেবীকে বিপথে চালিয়েছিল। – ভাবলুম, এই ভুবনব্যাপী যুদ্ধে যে-কোনো দিকে যোগ দিয়ে যত শিগগির পারি এই পাপ-জীবনের অবসান করে দিই। তারপর? তারপর আর কী? যা সব পাপীদের হয়, আমারও হবে।

পাপী যদি সাজা পায়, তা হলে সে এই বলে শান্তি পায় যে তার উপর অবিচার করা হচ্ছে না, এই শাস্তিই যে তার প্রাপ্য। কিন্তু শাস্তি না পেলে ভিতরের বিবেকের যে দংশন, তা নরক-যন্ত্রণার চেয়ে অনেক বেশি ভয়ানক।

যা ভাবলুম, তা আর হল কই! ঘুরতে ঘুরতে শেষে এই মুক্তিসেবক সৈন্যদলের দলে যোগ দিলুম। এ পরদেশিকে তাদের দলে আসতে দেখে এই সৈন্যদল খুব উৎফুল্ল হয়েছে। এরা মনে করছে, এদের এই মহান নিঃস্বার্থ ইচ্ছা বিশ্বের অন্তরে অন্তরে শক্তি সঞ্চয় করছে। আমায় আদর করে এদের দলে নিয়ে এরা বুঝিয়ে দিলে যে কত মহাপ্রাণতা আর পবিত্র নিঃস্বার্থপরতা-প্রণোদিত হয়ে তারা উৎপীড়িত বিশ্ববাসীর পক্ষ নিয়ে অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, – এবং আমিও সেই মহান ব্যক্তিসংঘের একজন। আমার কালো বুকে অনেকটা তৃপ্তির আলোক পেলুম! –

খোদা, আজ আমি বুঝতে পারলুম, পাপীকেও তুমি ঘৃণা কর না, দয়া কর। তার জন্যেও সব পথই খোলা রেখে দিয়েছ। পাপীর জীবনেরও দরকার আছে। তা দিয়েও মঙ্গলের সলতে জ্বালানো যায়। সে ঘৃণ্য অস্পৃশ্য নয়!

কিন্তু সহসা এ কী দেখলুম? দারা কোথা থেকে এখানে এল? সেদিন তাকে অনেক জিজ্ঞেস করায় সে বললে, – ‘এর চেয়ে ভালো কাজ আর দুনিয়ায় খুঁজে পেলুম না, তাই এ-দলে এসেছি।’ আঘাত খেয়ে খেয়ে কত বিরাট গম্ভীর হয়ে গিয়েছে সে! আমাকে ক্ষমা চাইতেই হবে যে এই বেদনাতুর যুবকের কাছে; নইলে আমার কোথাও ক্ষমা নেই। এর প্রাণে এই ব্যথার আগুন জ্বালিয়েছি তো আমিই, একে গৃহহীন করেছি তো আমিই।

কী অচিন্ত্য অপূর্ব অসমসাহসিকতা নিয়ে যুদ্ধ করছে দারা। সবাই ভাবছে, এত অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রাণের প্রতি ভ্রুক্ষেপও না করে বিশ্ববাসীর মঙ্গলের জন্যে হাসতে হাসতে যে এমন করে বুকের রক্ত দিচ্ছে, সে বাস্তবিকই বীর, আর তাদের জাতিও বীরের জাতি! এমন দিন নেই, যেদিন একটা-না-একটা আঘাত আর চোট খেয়েছে সে। সেদিকে কিন্তু দৃষ্টিই নেই তার। সে যেন অগাধ অসীম এক যুদ্ধ-পিপাসা নিয়ে প্রচণ্ড বেগে মৃত্যুর মতো কঠোর হয়ে অন্যায়কে আক্রমণ করছে। যতক্ষণ এতটুকুও জ্ঞান থাকে তার, ততক্ষণ কার সাধ্য তাকে যুদ্ধস্থল থেকে ফেরায়! – কী একরোখা জেদ! আমি কিন্তু বুঝতে পারছি, এ সংগ্রাম তার বাইরের জন্যে নয়, এ যে ভিতরের ব্যথার বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভিযান। আমি জানি, হয় এর ফল অতি বিষময়, নতুবা খুবই শান্তসুন্দর!

কদিন থেকে বোমা আর উড়োজাহাজ হয়েছে এর সঙ্গী। বাইরে ভিতরে এত আঘাত এত বেদনা অম্লান বদনে সহ্য করে কী করে একাদিক্রমে যুদ্ধ জয় করছে এই উন্মাদ যুবক! ভয়টাকে যেন এ আরব সাগরে বিসর্জন দিয়ে এসেছে! আজ সে একজন সেনাপতি। কিন্তু এ কী অতৃপ্তি এখনও তার মুখে বুকে জাগছে! রোজই জখম হচ্ছে, কিন্তু তাকে হাসপাতালে পাঠায় কার সাধ্য? গোলন্দাজ সৈনিককে ঘুমাবার ছুটি দিয়ে ভাঙা-হাতেই সে কামান দাগছে। সেনাপতি হলেও সাধারণ সৈনিকের মতো তার হাতে গ্রিনেডের আর বোমার থলি, পিঠে তরল আগুনের ভালোতি, আর হাতে রিভলভার তো আছেই। রক্ত বইয়ে, লোককে হত্যা করে তার যে কী আনন্দ, সে আর কী বলব! সে বলছে, – পরাধীন লোক যত কমে ততই মঙ্গল।

আমি অবাক হচ্ছি, এ সত্যি-সত্যিই পাগল হয়ে যায়নি তো!

* * *

এ কী করলে খোদা? এ কী করলে? এত আঘাতের পরেও হতভাগা দারাকে অন্ধ আর বধির করে দিলে? এই পৈশাচিক যুদ্ধ-তৃষ্ণার ফলে যে এই রকমই একটা কিছু হবে, তা আমি অনেক আগে থেকেই ভয় করছিলাম! আচ্ছা করুণাময়, তোমার লীলা আমরা বুঝতে পারিনে বটে, কিন্তু এই যে নিরাপরাধ যুবকের চোখ দুটো বোমার আগুনে অন্ধ আর কান দুটো বধির করে দিলে, আর আমার মতো পাপী শয়তানের গায়ে এতটুকু আঁচড় লাগল না, এতেও কি বলব যে, তোমার মঙ্গল-ইচ্ছা লুকানো রয়েছে? কী সে মঙ্গল, এ অন্ধকে দেখাও প্রভু, দেখাও! এ অন্ধের দাঁড়াবার যষ্টিও যে ভেঙে দিয়েছি আমি। তবে কি আমার বাহিরটা অক্ষত রেখে ভিতরটাকে এমনই ছিন্ন-ভিন্ন আর ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকবে? ওগো ন্যায়ের কর্তা! এই কি আমার দণ্ড, এই বিশ্বব্যাপী অশান্তি? …

* * *

আজ আমাদের ঈপ্সিত এই প্রধান জয়োল্লাসের দিনেও আমাদের জয়-পতাকাটা রাজ-অট্টালিকার শিরে থর থর করে কাঁপছে! বিজয়-ভেরিতে জয়নাদের পরিবর্তে যেন জান-মোচড়ানো শ্রান্ত ‘ওয়ালটজ’-রাগিণীর আর্ত সুর হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বেরোচ্ছে! তূর্য-বাদকের স্বর ঘন ঘন ভেঙে যাচ্ছে! – আজ অন্ধ সেনানী দারার বিদায়ের দিন। অন্ধ-বধির আহত দারা যখন আমার কাঁধে ভর করে সৈনিকদের সামনে দাঁড়াল, তখন সমস্ত মুক্তি সেবক সেনার নয়ন দিয়ে হু হু করে অশ্রুর বন্যা ছুটেছে! আমাদের কঠোর সৈনিকদের কান্না যে কত মর্মন্তুদ, তা বোঝাবার ভাষা নেই। মুক্তিসেবক-সৈন্যাধ্যক্ষ বললেন, – তাঁর স্বর বারংবার অশ্রুজড়িত হয়ে যাচ্ছিল, – ‘ভাই দারাবি! আমাদের মধ্যে ‘ভিক্টোরিয়া ক্রস’ ‘মিলিটারি ক্রস’ প্রভৃতি পুরস্কার দেওয়া হয় না, কেননা আমরা নিজে নিজেই তো আমাদের কাজকে পুরস্কৃত করতে পারিনে। আমাদের বীরত্বের, ত্যাগের পুরস্কার বিশ্ববাসীর কল্যাণ; কিন্তু যারা তোমার মতো এই রকম বীরত্ব আর পবিত্র নিঃস্বার্থ ত্যাগ দেখায়, আমরা শুধু তাদেরই বীর বলি! সৈন্যাধ্যক্ষ পুনরায় ঢোক গিলে আর কোটের আস্তিনে তাঁর অবাধ্য অশ্রু-ফোঁটা কটি মুছে নিয়ে বললেন – ‘তুমি অন্ধ হয়েছ, তুমি বধির হয়েছ, তোমার সারা অঙ্গে জখমের কঠোর চিহ্ন, – আমরা বলব, এই তোমার বীরত্বের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার! অনাহূত তুমি বিশ্বের মঙ্গল-কামনায় প্রাণ দিতে এসেছিলে, তার বিনিময়ে খোদা নিজ হাতে যা দিয়েছেন, – হোক না কেন তা বাইরের চোখে নির্মম – তার বড়ো পুরস্কার মানুষ আমরা কী দেব ভাই? ‘খোদা নিশ্চয়ই মহান এবং তিনি ভালো কাজের জন্যে লোকদের পুরস্কৃত করেন!’ – এ যে তোমাদেরই পবিত্র কোরানের বাণী! অতএব হে বীর সেনানী, হয়তো তোমার এই অন্ধত্ব আর বধিরতার বুকেই সব শান্তি সব সুখ সুপ্ত রয়েছে! খোদা তোমায় শান্তি দিন!’ দারা তার দৃষ্টিহীন চোখ দুটি দিয়ে যতদূর সাধ্য সৈনিকগণকে দেখবার ব্যর্থ চেষ্টা করে অশ্রুচাপা কণ্ঠে শুধু বলতে পেরেছিল, –‘বিদায়, পবিত্র বীর ভাইরা আমার!’

আমি অন্ধ দারার সঙ্গে আবার এই গোলেস্তানেই এলাম! আর এই তো আমার ব্যর্থ জীবনের সান্ত্বনা, এই নির্বিকার বীরের সেবা! দারা আমায় ক্ষমা করেছে, আমায় সখা বলে কোল দিয়েছে! এতদিনে না এই হতভাগ্য যুবকের রিক্ত জীবন সার্থকতার পুষ্পে পুষ্পিত হয়ে উঠল! এতদিনে না সত্যিকার ভালোবাসায় তাকে ওই অসীম আকাশের মতোই অনন্ত উদার করে দিলে! রাস্তায় আসতে আসতে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, – ‘আচ্ছা ভাই, তুমি বেদৌরাকে ক্ষমা করেছ?’ সে কান্না-ভরা হাসি হেসে সাধকশ্রেষ্ঠ প্রেমিক রুমীর এই গজলটা গাইলে – ‘ওগো প্রিয়তম! তুমি যত বেদনার শিলা দিয়ে আমার বুকে আঘাত করেছ, আমি তাই দিয়ে যে প্রেমের মহান-মসজিদ তৈরি করেছি!’

আমার বিশ্বাস, শিশুদের চেয়ে সরল আর কিছু নেই দুনিয়ায়। দারাও প্রেমের মহিমায় যেন অমনই সরল শিশু হয়ে পড়েছে। তার মুখে কেমন সহজ হাসি, আবার কেমন অসংকোচ কান্না! তা কিন্তু অতি বড়ো পাষাণকেও কাঁদায়! আমি সেদিন হাসতে হাসতে বললাম, – ‘হাঁ ভাই, এই যে অন্ধ আর বধির হলে, এতে মঙ্গলময়ের কোনো মঙ্গলের আভাস পাচ্ছ কি?’ সে বললে, – ‘ওরে বোকা, এই যে তোদের আজ ক্ষমা করতে পেরেছি – এই যে আমার মনের সব গ্লানি সব ক্লেদ ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে গিয়েছে, সে এই অন্ধ হয়েছি বলেই তো, – এই বাইরের চোখ দুটোকে কানা করে আর শ্রবণ দুটোকে বধির করেই তো! অন্ধেরও একটা দৃষ্টি আছে, সে হচ্ছে অর্ন্তদৃষ্টি যা অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি। এখন আমি দেখছি দুনিয়া-ভরা শুধু প্রিয়ার রূপ আর তারই হাসির অনন্ত আলো! আর এই কালা কান দুটো দিয়ে কী শুনছি, জানিস? শুধু তার কানে-কানে-বলা গোপন-প্রেমালাপের মঞ্জু গুঞ্জন আর চরণ-ভরা মঞ্জীরের রুনু-ঝুনু বোল! – আমি যে এই নিয়েই মশগুল!’ বলেই অভিভূত হয়ে সে গান ধরলে, –

‘যদি আর কারে ভালোবাস, যদি আর ফিরে নাহি আস,
তবে তুমি যাহা চাও, তাই যেন পাও, আমি যত দুখ পাই গো!
আমার পরান যাহা চায়, তুমি তাই তুমি তাই গো,
তোমা ছাড়া মোর এ জগতে আর কেহ নাই কিছু নাই গো!’ –

কানাড়া রাগিণীর কোমল গান্ধারে আর নিখাদে যেন তার সমস্ত আবিষ্ট বেদনা মূর্তি ধরে মোচড় খেয়ে খেয়ে কেঁদে যাচ্ছিল! – কিন্তু কত শান্ত স্নিগ্ধ বিরাট নির্ভরতা আর ত্যাগ এই গানে!

সবচেয়ে আমার বেশি আশ্চর্য বোধ হচ্ছে যে, বেদৌরাও আমাকে ক্ষমা করেছে, অথচ তার এ-বলায় এতটুকু কৃত্রিমতা বা অস্বাভাবিকতা নেই। এ যেন প্রাণ হতে ক্ষমা করে বলা!

খোদা, তুমি মহান! ‘যার কেউ নেই তুমি তার আছ।’ এই প্রেমিকদের সোনার কাঠির স্পর্শে আমি যে আমি, তারও আর কোনো গ্লানি নেই, সংকোচ নেই।

আজ এই বিনা কাজের আনন্দ, – ওঃ তা কত মধুর আর সুন্দর!

 ০৫. বেদৌরার কথা

গোলেস্তান

(নির্ঝরের অপর পার)

তিনি আমায় ক্ষমা করেছেন একেবারে প্রাণ খুলে হৃদয় হতে! এবার এ-ক্ষমায় এতটুকু দীনতা নেই। এ যে হবেই, তাতো আমি জানতামই, আর তাই যে এমন করে আমার প্রতীক্ষার সকাল-সাঁঝগুলি আনন্দেই কেটে গিয়েছে! আমার এই আশায় বসে-থাকা দিনগুলির, বিরলে-গাঁথা ফুলহারগুলি আর বেদনাবারিসিক্ত বিরহ-গানগুলি তাঁরই পায়ে ঢেলে দিয়েছি। তিনি তা গলায় তুলে তার বিনিময়ে যা দিয়েছেন, সেই তো গো তাঁর আমায়-দেওয়া ব্যথার দান!

তিনি বললেন, – ‘বেদৌরা! কামনা আর প্রেম, এ দুটো হচ্ছে সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। কামনা একটা প্রবল সাময়িক উত্তেজনা আর প্রেম হচ্ছে ধীর, প্রশান্ত ও চিরন্তন। কামনার প্রবৃত্তি বা তার নিবৃত্তিতে হৃদয়ের দাগ-কাটা ভালোবাসাকে যে ঢাকতেই পারে না, এ হচ্ছে ধ্রুব সত্য। এই রকম বিড়ম্বিত যে বেচারারা এই কথাটা একটু তলিয়ে দেখে ধীরভাবে বিশ্বাস করে না, তারা মস্ত ভুল করে, আর তাদের মতো হতভাগ্য অশান্তির জীবনও আর কারুর নেই। – বাদলার দিনে কালো মেঘগুলো সূর্যকে গ্রাস করতে যতই চেষ্টা করুক, তা কিন্তু পারে না। তবে তাকে খানিকক্ষণের জন্যে আড়াল করে থাকে মাত্র। কেননা সূর্য থাকে মেঘের নাগাল পাওয়ার সে অনেক দূরে। কোন্ ফাঁকে আর সে কেমন করে যে অত মেঘের পুরু স্তর ছিঁড়ে রবির কিরণ দুনিয়ার বুকে প্রতিফলিত হয়, তা মেঘও ভেবে পায় না, আর আমরাও জানতে চেষ্টা করিনে। তার পর মেঘ কেটে গেলেই সূর্য হাসতে থাকে আরও উজ্জ্বল হয়ে। কারণ তাতে তো সূর্যের কোনো অনিষ্টই হয় না, – সে জানে, সে যেমন আছে তেমনই অটুট থাকবেই; ক্ষতি যা তোমার আমার – এ দুনিয়ার। তাই বলে কি বাদলের মেঘ আসবে না? সে এসে আকাশ ছাইবে না? সে আসবেই, ও যে স্বভাব; তাকে কেউ রুখতে পারবে না। তবে অত বাদলেও সূর্যকিরণ পেতে হলে মেঘ ছাড়িয়ে উঠতে হয়। সেটা তেমন সোজা নয়, আর তা দরকারও করে না – কামনাটা হচ্ছে ঠিক এই বাদলের মতো; আর প্রেম জ্বলছে হৃদয়ে ওই রবিরই মতো একইভাবে সমান ঔজ্জ্বল্যে!

‘কামনায় হয়তো তোমার বাহিরটা নষ্ট করেছে, কিন্তু ভিতরটা নষ্ট তো করতে পারেনি। তাছাড়া, ও না হলে যে তুমি আমাকে এত বেশি করে চিনতে না, এত বড়ো করে পেতে না। বাইরের বাতাস প্রেমের শিখা নিবাতে পারে না, আরও উজ্জ্বল করে দেয়। আর আমার অন্ধত্ব ও বধিরতা? ওর জন্যে কেঁদো না বেদৌরা, এগুলো থাকলে তো আমি তোমায় আর পেতাম না!’

পুষ্পিত সেব গাছ থেকে অশ্রুচাপা কণ্ঠে ‘পিয়া পিয়া’ করে বুলবুলগুলো উড়ে গেল।

তিনি আবার বললেন, – ‘দেখ বেদৌরা, আজ আমাদের শেষ বাসর-শয্যা হবে। তার পর রবির উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তুমি চলে যাবে নির্ঝরটার ও-পারে, আর আমি থাকব এ-পারে। এই দু-পারের থেকে আমাদের দুজনেরই বিরহ-গীতি দুইজনকে ব্যথিয়ে তুলবে। আর ওই ব্যথার আনন্দেই আমরা দুজনে দুজনকে আরও বড়ো – আরও বড়ো করে পাব!’

সেই দিন থেকে আমি নির্ঝরটার এ-পারে।

আমারও অশ্রু-ভরা দীর্ঘশ্বাস হুহু করে ওঠে, যখন মৌন-বিষাদে-নীরব সন্ধ্যায় তাঁর ভারী চাপা কণ্ঠ ছেপে রাগিণী ও-পার হতে কাঁদতে কাঁদতে এ-পারে এসে বলে, –

আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন,
আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন!

০৬. হেনা

ভার্দুন ট্রেঞ্চ, ফ্রান্স
ওঃ! কী আগুন-বৃষ্টি! আর কী তার ভয়ানক শব্দ! – গুড়ুম – দ্রুম – দ্রুম! – আকাশের একটুও নীল দেখা যাচ্ছে না, যেন সমস্ত আশমান জুড়ে আগুন লেগে গেছে! গোলা আর বোমা ফেটে ফেটে আগুনের ফিনকি এত ঘন বৃষ্টি হচ্ছে যে, অত ঘন যদি জল ঝরত আসমানের নীলচক্ষু বেয়ে, তা হলে এক দিনেই সারা দুনিয়া পানিতে সয়লাব হয়ে যেত! আর এমনই অনবরত যদি এই বাজের চেয়েও কড়া ‘দ্রুম দ্রুম’ শব্দ হত, তাহলে লোকের কানগুলো একেবারে অকেজো হয়ে যেত। আজ শুধু আমাদের সিপাইদের সেই ‘হোলি’ খেলার গানটা, মনে পড়ছে, –

‘আজু তলওয়ার সে খেলেঙ্গে হোরি
জমা হো গয়ে দুনিয়া কা সিপাই।
ঢালোঁও কি ডঙ্কা বাদন লাগি, তোপঁও কে পিচকারী,
গোলা বারুদকা রঙ্গ বনি হ্যায়, লাগি হ্যায় ভারী লড়ান্!’

বাস্তবিক এ গোলা-বারুদের রঙে আশমান-জমিন লালে-লাল হয়ে গেছে! সব চেয়ে বেশি লাল ওই বুকে ‘বেয়নেট’-পোরা হতভাগাদের বুকের রক্ত! লালে লাল! শুধু লাল আর লাল! এক একটা সিপাই ‘শহিদ’ হয়েছে, আর যেন বিয়ের নওশার মতো লাল হয়ে শুয়ে আছে!

ওঃ! সবচেয়ে বিশ্রী ওই ধোঁয়ার গন্ধটা। বাপ রে বাপ! ওর গন্ধে যেন বত্রিশ নাড়ি পাক দিয়ে ওঠে। – মানুষ, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব, তাদের মারবার জন্যে এ-সব কী কুৎসিত নিষ্ঠুর উপায়। রাইফেলের গুলির প্রাণহীন সিসাগুলো যখন হাড়ে এসে ঠেকে, তখন সেটা কী বিশ্রী রকম ফেটে চৌচির হয়ে দেহের ভিতরের মাংসগুলোকে ছিঁড়ে বেরিয়ে যায়।

এত বুদ্ধি মানুষ অন্য কাজে লাগালে তারা ফেরেশতার কাছাকাছি একটা খুব বড়ো জাত হয়ে দাঁড়াত!

ওঃ! কী বুক-ফাটা পিয়াস! এই যে পাশের বন্ধু রাইফেলটা কাত করে ফেলে ঘুমিয়ে পড়েছে, একে আর হাজার কামান এক সঙ্গে গর্জে উঠলেও জাগাতে পারবে না। কোনো সেনাপতি আর তার হুকুম মানাতে পারবে না একে। এই সাত দিন ধরে একরোখা ট্রেঞ্চে কাদায় শুয়ে শুয়ে অনবরত গুলি ছোড়ার ক্লান্তির পর সে কী নিবিড় শান্তি নেমে এসেছে এর প্রাণে! তৃপ্তির কী স্নিগ্ধ স্পর্শ এখনও লেগে রয়েছে এর শুষ্ক শীতল ওষ্ঠপুটে!

যাক – যে ভয়ানক পিয়াস লেগেছে এখন আমার! এখন ওর কোমর থেকে জলের বোতলটা খুলে একটু জল খেয়ে জানটা ঠান্ডা করি তো! কাল থেকে আমার জল ফুরিয়ে গিয়েছে, কেউ এক ফোঁটা জল দেয়নি। – আঃ! আঃ!! গভীর তৃষ্ণার পর এই এক চুমুক জল, সে কত মিষ্টি। অনবরত চালিয়ে চালিয়ে আমার লুইস গানটাও আর চলছে না। এখন আমার মৃত বন্ধুর লুইস গানটা দিয়ে দিব্যি কাজ চলবে! – এর যদি মা কিংবা বোন কিংবা স্ত্রী থাকত আজ এখানে, তা হলে এর এই গোলার আঘাতে ভাঙা মাথার খুলিটা কোলে করে খুব এক চোট কেঁদে নিত! যাক, খানিক পরে একটা বিশ-পঁচিশ মনের মস্ত ভারী গোলা হয়তো ট্রেঞ্চের সামনেটায় পড়ে আমাদের দুজনাকেই গোর দিয়ে দেবে! সে মন্দ হবে না!

হাঁ, আমার এত হাসি পাচ্ছে ওই কান্নার কথা মনে হয়ে! আরে ধ্যেত, সবাই মরব; আমি মরব, তুইও মরবি! এত বড়ো একটা নিছক সত্যি একটা স্বাভাবিক জিনিস নিয়ে কান্না কীসের?

এই যে এত কষ্ট, এত মেহনত করছি, এত জখম হচ্ছি, তবুও সে কী একটা পৈশাচিক আনন্দ আমার বুক ছেয়ে ফেলেছে! সে আনন্দটা এই কাঠ-পেনসিলটার সিসা দিয়ে এঁকে দেখাতে পারছিনে! মস্ত ঘন ব্যথার বুকেও একটা বেশ আনন্দ ঘুমপাড়ানো থাকে, যেটা আমরা ভালো করে অনুভব করতে পারিনে। এই লেখা অভ্যেসটা কী খারাপ! এত আগুনের মধ্যে সাঁতরে বেড়াচ্ছি, – পায়ের নীচে দশ-বিশটা মড়া , মাথার উপর উড়োজাহাজ থেকে বোমা ফাটছে – দুম – দুম – দুম, সামনে বিশ হাত দূরে বড়ো বড়ো গোলা ফাটছে, গুড়ুম গুড়ুম, পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে ‘রাইফ্‌ল’ আর ‘মেশিনগানে’র গুলি – শোঁ শোঁ শোঁ, –তবুও এই সাতটা দিন মনের কথাগুলি খাতার কাগজগুলিকে না জানাতে পেরে জানটাকে কী ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল! আজ এই কটা কথা লিখে বুকটা হালকা বোধ হচ্ছে!

আঃ পাশের মরা বন্ধুর গায়ে ঠেস দিয়ে দিব্যি একটু আরাম করে নেওয়া যাক! – ওঃ কী আরাম! …

এই সিন্ধুপারের একটা অজানা বিদেশিনি ছোট্ট মেম আমায় খানিকটা আচার আর দুটো মাখন-মাখা রুটি দিয়েছিল। সেটা আর খাওয়াই হয়নি। এদেশের মেয়েরা আমাদের এত স্নেহের আর করুণার চক্ষে দেখে – হা-হা-হা-হাঃ, রুটি দুটো দেখছি শুকিয়ে দিব্যি ‘রোস্ট’ হয়ে আছে! দেখা যাক রুটি শক্ত না আমার দাঁত শক্ত! ওই খেতে হবে কিন্তু, পেটে যে আগুন জ্বলছে! – আচারটা কিন্তু বেড়ে তাজা আছে, দেখছি!

ওই তেরো চৌদ্দ বছরের কচি মেয়েটা (আমাদের দেশে ও-রকম মেয়ে নিশ্চয়ই সন্তানের জননী নতুবা যুবতি গিন্নি!) যখন আমার গলা ধরে চুমো খেয়ে বললে, – ‘দাদা, এ-লড়াইতে কিন্তু শত্তুরকে খুব জোর তাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে’, তখন আমার মুখে সে কী একটা পবিত্র বেদনা-মাখা হাসি ফুটে উঠেছিল!

আঃ! এতক্ষণ আকাশটা বেরোবার একটু ফঁক পেয়েছে।

রাশি রাশি জল-ভরা মেঘের ফাঁকে একটু একটু নীল আশমান দেখা যাচ্ছে। সে কত সুন্দর! ঠিক যেন অশ্রুভরা চোখের ঈষৎ একটু সুনীল রেখা!

থাক গে, এখন অন্য সময় বাকি কথাগুলো লেখা যাবে। মরা বন্ধুর আত্মা হয়তো আমার উপর চটে উঠেছে এতক্ষণ। কি বন্ধু, একটু জল দেব নাকি মুখে? – ইস, হাঁ করে তাকাচ্ছেন দেখ! না বন্ধু – না, তোমার পরপারের প্রিয়তমা হয়তো তোমার জন্যে শরবতের গেলাস-হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে! আহা, সে বেচারিকে বঞ্চিত করব না তার সেবার আনন্দ হতে!

আজ কত কথাই মনে হচ্ছে, – না – না, কিছু মনে হচ্ছে না, সব ঝুটা! – ফের লুইস গানটায় গুলি চালানো যাক! – আমার সাহায্যকারী কয়জন বেশ তোয়াজ করে ঘুমিয়ে নিলে তো দেখছি!

ওই – ওই, পাশে কাদের তালে তালে পা মিলিয়ে চলার শব্দ পাচ্ছি! ঝপ ঝপ ঝপ – লেফট রাইট লেফট! ওই মিলিয়ে চলার শব্দটা কী মধুর! ও বুঝি আমাদের ‘রিলিভ’ করতে আসছে অন্য পলটন।

উঃ! এতটুকু অসাবধানতার জন্যে হাতের এক টুকরো মাংস ছিঁড়ে নিয়ে গেল দেখছি একটি গুলিতে!

ব্যান্ডেজটা বেঁধে নিই নিজের। নার্সগুলোকে আমি দুচোখে দেখতে পারিনে। নারী যদি ভালো না বেসে সেবা করে আমার, তবে সে সেবা আমি নেব কেন?

আঃ যুদ্ধের এই খুনোখুনির কী মাদকতা-শক্তি! মানুষ মারার কেমন একটা গাঢ় নেশা!

পাশে আমার চেয়ে অত বড়ো জোয়ানটা এলিয়ে পড়েছে দেখছি! আমি দেখছি শরীরের বলের চেয়ে মনের বলের শক্তি অনেক বেশি।

লুইস গানে এক মিনিটে প্রায় ছয়-সাতশো করে গুলি ছাড়ছি। যদি জানতে পারতুম, ওতে কত মানুষ মরছে! – তা হোক এই দু-কোণের দুটো লুইস গানই শত্রুদের জোর আটকিয়ে রেখেছে কিন্তু।

কী চিৎকার করে মরছে শত্রুগুলো দলে দলে! কী ভীষণ সুন্দর এই তরুণের মৃত্যুমাধুরী!

সিঁন নদীর ধারে তাম্বু, ফ্রান্স
এই দুটো দিনের ৪৮ ঘন্টা খালি লম্বা ঘুম দিয়ে কাটিয়ে দেওয়া গেল। এখন আবার ধড়া-চুড়ো পরে বেরোতে হবে খোদার সৃষ্টি নাশ করতে। এই মানুষ-মারা বিদ্যে লড়াইটা ঠিক আমার মতো পাথর-বুকো কাঠখোট্টা লোকেরই মনের মতো জিনিস।

আজ সেই বিদেশিনি কিশোরী আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। কী পরিষ্কার সুন্দর ফিটফাট বাড়িগুলো এদের! – মেয়েটা আমাকে খুব ভালোবেসেছে। আমিও বেসেছি। আমাদের দেশ হলে বলত মেয়েটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে! কুড়ি একুশ বছরের একজন যুবকের সঙ্গে একটা কুমারী কিশোরীর মেলা-মেশা আদৌ পছন্দ করত না!

ভালোবাসাটাকে কী কুৎসিত চক্ষে দেখেছে আজকাল লোকেরা! মানুষ তো নয়, যেন শকুনি! – দুনিয়ায় এত পাপ! মানুষ এত ছোটো হল কী করে? – তাদের মাথার উপর অমন উদার অসীম নীল আকাশ, আর তার নীচে মানুষ কী সংকীর্ণ, কী ছোটো!

আগুন, তুমি ঝরো – ঝম ঝম ঝম! খোদার অভিশাপ, তুমি নেমে এসো ওই নদীর বুকে জমাট বরফের মতো হয়ে – ঝুপ ঝুপ ঝুপ! ইসারাফিলের শিঙ্গা, তুমি বাজো সবকে নিঃসাড় করে দিয়ে – ওম ওম ওম! প্রলয়ের বজ্র, তুমি কামানের গোলা আর বোমার মধ্যে দিয়ে ফাটো ঠিক মানুষের মগজের উপর – দ্রুম-দ্রুম-দ্রুম! আর সমস্ত দুনিয়াটা – সমস্ত আকাশ উলটে ভেঙে পড়ো তাদের মাথায়, যারা ভালোবাসায় কলঙ্ক আনে, ফুলকে অপবিত্র করে।

এখন যে সাজে সেজেছি, ঠিক এই রকম সাজে যদি আমাদের দেশের একটা লোককে সাজিয়ে উলটে ফেলে দিই, তাহলে হাজার ধ্বস্তাধ্বস্তি করেও সে আর উঠতে পারবে না। আমার নিজেরই হাসি পাচ্ছে আমার এখনকার এই গদাই-লশকরি চেহারা দেখে!

আমার এক ‘ফাজিল’ বন্ধু বলেছেন – ‘কী নিমকিন চেহারা!’ – আহা কী উপমার ছিরি! কে নাকি বলেছিল, – ‘ষাঁড়টা দেখতে যেন ঠিক কাতলা মাছ!’

ফ্রান্স
প্যারিসের পাশের ঘন বন
কাল হঠাৎ এই মস্ত জঙ্গলটায় আসতে হল। কেন এ রকম পিছিয়ে আসতে হল তার এতটুকুও জানতে পারলুম না! এ মিলিটারি লাইনের ওইটুকু সৌন্দর্য! তোমার উপর হুকুম হল, ‘ওই কাজটা করো!’ ‘কেন ও-রকম করব?’ তার কৈফিয়ত চাইবার কোনো অধিকার নেই তোমার। বাস – হুকুম! যদি বলি, ‘মৃত্যু যে ঘনিয়ে আসছে!’ অমনি বজ্রগম্ভীর স্বরে তার কড়া জবাব আসবে, – ‘যতক্ষণ তোমার নিশ্বাস আছে, ততক্ষণ কাজ করে যাও; যদি চলতে চলতে তোমার ডান পায়ের উপর মৃত্যু হয়, তবে বাম পা পর্যন্ত চলো!’

আঃ এই হুকুম মানায়, এই জীবন-পণ আনুগত্যে কত সে নিবিড় মাধুরী! বাজের মাঝে এ কী কোমলতা! যদি সমস্ত দুনিয়াটা এমনই একটা (এবং কেবল একটা) সামরিক শক্তির অধীন হয়ে যেত, তা হলে এই মাটির জমিনই এমন একটা সুন্দর স্থান হয়ে দাঁড়াত যাকে ‘জিন্নাতুল বাকিয়া’ (শ্রেষ্ঠতম স্বর্গ) বললেও লোক তৃপ্ত হত না!

কী শৃঙ্খলা এই ব্রিটিশ জাতিটার কাজে-কর্মে কায়দা-কানুনে, তাই তারা আজ এত বড়ো। উপর দিকে চাইতে গিয়ে আমাদের মাথার পাগড়ি পড়ে গেলেও তাদের মাথাটা দেখতে পাব না! মোটামুটি বলতে গেলে তাদের এই দুনিয়া-জোড়া রাজত্বিটা একটা মস্তো বড়ো ঘড়ি, আর সেটা খুবই ঠিক চলছে, কেননা তার সেকেন্ডের কাঁটা থেকে ঘন্টার কাঁটা পর্যন্ত সব তাতে বড্ডো কড়া বাঁধাবাঁধি একটা নিয়ম। সেটা আবার রোজই ‘অয়েল্ড’ হচ্ছে তার কোথাও একটু জং ধরে না।

আমরাই নিয়ে গেলুম জার্মানদের ‘হিন্ডেনবার্গ লাইন’ পর্যন্ত খেদিয়ে, আবার আমাদেরই এতটা পিছিয়ে যেতে হল! – ঘড়িটা যে তৈরি করেছে, সে জানে কোন্ কাঁটার কোন্খানে কী কাজ, কিন্তু কাঁটা কিছু বুঝতে পারে না। তবু তাকে কাজ করে যেতে হবে, কেননা, একটা স্প্রিং অনবরত তার পেছন থেকে তাকে গুঁতো মারছে!

এমনই একটা বিরাট কঠিন শৃঙ্খল, মস্ত বাঁধাবাঁধি আমাদের খুবই দরকার। আমাদের এই ‘বেঁড়ে’ জাতটাকে এমনই খুব পিঠ-মোড়া করে বেঁধে দোরস্ত না করলে এর ভবিষ্যতে আর উঠে দাঁড়াবার কোনো ভরসা নেই! দেশের সবাই মোড়ল হলে কী আর কাজ চলে!

ওঃ, এত দূরেও আমাদের উপর গোলাবৃষ্টি! এ যেন একটা ভূতুড়ে কাণ্ড। কোথায় কোন্ সুদূরে লড়াই হচ্ছে, আর এখানে কী করে এই জঙ্গলে গোলা আসছে?

হাতি যখন ভাবে, তার চেয়ে বড়ো জানোয়ার আর নেই, তখন ছোট্ট একটি মশা তার মগজে কামড়ে কীরকম ঘায়েল করে দেয় তাকে।

এখানে এই গাছ-পালার আড়ালে একটা স্নিগ্ধ ছায়ার অন্ধকারে বেশ থাকা যাচ্ছে, কিন্তু এমনই একটু অন্ধকারের জন্যে আমার জানটা বড্ড বেশি আকুলি-বিকুলি করে উঠেছিল!

হায়! এই অন্ধকারে এলে কত কথাই মনে পড়ে আমার আবার – নাঃ! যাই একবার গাছে চড়ে দেখি আশে পাশে কোথাও দুশমন লুকিয়ে আছে কিনা।

আঃ, গাছ থেকে ওই দূরে বরফে-ঢাকা নদীটা কী সুন্দর। আবার ওই গোলার ঘায়ে ভাঙা মস্ত বাড়িগুলো কী বিশ্রী হাঁ করে আছে!

এইসব ভাঙা-গড়া দেখে আমার সেই ছোট্টবেলাকার কথা মনে পড়ে। তখন আমরা খুব ঘটা করে ধূলোবালির ঘর বানাতুম। তারপর খেলা শেষ হলে সেগুলোকে পা দিয়ে ভেঙে দিতুম, আর সমস্বরে ভাঙার গান গাইতুম, –

‘হাতের সুখে বানালুম
পায়ের সুখে ভাঙলুম!’

অনেক দূরে ওই কামানের গোলাগুলো পড়ছে আর এখান থেকে দেখাচ্ছে যেন আশমানের বুক থেকে তারাগুলো খসে খসে পড়ছে!

ওঃ, কী বোঁ বোঁ শব্দ! ওই যে মস্ত উড়োজাহাজ কী ভয়ানক জোরে ঘুরছে, উঠছে আর নামছে! ঠিক যেন একটা চিলেঘুড়িকে খেলোয়াড় গোঁতা মারছে। ওটা আমাদেরই। জার্মানদের জেপেলিনগুলো দূরে থেকে দেখায় যেন একটা বড়ো শুঁয়োপোকা উড়ে যাচ্ছে।

যাক, আমার ‘হ্যাভারস্যাক’ থেকে একটু আচার বের করে খাওয়া যাক। সেই বিদেশিনি মেয়েটি আজ কত দূরে, কিন্তু তার ছোঁয়া যেন এখনও লেগে রয়েছে এই ফলের আচারে! – দূর ছাই! যত সব বাজে কথা মনে হয় কেন? খামোখা সাত ভূতের বেদনা এসে জানটা কচলে কচলে দিয়ে যায়!

হা–হা–হা–হাঃ, বন্ধু আমার পাশের গাছটায় ঘুমোবার চেষ্টা করছেন দেখছি, ওই যে দিব্যি কোমরবন্ধটা দিয়ে নিজেকে একটা ডালের সঙ্গে বেশ শক্ত করে বেঁধেছেন। একবার পড়েন যদি ঝুপ করে ওই নীচের জলটায়, তাহলে বেড়ে একটা রগড় হয় কিন্তু! পড়িস আল্লা করে – এই সড়াৎ দু–ম্!…

দেব নাকি তার কানের গোড়া দিয়ে শোঁ করে একটা পিস্তলের গুলি ছেড়ে? আহা-হা, না, না ঘুমুক বেচারা! আমার মতন এমন পোড়া-চোখ তো আর কারুর নেই যে, ঘুম আসবে না, আর এমন পোড়া মনও কারুর নেই, যে সারা দুনিয়ার কথা ভেবে মাথা ধরাবে!

রাত্রি হয়েছে, – অনেকটা হবে। ভোর পর্যন্ত এমনি করেই কুঁকড়ো অবতার হয়ে থাকতে হবে। … বুড়ো কালে (অবশ্য, যদি ততদিন বেঁচে থাকি!) এইসব কথা আর খাটুনির স্মৃতি কী মধুর হয়ে দেখা দেবে!

মেঘ ছিঁড়ে পূর্ণিমার আগের দিনের চাঁদের জ্যোছনা কেমন ছিটে-ফোঁটা হয়ে পড়ছে সারা বনটার বুকে! এখন সমস্ত বনটাকে একটা চিতাবাঘের মতো দেখাচ্ছে!

কালো ভারী জমাট মেঘগুলো আমার মাথার দু-হাত উপর দিয়ে আস্তে আস্তে কোথায় ভেসে উধাও হয়ে যাচ্ছে, আর তারই দু -এক ফোঁটা শীতল জল আমার মাথায় পড়ছে টপ-টপ-টপ! কী করুণ শীতল সে জমাট মেঘের দু-ফোঁটা জল! আঃ!

চাঁদটা একবার ঢাকা যাচ্ছে, আবার শাঁ করে বেরিয়ে আর একটা মেঘে সেঁধিয়ে পড়ছে! এ যেন বাদশাহজাদার শিশমহলের সুন্দরীদের সাথে লুকোচুরি খেলা। কে ছুটছে? চাঁদ, না মেঘ? আমি বলব ‘মেঘ’, একটি সরল ছোট্ট শিশু বলবে ‘চাঁদ’। কার কথা সত্যি? –

আহা, কী সুন্দর আলো-ছায়া!

দূরে ওটা কি একটা পাখি অমন করে ডাকছে? এ দেশের পাখিগুলোর সুর কেমন একটা মধুর অলসতায় ভরা! শুনতে যেন নেশা ধরে।

এই আলো ছায়ায় আমার কত কথাই না মনে পড়ছে! ওঃ তার চিন্তাটা কী ব্যথায় ভরা! –

আমার মনে পড়ছে আমি বললুম, – ‘হেনা, তোমায় বড্ডো ভালোবাসি।’

সে, – হেনা তার কস্তুরীর মতো কালো পশমিনা অলকগোছা দুলিয়ে দুলিয়ে বললে, – ‘সোহরাব , আমি যে এখনও তোমায় ভালোবাসতে পারিনি!

সেদিন জাফরানের ফুলে যেন ‘খুন-খুশরোজ ’ খেলা হচ্ছিল বেলুচিস্তানের ময়দানে!

আমি আনমনে আখরোটের ছোট্ট একটা ডাল ভেঙে কাছের দেবদারু গাছ থেকে কতকগুলো ঝুমকো ফুল পেড়ে হেনার পায়ের কাছে ফেলে দিলুম!

স্তাম্বুলি -সুরমা-মাখা তার কালো আঁখির পাতা ঝরে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল! তার মেহেদি-ছোবানো হাতের চেয়েও লাল হয়ে উঠেছিল তার মুখটা!

একটা কাঁচা মনক্কার থোকা ছিঁড়ে নিয়ে অদূরের কেয়াঝোপের বুলবুলিটার দিকে ছুঁড়ে দিলুম। সে গান বন্ধ করে উড়ে গেল।

মানুষ যেটা ভাবে সব চেয়ে কাছে, সেইটাই হচ্ছে সব চেয়ে দূরে! এ একটা মস্ত বড়ো প্রহেলিকা!

হেনা ! হেনা!! আপশোশ!!!

হিন্ডেনবার্গ লাইন
ওঃ! আবার কোথায় এসেছি! এটা যে একটা পাতালপুরি, – দেও আর পরিদের রাজ্যি, তা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিনে! যুদ্ধের ট্রেঞ্চ যে একটা বড়ো শহরের মতো এরকম ঘর-বাড়িওয়ালা হবে, তা কি কেউ অনুমান করতে পেরেছিল? জমিনের এত নীচে কী বিরাট কাণ্ড! এও একটা পৃথিবীর মস্ত বড়ো আশ্চর্য! দিব্যি বাংলার নওয়াবের মতো থাকা যাচ্ছে কিন্তু এখানে!…

এ শান্তির জন্যে তো আসিনি এখানে! আমি তো সুখ চাইনি! আমি চেয়েছি শুধু ক্লেশ, শুধু ব্যথা, শুধু আঘাত! এ আরামের জীবন আমার পোষাবে না বাপু! তাহলে আমাকে অন্য পথ দেখতে হবে। ও যেন ঠিক ‘টকের ভয়ে পালিয়ে এসে তেঁতুলতলায় বাসা।’

উঁহুঁ, – আমি কাজ চাই! নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে চাই। এ কী অস্বস্তির আরাম!

আচ্ছা, আগুনে পুড়ে নাকি লোহাও ইস্পাত হয়ে যায়। মানুষ কী হয়? শুধু ‘ব্যাপটাইজড’?

আবার মনটা ছাড়া পেয়ে আমার সেই আঙুর আর বেদানা গাছে ভরা ঘরটার দৌড় মেরেছে! আবার মনে পড়ছে সেই কথা! …

‘হেনা, আমি যাচ্ছি মুক্ত দেশের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে! যার ভিতরে আগুন, আমি চাই তার বাইরেও আগুন জ্বলুক! আর হয়তো আসব না। তবে আমার সম্বল কী? পাথেয় কই? আমি কী নিয়ে সেই অচিন দেশে থাকব?’

আমার হাতের মুঠোয় হেনার হেনারঞ্জিত হাত দুটি কিশলয়ের মতো কেঁপে কেঁপে উঠল। সে স্পষ্টই বললে, – ‘এ তো তোমার জীবনের সার্থকতা নয় সোহরাব! এ তোমার রক্তের উষ্ণতা! এ কী মিথ্যাকে আঁকড়ে ধরতে যাচ্ছ! এখনও বোঝ! – আমি তোমায় আজও ভালবাসতে পারিনি।’

সব খালি! সব শূন্য! খাঁ – খাঁ – খাঁ! একটা জোর দমকা বাতাস ঘন ঝাউ গাছে বাধা পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, – আঃ – আঃ – আঃ!

যখন কোয়েটা থেকে আমাদের ১২৭ নম্বর বেলুচি রেজিমেন্টের প্রথম ‘ব্যাটেলিয়ন’যাত্রা করলে এই দেশে আসবার জন্যে, তখন আমার বন্ধু একজন যুবক বাঙালি ডাক্তার সেব গাছের তলায় বসে গাচ্ছিল, –

‘এখন ফিরাবে তারে কীসের ছলে,
বিদায় করেছ যারে নয়ন-জলে। –
আজি মধু সমীরণে
নিশীথে কুসুম-বনে,
তারে কি পড়েছে মনে বকুল-তলে,
এখন ফিরাবে হায় কীসের ছলে!
মধুনিশি পূর্ণিমার
ফিরে আসে বার বার
সে জন ফিরে না আর যে গেছে চলে!
এখন ফিরাবে আর কীসের ছলে!’

কী দুর্বল আমি। সাধে কী আসতে চাইনি এখানে! ওগো, এরকম নওয়াবি-জীবন আমার চলবে না!

আমার রেজিমেন্টের লোকগুলো মনে করে আমার মতো এত মুক্ত, এত সুখী আর নেই! কারণ আমি বড্ড বেশি হাসি। হায়, মেহেদি পাতার সবুজ বুকে যে কত ‘খুন’ লুকানো থাকে, কে তার খবর নেয়!

আমি পিয়ানোতে ‘হোম হোম সুইট সুইট হোম’ গতটা বাজিয়ে সুন্দর রূপে গাইলুম দেখে ফরাসিরা অবাক হয়ে গেছে, যেন আমরা মানুষই নই, ওদের মতো কোনো কাজ করা যেন আমাদের পক্ষে এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার! এ ভুল কিন্তু ভাঙাতেই হবে।

হিন্ডেনবার্গ লাইন
কী করি, কাজ না থাকলেও আমায় কাজ খুঁজে নিতে হয়। কাল রাত্তিরে প্রায় দু-মাইল শুধু হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে ওদের অনেক তার কেটে দিয়ে এসেছি। কেউ এতটুকু টের পায়নি।

আমার ‘কমান্ডিং অফিসার’ সাহেব বলেছেন, ‘তুমকো বাহাদুরি মিল যায়েগা।’

আজ আমি ‘হাবিলদার’ হলুম।

এ মন্দ খেলা নয় তো! –

আবার সেই বিদেশিনির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এই দুবছরে কত বেশি সুন্দর হয়ে গেছে সে! সেদিন সে সোজাসুজি বললে যে, (যদি আমার আপত্তি না থাকে) সে আমায় তার সঙ্গী-রূপে পেতে চায়! আমি বললুম, – ‘না, তা হতেই পারে না।’

মনে মনে বললুম, – ‘অন্ধের লাঠি একবার হারায়। আবার? আর না, যা যা খেয়েছি, তাই সামলানো দায়।’

বিদেশিনির নীল চোখ দুটা যে কীরকম জলে ভরে উঠেছিল, আর বুকটা তার কীরকম ফুলে ফুলে উঠেছিল, তা আমার মতো পাষাণকেও কাঁদিয়েছিল!

তারপর সে নিজেকে সামলে নিয়ে বললে, – ‘তবে আমাকে ভালোবাসতে দেবে তো? অন্তত ভাই-এর মতো …’

আমি বেওয়ারিশ মাল। অতএব খুব আগ্রহ দেখিয়ে বললুম, – ‘নিশ্চয়, নিশ্চয়!’ তার পর তার ভাষার ‘অডিএ’ (বিদায়) বলে সে যে সেই গিয়েছে, আর আসেনি! আমার শুধু মনে হচ্ছে, – ‘সে জন ফিরে না আর যে গেছে চলে! …’

ওঃ –

যা হোক, আজ গুর্খাদের পেয়ে বেশ থাকা গেছে কিন্তু। গুর্খাগুলো এখনও যেন এক একটা শিশু । দুনিয়ার মানুষ যে এত সরল হতে পারে, তা আমার বিশ্বাসই ছিল না। এই গুর্খা আর তাদের ভায়রা-ভাই ‘গাড়োয়াল’, এই দুটো জাতই আবার যুদ্ধের সময় কীরকম ভীষণ হয়ে ওঠে! তখন প্রত্যেকে যেন এক-একটা ‘শেরে বব্বর’! এদের ‘খুক্‌রি’ দেখলে এখনও জার্মানরা রাইফেল ছেড়ে পালায়। এই দুটো জাত যদি না থাকত, তাহলে আজ এতদূর এগুতে পারতুম না আমরা। তাদের মাত্র কয় জন আর বেঁচে আছে। রেজিমেন্টকে রেজিমেন্ট একেবারে সাবাড়! অথচ যে দু-চার জন বেঁচে আছে, তারাই কীরকম হাসছে খেলছে! যেন কিছুই হয়নি।

ওরা যে মস্ত একটা কাজ করেছে, এইটেই কেউ এখনও ওদের বুঝিয়ে উঠতে পারেনি! আর ওই অত লম্বা-চওড়া শিখগুলো, তারা কী বিশ্বাসঘাতকতাই না করেছে! নিজের হাতে নিজে গুলি মেরে হাসপাতালে গিয়েছে।

বাহবা! ট্রেঞ্চের ভিতর একটা ব্যাটালিয়ন ‘মার্চ’ হচ্ছে। ফ্রান্সের মধুর ব্যান্ডের তালে তালে কী সুন্দর পা-গুলো পড়ছে আমাদের! লেফট – রাইট – লেফট! ঝপ – ঝপ – ঝপ। এই হাজার লোকের পা এক সঙ্গেই উঠছে, এক সঙ্গেই পড়ছে! কী সুন্দর!

বেলুচিস্তান
কোয়েটার দ্রাক্ষাকুঞ্জস্থিত
আমার ছোট্ট কুটির
এ কী হল? আজ এই আখরোট আর নাশপাতির বাগানে বসে বসে তাই ভাবছি!

আমাদের সব ভারতীয় সৈন্য দেশে ফিরে এল, আমিও এলুম। কিন্তু সে দুটো বছর কী সুখেই কেটেছে!

আজ এই স্বচ্ছ নীল একটু-আগে-বৃষ্টির জলে-ধোয়া আশমানটি দেখছি, আর মনে পড়ছে সেই ফরাসি তরুণীটির ফাঁক ফাঁক নীল চোখ দুটি। পাহাড়ে ওই চমরী মৃগ দেখে তার সেই থোকা থোকা কোঁকড়ান রেশমি চুলগুলো মনে পড়ছে। আর ওই যে পাকা আঙুর ঢল ঢল করছে, অমনি স্বচ্ছ তার চোখের জল।

আমি ‘আফসার’ হয়ে ‘সর্দার বাহাদুর’ খেতাব পেলুম। সাহেব আমায় কিছুতেই ছাড়বে না। – হায়, কে বুঝবে আর কাকেই বা বোঝাব, ওগো আমি বাঁধন কিনতে আসিনি। সিন্ধুপারে কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে নিয়েও যাইনি। ও শুধু নিজেকে পুড়িয়ে খাঁটি করে নিতে, – নিজেকে চাপা দিতে! –

আবার এইখানটাতেই, যেখানে কখনও আসব না মনে করেছিলুম, আসতে হল। এ কী নাড়ির টান! … আমার কেউ নেই, কিছু নেই, তবু কেন রয়ে রয়ে মনে হচ্ছে, – না, এইখানেই সব আছে। এ কার মূঢ় অন্ধ সান্ত্বনা? –

কারুর কিচ্ছু করিনি, আমারও কেউ কিচ্ছু করেনি, তবে কেন এখানে আসছিলুম না? – সে একটা অব্যক্ত বেদনার অভিমান, – সেটা প্রকাশ করতে পারছিনে।

হেনা! হেনা! – সাবাস! কেউ কোথাও নেই, তবুও ওধার থেকে বাতাসে ভেসে আসছে ও কী শব্দ, – ‘না,–না–না।’

পাহাড় কেটে নির্ঝরটা তেমনই বইছে, কেবল যার মেহেদি-রাঙানো পদ-রেখা এখনও ওর পাথরের বুকে লেখা রয়েছে, সেই হেনা আর নেই। এখানে ছোটো-খাটো কত জিনিস পড়ে রয়েছে, যাতে তার কোমল হাতের ছোঁয়ার গন্ধ এখনও পাচ্ছি।

হেনা! হেনা! হেনা! আবার প্রতিধ্বনি, নাঃ–নাঃ–নাঃ!

* * *
পেশোয়ার
পেয়েছি, পেয়েছি! আজ তার দেখা পেয়েছি! হেনা! হেনা! – তোমাকে আজ দেখেছি এইখানে, এই পেশোয়ারে! তবে কেন মিথ্যা দিয়ে এত বড়ো একটা সত্যকে এখনও ঢেকে রেখেছ?

সে আমায় লুকিয়ে দেখেছে আর কেঁদেছে। … কিছু বলেনি, শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছে আর কেঁদেছে।…

এরকম দেখায় যে অশ্রু প্রাণের শ্রেষ্ঠ ভাষা। সে আজও বললে, – ‘সে আমায় ভালোবাসতে পারেনি।…

ওই ‘না’ কথাটা বলবার সময়, সে কী করুণ একটা কান্না তার গলা থেকে বেরিয়ে ভোরের বাতাসটাকে ব্যথিয়ে তুলেছিল!

দুনিয়ার সবচেয়ে মস্ত হেঁয়ালি হচ্ছে – মেয়েদের মন!

ডাক্‌কা ক্যাম্প
কাবুল
যখন মানুষের মতো মানুষ আমির হাবিবুল্লাহ খাঁ শহিদ হয়েছেন শুনলুম, তখন আমার মনে হল এত দিনে হিন্দুকুশের চূড়াটা ভেঙে পড়ল! সুলেমান পর্বত জড়সুদ্ধ উখড়িয়ে গেল।

ভাবতে লাগলুম, আমার কী করা উচিত? দশ দিন ধরে ভাবলুম। বড্ড শক্ত কথা!

নাঃ, আমিরের হয়ে যুদ্ধ করাই ঠিক মনে করলুম। কেন? এ ‘কেন’র উত্তর নেই। তবুও আমি সরল মনে বলছি, ইংরেজ আমার শত্রু নয়। সে আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু। যদি বলি, আমার আবার এ যুদ্ধে আসার কারণ একটা দুর্বলকে রক্ষা করবার জন্যে প্রাণ আহুতি দেওয়া, তা হলেও ঠিক উত্তর হয় না।

আমার অনেক খামখেয়ালির অর্থ আমি নিজেই বুঝি না!

সেদিন ভোরে ডালিম ফুলের গায়ে কে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল! ওঃ, সে যেন আমারই মতো আরও অনেকের বুকের খুন-খারাবি! …

উদার আকাশটা কেঁদে কেঁদে একটুর জন্যে থেমেছে। তার চোখটা এখনও খুব ঘোলা, আবার সে কাঁদবে। কার সে বিয়োগ-ব্যথায় বিধুর কোয়েলিটাও কেঁদে কেঁদে চোখ লাল করঞ্জ করে ফেলেছিল, আর তার উহুঁ – উহুঁ, শব্দ প্রভাতের ভিজে বাতাসে টোল খাইয়ে দিচ্ছিল! শুকনো নদীটার ও-পারে বসে কে সানাইতে আশোয়ারি রাগিণী ভাঁজছিল। তার মিড়ে মিড়ে কত যে চাপা হৃদয়ের কান্না কেঁপে কেঁপে উঠছিল, তা সবচেয়ে বেশি বুঝছিলুম আমি। মেহেদি ফুলের তীব্র গন্ধে আমাকে মাতাল করে তুলেছিল।

আমি বললুম, – ‘হেনা, আমিরের হয়ে যুদ্ধে যাচ্ছি। আর আসব না। বাঁচলেও আর আসব না।’

সে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বললে, – ‘সোহরাব প্রিয়তম! তাই যাও! – আজ যে আমার বলবার সময় হয়েছে, তোমায় কত ভালোবাসি! – আজ আর আমার অন্তরের সত্যিকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে আশেককে কষ্ট দেব না।’

আমি বুঝলুম, সে বীরাঙ্গনা, আফগানের মেয়ে। যদিও আফগান হয়েও আমি শুধু পরদেশির জীবন যাপন করেই বেড়িয়েছি, তবু এখন নিজের দেশের পায়ে আমার জীবনটা উৎসর্গ করি, এই সে চাচ্ছিল।

ওঃ, রমণী তুমি! কী করে তবে নিজেকে এমন করে চাপা দিয়ে রেখেছিলে হেনা?

কী অটল ধৈর্যশক্তি তোমার! কোমলপ্রাণা রমণী সময়ে কত কঠিন হতে পারে।…

হেনা! হেনা!!

 ০৭. বাদল বরিষনে

বৃষ্টির ঝম-ঝমানি শুনতে শুনতে সহসা আমার মনে হল, আমার বেদনা এই বর্ষার সুরে বাঁধা!…

সামনে আমার গভীর বন। সেই বনে ময়ূরে পেখম ধরেছে, মাথার উপর বলাকা উড়ে যাচ্ছে, ফোটা কদম ফুলে কার শিহরণ কাঁটা দিয়ে উঠছে, আর কীসের ঘন-মাতাল-করা সুরভিতে নেশা হয়ে সারা বনের গা টলছে!…

এটা শ্রাবণ মাস, না? – আহা, তাই অন্তরে আমার বরিষণের ব্যথাটুকু ঘনিয়ে আসছে! –

সে হল আজ তিন বছরের কথা। আমার এই খাপছাড়া জীবন তার স্মৃতিগুলো ঝড়ের মুখে পদ্মবনের মতো ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে! কখনও তার একটি কথা মনে পড়ে, কখনও তার আধখানি ছোঁয়া আমার দাগা-পাওয়া বুকে জাগে! মানস-বনের জুঁই-কুঁড়ি আমার ফুটতে গিয়ে ফুটতে পায় না, শিউলির বোঁটা শিথিল হয়ে যায়। ওরই সাথে এই শাওন-ঘন দেয়া-গরজনে আর এক দিনের অমনই মেঘের ডাক মনে পড়ে, আর আঁখি আমার আপনি জলে ভরে ওঠে!

সেদিন ছিল আজকার মতোই শ্রাবণের শুক্লা পঞ্চমী। পথহারা আমি ঘুরতে ঘুরতে যেদিন প্রথম এই কালিঞ্জরে এসে পড়ি, সেদিন এখানে কাজরি উৎসবের মহা ধুম পড়ে গেছে – আকাশভরা হালকা জলো মেঘ আমারই মতো খাপছাড়া হয়ে যেন অকূল আকাশে কূল হারিয়ে ফিরছিল। তারই ঈষৎ ফাঁকে সুনীল গগনের এক ফালি নীলিমা যেন কোন্ অনন্ত-কান্নারত প্রেয়সীর কাজল-মাখা কালো চোখের রেখার মতো করুণ হয়ে জাগছিল! পথ-চলার নিবিড় শ্রান্তি নিয়ে কালিঞ্জরের উপকণ্ঠের বাঁকে উপবনের পাশে তার সাথে আমার প্রথম দেখা। এই হঠাৎ দেখাতেই কেন আমার মনে হল, এ-মুখ যে আমার কত কালের চেনা – কোথায় যেন একে হারিয়েছিলাম! সেও আমার পানে চেয়ে আমার চাওয়ায় কী দেখতে পেলে সেই জানে, – তাই পথ চলতে চলতে তার হাতের কচি ধানের ছোট্ট গোছাটি মুখের উপর আধ-আড়াল করে আমায় জিজ্ঞেস করলে, – ‘পরদেশিয়া রে, তুহার দেশ কাহাঁ?’ সে স্বর আমার বাইরে ভিতরে এক ব্যাকুল রোমাঞ্চ দিয়ে গেল, বুকের সমস্ত রক্ত আকুল আবেগে কেঁপে কেঁপে নৃত্য করে উঠল!

এ কোন্ চির-পরিচিত স্বর? এ কে ছলনা করে আমায়? পূবের হাওয়া আমার পাশ দিয়ে কেঁদে গেল – ‘হায় গৃহহীন, হায় পথহারা!’ ঝড়ে-ওড়া এক দল পলকা মেঘের মতো মল্লারের সুরে পথের আকাশ-বাতাস ভরিয়ে কাজরি গায়িকা রূপসিরা গেয়ে যাচ্ছিল, – ‘ঘুঙঘট-পট খোলো আরে সাঁবলিয়া!’ (ওগো শ্যামল, এখন তোমার ঘোমটা খুলে ফেল।)

আমার কাছে তাকে এমন করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তরুণীরা আঁখির পলকে থমকে দাঁড়াল, তারপর চুল ছড়িয়ে বাহু দুলিয়ে আঁচল উড়িয়ে বলে উঠল, – ‘কাজরিয়া গে! ক্যা তোরি সাঁবলিয়া আ গয়ি?’

সে তাদের এক পাশে সরে গিয়ে কাঁপা-গলায় বললে, – ‘নহি রে সজনিয়া, নহি! য়্যে পরদেশি জোয়ান –’

তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আর একজন বলে উঠল, – ‘ক্যা তেরি দিল্ ছিন্ লিয়া?’

সে লজ্জায় আর দাঁড়াতে পারল না, খামখা আমার দিকে অনুযোগ-তিরস্কার-ভরা বাঁকা চাউনি হেনে চলে গেল!

পথের ওই বাঁক থেকেই অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল তাদের ধানি রং-এর শাড়ির ঢেউ আর আশমানী রং-এর ওড়নার আকুল প্রান্ত। রয়ে রয়ে তাদের এলানো কেশপাশ বেয়ে কেমন মধুর এক সোঁদা-গন্ধ ভেসে আসছিল। অতগুলি সুন্দর মুখের মাঝ থেকে আমার মনে জগজগ করছিল শুধু ওই কাজরিয়ার ছোট্ট কালো মুখ, – যা শিল্পীর হাতে কালো পাথর-কোঁদা দেবীমুখের মতো নিটোল! বিজলি-চমকের মতো তার ওই যে একটি দুরন্ত চপল গতি, তারই মধুরতাটুকু আমার মনের মেঘে বারে-বারে তড়িৎ হেনে যাচ্ছিল।

পথের পাশের দোলনা-বাঁধা দেবদারু-তলায় দাঁড়িয়ে আমার শুধু এই কথাটি মনে হতে লাগল, এই এক পলকের আধখানি চাওয়ায় কেমন করে মানুষ এত চিরপরিচিত হয়ে যেতে পারে।

* * *

[অভিমানের দেখা-শোনা]

তার পরের দিন আমলকি বনে দাঁড়িয়ে সেই আগেকার দিনের কথাটাই ভাবছিলাম, – আচ্ছা, এই যে আমার মানসী বঁধু, – একে কবে কোন্ পুরবির কান্না-ভরা খেয়ার পারে হারিয়ে এসেছিলাম? সকল স্মৃতি উলট-পালট করেও তার দিন ক্ষণ মনে আসি-আসি করেও যেন আসে না, অথচ মনের মানুষ আমার একে দেখেই কেমন করে চিনে ফেললে। তাই সে আমার আঁখির দীপ্তিতে ফুটে উঠে বলে উঠল, – এই তো আমার চির-জনমের চাওয়া তুমি! ওগো, এই তো আমার চির-সাধনার ধন তুমি! …

আর একবার আমার স্মৃতির অতল তলে ডুব দিলাম, এমন সময় ঝড়ের সুরে কাজরি গান গাইতে রূপসি নাগরীরা আমার পাশ দিয়ে উধাও হয়ে গেল, –

চঢ়ে ঘটা ঘন ঘোর গরজ রহে বদরা রে হোরি।
রিম ঝিম রিম ঝিম পানি বরষৈ রহি রহি জিয়া ঘাবরাবৈ রামা।
বহৈ নয়নাসে নীর ময়েল ভয়ি কজরা রে হোরি!

[ঘোর ঘটা করে গগনে মেঘ করেচে, বাদল গরজন করছে, রিম-ঝিম-রিম-ঝিম বৃষ্টি ঝরচে, থেকে থেকে জান আমার ঘাবড়িয়ে উঠছে, নয়ন বেয়ে আঁসু ঝরছে; – ওগো, চোখের কাজল আমার মলিন হয়ে গেল!]

বর্ষার মেঘ চলে গেল। মর্মে আমার তারই গাঢ় গমক গুমরে ফিরতে লাগল, – ‘ময়েল ভয়ি কজরা রে হোরি!’ – ওগো প্রিয়, চোখের কাজল আমার মলিন হয়ে গেল! সে কোন্ অচেনার উদ্দেশ্যে এ অবুঝ-কান্না তোমার বিদেশিনি? সে-কথা সেও জানে না, তার মনও জানে না! …

আবার সেই সন্তাপহারী আমার চিরবাঞ্ছিত মেঘ-গুরু-গরজনে ডেকে উঠল। বনের সিক্ত আকাশকে ব্যথিয়ে ময়ূরের কেকা-ধ্বনির সাথে চাতকের অতৃপ্তির কাঁদন রণিয়ে রণিয়ে উঠছিল, – ‘দে জল, দে জল!’ হায় রে চিরদিনের শাশ্বত পিয়াসী! তোর এ অনন্ত পিয়াসা কি সারা সাগরের জলেও মিটল না? আমার কেমন আবছা এক কণা স্মৃতি মনের কানে বলছিল, – ‘তুমি আগে এমনই চাতক ছিলে, তোমার পিপাসা মিটবার নয়!’

ভেজা মাটির আর খস-খস-এর গুমোট-ভরা ভারী গন্ধে যেন দম আটকে যাচ্ছিল; ও-ধারে ফোটা কেয়া ফুলের, আধফোটা যূথীর, বেলির কুঁড়ির, ঝরা শেফালি-বকুলের দিল্‌-মাতানো খোশবুর মাঝে মাঝে পদ্ম আর কদম্বের স্নিগ্ধ সুরভি মধুর আমেজ দিচ্ছিল! বর্ষার ব্যথা আমার দিকে গভীর মৌন চাওয়া চেয়ে শুধাচ্ছিল, –

‘এমন দিনে তারে বলা যায় এমন ঘন ঘোর বরিষায়!’

হায়, কী বলা যায়? কাকে বলা যায়? এ উতল-পাগল তার কিছুই জানে না, অথচ সে কী যেন বলতে চায় – কাকে যেন বুকের কাছে পেতে চায়! এই মেঘদূত তার কাছে তার পালিয়ে যাওয়া প্রিয়তমার সন্ধান করে গেছে, সেই চাওয়া-পাওয়াটুকুর বার্তা পৌঁছিয়ে দিয়ে গেছে, তাই সে মেঘদূতকে অভিনন্দন জানাচ্ছে –

‘এস হে সজল ঘন বাদল বরিষনে!’

আজ আর একবার মনে হল সে তার বিদায়ের দিনে বলেছিল, – ‘আবার দেখা হবে, তখন হয়তো তুমি চিনতে পারবে না!’

আজ সেই বিদায়-বাণী মনে পড়ে আমার বক্ষ কান্নায় ভরে উঠছে! আমার পাশ দিয়ে কালো কাজরিয়া যখন তার চাউনি হেনে চলে গেল, তখন ওই কথাটিই বারে বারে মনে পড়ছিল, – হয়তো তুমি চিনতে পারবে না!

তাই কাজরিয়াকে ডেকে বললাম, – ‘এই তো তোমায় চিনতে পেরেছি তোমার এই চোখের চাওয়ায়!’

কাজরিয়া চুল দিয়ে মুখ ঝেঁপে চলে গেল! তার ওই না-চাওয়াই বলে গেল, সেও আমায় চিনতে পেরেছে।…

আবার তার অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। – ঝঞ্ঝার উতরোলের মতো দোল খেয়ে খেয়ে পাশের উপবন হতে তরুণী-কণ্ঠের মল্লার হিন্দোলা ভেসে আসছিল, – ‘মেঘবা ঘুম ঘুম বরষাবৈ ছাবৈ বদরিয়া শাওন মে!’

পথের মাঝে দাঁড়িয়ে দেখলাম, আকাশ বেয়ে হাজার পাগলা-ঝোরা ঝরছে – ঝম ঝম ঝম! যেন আকাশের আঙিনায় হাজার হাজার দুষ্টু মেয়ে কাঁকর-ভরা মল বাজিয়ে ছুটোছুটি করছে! তপোবনে গিয়ে দেখলাম, সেই বৃষ্টিধারায় ভিজে ভিজে মহা উৎসাহে বিদেশিনি তরুণীরা দেবদারু ও বকুল শাখায় ঝুলানো দোলনায় দোল খেয়ে খেয়ে কাজরি গাইছে। ঝড়-বৃষ্টির সাথে সে কী মাতামাতি তাদের! আজ তাদের কোথাও বন্ধন নেই, ওদের প্রত্যেকেই যেন এক একটা পাগলিনি প্রকৃতি! কী সুন্দর সেই প্রকৃতির উদ্দাম চঞ্চলতার সনে মানব-মনের আদিম চির-যৌবনের বন্ধ-হারা গতি-রাগের মিলন!–শাওন মেঘের জমাট সুরে আমার মনের বীণায় মূর্ছনা লাগল। আমার যৌবন-জোয়ারও অমনি ঢেউ খেলে উঠল। মনের পাগল অমনি করে দোদুল দোলায় দুলে সুন্দরীদের এলো চুলের মতোই হাওয়ার বেগে মেঘের দিকে ছুটল, – হায় কোথায়, কোন্ সুদূরে তার সীমা-রেখা!

হিন্দোলার কিশোরীরা গাচ্ছিল কাজল-মেঘের আর নীল আকাশের গান। নীচে শ্যামল দুর্বায় দাঁড়িয়ে বিনুনি-বেণি-দোলানো সুন্দরীরা মৃদঙ্গে তাল দিয়ে গাচ্ছিল কচি ঘাসের আর সবুজ ধানের গান। তাদের প্রাণে মেঘের কথার ছোঁয়া লেগেছিল। … মেঘের এই মহোৎসব দেখে আপনি আমার চোখে জল ঘনিয়ে এল। দেখলাম সেই কালো কাজ্‌রিয়া – দোলনা ছেড়ে আমার পানে সজল চোখের চেনা চাউনি নিয়ে চেয়ে আছে। আমার চোখে চোখ পড়তেই সে এক নিমেষে দোলনায় উঠে কয়ে উঠল, – সজনিয়া গে, ওহি সুন্দর পরদেশিয়া। তার সই মতিয়া দুলতে দুলতে বাদল-ধারায় এক রাশ হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বলল, –‘হা রে কাজরিয়া, তুহার সাঁবলিয়া!’

কাজরিয়া মতিয়ার চুল ধরে টেনে ফেলে দিয়ে পাশের বকুল গাছটার আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল।

আমি ভাবছিলাম, এমনি করেই বুঝি মেঘে আর মানুষে কথা কওয়া যায় – এমনি করেই বুঝি ও-পারের বিরহী যক্ষ মেঘকে দূতী করে তার বিচ্ছেদ-বিধুরা প্রিয়তমাকে বুকের ব্যথা জানাত। আমার ভেজা-মন তাই কালো মেঘকে বন্ধু বলে নিবিড় আলিঙ্গন করলে!

চমকে চেয়ে দেখলাম, সে কখন এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। তার গভীর অপলক দৃষ্টি মেঘ পেরিয়ে কোন্ অনন্তের দিগ্‌বলয়ে পৌঁছেছিল, সেই জানে। তার পাশে থেকে আমারও মনে হল ওই দূর মেঘের কোলে গিয়ে দাঁড়িয়েছি শুধু সে আর আমি। কেউ কোথাও নেই, উপরে নীচে আশে-পাশে শুধু মেঘ আর মেঘ, – সেই অনন্ত মেঘের মাঝে সে মেঘের-বরণ বাহু দিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে তার মেঘলা-দৃষ্টিখানি আমার মুখের উপর তুলে ধরেছে। ওইখানেই – ওই চেনা-শোনা জায়গাটিতেই যেন আমাদের প্রথম দেখা-শোনা, ওইখানেই আবার আমাদের অভিমানের ছাড়াছাড়ি, এই কথাটি আমাদের দুই জনেরই মনের অচিন কোণে ফুটে উঠতেই আমরা একান্ত আপনার হয়ে গেলাম। যে কথাটি হয়তো সারা জীবন চোখের জলে ভেসেও বলা হত না, এই ঝড়-বৃষ্টির মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক নিমেষে চারটি চোখের অনিমিখ চাউনিতে তা কওয়া হয়ে গেল।

আমি বললাম – ‘কাজরি, আমি অনেক জীবনের খোঁজার পর তোমায় পেয়েছি!’ এই মেঘের ঝরায় যে প্রাণের কথা প্রাণ দিয়ে সে শুনছিল, সহসা তাতে বাধা পেয়ে সে সচেতন হয়ে উঠল। চখা হরিণীর মতো ভীত-ত্রস্ত চাউনি দিয়ে চারিদিকে চেয়ে আচমকা আর্ত আকুল স্বরে সে কেঁদে উঠল। সে আর দাঁড়াল না, হুঁকরে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিলে। যেতে যেতে বলে গেল –‘নহি রে সুন্দর পরদেশি ম্যয় কারী কাজরিয়া হুঁ – ‘ওগো সুন্দর বিদেশি, আমি কালো।’ আরও কী বলতে বলতে অভিমানে ক্ষোভে তার মুখে আর কথা ফুটল না, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল!

একটি পুরো বছর আর তার দেখা পাইনি।

আজ শাঙন রাতের মাতামাতিতে হৃদয় আমার কথায় আর ব্যথায় ভরে উঠেছে, আর তার সেই বিদায়-দিনের আরও অনেক কিছু মনে পড়ছে। আজ আমার শিয়রের ক্ষীণ দীপশিখাটিতে বাদল-বায়ের রেশ লেগে তাকে কাঁপিয়ে তুলছে, আমার বিজন কক্ষটিতে সেই কাঁপুনি আমার মনে পড়িয়ে দিচ্ছে – হায়, আজ তেমন করে আঘাত দেবারও আমার কেউ নেই। প্রিয়তমের কাছ থেকে আঘাত পাওয়াতে যে কত নিবিড় মাধুরী, তা বেদনাতুর ছাড়া কে বুঝবে? যার নিজের বুকে বেদনা বাজেনি, সে পরের বেদন বুঝবে না, বুঝবে না…

সে বলেছিল, – ‘দেখ বিদেশি পথিক। আমি নিবিড় কালো, লোকে তাই আমাকে কাজরিয়া বলে উপহাস করে; তাদের সে আঘাত আমি সইতে, উপেক্ষা করতে পারি, আমার সে সহ্যশক্তি আছে, কিন্তু ওগো নিষ্ঠুর! তুমি কেন আমায় ভালোবাসি বলে উপহাস করছ? ওগো সুন্দর শ্যামল। তুমি কেন এ হতভাগিনিকে আঘাত করছ? এ অপমানের দুর্বার লজ্জা রাখি কোথায়? জানি, আমি কালো কুৎসিত, তাই বলে ওগো পরদেশি, তোমার কী অধিকার আছে আমাকে এমন করে মিথ্যা দিয়ে প্রলুব্ধ করবার? ছি, ছি, আমায় ভালোবাসতে নেই – ভালোবাসা যায় না, ভালোবাসতে পারবে না। এমন করে আর আমায় দুর্বলতায় বেদনা-ঘা দিয়ো না শ্যামল, দিয়ো না! ও তো আমার অপমান নয়, ও যে আমার ভালোবাসার অপমান; তা কেউ সইতে পারে না। – বিদায় শ্যামল, বিদায়!’

আমি মনে মনে বললাম, – ওগো অভিমানিনী। অভিমানের গাঢ় বিক্ষোভ তোমায় অন্ধ করেছে, তাই তুমি সকল কথা বুঝেও বুঝছ না। আমিও যে তোমারই মতো কালো। তুমি তো নিজ মুখেই আমায় শ্যামল বলেছ, অথচ সুন্দর বলছ কেন? তোমার চোখে তুমি আমায় যেমন সুন্দর দেখেছ, আমার চোখে আমিও তেমনই তোমার সৌন্দর্য দেখেছি। তোমার ওই কালো রূপেই আমার চির-আকাঙ্ক্ষিতাকে খুঁজে পেয়েছি, যেন সে কোন্ অনাদি যুগের অনন্ত অন্বেষণের পর! আর যদি অধিকারই না থাকে, তবে তুমি আর কারুর আঘাতে বেদনা পেলে না, অথচ আমার স্নেহ সইতে পারলে না কেন? আমারই উপরে বা তোমার কী দাবি পেয়েছ, যার জোরে সবারই আঘাত-বেদনাকে উপেক্ষা করতে পার, শুধু আমাকেই পার না? আমার বক্ষ দলিত করে কী করে আমায় এমন ছেড়ে যেতে পারছ? যার ভালবাসায় বিশ্বাস নেই, তার উপর তো অভিমান করা চলে না। যাকে বুঝি, আর আমার দাবি আছে যে, আমার অভিমান এ সহ্য করবে, তার উপর অভিমান আসে, তারই উপর রাগ করা যায়। আমার যে তখন মস্ত বিশ্বাস থাকে যে, আমার এ অহেতুক অভিমানের আব্দার এ সহ্য করবেই – কেননা, সে যে আমায় ভালোবাসে।

সে কোনো কথা বুঝল না, চলে গেল। এ তীব্র অভিমান যে তার কার উপর, নিজেই বলতে পারত না, তবে কতকটা যেন তার এই কালো রূপের স্রষ্টার উপর। তার বুক-ভরা অভিমান আহত পক্ষী-শাবকের মতো যেন সেই দুর্বোধ্য রূপস্রষ্টার পায়ে লুটিয়ে পড়ে বলেছিল, – ওগো, আমাকেই কি সারা দুনিয়ার মাঝে এমন করে কালো কুৎসিত করে সৃষ্টি করতে হয়? তোমার কুম্ভ-ভরা রূপের একটি রেণু এ-অভাগিকে দিলে কি তোমার ভরা-কুম্ভ খালি হয়ে যেত? যদি কালো করেই সৃষ্টি করলে তবে ওই অন্ধকারের মাঝে আলোর মতো ভালোবাসা দিলে কেন? আবার অন্যেরে দিয়ে ভালোবাসিয়ে লজ্জিত কর কেন? … হায়, সে যে কখনও বোঝেনি যে, সত্য-সৌন্দর্য বাইরে নয়, ভিতরে – দেহে নয়, অন্তরে।

আমি সেদিন এই একটা নতুন জিনিস দেখেছিলাম যে, যতদিন সে কারুর ভালোবাসা পায়নি, ততদিন তার সারা জনমের চাপা অভিমান এমন বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেনি; কিন্তু যেই সে বুঝলে, কেউ তাকে ভালোবেসেছে, অমনি তার কান্না-ভরা অভিমান ওই স্নেহের আহ্বানে দুর্জয় বেগে হাহাকার করে গর্জন করে উঠল। এই ফেনিয়ে-ওঠা অভিমানের জন্যেই সে যাকে ভালোবাসে, তাকে এড়িয়ে গেল। এমন ভালোবাসায় যে প্রিয়তমাকে এড়িয়ে চলাতেই আনন্দ। এ বেদনা-আনন্দের মাধুরী আমার মতো আর কেউ বোঝেনি।

হায়, আমার মনের এত কথা বুঝি মনেই মরে গেল। এ জীবনে আর তা বলা হবে না।

* * *

[চির-জনমের ছাড়াছাড়ি]

তার পর-বছরের কথা।

কাজরিয়ার সঙ্গে আবার আমার দেখা হল মির্জাপুরের পাহাড়ের বুকে বিরহী নামক উপত্যকায়। সেদিন ছিল ভাদ্রের কৃষ্ণা-তৃতীয়া। সেদিনও মেঘে আঁধারে কোলাকুলি করছিল। সেদিন ছিল কাজরি উৎসবের শেষ দিন। সেদিন বাদল মেঘ ধানের খেতে তার শেষ বিদায়-বাণী শোনাচ্ছিল, আর নবীন ধানও তার মঞ্জরি দুলিয়ে কেঁপে কেঁপে বাদলকে তার শেষ অভিনন্দন জানাচ্ছিল। হায়, এদের কেউ জানে না, আবার কোন্ মাঠে কোনো তালি-বনের রেখা-পারে তাদের নতুন করে দেখাশোনা হবে। আজ সুন্দরীদের চোখের কাজল মলিন, তাদের সুরে কেমন একটা ব্যথিত ক্লান্তি, সুন্দর ছোট্ট মুখগুলি রোদের তাপে শালের কচি পাতার মতো ম্লান – এলানো! কাল যে এই সারা-বছরের চাওয়া বাদল-উৎসবের বিসর্জন, এইটাই তাদের এত আনন্দকে বার-বারে ব্যথা দিয়ে যাচ্ছিল। কে জানে, তাদের এই সব সখীদের এমনি করে পর-বছর আবার দেখা হবে কি না। হয়তো এরই মাঝের কত চেনা মুখ কোথায় মিলিয়ে যাবে, সারা দুনিয়া খুঁজেও সে মুখ আর দেখতে পাবে না।

দোলনার সোনালি রং-এর ডোরকে উজ্জ্বলতর করে বারে বারে ছুরি-হানার মতো বিজুরি চমকে যাচ্ছিল। কাজরি ছুটে এসে আমার ডান হাতটি তার দু হাতের কোমল মুঠির মধ্যে নিয়ে বুকের উপর রাখলে, তার পর বললে, – ‘ওগো পরদেশি শ্যামল, তোমায় আমি চিনেছি। তুমি সত্য। তুমি আমায় ভালোবাস। নিশ্চয়ই ভালোবাস। সত্যি ভালোবাস।’ দেখলাম, তার শীর্ণ চোখের উজ্জ্বল চাউনিতে গভীর ভালোবাসার ছল-ছল জ্যোতি শরৎপ্রভাতের জল-মাখা রোদ্দুরের মতো করুণ হাসি হেসেছে। আহ, এত দিনের বিরহের কঠোর তপস্যায় সে তার সত্যকে চিনতে পেরেছে। তার খিন্ন মলিন তনুলতার দিকে চেয়ে চেয়ে আমার চোখের জল সামলানো দায় হয়ে উঠল। এক বিন্দু অসংবরণীয় অবাধ্য অশ্রু তার পাণ্ডুর কপোলে ঝরে পড়তেই সে আমার পানে আর্ত দৃষ্টি হেনে ওইখানেই বসে পড়ল! বকুল-শাখা আর শিউলি পাতা তার মাথায় ফুল-পাতা ফেলে সান্ত্বনা দিতে লাগল।

মতিয়া বললে, আবারও সে অনেক আশা করে আগের বছরের মতোই শ্রাবণ-পঞ্চমীর ভোরে কাজরি গেয়ে যমুনা-সিনানে গিয়ে সেখানকার মাটি দিয়ে ধানের অঙ্কুর উদ্‌গম করেছিল। সেই অঙ্কুরগুলি সে নিবিড় যতনে তার ছিন্ন ভেজা ওড়না দিয়ে আজও ঢেকে রেখেছে। সে রোজই বলত – ‘মতিয়া রে, এবার আমার পরদেশি বঁধু আসবে। ওই যে শুনতে পাচ্ছি তার পথিক-গান।’

আজ ভাদ্র-তৃতীয়াতে ‘নবীন ধানের মঞ্জরি’ নিয়ে কতকগুলি সে দরিয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে এসেছে, আর কয়েকটি শিষ এনেছে আমাকে উপহার দিতে। …

আমি তার হাতে নাড়া দিয়ে বললাম, ‘কাজরি, আর আমাকে ছেড়ে যেও না।’

শুষ্ক অধর-কোণে তার আধ টুকরো ম্লান হাসি ফুটতে ফুটতে মিলিয়ে গেল। সে অতি কষ্টে তার আঁচল থেকে বহু যত্নে রক্ষিত ধানের সবুজ শিষ কটি বের করে একবার তার দুটি জল-ভরা চোখের পূর্ণ চাওয়া দিয়ে আমার পানে চেয়ে দেখলে, তার পর আমার স্কন্ধদেশে ক্লান্ত বাহু দুটি থুয়ে আমার কর্ণে শিষগুলি পরিয়ে দিলে। একটা গভীর তৃপ্তির দীঘল শ্বাসের সঙ্গে পবিত্র একরাশ হাসি তার চোখে মুখে হেসে উঠল। দেখে বোধ হল, এমন প্রাণ-ভরা সার্থক হাসি সে যেন আর জন্মে হাসেনি। আবার একটু পরেই কী মনে হয়ে তার সারা মুখ ব্যথায় পাণ্ডুর হয়ে উঠল। সহসা চিৎকার করে সে কয়ে উঠল, – ‘না শ্যামল, না – আমাকে যেতেই হবে। তোমার এই বুকভরা ভালোবাসার পরিপূর্ণ গৌরব নিয়ে আমায় বিদায় নিতে দাও।’

কোলের উপর তার শ্রান্ত মাথা লুটিয়ে পড়ল। চির-জনমের কামনার ধনকে আমার বুকের উপর টেনে নিলাম। আকুল ঝঞ্ঝা উন্মাদ বৃষ্টিকে ডেকে এনে আমায় ঘিরে আর্তনাদ করে উঠল, ওহ! – ওহ! – ওহ।

আমার মনে হয়, চাওয়ার অনেক বেশি পাওয়ার গর্বই তাকে বাঁচতে দিলে না, সে মরণ-ত্যাগী হয়ে তার কালো রূপস্রষ্টার কাছে চলে গেল। এবার বুঝি সে অনন্ত রূপের ডালি নিয়ে আর এক পথে আমার অপেক্ষায় বসে থাকবে। … কালো মানুষ বড্ডো বেশি চাপা অভিমানী। তাদের কালো রূপের জন্যে তারা মনে করে, তাদের কেউ ভালোবাসতে পারে না। কেউ ভালোবাসছে দেখলেও তাই সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। বেচারাদের জীবনের এইটাই সবচেয়ে বড়ো ট্র্যাজেডি।

* * *

[বাদল-ভেজা তারই স্মৃতি]

এ বছরও তেমনই শাঙন এসেছে। আজও আমার সেই প্রথম-দিনে-শোনা কাজরি গানটি মনে পড়ছে, – ‘ওগো শ্যামল, তোমার ঘোমটা খোলো।’

হায় রে পরদেশি সাঁবলিয়া। তোমার এ অবগুণ্ঠন আর এ জীবনে খুলল না, খুলবে না। …

আজ যখন আমার ক্লান্ত আঁখির সামনে আকাশ-ভাঙা ঢেউ ভেঙে ভেঙে পড়ছে, পূরবী-বায় হুহু করে সারা বিশ্বের বিরহ-কান্না কেঁদে যাচ্ছে, নিরেট জমাট আঁধার ছিঁড়ে ঝড়ের মুখে উগ্র মল্লারের তীব্র গোঙানি ব্যথিয়ে ব্যথিয়ে উঠছে, – ওগো, সামনে আমার পথ নেই – পথ নেই। অনন্ত বৃষ্টির আকুল ধারা বইছে। – এমন সময় কোথায় ছিলে ওগো প্রিয়তম আমার। এ বছরের মেঘ-বাদলে এমন করে আমায় যে দেখা দিয়ে গেলে, আমার প্রাণে যে কথা কয়ে গেলে! হারানো প্রেয়সী আমার! তোমার কানে-কানে-বলা গোপন গুঞ্জন আমি এই বাদলে শুনেচি, শুনেচি। এই তোমার টাটকা-ভাঙা রসাঞ্জনের মতো উজ্জ্বল-নীল গাঢ় কান্তি। ওগো, এই তো তোমার কাজল-কালো স্নিগ্ধ-সজল রূপ আমার চোখে অঞ্জন বুলিয়ে গেল! ওগো আমার বারে-বারে-হারানো মেঘের দেশের চপল প্রিয়! এবার তোমায় অশ্রুর ডোরে বেঁধেছি। এবার তুমি যাবে কোথা? লোহার শিকল বারে-বারে কেটেছ তুমি মুক্ত-বনের দুষ্ট পাখি, তাই এবার তোমায় অশ্রুর বাঁধনে বেঁধেছি, তাকে ছেদন করা যায় না! ওই ঘন নীল মেঘের বুকে, এই সবুজ-কচি দুর্বায়, ভেজা ধানের গাছের রঙে তোমায় পেয়েছি। ওগো শ্যামলি! তোমার এ শ্যামশোভা লুকাবে কোথায়? ওই সুনীল আকাশ এই সবুজ মাঠ, পথহারা দিগন্ত, – এতেই যে তোমার বিলিয়ে-দেওয়া চিরন্তন শ্যামরূপ লুটিয়ে পড়ছে। তাই আজ এই শ্রাবণ-প্রাতে ধানের মাঝে বসে গাইছি, –

আমার নয়ন-ভুলানো এলে!
আমি কী হেরিলাম হৃদয় মেলে।
শিউলিতলার পাশে পাশে,
ঝরা ফুলের রাশে রাশে,
শিশির-ভেজা ঘাসে ঘাসে,
অরুণ-রাঙা চরণ ফেলে
নয়ন-ভুলানো এলে!

যখন চোখ মেলে চাইলাম, তখনও বৃষ্টির ধারা বাঁধ-ছাড়া অযুত পাগলাঝোরার মতো ঝরে ঝরে পড়ছে – ঝম ঝম ঝম! এত জলও ছিল আজকার মেঘে! আকাশ-সাগর যেন উলটে পড়েছে, এ বাদল-বরিষনের আর বিরাম নেই, বিরাম নেই!…

বৃষ্টিতে কাঁপতে কাঁপতে দেখলাম, আঁখির আগে আমার নীলোৎপল-প্রভ মানস-সরোবরে ফুটে রয়েছে সরোবর-ভরা নীল-পদ্ম।

০৮. ঘুমের ঘোরে

সাহারা মরূদ্যান-সন্নিহিত ক্যাম্প
আফ্রিকা
ঘুম ভাঙল। ঘুমের ঘোর তবু ভাঙল না। … নিশি আমার ভোর হলে, সে স্বপ্নও ভাঙল, আর তার সঙ্গে ভাঙল আমার বুক! কিন্তু এই যে তার শাশ্বত চিরন্তন স্মৃতি, তার আর ইতি নেই। না – না, মরুর বুকে ক্ষীণ একটু ঝরনা-ধারার মতো এই অম্লান স্মৃতিটুকুই তো রেখেছে আমার শূন্য বক্ষ স্নিগ্ধ-সান্ত্বনায় ভরে। বয়ে যাও ওগো আমার ঊষর মরুর ঝরনা-ধারা, বয়ে যাও এমনি করে বিশাল সে এক তপ্ত শূন্যতায় তোমার দীঘল রেখার শ্যামলতার স্নিগ্ধ ছায়া রেখে। দুর্বল তোমার এই পূত ধারাটিই বাঁচিয়ে রেখেছে বিরাট কোনো এক মরুভূ-প্রান্তরকে, তা তুমি নিজেও জান না, – তবু বয়ে যাও ওগো ক্ষীণতোয়া নির্ঝরিণীর নির্মল ধারা, বয়ে যাও।

নিশি-ভোরটা নাকি বিশ্ববাসী সবার কাছেই মধুর, তাই এ-সময়কার টোড়ি রাগিণীর কল-উচ্ছ্বাসে জাগ্রত নিখিল অখিলের পবিত্র আনন্দ-সরসী-সলিলে ক্রীড়ারত মরালযূথের মতো যেন সঞ্চরণ করে বেড়ায়, কিন্তু আমার নিশি ভোর না হলেই ছিল ভালো। এ আলো আমি আর সইতে পারছি নে, – এ যে আমার চোখ ঝলসিয়ে দিলে! এ কী অকল্যাণময় প্রভাত আমার!

ভোর হল। বনে বনে বিহগের ব্যাকুল কূজন বনান্তরে গিয়ে তার প্রতিধ্বনির রেশ রেখে এল! সবুজ শাখীর শাখায় শাখায় পাতার কোলে ফুল ফুটল। মলয় এল বুলবুলির সাথে শিস দিতে দিতে। ভ্রমর এল পরিমল আর পরাগ মেখে শ্যামার গজল গানের সাথে হাওয়ার দাদরা তালের তালে তালে নাচতে নাচতে। কোয়েল, দোয়েল, পাপিয়া সব মিলে সমস্বরে গান ধরলে, –

ওহে সুন্দর মরি মরি!
তোমায় কী দিয়ে বরণ করি!

অচিন কার কণ্ঠ-ভরা ভৈরবীর মিড় মোচড় খেয়ে উঠল – ‘জাগো পুরবাসী।’ সুষুপ্ত বিশ্ব গা মোড়া দিয়ে তারই জাগরণের সাড়া দিলে!

তুমি সুন্দর, তাই নিখিল বিশ্ব সুন্দর শোভাময়।

পড়ে রইলুম কেবল আমি উদাস আনমনে, আমার এই অবসাদ-ভরা বিষণ্ণ দেহ ধরার বুকে নিতান্ত সংকুচিত গোপন করে, হাস্যমুখরা তরল উষার গালের একটেরে এককণা অশুষ্ক অশ্রুর মতো! অথচ এই যে এক বিন্দু অশ্রুর খবর, তা উষা-বালা নিজেই জানে না, গত নিশি খোওয়াবের খামখেয়ালিতে কখন সে কার বিচ্ছেদ-ব্যথা কল্পনা করে কেঁদেছে, আর তারই এক রতি স্মৃতি তার পাণ্ডুর কপোলে পূত ম্লানিমার ঈষৎ আঁচড় কেটে রেখেছে।

ঘুমের ঘোর টুটলেই শোর ওঠে, –ওই গো ভোর হল! জোর বাতাসে সেই কথাই নিভৃত-সব কিছুর কানে কানে গুঞ্জরিত হয়। সবাই জাগে – ওঠে – কাজে লাগে। আমার কিন্তু ঘুমের ঘোর টুটেও উঠতে ইচ্ছে করছে না। এখনও আপশোশের আঁসু আমার বইছে আর বইছে। সব দোরই খুলল, কিন্তু এ উপুড়-করা গোরের দোর খুলবে কী করে? – না, তা খোলাও অন্যায়, কারণ এ গোরের বুকে আছে শুধু গোরভরা কঙ্কাল আর বুকভরা বেদনা, যা শুধু গোরের বুকেই থেকেছে আর থাকবে! – দাও ভাই, তাকে পড়ে থাকতে দাও এমনি নীরবে মাটি কামড়ে, আর ওই পথ বেয়ে যেতে যেতে যদি ব্যথা পাও, তবে শুধু একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলো, আর কিচ্ছু না!

* * *

আচ্ছা, আমি এই যে আমার কথাগুলো লিখে রাখছি সবাইকে লুকিয়ে, এ কি আমার ভালো হচ্ছে? নাঃ, তা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি নে, – এ ভালো, না মন্দ। হাঁ, আর এই যে আমার লেখার উপর কুয়াশার মতো তরল একটা আবরণ রেখে যাচ্ছি, এটাও ইচ্ছায়, না অনিচ্ছায়? তাই বলছি, এখন যেমন আমি অনেকেরই কাছে আশ্চর্য একটা প্রহেলিকা, আমি চাই চিরটা দিনই এমনি করে নিজেকে লুকিয়ে থাকতে – আমার সত্যিকারের ব্যথার উৎসে পাথর চাপা দিয়ে আর তারই চারি পাশে আবছায়ার জাল বুনে ছাপিয়ে থাকতে, বুকের বেদনা আমার গানের মুখর কলতানে ডুবিয়ে দিতে। –কেননা, যখন লোকে ভাববে আর হাসবে, যে, ছি! – সৈনিকেরও এমন একটা দুর্বলতা থাকতে পারে ! না না – এখন থেকে আমার বুক সে চিন্তাটার লজ্জায় ভরে উঠছে! – আমার এই ছোটো কথা ক-টি যদি এমনই এক করুণ আবছায়ার অন্তরালেই রেখে যাই, তাহলে হয়তো কারুর তা বুঝবার মাথা-ব্যথা হবে না। আর কোনো অকেজো লোক তা বুঝবার চেষ্টা করলেও আমায় তেমন দূষতে পারবে না। দূর ছাই, যতসব সৃষ্টিছাড়া চিন্তা। কারই বা গরজ পড়েছে আমার এ লেখা দেখবার? তবু যে লিখছি? মানুষ মাত্রেই চায় তার বেদনায় সহানুভূতি, তা নইলে তার জীবনভরা ব্যথার ভার নেহাৎ অসহ্য হয়ে পড়ে যে। দরদি বন্ধুর কাছে তার দুখের কথা কয়ে আর তার একটু সজল সহানুভূতি আকর্ষণ করে যেন তার ভারাক্রান্ত হৃদয় অনেকটা লঘু হয়। তাছাড়া, যতই চেষ্টা করুক, আগ্নেয়গিরি তার বুক-ভরা আগুনের তরঙ্গ যখন নিতান্ত সামলাতে না পেরে ফুঁপিয়ে ওঠে, তখন কী অত বড়ো শক্ত পাথরের পাহাড়ও তা চাপা দিয়ে আটকে রাখতে পারে? কখনই না। বরং সেটা আটকাতে যাবার প্রাণপণ আয়াসের দরুন পাহাড়ের বুকের পাষাণ-শিলাকে চুর-মার করে উড়িয়ে দিয়ে আগুনের যে হলকা ছোটে, সে দুর্নিবার স্রোতকে থামায় কে?… হাঁ, তবু ভাববার বিষয় যে, সে দুর্মদ দুর্বার বাষ্পোচ্ছ্বাসটা আগ্নেয়গিরির বুক থেকে নির্গম হয়ে যাবার পরই সে কেমন নিস্পন্দ শান্ত হয়ে পড়ে। তখন তাকে দেখলে বোধ হয়, মৌন এই পাষাণ-স্তূপের যেন বিশ্বের কারুর কাছে কারুর বিরুদ্ধে কিছু বলবার কইবার নেই। শুধু এক পাহাড় ধীর প্রশান্ত-নির্বিকার শান্তি! আঃ – সেই বেশ!

আচ্ছা, বাইরে আমি এতটা নিষ্করুণ নির্মম হলেও আমার যে এই মরু-ময়দানের শুকনো বালির নীচে ফল্গুধারার মতো অন্তরের বেদনা, তার জন্যে করুণায় একটি আঁখিও কি সিক্ত হয় না? এতই অভিশপ্ত বিড়ম্বিত জীবন আমার! হয়তো থাকতেও পারে। তবু চাই নে যে? – না ভাই, না, প্রত্যাখ্যান আর বিদ্রুপের ভয় ও বেদনা যে বড়ো নিদারুণ! তাই আমার অন্তরের ব্যথাকে আর লজ্জাতুর করতে চাই নে – চাই নে। হয়তো তাতে সে কোন্ এক পবিত্র স্মৃতির অবমাননা করা হবে। সে তো আমি সইতে পারব না। – অথচ একটু সান্ত্বনা যেন এ নিরাশ নীরস জীবনে খুবই কামনার জিনিস হয়ে পড়েছে। এখন আমার সান্ত্বনা হচ্ছে এই লিখেই – এমনি করে আমার এই গোপন খাতাটির সাদা বুকে তারই – সেই বেদনাতুর মূর্তিটিরই প্রতিচ্ছবি আবছায়ায় এঁকে। আমার সাদা খাতার এই কালো কথাগুলি আর গানের স্নিগ্ধ-কল্লোল এই দুটি জিনিসই আমার আগুন-ভরা জীবনে সান্ত্বনা-ক্ষীর ঢেলে দিচ্ছে আর দেবে!…

আমার আজ দুনিয়ার কারুর উপর অভিমান নেই! আমার সমস্ত মান-অভিমান এখন তোমারই উপর খোদা! তুমিই তো আমায় এমন করে রিক্ত করেছ, তুমিই যে আমার সমস্ত স্নেহের আশ্রয়কে ঝড়ো-হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে সারা বিশ্বকে আমার ঘর করে তুলছ, – এখন পর হলে চলবে না – এড়িয়ে যেতেও পারবে না। এখন তুমি না সইলে এ দুরন্তের আবদার অত্যাচার কে সইবে বল? ওগো আমার দুর্জ্ঞেয় মঙ্গলময় প্রভু, এখন তুমিই আমার সব! –

* * *

হাঁ, এখনই লিখে থুই, নইলে কে জানে কোন্ দিন দুশমনের শেলের একটা তীব্র আঘাত ক্ষণিকের জন্যে বুকে অনুভব করে চিরদিনের মতো নিথর-নিঝুম হয়ে পড়ব! এই মহাসমরসাগরে ছোট্ট এক বুদ্‌বুদের মতোই মাথা তুলে উঠেছি, আবার হয়তো এক পলকেই আমার ক্ষুদ্র বুকের সমস্ত আশা-উৎসাহ ব্যথা-বেদনা থেমে গিয়ে ওই বুদ্‌বুদটির মতোই কোথায় মিলিয়ে যাব। কেউ আহা বলবে না – কেউ উহুঁ করবে না! আমার কাছে সেই মৃত্যুর চিন্তাটা কেমন একরকম প্রশান্ত মধুর!

আর একটা কথা, – আমাকে কিন্তু বাইরে এখনকার মতোই এমনই রণদুর্মদ, কর্তব্যের সময় এমনই মায়া-মমতাহীন ক্রূর সেনানী, যুদ্ধে সমুদ্রের উচ্ছ্বাসের চেয়েও দুর্বিনীত দুর্বার নররক্তপিপাসু দুর্বৃত্ত দানবের মতোই থাকতে হবে। কলের মানুষের মতো আমার অধীন সৈনিকগণ যেন আমার হুকুম মানতে শেখে। আমার দায়িত্বজ্ঞানে আমার কাজে কলঙ্ক বা শৈথিল্যের যেন এতটুকু আঁচড় না পড়ে। সৈনিকের যে এর বড়ো বদনাম নেই। – তার পর কর্তব্য-অবসানেই আমি তাদের সেই চিরহাস্য প্রফুল্ল গীতিমুখর স্নেহময় ভাই! তখন আমার এই অগ্নি-উদ্‌গারী নয়নেই যেন স্নেহের সুরধুনী ক্ষরে, বজ্রনির্ঘোষের মতো এই কাঠচোটা স্বরেই যেন করুণা আর স্নেহ ক্ষীর হয়ে ঝরে, আমার কণ্ঠভরা গানে তাদের চিত্তের সব গ্লানি দূর হয়ে যায়! আমার অন্তর আর বাহির যেন এমন একটা অস্বচ্ছ আবরণে চির-আবৃত থাকে যে, কেউ আমার সত্যিকার কান্নারত মূর্তিটি দেখতে না পায়, হাজার চেষ্টাতেও না!

খোদা, আমার অন্তরের এই উচ্ছ্বসিত তপ্তশ্বাস যেন আনন্দ-পুরবির মুখরতানে চিরদিনই এমনই ঢাকা পড়ে যায়, শুধু এইটুকুই এখন তোমার কাছে চাইবার আছে। আর যদি এই অজানার অচিন ব্যথায় কোনো অবুঝ হিয়া ব্যথিয়ে ওঠে, তবে সে যেন মনে মনে আমার প্রার্থনায় যোগ দিয়ে বলে, – ‘আহা, তাই হোক!’ কেননা এমনিতর স্নেহ-কাঙাল, যারা, – যাদের মৃত্যুতে এক ফোঁটা আঁসু ফেলবারও কেউ নেই এ দুনিয়ায়, যারা কারুর দয়া চায় না, অথচ এক বিন্দু স্নেহ-সহানুভূতির জন্যে উদ্‌বেগ-উন্মুখ হয়ে চেয়ে থাকে, – তাদের দেওয়ার এর বেশি কিছু নেই, আর থাকলেও তারা তা চায়ও না। এই একটু স্নিগ্ধ বাণীই গুহার ম্লান বুকে জ্যোৎস্নার শুভ্র আলোর মতো তাদের সান্ত্বনা দেয়।

* * *

সে ছিল এমনই এক চাঁদনী-চর্চিত যামিনী, যাতে আপনি দয়িতের কথা মনে হয়ে মর্মতলে দরদের সৃষ্টি করে! মদির খোশ-বুর মাদকতায় মল্লিকা-মালতীর মঞ্জুল মঞ্জরিমালা মলয় মারুতকে মাতিয়ে তুলেছিল। উগ্র রজনিগন্ধার উদাস সুবাস অব্যক্ত অজানা একটা শোক-শঙ্কায় বক্ষ ভরে তুলেছিল। … সে এল মঞ্জীর-মুখর-চরণে সেই মুকুলিত লতাবিতানে! তার বাম করে ছিল চয়িত ফুলের ঝাঁপি। কবরী-ভ্রষ্ট আমের মঞ্জরি শিথিল হয়ে তারই বুকে ঝরে ঝরে পড়ছিল, ঠিক পুষ্প-পাপড়ি বেয়ে পরিমল ঝরার মতো। কপোল-চুম্বিত তার চূর্ণকুন্তল হতে বিক্ষিপ্ত কেশর-রেণুর গন্ধ লুটে নিয়ে লালস-অলস ক্লান্ত সমীর এরই খোশ খবর চারিদিকে রটিয়ে এল, – ওগো ওঠো, দেখো ঘুমের দেশ পেরিয়ে স্বপ্ন-বধূ এসেছে!’ উল্লাস-হিল্লোলে শাখায় শাখায় ঘুমন্ত ফুল দোল খেয়ে উঠল! আমার কপালে ঘাম ভরে উঠল, বক্ষ দুরু দুরু করে কাঁপিয়ে গেল সে কোন্ বিবশ শঙ্কা। ঘন ঘন শ্বাস পড়ে আমার হাতের কামিনী-গুচ্ছটির দলগুলি খসে খসে পড়তে লাগল। আমার বোধ হল, এ কোন্ ঘুমের দেশের রাজকন্যা আমার কিশোরী মানস-প্রতিমার পূর্ণ পরিণতির রূপে এসে আমার চোখে স্বপ্নের জাল বুনে দিচ্ছে! ভয়ে ভয়ে আমার আবিষ্ট চোখের পাতা তুলেই দেখতে পেলুম, বেতস লতার মতো সে আমার সামনে অবনত মুখে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। আমাকে চোখ মেলে চাইতে দেখে যেন সে চলে যেতে চাইল। আমি তাড়াতাড়ি ভীত জড়িত স্বরে বললুম, – ‘কে তুমি – পরি?’

তার আয়ত আঁখির এক অনিমিখ চাউনি দিয়ে আমার পানে চেয়েই সে থমকে দাঁড়াল! শুক্ল জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট দেখতে পেলুম, তার দুটি বড়ো বড়ো চোখে চোখ-ভরা জল! … এক পলকে পরির নূপূরের রুনু-ঝুনু শিঞ্জিনী চমকে যেন কী বলে উঠল। আনন্দ-ছন্দের হিন্দোলার দোল আর দুলল না! অসম্বৃতা তার লুণ্ঠিত চঞ্চল অঞ্চল সম্বৃত হল। শিথিলবসনার ফুল্ল কপোলে লাজ-শোণিমা বিদীর্ণপ্রায় দাড়িম্বের মতো হিঙ্গুল হয়ে ফুটল। সমীরের থামার সাথে সাথে যেন উলসিত-সরসী-সলিলের কল-কল্লোল নিথর হয়ে থামল, আর তারই বুকে এক রাস পাতার কোলে দুটি রক্ত-পদ্ম ফুটে উঠল। ত্রস্তা কুরঙ্গীর মতো ভীতি তার নলিন-নয়নে করুণার সঞ্চার করলে। বারবার সংযত হয়ে ক্ষীণকণ্ঠে সে কইলে, – ‘তুমি – আপনি কখন এলেন? –’

আমি বললুম, – ‘আজ এসেছি। তুমি বেশ ভালো আছ পরি?’

সে একটু ক্লিষ্ট হাসি হেসে কইলে, ‘হ্যাঁ, আজ এখানে মা আর আমাদের বাড়ির সকলে বেড়াতে এসেছেন। এ বাগানটা ভাইজান নতুন করে করলেন কিনা! – ওই যে তাঁরা পুকুরটার পাড়ে বসে গল্প করছেন।’

আমার নেশা যেন অনেকটা কেটে গেল। তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে বললুম, ‘ওঃ, আজ প্রায় দু-বছর পরে আমাদের দেখা, নয় পরি? তোমাকে যেন একটু রোগা-রোগা দেখাচ্ছে, কোনো অসুখ করেনি তো?’

সে তার ব্যথিত দুটি আঁখির আর্ত দৃষ্টি দিয়ে আমার পানে অনেকক্ষণ চেয়ে অস্ফুট কণ্ঠে বললে, ‘– না! –’

তারপরেই যেন তার কী কথা মনে পড়ে গেল। সে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কয়ে উঠল, ‘আপনি! এখানে কেন আর? যান!…’ এক নিমেষে এমন আকাশভরা জ্যোৎস্না যেন দপ করে নিভে গেল! একটা অপ্রত্যাশিত আঘাতের বেদনায় সমস্ত দেহ আমার অনেকক্ষণের জন্যে নিসাড় হয়ে রইল। কখন যে মাথা ঘুরে পড়ে পাশের বেঞ্চিটার হাতায় লেগে আমার চোখের কাছে অনেকটা ফেটে গিয়ে তা দিয়ে ঝর-ঝর করে খুন ঝরছিল, আর পরি তার আঁচলের খানিকটা ছিঁড়ে আমার ক্ষতটায় পটি বেঁধে দিয়েছিল, তা আমি কিছুই জানতে পারিনি! যখন চোখ মেলে চাইলুম, তখন পরি আমার আঘাতটাতে জল চুঁইয়ে দিচ্ছে, আর সেই চোঁয়ানো জলের চেয়েও বেগে তার দুই চোখ বেয়ে অশ্রু চুঁয়ে পড়ছে! … এতক্ষণে আহত অভিমান আমার সারা বক্ষ আলোড়িত করে গুমরে উঠল! বিদ্যুদ্‌বেগে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আহত স্বরে বললুম, ‘বড়ো ভুল হয়েছে পরি, তুমি আমায় ক্ষমা করো!’

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে যেন কী সামলে নিয়ে, তার পরে আনমনে চিবুকছোঁয়া তার একটা পীত গোলাবের পাপড়ি নখ দিয়ে টুঙতে টুঙতে অভিভূতের মতো কী বলে উঠল!

আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলুম না, বললুম, ‘তবে যাই পরি!’
অশ্রুবিকৃত কণ্ঠে সে বলে উঠল, ‘আহ্, তাই যাও!’

কিন্তু জ্যোৎস্না-বিবশা নিশীথিনীর মতোই যেন তার চরণ অবশ হয়ে উঠেছিল, তাই কুণ্ঠিত অবগুণ্ঠিত বদনে সে পাথরের মতো সেইখানে দাঁড়িয়েই রইল। যখন দেখলুম হেমন্তে শিশির-পাতের মতো তার গণ্ড বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, তখন অতি কষ্টে আমার এক বুক দীর্ঘশ্বাস চেপে চলে এলুম। তখন তীক্ষ্ণ ক্লেশের চোখা বাণ আমার বাইরে ভিতরে এক অসহনীয় ব্যথার সৃষ্টি করছিল। মনে হচ্ছিল, এই চাঁদিমা-গর্বিত যামিনীর সমগ্র বক্ষ ব্যেপে সাহানা সুরের পাষাণ-ফাটা কান্না আকণ্ঠ ফুঁপিয়ে উঠছে, আর তাই সে শুধু সিক্ত চোখে মৌন মুখে আকাশ-ভরা তারার দিকে তাকিয়ে ভাবছে, আকাশের মতো আমারও মর্ম ভেদ করে এমনই তো কোটি কোটি আগুন-ভরা তারা জ্বলছে, উষ্ণতায় সেগুলো মার্তণ্ডের চেয়েও উত্তপ্ত। স্থির সৌদামিনীর মতো সেগুলো শুধু জ্বালাময়ী প্রখর তেজে জ্বলছে – ধু-ধু-ধু!

* * *

এটাও একবার কিন্তু মনে হয়েছিল সে দিন যে, আহ, কী হতভাগা আমি! যা পেয়েছিলাম, তাতেই সন্তুষ্ট থাকলুম না কেন, তাকে দেখতে পেয়েই পালিয়ে এলুম না কেন?

দূরে ওই একটু অনুরাগ সঞ্চিত সলাজ চাউনি, – নানান কাজের অনর্থক ব্যস্ততার আড়ালে দু-তিন বার দৃষ্টি-বিনিময়, হঠাৎ একটি শিহরণ ভরা পরশ, – যাই-যাই করেও না যেতে পারার মাধুরীময় সলজ্জ কুণ্ঠা, মুখর হাসি ওষ্ঠ-অধরের নিষ্পেষণে চাপতে গিয়ে চোখের তারায় ফুটে ওঠা, আর সেই শরমে কর্ণমূলটি আরক্ত হয়ে ওঠা – এই সব ছোটোখাটো পাওয়া আর টুকরো টুকরো আনন্দের গাঢ় অনুভূতি আমার প্রাণে যে এক নিবিড় মাধুরীর মাদকতা ঢেলে নেশায় মশগুল করে রেখেছিল, তার চেয়েও বেশি আমি তো আর পেতে চাইনি, তবে কেন সে আমায় এমন অপমান করলে?

আমি তাকে ভালোবেসে আসছি, সে-যে কবে থেকে তার কোনো দিন-ক্ষণ মনে নেই; বড়ো প্রাণ দিয়েই ভালোবেসেছি তাকে, কিন্তু কোনো দিন কামনা করিনি। আগেও মনে হত আর আজও হয় যে, তাকে না পেয়ে আমার জীবনটা ব্যর্থই হয়ে গেল, তবু প্রাণ ধরে কোনো দিনই তো তাকে কামনা করতে পারিনি। বরং যখনই ওই বিশ্রী কথাটা – মিলন আর পাওয়ার এবড়ো-খেবড়ো দিকটা, একটুখানির জন্যে মনের কোণে উঁকি মেরে গিয়েছে, তখনই যেন লজ্জায় আর বিতৃষ্ণায় আমার বুক এলিয়ে পড়েছে । এত ভুবন-ভরা ভালোবাসা আমার কি শেষে দুদিনেই বাসি হয়ে পড়তে দেব? – ছি ছি! না না!

সেদিন মনে হয়েছিল, যে ভালোবাসা দুজনের দেহকে দুদিক থেকে আকর্ষণ করে মিলিয়ে দেয়, সে তো ভালোবাসা নয়, সেটা অন্য কিছু বা মোহ আর কামনা। হয়তো এই মোহটাই শেষে ভালোবাসায় পরিণত হতে পারত এমনই দূরে দূরেই থেকে, কিন্তু এক নিমিষের মিলনেই সে পবিত্র ভালোবাসা কেমন বিশ্রী কদর্যতায় ভরে গেল! প্রেমের মিলন তো এত সহজে এমন বিশ্রী হয় না! তাই জীবন আমার ব্যর্থ হবে জেনেও আমি প্রাণ থাকতে তার সঙ্গে মিলিনি। জীবনভরা দুঃখ আর ক্লেশ-যাতনা অপমানের পসরা মাথা পেতে নিয়েছি, তবু আমি ভুলেও ভাবতে পারিনি যে, এমনই নির্লজ্জের মতো এসে এই আঁধারে-পথের মামুলি মিলনে আমার প্রিয়ার অবমাননা করি। আমি জানি, এমন করেই তাকে এমন করে পাব, যে-পাওয়া সকলে পায় না। কেউ বলে না দিলেও আমার বিশ্বাস আছে যে, আজ যাকে ব্যর্থ বলে মনে করছি, আমার জীবনে সেই ব্যর্থতাই একদিন সার্থকতায় পুষ্পিত পল্লবিত হয়ে উঠবে – …আ মলো, – কী লিখতে গিয়ে কী সব বাজে কথা লিখছি! হাঁ, কী বলছিলুম? তাকে ভালোবাসি বলেই তাকে এমন করে এড়িয়ে এলুম, এই কথাটা বুঝতে না পেরেই কী সে আমায় এমন করে প্রত্যাখ্যান করলে! – হায়! প্রাণ প্রিয়তমের পাওয়াকে এড়িয়ে চলবার ধৈর্য আর শক্তি পেতে যে আমি কত বেশি বেদনা আর কষ্ট পেয়েছি, তা তুমি বুঝবে না পরি – বুঝবে না! তবু কিন্তু বড়ো কষ্ট রয়ে গেল যে, হয়তো তুমি আমার ভালোবাসার গভীরতা বুঝতে পারলে না। তোমায় অন্যকে বিলিয়ে দিয়ে তোমায় যত বেদনা দিয়েছি, তার চেয়ে কত বেশি ব্যথা যে আমাকে চাপতে হয়েছে, কতো বড়ো কষ্ট যে নীরবে সইতে হয়েছে, তা যদি তুমি জানতে পারতে পরি, তাহলে সেদিন এই কথাটা মনে করে আমায় এতো বড়ো আঘাত করতে পারতে না।…

আমি জানি প্রিয়, সেদিন তোমার আসবেই আসবে, যেদিন আমার এই অভিশপ্ত জীবনের সকল কথা সকল আশা অন্তত তোমার কাছে লুকানো থাকবে না। এ তুমি নিজেই আপনা-আপনি বুঝতে পারবে, কাউকে তা বলে দিতে বা বুঝিয়ে দিতে হবে না। কিন্তু সেদিন কি আমি আর এ-জীবনে জানতে পারব প্রিয়, তুমি আমায় ভুল বোঝনি? তা যদি না জানতে পারি, তবে আপশোশ প্রিয়, আপশোশ! …

এই নাও, আমার সব গুলিয়ে গেল দেখছি! এ যেন ঠিক ঘুমের ঘোরে হাজার রকমের স্বপ্ন দেখার মতো! কোনোটার সঙ্গে কোনোটারই সামঞ্জস্য নেই, অথচ অলক্ষ্য থেকে স্বপ্ন-রানি সবগুলিকে একটি ক্ষীণ সুতো দিয়েই গেঁথে দিচ্ছে! আমার সব কথাগুলো যেন ঠিক লাখো ফুলের এলোমেলো মালা!

আবার আমার মনে হচ্ছে আমার পক্ষে তার কাছে ও-রকম করে কথা কওয়া বা দেখা দেওয়া কিছুতেই উচিত হয়নি। কেননা সে নিশ্চয় মনে করেছিল যে, আমি আমার মিথ্যা অহংকারকে কেন্দ্র করে তার কাছে ত্যাগের গর্ব দেখাতে গিয়েছিলুম, আর তাই হয়তো যখন এই কথাটা তার হঠাৎ মনে হল অমনি কেমন একটা বিতৃষ্ণায় তার মন ভরে উঠল, আর সে আমায় ও-রকম নির্দয়তা না দেখিয়েই পারলে না। – আর একটা কথা, কেউ একটু সামান্য প্রশ্রয় দিলেই আমাদের মতো স্নেহ-বুভুক্ষু হতভাগারা এতটা বাড়াবাড়ি করে তোলে যে, সে তখন এই দুর্ভাগাদের চেতন করিয়ে দিতে বাধ্য হয়, আর আমরা সেইটাকে হয়তো অপমানের আঘাত বলেই মনে করি। এটা তো আমাদেরই দোষ। –

অন্তরের গোপন কথা অন্তরেই না রাখতে পেরে বাইরে প্রকাশ করে দেওয়ার যে দুর্বার লজ্জা আর অক্ষমণীয় অপমান, তা হতে আমায় রক্ষা করো খোদা, রক্ষা করো! এর যা শাস্তি, তা বড়ো নির্মম নিষ্করুণ হয়েই আমার মাথার উপর চাপাও।

কিন্তু ঘুমের ঘোর আমার এখনও কাটেনি। মন এমন একটা জিনিস বা মনের এমন একটা দুর্বলতা আছে যে, সে সহজে কোনো জিনিসের শক্ত দিকটা দেখতে চায় না। বুঝলেও অবুঝের মতো সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে চলতে চায়! কিন্তু আশ্চর্য এই যে, কে যেন মুণ্ডটা ধরে ওই নিষ্করুণ নীরস দিকটাই দেখতে বাধ্য করায়; সে বোধ হয়, মনেরই পেছনে প্রচ্ছন্ন একটা দুর্নিবার শক্তি।

দেখেছ মজা! আমার মন এটা নিশ্চয়ই জেনে বসেছে যে, সে আমাকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তবে সেদিন যে সে আমায় অপমান করে তাড়িয়ে দিলে? সে বড়ো দুঃখে গো, বড়ো দুঃখে! তার মতো অভিমানিনীর আত্মমর্যাদাকে ডিঙিয়ে চলার সামর্থ্য নেই। তাই বড়ো কষ্টে তাকে এত শক্ত হতে হয়েছিল, নইলে ওই নিষ্ঠুর কথাটা বলবার পরই কেন হুহু করে অশ্রুর হড়পা-বান বয়ে গেল তার চোখের বুকের সব আবরণ ভাসিয়ে দিয়ে! সব মিথ্যা হতে পারে, কিন্তু ওইটা – এত বড়ো একটা সত্য তো মিথ্যা হতে পারে না। অন্ধ, তুমি সেই সময় যদি তার মর্মন্তুদ ব্যথার বেদনা বুঝতে পারতে, তার এই অভিমান-বিধুর অকরুণ কথার উৎস কোথায় দেখতে পেতে, তাহলে আজ ওই মিথ্যা দুঃখটা তোমায় এত কষ্ট দিত না! সে যদি এত বেশি অভিমানিনী না হত, তা হলে সাধারণ রমণীর মতো অনায়াসে তোমার পায়ে মুখ গুঁজে পড়ে কেঁদে উঠত, – ওগো, অকরুণ দেবতা! খুব করেছ! খুব উদারতা দেখিয়েছ, আর এ হতভাগিনিকে জ্বালিও না! এতই দেবত্ব দেখাতে চাও যদি, তবে এসো না। কিন্তু তা হলে তো ‘আমার প্রিয় মহান!’ এই কথাটির গৌরবে আমার রিক্ত বুক এমন করে ভরে উঠতে পারত না! – ভালোই করেছ খোদা, তুমি ভালোই করেছ! প্রতিদিনের মতো আজ তাই বড়ো প্রাণ হতেই বলেছি, – তুমি চির মঙ্গলময়! আবার বলছি, – ‘তোমারই ইচ্ছা হউক পূর্ণ করুণাময় স্বামী!’

* * *

এ আর এক দিনের কথা! … পরি তার তে-তলার দালানের কামরায় বসে নিশীথ-রাতের সুষুপ্তিকে ব্যথিয়ে আনমনে গাচ্ছিল, – দিগ্‌বালারা আজ জাগল না। নব-ফাল্গুনে মেঘ করেছে। মুখর ময়ূরের কলকণ্ঠের সাথে মাঝে মাঝে আকুল মেঘের ঝমঝমানি শোনা যাচ্ছে, ঝিম ঝিম ঝিম! … নিত্যকার নৃত্যমুখর প্রভাত এখন রোজই স্তব্ধ হয়ে শুধু ভাবে আর ভাবে। বর্ষণ-পুলকিত পুষ্প-আকুলিত এই বল্লি-বিতানের আর্দ্র-স্নিগ্ধ ছায়ে বসে আমার মনে হয়, আমার প্রিয়তমাকে আমি হারিয়েছি, আবার মনে হয়, না, বড়ো বুক ভরেই পেয়েছি গো, তাকে পেয়েছি! – আজ আমার ফুল-শয্যার নিশিভোর হবে। এ ভোরে বারিও ঝরবে, বারি-বিধৌত ফুলও ঝরবে, আবার শিশুর-মুখের অনাবিল-হাসির-মতো শান্ত কিরণও ঝরবে। – ওগো আমার বসন্ত-বর্ষার বাসরনিশি তুমি আর যেয়ো না – হায় যেয়ো না!

আমার বিজন কুটিরে সেই গান আমার বিনিদ্র কানে যেন এক রোদন-ভরা প্রতিধ্বনি তুলছিল। – আমি ভাবছিলুম যে, হায় মাঝে আর তিনটি দিন বাকি! তার পর এই পনেরো বছরের চেনা-গলার মিঠা আওয়াজ আর শুনতে পাব না, এই আমার বিশ বছরের জীবনে জড়িয়ে-পড়া নিতান্ত আপনার মানুষটিকে হারাতে হবে। কিন্তু হয়তো সারা জনম ধরে এরই রেশ আমার প্রাণে বীণার ঝংকার তুলবে। … এই তিনটি দিনই মাত্র তাকে আমার বলে ভাবতে পারব, তার পরে আমার কাছে তার চিন্তাটা যেমন দূষণীয়, তার কাছেও আমার চিন্তাটা সেই রকম অমার্জনীয় অপরাধ হবে! আর এক জনের হয়ে সে কোনো দূর দেশে চলে যাবে, আমি চলে যাব সে কোন্ বাঁধনহারার দেশ পেরিয়ে। তার পর দীর্ঘ বিধুর-মধুর অলঙ্ঘনীয় একটা ব্যবধান! …

এই সব কথা মনে পড়তেই আমি বৃষ্টি-ধারার ঝম-ঝমানির সাথে গলায় সুর বেঁধে গাইলুম, – ওগো প্রিয়তম, এসো আমরা দু-জনেই পিয়াসি চাতক-চাতকীর মতো কালো মেঘের কাছে শান্ত বৃষ্টি-ধারা চাই। আমরা চাঁদের সুধা নেব না প্রিয়! আমরা তো চকোর-চকোরী নই। চাতক-মিথুন বাদলের দিনে আমরা চাইব শুধু বর্ষণের পূত আকুল ধারা। এসো প্রেয়সী আমার, এই আমাদের ফাল্গুনের মেঘ-বাদলের দিনে আমরা উভয়ে উভয়কে স্মরণ করি আর চলে যাই! এই বসন্ত-বর্ষার নিশীথিনীর মতোই আমার মনের মাঝে এসো তোমার গুঞ্জরণ-ভরা ব্যথিত চরণ ফেলে! … তার পরে দূরে দাঁড়িয়ে সজল চারিটি চোখের চাউনির নীরব ভাষায় বলি, – ‘বিদায়’! …

সে আমার গান শুনেছিল কিনা জানি নে। কিন্তু সে সময় মেঘের ঝরা থেমেছিল, আর তার বাতায়ন চিরে ম্লান একটু দীপশিখা আমার বিজন কুটিরে কাঁপতে কাঁপতে নেমেছিল! … তার পরে ঝড়ো হাওয়ার সাথে মেতে আগল-ছাড়া পাগল মেঘের ওই একরোখা শব্দ, – রিম্ – ঝিম্ – রিম। …

* * *

বিসর্জনের দিন। নহবৎ-খানায় তারই বিসর্জনের বাজনা বাজছে। সান্ত্বনা আর অশান্ত একবুক বেদনা – এই দুটো মিলে আমায় এমন অভিভূত করে ফেলেছে যে, অতি কষ্টে আমার এ শ্রান্ত দেহটাকে খাড়া করে রেখেছি। আর – আর একটু পরেই যেন খুঁটি-দিয়ে খাড়া করা এই জীর্ণ ঘরটা হুড়মুড় করে ধসে পড়বে। …

বাইরে বেরিয়ে এলুম। সেখানেও ওই একই একটা অস্বস্তি আর অরুন্তুদ যন্ত্রণা! নিদাঘ সাঁঝের ধূসর আকাশ ব্যথায় উদাস-পাণ্ডুর হয়ে ধরার বুক আঁকড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল, আর অলক্ষ্যে ক্রমেই সে বেদনায় গুমোট কালো জমাট হয়ে আসছিল। আমের মুকুলের সাথে পাশের গোরস্থান থেকে গুলঞ্চের মালঞ্চ যে করুণ সুগন্ধের আমেজ দিচ্ছিল, তাতে আমি কিছুতেই কান্না চেপে রাখতে পারছিলুম না। ওঃ! সে কী দুর্জয় অহেতুক কান্নার বেগ! এই রোদনের সাথে একটা ক্লান্তি-ভরা স্নিগ্ধতাও যেন ফেনিয়ে আমার ওষ্ঠ পর্যন্ত ছেপে উঠেছিল!

* * *

পরির বিয়ে হল। দৃষ্টি-বিনিময় হল। সম্প্রদান হল। তার পরেই আমি আর এই কথাটা গোপন রাখতে পারলুম না, যে, আমি যুদ্ধে যাচ্ছি। তখন সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করলে যে, আমাদের মতো আত্মীয়-স্বজনহীন ভবঘুরে হতভাগাদের জন্যেই বিশেষ করে এই সৈন্যদলের সৃষ্টি! আমিও মনে মনে বললুম, – ‘তথাস্তু’। – দু-একজন বন্ধু মামুলি ধরনের লৌকিকতা দেখিয়ে একটু-আধটু দুঃখ প্রকাশও করলেন। সেদিন কেঁদেছিল শুধু আমার দূর সম্পর্কের একটি ছোটো বোন। তাই তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে সে বললে, – ‘যাও ভাই-জান! হয়তো আর তোমায় ফিরে পাব না! তবু কিন্তু তুমি বড়ো একটা কাজে যাচ্ছে যে, সেটায় বাধা দেওয়াও মস্ত পাপ আর স্বার্থপরতা। এমন একটা কাজে জীবন উৎসর্গ করতে গেলে দেশের কোনো বোনই যে তার ভাইকে বাধা দিতে পারে না! আমাদের দেশে বীরাঙ্গনা থাকলেও বীর-ভাইদের বোন হওয়ার মতো সৌভাগ্যবতী অনেক রমণী আছেন। তাঁরা নিশ্চয়ই নিজের ভাইকে বীর-সাজে সাজিয়ে দেশরক্ষা করতে পাঠাতে পারেন। ভুলে যেয়োনা ভাই-জান যে, রণদুর্মদ মুসলমান জাতির উষ্ণ রক্ত আমাদেরও দেহে রয়েছে! আমরাও আসছি সেই এই একই উৎস হতে। এ রক্ত তো শীতল হবার নয়!’ …

আমি আমার এই মুখরা বোনটিকে বড়ো বেশি স্নেহ করতুম। তাই তার সেদিনকার এই সব কথায় গৌরবে আমার বুক ভরে উঠেছিল! আমার অসংবরণীয় অশ্রু রুখতে গিয়ে দেখলুম ততক্ষণে আমার ছোটো বোনের চোখ দুটি জলে ভাসছে! তাকে আর কখনও কাঁদতে দেখিনি। একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে অশ্রু-বিকৃত কণ্ঠে সে আমায় বললে, – ‘তোমাকে কেউ বাধা দিতে নেই বলে তুমি হয়তো অন্তরে বড়ো কষ্ট পাচ্ছ ভাইজান, কিন্তু এটা নিশ্চয় জেনো যে, আমার মতো আজ অনেকেই তোমার কথা ভেবে লুকিয়ে কাঁদছে! – হাঁ, একটা কথা । একবার আমার সই পরিদের বাড়ি যাও। এ শেষ দেখায় কোনো লজ্জা-শরম কোরো না ভাই! পরি বড়ো অস্থির হয়ে পড়েছে, তার অন্তিম অনুরোধ, একবার তাকে দেখা দাও।’ …

হায় রে সংসার-মরুর স্নেহ-নির্ঝরিণী-স্বরূপা ভগিনিগণ! তোরা চিরকালই এমনই সন্ন্যাসিনী, অথচ ভারে ভারে পবিত্র স্নেহ ঘরে ঘরে বিলিয়ে বেড়াচ্ছিস! বড়ো দুঃখ তোদের সহজে কেউ চেনে না। যে হতভাগার বোন নেই, সেই বোঝে তার দুঃখ কষ্ট কত বড়ো! মুখে অনেক সময় তোদের কষ্ট দেবার ভান করলেও তোরা বোধ হয় সহজেই বুঝিস, যে, আমাদেরও বুকে তোদেরই মতো অনাবিল একটি স্নেহ-প্রীতির প্রশান্ত ধারা বয়ে যাচ্ছে, তাই তোরা মুখ টিপে হাসিস। আবার কাজের সময় কেমন করে এত বড়ো তোদের স্নেহ-বেষ্টনীকে ধূলিসাৎ করে দিস!

আমার এই বড়ো গৌরবের, বড়ো স্নেহের বোনটিকে আশীর্বাদ করবার ভাষা পাইনি সেদিন! তার আনত মস্তকে শুধু দু-ফোঁটা তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ে আমার প্রাণের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা জানিয়েছিল।

খুব সহজেই পরির সঙ্গে দেখা করতে গেলুম। এই নির্বিকার তৃপ্তিতে আমার নিজেরই বিস্ময় এল! কী করে এমন হয়? …

পরি নববধূর বেশে এসে যখন আমার পা ছুঁয়ে সালাম করলে, তখন বরষার স্রোতস্বিনীর চেয়েও দুর্বার অশ্রুর বন্যা তার চোখ দিয়ে গলে পড়ছে! মুহূর্তের জন্যে দুর্জয় একটা ক্রন্দনের উচ্ছ্বাসে আমার বুকটা যেন খান খান হয়ে ভেঙে পড়বার উপক্রম হল। প্রাণপণে আমি আমার অশ্রুরুদ্ধ কম্পিত স্বরকে সহজ সরল করে তার মাথায় হাত রেখে স্নিগ্ধ-সজল কণ্ঠে বললুম, ‘চির-আয়ুষ্মতী হও! সুখী হও!’

সে শুধু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল! তার পর মহিমময়ী রানীর মতোই চলে গেল!

যখন আমার ভাঙা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে একবার চারিদিকে শেষ-চাওয়া চেয়ে নিলুম, তখন মনে হল যেন সজনে ফুলের হাত-ছানিতে আমার পল্লি-মাতা আমায় ইশারায় বিদায় দিলে! একবার নদীপারে শিমুল গাছটার দিকে চেয়ে মনে হল যেন তার ডালে ডালে নিরাশ প্রেমিকের ‘খুন-আলুদা ’ হৃৎপিণ্ডগুলি টাঙানো রয়েছে! … সে দিন ছল-ছল ময়ূরাক্ষীর নির্মল ধারা তেমনই মায়ের বুকের শুভ্র ক্ষীর-ধারার মতোই বয়ে যাচ্ছিল!

স্বপ্নের মতো বিহ্বলতায় ভরা সে কোন্ সুরপুর হতে আধঘুমে গানের প্রাণস্পর্শী ব্যঞ্জনা আমার কানে এল, –

অনেক দিনের অনেক কথা ব্যাকুলতা, বাঁধা বেদন-ডোরে,
মনের মাঝে উঠেছে আজ ভরে!’

শান্তির মতো শুভ্র এক-বুক পবিত্রতা নিয়ে এই অজানার দিকে তখন পাড়ি দিলুম! – আর একটিবার আমার শূন্য ঘরটার দিকে অশ্রু-ভরা দৃষ্টি ফিরিয়ে আকুল কণ্ঠে কয়ে উঠলুম, – ‘জয় অজানার জয়!’

 ০৯. পরির কথা

ময়ূরেশ্বর – বীরভূম
সব ছাপিয়ে আমার মনে পড়ছে তাঁরই গাওয়া অনেক আগের একটা গানের সান্ত্বনা, –

অনেক পাওয়ার মাঝে মাঝে কবে কখন একটুখানি পাওয়া
সেইটুকুতেই জাগায় দখিন হাওয়া,
দিনের পরে দিন চলে যায় যেন তারা পথের স্রোতেই ভাসা,
বাহির হতেই তাদের যাওয়া আসা;
কখন আসে একটি সকাল সে যেন মোর ঘরেই বাঁধে বাসা,
সে যেন মোর চিরদিনের চাওয়া।
হারিয়ে যাওয়া আলোর মাঝে কণা কণা কুড়িয়ে পেলেম যারে,
রইল গাঁথা মোর জীবনের হারে;

সেই যে আমার জোড়া-দেওয়া ছিন্ন দিনের খণ্ড আলোর মালা,
সেই নিয়ে আজ সাজাই আমার থালা।
এক পলকের পুলক যত, এক নিমেষের প্রদীপখানি জ্বালা,
একতারাতে আধখানা গান গাওয়া!’

আমার আজ সেই কথাটাই বারে বারে মনে হচ্ছে যে, যাকে হারিয়ে-যাওয়া আলোর মাঝে কণা কণা করে কুড়িয়ে পেলুম, সেই আমার জীবনের হারে গাঁথা রইল! আর সেই আমার জোড়া দেওয়া ছিন্ন দিনের খণ্ড আলোর মালা নিয়ে আজ আমার দুখের থালা সাজিয়ে বসে আছি, – ওঃ সে বড়ো আশায়! – এ কোন্-সেদিনের আশায় আর কার প্রতীক্ষায়?

* * *
তিনি যখন আমায় আশীর্বাদ করতে এলেন, তখন একবার মনে হল বুঝি এইবার আমার সকল বাঁধন টুটল! ওঃ খোদা! আমাদের বুকে তুমি রাশি রাশি ব্যথা আর দুঃখ বোঝাই করে রেখেছ, তা সহ্য করতে তেমনই ধৈর্য-শক্তি যদি আমাদের না দিতে তাহলে আমাদের লজ্জা রাখবার আর জায়গা থাকত না, – অপমানের চূড়ান্ত হত! সেদিন আমি নিজেকে সংযত করতে না পারলে আমার নারীত্বের মাথায় যে পদাঘাত পড়ত, তাতে আমি হয়তো আর এই আজকের মতো মাথা তুলেই দাঁড়াতে পারতাম না! তুমি হৃদয়ে বল দিয়েছ প্রভু, তাই অসংকোচে এমন একটা গৌরব অনুভব করতে পারছি আজ, হোক না কেন সে গৌরব বড়ো কষ্টের!

আমার ভালোবাসাই হয়তো তাঁর কর্তব্যের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাঁর সুখের জন্যে, তাঁর তৃপ্তির জন্যে আমি কেন তবে সে-পথ হতে সরে দাঁড়াব না? আমার সর্বস্বের বিনিময়েও যে তাঁকে সুখী করতে পেরেছি, এই তো আমার শ্রেষ্ঠ সান্ত্বনা।

এই তাঁর চিন্তাটা যে আজ হতে জোর করে মন থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে, সেইটাই আমায় সবচেয়ে কষ্ট দিচ্ছে। বাইরের শাসন আর ভিতরের শাসন এই দুটোয় মস্ত টানাটানি পড়ে গিয়েছে এখন। – সমাজ, ধর্ম আমার মনকে মুখ ভেঙিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলছে, – ‘সে চিন্তাটা তোমার ভয়ানক অন্যায়, অমার্জনীয় পাপ।’

মনও বেশ প্রশান্ত হাসি হেসে বলছে, – আমি মিথ্যাকে মানব কেন? যা অন্তরের সত্য, সেইটাই আসল, সেইটাকে এড়িয়ে চললেই পাপ। গভীর সমাজ-তত্ত্বের সাথে গভীর সত্যের কথাটাও একবার ভেবে দেখো।

বাস্তবিক, অন্তরের গভীর সত্যকে বরণ করে নিতে গিয়ে সমাজ আর ধর্মকে আঘাত করা হয় বলে যদি মনে করি, তাহলে সেটা আমাদেরই ভুল; কারণ আমরা সমাজ আর ধর্মের অন্তর্নিহিত আদত সত্যকে উপেক্ষা করে তাদের বাইরের খোলসটাকে আঁকড়ে ধরে মনে করি, আমাদের মতো সত্যবিশ্বাসী আর নেই। আমাদের এ অন্ধবিশ্বাস যে মিথ্যা, তা সব চেয়ে বেশি করে জানি আমরা নিজেরাই। তবু সেটা আমরা কিছুতেই স্বীকার করব না, উলটে হাজার ‘ফ্যাচাং’-এর দলিল নজির পেশ করব! কিন্তু তাই যদি হয়, তাহলে অন্তরের সত্যকে উপেক্ষা করে এই যে আর একজনকে আমার স্বামী বলে নিজ মুখে মেনে নিলুম, তার কী হবে?

মনও যেন তখন বিরক্তি-বিতৃষ্ণায় জ্বলে উঠে বলে, – ‘হাঁ, একটা বড়ো কাজ করছ বলে এই যে এত বড়ো সত্যের অবমাননা করলে, তার শাস্তি খুব কঠোর নির্দয়ভাবেই পেতে হবে। এখন যে তাকে আর চিন্তা করতেও পাবে না, এইটাই তোমার উপযুক্ত শাস্তি!’

মনের এই অভিমান-ভরা উক্তিতে আমি না কেঁদে থাকতে পারি নে। আমারও কেন মনে হয় যে, আমি ইচ্ছে করেই তাঁকে এড়িয়ে গিয়েছি, কিন্তু বুক-ভরা অভিমান আমার তাঁর বিরুদ্ধে এখনও জমে রয়েছে। প্রিয়ের বিরুদ্ধে এ অভিমান আমার জন্মে জন্মে সঞ্চিত রইল।

* * *
কাল ছিল আমার ফুলশয্যা। এই বাসর রাত্রিটি অনেক নারীর জীবনে মাত্র একটি নিশির জন্যেই সুখদ হয়ে আসে। এর বিনোদ স্মৃতিটা প্রভাতের শুকতারার চেয়েও স্নিগ্ধ উজ্জ্বল হয়ে দুঃখ-বেদনা-ক্লিষ্ট নারীর জীবনে অনেকখানি আনন্দের আলো বিকীর্ণ করে!

কিন্তু এমন সুখ-নিশিতেও কী জানি কেন কিছুতেই আমার উচ্ছ্বসিত ক্রন্দন রোধ করতে পারছিলুম না। আমার স্বামী আমায় হাত ধরে তুলে আর্দ্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, – ‘কেন কাঁদছ পরি?’ – ব্যথায় তাঁর স্বর আহত হয়ে উঠল!

আমি বড়ো কষ্টে উপাধানে তেমনি করে নিজের এই নির্লজ্জ চোখ দুটোকে লুকিয়ে মনে মনে বললুম, – ‘বুকে বড়ো বেদনা!’ আমার হাতে তাঁর তপ্ত অশ্রু টস্‌টস্ করে ঝরে পড়তে লাগল। পুরুষ মানুষ যে কত কষ্টে এমন করে কাঁদতে পারে, তা বুঝে আমার হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া যেন বন্ধ হবার উপক্রম হল। একটু পরেই তিনি বেশ স্নিগ্ধ সহানুভূতির স্বরে যেন আমার মনের কথাটি টেনে নিয়ে বললেন, ‘তোমার বেদনা তো আমি জানি পরি, তোমার এ বুকজোড়া বেদনা কী দিয়ে আরাম করতে পারব বল?’

এক নিমেষে আমার লুপ্ত জ্ঞান যেন ফিরে এল। আমি সোজা হয়ে বসে বসলুম, – ‘আপনি সব জানেন?’

তিনি করুণ হাসি হেসে বললেন, – ‘তুমি বোধ হয় জান না, যে, আজহার আমার অনেক দিনের বন্ধু। আমরা বরাবর দুজনে এক সঙ্গেই পড়েছি। সে যাবার আগে আমায় সব বলেছে! তাকে আমি বরাবরই চিনি, – সে মিথ্যা বলে না, সে শিশুর মতোই সরল। তবু সকল কথা জেনেও মনে হচ্ছে, আমি তাকে সুখী করতে গিয়েও কী যেন মস্ত অন্যায় করেছি। এখন ভাবছি যে, তাকে সুখী তো করতেই পারিনি, উল্‌টে তার দুঃখ-কষ্টকে হয়তো আরও বাড়িয়ে দিয়েছি। সে হতভাগা বোধ হয় শান্তিতে মরতেও পারবে না! এই আমার জীবনে প্রথম আর শেষ অন্যায়। – সে আমার পা ধরে মুক্তি চেয়েছিল। তখন কিন্তু বুঝিনি, সে কোন্ মুক্তি! – আমার সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছি পরি, কিন্তু এতে আত্মতৃপ্তির চেয়ে আত্মগ্লানিই বেশি করে পেলুম; কেননা আমার অবস্থাটা এখন সেই রকমের হয়ে দাঁড়িয়েছে, যারা সবাইকে সন্তুষ্ট করতে চায়, অথচ কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারে না! … আজহার প্রতিজ্ঞা করেছে যে, এই কথাটা তার জীবনে আর দ্বিতীয়বার মুখ দিয়ে বেরুবে না, আর তার সত্যে আমার বিশ্বাস আছে। সে তোমাকে সুখী করবার জন্যে আমায় অনুরোধ করেছে। – বলো পরি, তুমি কিসে সুখী হবে?’

আমি তাঁর পায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে বললুম, – ‘তুমি আমায় এক বিন্দু ছেড়ে থেকো না, তোমার এই পায়ে এমনই করে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে দিয়ো। আমার বড়ো কষ্ট!’…

অনেকক্ষণ পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে বসে থেকে তিনি আমায় বুকে তুলে নিয়ে বললেন, – ‘না পরি, পায়ে কেন, এই বুকে করে রাখব! এমন রত্ন সে হতভাগা কী করে জান ধরে আমায় বিলিয়ে দিতে পারল, তাই ভাবছি!’ – বলেই হেসে উঠলেন।

এক মুহূর্তে এই সোজা লোকটির সরলতায় আমার বুক বেদনায় আর শ্রদ্ধায় আলোড়িত হয়ে উঠল। তবু মনে মনে না বলে পারলুম না যে, এমন করে বিলিয়ে দিতে গেলে যে বড্ড বেশি ভালোবাসতে হয় আগে, এ ক্ষমতা কি যার তার থাকে? আবার কী মনে করে তিনি আমায় বলে উঠলেন, – ‘যা হয়ে গেছে, তার জন্যে খামোখা লজ্জিত হয়ো না পরি। – বীর সে, দেশের কাজে গিয়েছে, তাকে আর ডেকো না। মনে করো, যা হয়ে গেছে, তা শুধু ঘুমের ঘোরে!’ বলেই তিনি আবার মাথাটা জোর করে তুলে সুর করে গাইতে লাগলেন, –

‘সধবা অথবা বিধবা তোমার রহিবে উচ্চ শির,
উঠো বীর জায়া, বাঁধো কুন্তল, মুছো এ অশ্রু-নীর!’

এ কী রহস্য খোদা! … এ দেবতাকে যেন কোনোদিন প্রতারণা করি না, এই শক্তি দাও, হৃদয়ে এমনই বল দাও! – এখন শুধু শিশুর মতো ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে আমার। শান্তি দাও খোদা, শান্তি দাও এঁকে – তাঁকে, আর এমনই ব্যথিত বিশ্ববাসীকে!

আহা! ভালোবাসা দিয়ে যারা ভালোবাসা পায় না, তাদের জীবন বড়ো দুঃখের, বড়ো যাতনার! আবার এই জন্যে সেটা এত যাতনার যে, ওই না-ভালোবাসার দরুণ কাউকে অভিযোগ করবারও নেই। জোর করে তো আর কাউকে ভালোবাসানো যায় না।

আমি কি আবার ভালোবাসতে পারব গো! কী করে ভুলব? যে বিদায় নিয়ে এমন করে জয়ী হয়ে চলে গেল, তাকে যে সারা জীবনেও কিছুতেই ভোলা যায় না! তিনি যদি আমার সামনে থেকে অন্য কোনো দিকে জীবনটা সার্থক করে তুলতেন, তা হলে হয়তো তাঁকে ভুলতেও পারতাম। সব হারিয়ে যে এমন জীবনটা ব্যর্থ করে দিলে এই হতভাগিনির জন্যে, হায়! তাকে কি ভোলা যায়? নারীর ভালোবাসা কি এত ছোটো?

ওই যে এখনও আমার স্বামী তেমনই হাসিমুখে গাচ্ছেন, –

‘ওগো দেখি আঁখি তুলে চাও,
তোমার চোখে কেন ঘুম-ঘোর!’

 ১০. অতৃপ্ত কামনা

সাঁঝের আঁধারে পথ চলতে চলতে আমার মনে হল, এই দিনশেষে যে হতভাগার ঘরে একটি প্রিয় তরুণ মুখ তার ‘কালো চোখের করুণ কামনা’ নিয়ে সন্ধ্যাদীপটি জ্বেলে পথের পানে চেয়ে থাকে না, তার মতো অভিশপ্ত বিড়ম্বিত জীবন আর নেই!

আমারই বেদনা-রাগে রঞ্জিত হয়ে গগনের পশ্চিম দুয়ারে জ্বালা সন্ধ্যা-তারা আমার মুখে তার অশ্রু-ভরা ছল-ছল চোখ নিয়ে চেয়ে ওই কথাটিতে সায় দিলে। ঝিল্লি-তান-মুখরিত মাঠের মৌন পথ বেয়ে যেতে যেতে শ্রান্ত চিন্তা কয়ে গেল, – ‘তোমায় ব্যথা বোঝে শুধু ওই এক সাঁঝের তারা!’

যদি কোনো ব্যথাতুর একটি পল্লি হতে আর একটি পল্লিতে যেতে এমনই সাঁঝে একা শূন্য মাঠের সরু রাস্তা ধরে চলতে থাকে – তার সামনে এক টুকরো টাটকা কাটা-কলজের মতো এই সন্ধ্যাতারাটি ফুটে ওঠে, তবে সেই বুঝবে কত বুক-ফাটা ব্যথা সে সময় তার মনে হয়ে তাকে নিপীড়িত করতে থাকে।

এই মলিন মাঠের শূন্য বুকে কিছু শোনা যাচ্ছে না, শুধু কোথায় সান্ধ্য নীড়ে বসে একটি ‘ধূলো-ফুরফুরি’ শিস দিয়ে দিয়ে বাউল গান গাইছে, আর তারই সূক্ষ্ম রেশ রেশমি সুতোর মতো উড়ে এসে আমার আনমনা-মনে ছোঁয়া দিচ্ছে! একটি দুটি করে আশমানের আঙিনায় তারা এসে জুটছে, আমার মনের মাঝেও তাই অনেক দিনের অনেক সুপ্ত কথার, অনেক লুপ্ত স্মৃতির একটির পর একটির উদয় হচ্ছে।….

আমার এই একই কথা, একই ব্যথা যে কত দিক দিয়ে কত রকমে মনে পড়ছে, তার আর সংখ্যা নেই। তবু বারে বারে ও-কথাটি ও-ব্যথাটি জাগবেই! মন আমার এ বেদনার নিবিড় মাধুর্যকে আর এড়িয়ে যেতে পারলে না। সাপ যেমন মানিক ছেড়ে তার সেই মানিকটুকুর আলোর বাইরে যেতে পারে না, আমারও হয়েছে তাই। আমার এই বুকের মানিক বেদনাটুকুর অহেতুক অভিমানের মায়া এড়িয়ে যেতে পারলাম না!

অনেক দূরে হাটের ফেরতা কোনো ব্যথিতা পল্লি-বধূ মেঠো সুরে মাঠের বিজন পথে গেয়ে যাচ্ছিল, –

‘পরের জন্যে কাঁদ রে আমার মন,
হায়, পর কি কখন হয় আপন?’

আমি মনে মনে বললাম – হয় রে অভাগি, আপন হয়; তবে অনেকে সেটা বুঝতে পারে না। বুকের ধনকে ছেড়ে গেলেই লোকে ভুল বুঝে বলে, –

‘পর কি কখন হয় আপন?’

আর একজনও ঠিক এমনই ভুল করে আমায় ছেড়ে গেছে, সে বেদনা ভুলবার নয়!

পথের বিরহিণীর ওই প্রাণের গান আমায় মনে করিয়ে দিলে অমনি আর একজন অভিমানিনীর কথা। সেই দিল-মাতানো স্মৃতিটি মাঝিহারা ডিঙির মতো আমার হিয়ার যমুনায় বারে বারে ভেসে উঠছে!

তাতে-আমাতে পরিচয় তো শুধু ছেলেবেলা থেকে নয় – তারও অনেক আগে থেকে; সেই চির-পরিচয়ের দিন তারও মনে নেই, আমারও মনে নেই। …

আমাদের পাড়াতেই তার বাড়ি।

তাকে আমার বিশেষ করে দরকার হত সেই সময়, যখন কাউকে, মারবার জন্যে আমার হাত দুটো ভয়ানক নিশ-পিশ করে উঠত। এ-মারারও আবার বিশেষত্ব ছিল; যখন মারবার কারণ থাকত, তখন তাকে মারতাম না, কিন্তু বিনা কারণে মারাটাই ছিল আমার খেপা-খেয়াল। আমার এ-পিটুনি খাওয়াটাকে সে পছন্দ করত কি না জানি নে, তবে দু-দিন না মারলে সে আমার কাছে এসে হেসে বলত, – ‘কই ভাই, এ দু-দিন যে আমায় মারনি?’

আমি কষ্ট পেয়ে বলতাম, – ‘না রে মোতি, তোকে আর মারব না!’ তার পর, সে সময় আমার হাতের সামনে যা-কিছু ভালো জিনিস থাকত, তাই তাকে দিয়ে যেন আমার প্রাণে গভীর তৃপ্তি আসত! মনে হত, এই নিয়ে সে হয়তো আমার আঘাতটাকে ভুলবে।

বই থেকে ছবি ছিঁড়ে তাকে দেওয়াই ছিল আমার সবচেয়ে মূল্যবান উপহার। এর জন্যে প্রায়ই পাঠশালায় সারা দিন কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। কিন্তু যখন দেখতাম যে, আমার দেওয়া ওই মহা উপহার সে পরম আগ্রহে আঁচলের আড়াল করে নিয়ে গিয়ে তার পুতুলের বিছানা পেতে দিয়েচে, কিংবা তার খেলাঘরের দেওয়ালে ভাত দিয়ে সেগুলো এঁটে দিয়েছে, তখন আমার পাঠশালার সব অপমান ভুলে যেতাম। কিন্তু তার ওই মেনি বিড়ালটাকে আমি দু-চোখে দেখতে পারতাম না, তাকে যে অত আদর করবে রাতদিন, এ যেন আমার সইত না। সে আমায় রাগিয়ে তুলবার জন্যে কোনো দিন আমার দেওয়া সবচেয়ে ভালো ছবিটা আঠা দিয়ে ওই মেনি বিড়ালছানাটার পিঠে এঁটে দিত, আমিও তখন থাপ্পড়ের চোটে তার দুলালি বিড়ালবাচ্চাটাকে ত্রিভুবন দেখিয়ে দিতাম।

তার দেখাদেখি আমিও সময় বুঝে যেদিন সে রেগে থাকত বা মুখখানা হাঁড়ি-পানা করে বসে থাকত, তখন জোর ধুমসুনি দিয়ে তাকে কাঁদিয়ে ছাড়তাম। তখন আমার আনন্দ দেখে কে! সে যত কাঁদত, আমি তত মুখ ভেঙিয়ে তাকে কাঁদিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসতাম। এক এক দিন তার পিঠের চামড়ার পাঁচটি আঙুলের কালো দাগ ফুটিয়ে তবে ছাড়তাম! আশ্চর্য হয়ে দেখতাম, ওই মার খাওয়ার পরেই সে বেশ শায়েস্তা হয়ে গেছে; আর, এক মিনিটে কেমন করে সব ভুলে গিয়ে জল ভরা চোখে মুখে প্রাণভরা হাসি এনে আমার আঙুলগুলো টেনে মুচড়িয়ে ফুটিয়ে দিতে দিতে বলছে, – ‘তোমার এই মারহাট্টা হাতের দুষ্টু আঙুলগুলোকে একেবারে ভেঙে নুলো করে দিতে হয়! তা হলে দেখি, তোমার ওই ঠুঁটো হাত দিয়ে কেমন করে আমায় মার!’ তার হাসি দেখে রেগে পিঠের উপর মস্ত একটা লাথি মেরে বলতাম, – ‘তাহলে এমনি করে তোর পিঠে ভাদুরে তাল ফেলাই!’

সে কাঁদতে কাঁদতে তার দাদাজিকে বলে দিত গিয়ে এবং তিনি যখন চেলা-কাঠ নিয়ে আমায় জোর তাড়া করতেন, তখন সে হেসে একেবারে লুটিয়ে পড়ত! রাগে তখন শরীর গশ-গশ করত। তাই আবার ফাঁকে পেলেই তাকে পিটিয়ে দোরস্ত করে দিতাম। কোনোদিন বা তার খেলা-ঘরের সব ভেঙে চুরে একাকার করে দিতাম, এই দিন সে সত্যি-সত্যি খেপে গিয়ে আমার পিঠে হয়তো মস্ত একটা লাঠির ঘা বসিয়ে দিন পনেরো ধরে লুকিয়ে থাকত, ভয়ে আর কিছুতেই আমার সামনে আসত না। সেই সময়টা আমার বড্ড দুঃখ হত। আ মলো, ও-লাঠির বাড়িতে আমার এ মোষ-চামড়ার কি কিছু হয়? আর লাগলই বা! তাই বলে কি বাঁদরি এমন করে লুকিয়ে থাকবে? তার পর যখন নানান রকমের দিব্যি করে কসম খেয়ে ফুসলিয়ে তাকে ডেকে আনতাম, তখন সে আমার লম্বা চুলগুলো নিয়ে নানান রকমের বাঁকা-সোজা সিঁথি কেটে দিতে দিতে বলত ‘দেখো ভাই, আর আমি কখ্‌খনো তোমায় মারব না! যদি মারি তো আমার হাতে যেন কুঠ হয়, পোকা হয়!’

তারপরে হঠাৎ বলে উঠত, –‘আচ্ছা ভাই, তুমি যদি আমার মতোন বেটি ছেলে হতে, তাহলে বেশ হত, – নয়? – দাও না ভাই, তোমার চুলগুলো আমার ফিতে দিয়ে বেঁধে দিই।’ কোনোদিন সে সত্যি-সত্যিই কখনো কথা কইতে কইতে দুষ্টুমি করে চুলে এমন বিউনি গেঁথে দিত যে, তা ছাড়াতে আমার একটি ঘন্টা সময় লাগত।…

তার পর কী হল? …

এই শূন্য মাঠের খানিকটা রাস্তা পেরিয়েই আমার মনের শাশ্বত শ্রোতা জিজ্ঞেস করে উঠল, – হাঁ ভাই, তার পর কী হল?

আমার হিয়ার কথক কিছুক্ষণ এই নিঝুম সাঁঝের জমাট নিস্তব্ধতার মাঝে যেন তার কথা হারিয়ে ফেললে! হঠাৎ এই নীরবতাকে ব্যথিয়ে সে কয়ে উঠল, – ‘না – তোমায় আমি ভালোবাসি! সেদিন মিথ্যা কয়েছিলাম মোতি, মিথ্যা কয়েছিলাম!’ তার এই খাপছাড়া আক্ষেপ সাঁঝের বেলায় তোড়ি রাগিণী আলাপের মতো যেন বিষম বে-সুরো বাজল! – সে আবার স্থির হয়ে তার সুর-বাহারে পুরবির মূর্ছনা ফোটালে! চির-পিয়াসি আমার চিরন্তন তৃষিত আত্মা প্রাণ ভরে সে সুর-সুধা পান করতে লাগল!

এমনি করেই আমাদের দিন যাচ্ছিল। সে যখন এগারোর কাছাকাছি, তখন তাকে জোর করে অন্দর-মহলের আঁধার কোণে ঠেসে দেওয়া হল। সে কী ছটফটানি তখন তার আর আমার! মনে হল, এই বুঝি আমার জীবন-স্রোতের ঢেউ থেমে গেল! স্রোত যদি তার তরঙ্গ হারায়, তবে তার ব্যথা সে নিজেই বোঝে, বাঁধ-দেওয়া প্রশান্ত দিঘির জল তার সে বেদন বুঝবে না। মুক্তকে যখন বন্ধনে আনবার চেষ্টা করা হয়, তখনই তার তরঙ্গের কল্লোলে মধুর চল-চপলতার কলহ-বাণী ফুটে ওঠে! তাই এ-রকমে চলার পথে বাধা পেয়েই আমাদের সহজ ঢেউ বিদ্রোহী হয়ে মাথা তুলে সামনের সকল বাধাকে ডিঙিয়ে যেতে চাইলে। চির-চঞ্চলের প্রাণের ধারা এই চপল গতিকে থামাবে কে? পথের সাথি আমার হঠাৎ তার চলায় বাধা পেয়ে বক্র-কুটিল গতি নিয়ে তার সাথিকে খুঁজতে ছুটল। এতদিনে যেন সে তার প্রাণের ঢেউ-এর খবর পেলে!

সর্বক্ষণ কাছে পেয়ে যাকে সে পেতে চেষ্টা করেনি, সে দূরে সরে এই দূরত্বের ব্যথা, ছাড়াছাড়ির বেদনা তার বুকে প্রথম জেগে উঠতেই সে তাকে চিনল এবং বলে উঠল, – ‘যাকে চাই তাকে পেতেই হবে।’

বঞ্চিত স্নেহের হাহাকার, ছিন্ন বাসনার আকুল কামনা তার বুকে উদ্দাম উন্মাদনা জাগিয়ে দিয়ে গেল! তখন সে তার এই আকাঙ্ক্ষিত আশ্রয়কে নতুন পথে নতুন করে খুঁজতে লাগল। সে অন্তরে বুঝলে, এ সাথি না হলে আমি আমার গতি হারাব! এই রকম মুক্তি আর বন্ধনের যুঝাযুঝির মাঝে পড়ে সে কাহিল হয়ে উঠল! সমাজ বললে, – রাখ তোর এ মুক্তি – আমি এই দেওয়াল দিলাম!

সেই দেওয়ালে মাথা খুঁড়ে রক্ত-গঙ্গা বহালে, পাষাণের দেওয়াল – ভাঙতে পারলে না!

এ-দিকে আমাকে কেউ রাখতে পারলে না! লোকের চলার উলটো পথে উজান বেয়ে চলাই হল আমার কাজ! অনেক মারামারি করেও যখন আমাকে স্কুলের খাঁচায় পুরতে পারলে না, তখন সবাই বললে, – এ ছেলের যদি লেখাপড়া হয় তবে সুগ্রীব-সহচর দগ্ধমুখ হনুবংশ কী দোষ করেছিল? তারাও হাল ছেড়ে দিলে, আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে দেখলাম এই বাধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে যত তাকে ভুলে রয়েছি, ততই যেন সে আমার একান্ত আপনার হয়ে আমার নিকটতম কাছে এসে আমার উপর তার সব নির্ভরতা সঁপে গেছে! –

যমুনা আসছিল সাগরের পানে, ওই সাগরও তার দিগন্ত-ছোঁয়া ঢেউ-এর আকুলতা লক্ষ বাহুর ব্যগ্রতা নিয়ে তার দিকে ছুটে যেতে চাইল! দুজনেই অধীর হয়ে পড়েছিল এই ভেবে – হায়! কবে কোন্ মোহানায় তাদের চুমোচুমি হবে, তারা এক হয়ে যাবে!…

আর আমাদের দেখা-শোনা হত না। কথা যা হত, তা কখনও সবাইকে লুকিয়ে ওই একটি চোরা-চাওয়ায়, নয়তো বাতায়নের ফাঁক দিয়ে দুটি তৃষিত অতৃপ্ত দৃষ্টির বিনিময়ে। ওই এক পলকের চাওয়াতেই যে আমাদের কত কথা শুধানো হয়ে যেত, কত ব্যথা-পুলক শিউরে উঠত, তা ঠিক বোঝানো যায় না!

* * *
আরও পাঁচ বছর পরের কথা! –

একদিন শুনলাম তার বিয়ে হবে, মস্ত বড়ো জমিদারের ছেলে বি-এ পাস এক যুবকের সাথে। বিয়ে হবার পর সে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে, তার সাথে আমার এই চোখের চাওয়াটুকুও ফুরাবে, এই ব্যথাটুকুই বড়ো গভীর হয়ে মর্মে আমার দাগ কেটে বসে গেল! এ ব্যথার প্রগাঢ় বেদনা আমার বুকের ভিতর যেন পিষে পিষে দিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু যখন মেঘ-ছাড়া দীপ্ত মধ্যাহ্ন-সূর্যের মতো সহসা এই কথাটি আমার মনে উদয় হল যে, সে সুখী হবে, তখন যেন আমি আমার নতুন পথ দেখতে পেলাম। বললাম, – না, আমি জন্মে কারুর কাছে মাথা নত করিনি, আজও আমাকে জয়ী হতে হবে। আর দুঃখই বা কীসের? সে ধনী শিক্ষিত সুন্দর যুবকের অঙ্কলক্ষ্মী হবে, অভাগি মেয়েদের সুখী হবার জন্যে যা-কিছু চাওয়া যায় তার সব পাবে; কিন্তু হায়, তবু অবুঝ মন মানে না! মনে হয়, আমার মতোন এত ভালোবাসা তো সে পাবে না!

এই কথা ক-টি ভাবতে গিয়ে আমার বুক কান্নায় ভরে এল, – আমার যে বাইরের দীনতা তাই মনে পড়ে তখন আমাকে আমার অন্তরের সত্য-প্রেমের গৌরবের জোরে খাড়া হতে হল। এক অজানার উপর তীব্র অভিমানের আক্রোশে বললাম, নিজের সুখ বিলিয়ে দিয়ে এর প্রতিহিংসা নেব। ত্যাগ দিয়ে আমার দীনতাকে ভরে তুলব।

এত দ্বন্দ্বের মাঝে’ আমার প্রিয় সুখী হবে’ এই কথাটির গভীর তত্ত্ব প্রাণে আমার ক্রমেই কেটে কেটে বসতে লাগল, তার পর হঠাৎ এক সময় আমার বুকের সব ঝঞ্ঝা ঝড় বেদনা তরঙ্গ ধীর শান্ত স্তব্ধ হয়ে গেল! বিপুল পবিত্র সান্ত্বনায় তিক্ত মন আমার যেন সুধাসিক্ত হয়ে গেল! আঃ! কোথায় ছিলে এতদিন ওগো বেদনার আরাম আমার? এতদিন পরে নিশ্চিন্ততার কান্না কেঁদে শান্ত হলাম!

এ কোন্ অর্ফিয়াসের বাঁশির মায়া-তান, এমন করে আমার মনের দুরন্ত সিন্ধুকে ঘুম পাড়িয়ে গেল? … হায়, এতদিন বাঁশির এই জাদু-করা সুর কোথায় ছিল? –

সে দিন নিশীথ রাতে তার বাতায়নের পানে চেয়ে তাই গেয়েছিলাম, –

‘আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই
বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে!
এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর
জীবন ভরে?’

বাঃ, এরই মধ্যেই দেখচি মাঠের সারা পথটা পেরিয়ে গাঁয়ের সীমা-রেখার কাছাকাছি এসে পড়েছি! দূর হতে ঘরে ঘরে মাটির আর কেরোসিনের যে ধোঁয়া-ভরা দীপের আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তাতেই আমার মন কেমন ওই প্রদীপ-জ্বালা ঘরের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে! মনে হচ্ছে, ওই দীপের পাশে ঘোমটা-পরা একটি ছোটো মুখ হয়তো তার দু-চোখ-ভরা আকুল প্রতীক্ষা নিয়ে পথের পানে চেয়ে আছে। দখিন হাওয়ায় গাছের একটি পাতা ঝরে পড়লে অমনি সে চমকে উঠছে, – ওই গো বুঝি তার প্রতীক্ষার ধন এল! তার বুকে এই রকম আশা-নিরাশার যে একটা নিবিড় আনন্দ ঘুরপাক খাচ্ছে, তারই নেশায় সে মাতাল!

আমার মনের সেই চিরকেলে অক্লান্ত বিরহী শ্রোতা তাড়া দিয়ে কয়ে উঠল, – ও সব পরে ভেবোখন, তার পর কী হল, বলো!…

তখন গাঁয়ের মাথায় মায়ের নত-আঁখির স্নেহ-চাওয়ার মতো নিবিড় শান্তি নেমে এসেছে। করুণ বেদনার সাথে পবিত্র স্নিগ্ধতা মিশে আমার নয়ন-পল্লব সিক্ত করে আনলে।

জল-ভরা চোখে আমার বাকি কথাটুকু মনে পড়ল।…

তার বিয়ের দিন কতক আগের এক রাতে তাতে আমাতে প্রথম ও শেষ গোপন দেখা শোনা। সে বললে – ‘এ বিয়েতে কী হবে ভাই?’

আমি বললাম, ‘তুমি সুখী হবে।’

সে আমার সহজ কণ্ঠ শুনে তার বয়সের কথা, আমার বয়সের কথা – আমাদের ব্যবধানের কথা সব যেন ভুলে গেল। মাথার উপর আকাশ ভরা তারা মুখ টিপে হেসে উঠল। সে আবার তেমনই করে সেই ছেলেবেলার মতো আমার হাতের আঙুলগুলো ফুটিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘তা কী করে হবে? তোমাকে যে ছেড়ে যেতে হবে, তোমাকে যে আর দেখতে পাব না।’

এত দিনে তার এই নতুন রকমের আর্দ্র কণ্ঠের বাণী শুনলাম! তার টানা টানা চোখের ঘন দীর্ঘ পাতায় তারার ক্ষীণ আলো প্রতিফলিত হয়ে জানিয়ে দিল, সে কাঁদছে!

আমি বললাম, – ‘তোমার কথা বুঝতে পেরেছি মোতি। কিন্তু তুমি যার কাছে যাবে, সে আমার চেয়েও তোমায় বেশি ভালোবাসবে; সেখানে গেলে আমাদের সব কথা ভুলে যাবে।’

অন্যে আমার প্রিয়কে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসবে, এই চিন্তাটাও যেন অসহ্য। তার স্বামী আমার চেয়ে ধনী হোক, সুন্দর হোক, শিক্ষিত হোক, কিন্তু আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসবে আমার ভালোবাসার মানুষটিকে, বড়ো অভিমানেই ওই কথাটা আমি বললাম, কিন্তু এ-কথাটা বলেই এবার আমারও যেন বিপুল কান্না কণ্ঠে ফেটে বেরিয়ে আসতে লাগল। সে কান্না রুধবার শক্তি নেই – শক্তি নেই। মূর্ছাতুরার মতো সে আমার হাতটা নিয়ে জোরে তার চোখের উপর চেপে ধরে আর্ত কণ্ঠে কয়ে উঠল, ‘না–না– না।’ কীসের এ ‘না’?

আমি তীব্র কণ্ঠে কয়ে উঠলাম, – ‘ এ হতেই হবে মোতি, এ হতেই হবে। আমায় ছাড়তেই হবে।’

তখন এক অজানা দেবতার বিরুদ্ধে আমার মন অভিমানে আর তিক্ততায় ভরে উঠেছে। সে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে কয়ে উঠল, – ‘ওগো, চিরদিন তো আমায় মেরে এসেছ, এখনও কি তোমার মেরে সাধ মেটেনি? তবে মারো, আরও মারো – যত সাধ মারো।’

কত দিনের কত কথা কত ব্যথা আমার বুকের মাঝে ভরে উঠল! তার পরেই তীব্র তীক্ষ্ণ একটা অভিমানের কঠোরতা আমায় ক্রমেই শক্ত করে তুলতে লাগল। মন বললে – জয়ী হতেই হবে।

আমি ক্রূর হাসি হেসে মোতিকে বললাম, ‘হুঁ! কিছুতেই মানবে না তো, তবে সত্যি কথাটাই বলি, – মোতি, তোমায় যে আমি ভালোবাসি না।’

কথাটা তার চেয়ে আমার বুকেই বেশি বাজল। সে তীরবিদ্ধা হরিণীর মতো চমকে উঠে বললে, – ‘কী?’

আমি বললাম, – ‘তোমায় এতদিন শুধু মিথ্যা দিয়ে প্রতারিত করে এসেছি মোতি, কোনোদিন সত্যিকার ভালোবাসিনি।’

আমার কণ্ঠ যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। আহত ফণিনীর মতো প্রদীপ্ত তেজে দাঁড়িয়ে সে গর্জন করে উঠল, – ‘যাও চলে যাও – তোমায় আমি চাইনে, সরে যাও। তুমি জল্লাদের চেয়েও নিষ্ঠুর, বে-দিল ! – যাও, সরে যাও।… তোমার পায়ে পড়ি চলে যাও, আর আমার ভালোবাসার অপমান কোরো না।’

দু-চোখ হাত দিয়ে টিপে কালবৈশাখীর উড়ো ঝঞ্ঝার মতো উন্মাদ বেগে সে ছুটে গেল। আমি টাল খেয়ে মাথা ঘুরে পড়তে পড়তে শুনতে পেলাম আর্ত-গভীর আর্তনাদের সঙ্গে বিয়ে-বাড়ির ছালনা-বাঁধা আঙিনায় কে দড়াম করে আছড়ে পড়ে গোঙিয়ে উঠল, – ‘মা–গো।’

ওই যে অনেক দূরের খেয়া-পারে ক্লান্ত মাঝির মুখে পরিশ্রান্ত ক্লান্ত মনের চিরন্তন কান্নাটি ফুটে উঠেছে, ও যেন আমারই মনের কথা, –

মন-মাঝি তোর বইঠা নে রে,
আমি আর বাইতে পারলাম না।’
ওগো আমার মনের মাঝি, আমারও এ-ক্লান্তি-ভরা জীবন-তরি আর যে বাইতে পারি নে ভাই! এখন আমায় কূল দাও, না হয় কোল দাও! –

আমার মনে বড়ো ব্যথা রয়ে গেল, সে হয়তো আমার ব্যথা বুঝলে না। যাকে ভালোবাসি, তাকে ব্যথা দিতে গিয়ে আমার নিজের বুক যে ব্যথার আঘাতে, বেদনার কাঁটায় কত ছিন্ন-ভিন্ন কীরকম ঝাঁঝরা হয়ে গেছে, হায়, তা যদি সে জানত – তা যদি মোতি বুঝতে পারত। ওঃ যাকে ভালোবাসি সেও যদি আমাকে ভুল বোঝে, তবে আমি বাঁচি কী নিয়ে? আমার এ রিক্ত জীবনের সার্থকতা কী? হায়, দুনিয়ায় এর মতো বড়ো বেদনা বুঝি আর নেই।

এই তো আমার গাঁয়ের আমবাগানে এসে ঢুকেছি। ওই তো আমার বন্ধ-করা আঁধার ঘর। চার পাশে দীপ-জ্বালানো কোলাহল-মুখরিত স্নেহনিকেতন, আর তারই মাঝে আমার বিজন আঁধার কুটির যেন একটা বিষমাখা অভিশাপ শেলের মতো জেগে রয়েছে। দিনের কাজ শেষ করে বিনা-কাজের সেবা হতে ফিরে ঘরে ঢুকবার সময় রোজ যে-কথাটি মনে হয়, বন্ধ দুয়ারের তালা খুলতে খুলতে আজও সেই কথাটিই আমার মনের চির ব্যথার বনে দাবানল জ্বালিয়ে যাচ্ছে।

একে একে সব ঘরেই প্রদীপ জ্বলবে, শুধু আমার একা ঘরেই আর কোনো দিন সন্ধ্যা-দীপ জ্বলবে না। সেই ম্লান দীপ-শিখাটির পাশে আমার আসার আশায় কোনো কালোচোখের করুণ-কামনা ব্যাকুল হয়ে জাগবে না!

বাইরে আমার ভাঙা দরজায় উতল হাওয়ার শুধু একরোখা বুকচাপড়ানি আর কারবালা-মাতম রণিয়ে উঠল, –

‘হায় গৃহহীন, হায় পথবাসী, হায় গতি-হারা!’
আমার হিয়ার চিতার চিরন্তনী ক্রন্দসীও সাথে সাথে কেঁদে উঠল, –

‘হায় গৃহহীন, হায় পথবাসী, হায় গতি-হারা!’

১১. রাজবন্দীর চিঠি

প্রেসিডেন্সি জেল, কলিকাতা
মুক্তি-বার, বেলা-শেষ

প্রিয়তমা মানসী আমার।

আজ আমার বিদায় নেবার দিন। একে একে সকলেরই কাছে বিদায় নিয়েছি। তুমিই বাকি। ইচ্ছা ছিল, যাবার দিনে তোমায় আর ব্যথা দিয়ে যাব না, কিন্তু আমার যে এখনও কিছুই বলা হয়নি। তাই ব্যথা পাবে জেনেও নিজের এই উচ্ছৃঙ্খল বৃত্তিটাকে কিছুতেই দমন করতে পারলুম না। তাতে কিন্তু আমায় দোষ দিতে পারবে না, কেন না তোমার মনে তো চিরদিনই গভীর বিশ্বাস যে, আমার মতন এত বড়ো স্বার্থপর হিংসুটে দুনিয়ায় আর দুটি নেই।

আমার কথা তোমার কাছে কোনোদিনই ভালো লাগেনি। (কেন, তা পরে বলছি), আজও লাগবে না। তবু লক্ষ্মী, এই মনে করে চিঠিটা একটু পড়ে দেখো যে, এটা একটা হতভাগা লক্ষ্মীছাড়া পথিকের অস্ত-পারের পথহারা পথে চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার বিদায়-কান্না। আজ আমি বড়ো নিষ্ঠুর, বড়ো নির্মম। আমার কথাগুলো তোমার বে-দাগ বুকে না-জানি কত দাগই কেটে দেবে। কিন্তু বড়ো বেদনায় প্রিয়, বড়ো বেদনায় আজ আমায় এত বড়ো বিদ্রোহী, এত বড়ো স্বেচ্ছাচারী উন্মাদ করে তুলেছে। তাই আজও এসেছি কাঁদাতে। তুমিও বলো, আমি আজ জল্লাদ, আমি আজ হত্যাকারী কসাই। শুনে একটু সুখী হব।

আমার মন বড়ো বিক্ষিপ্ত। তাই কোনো কথাই হয়তো গুছিয়ে বলতে পারব না। যার সারা জীবনটাই বয়ে গেল বিশৃঙ্খল আর অনিয়মের পূজা করে, তার লেখায় শৃঙ্খলা বা বাঁধন খুঁজতে যেও না। হয়তো যেটা আরম্ভ করব সেইটেই শেষের, আর যেটায় শেষ করব সেইটেই আরম্ভের কথা। আসল কথা, অন্যে বুঝুক চাই নাই বুঝুক, তুমি বুঝলেই হল। আমার বুকের এই অসম্পূর্ণ না-কওয়া কথা আর ব্যথা তোমার বুকের কথা আর ব্যথা দিয়ে পূর্ণ করে ভরে নিও। – এখন শোনো।

প্রথমেই আমার মনে পড়ছে (আজ বোধ হয় তোমার তা মনেই পড়বে না), তুমি একদিন সাঁঝে আমায় জিজ্ঞেস করেছিলে, – ‘কী করলে তুমি ভালো হবে?’

তোমারই মুখে আমার রোগ-শিয়রে এই নিষ্ঠুর প্রশ্ন শুনে অধীর অভিমানের গুরু বেদনায় আমার বুকের তলা যেন তোলপাড় করে উঠল!

হায় আমার অসহায় অভিমান! হায়, আমার লাঞ্ছিত অনাদৃত ভালোবাসা। আমি তোমার সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। দেওয়া উচিতও হত না। তখন আমার হিয়ার বেদনামন্দিরে যেন লক্ষ তরুণ সন্ন্যাসীর ব্যর্থ জীবনের আর্ত হাহাকার আর বঞ্চিত যৌবনের সঞ্চিত ব্যথা-নিবেদনের গভীর আরতি হচ্ছিল। যার জন্যে আমার এত ব্যথা সেই এসে কিনা জিজ্ঞেস করে, – ‘তোমার বেদনা ভালো হবে কিসে?’ …

মনে হল, তুমি আমায় উপহাস আর অপমান করতেই অমন করে ব্যথা দিয়ে কথা কয়ে গেলে। তাই আমার বুকের ব্যথাটা তখন দশ গুণ হয়ে দেখা দিল। আমি পাশের বালিশটা বুকে জড়িয়ে নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লুম। আমার সবচেয়ে বেশি লজ্জা হতে লাগল, পাছে তুমি আমার অবাধ্য চোখের জল দেখে ফেল। পাছে তুমি জেনে ফেল যে, আমার বুকের ব্যথাটা আবার বেড়ে উঠেছে! যে আমার প্রাণের দরদ বোঝে না, সেই বে-দরদির কাছে চোখের জল ফেলা আর ব্যথায় এমন অভিভূত হয়ে পড়ার মতো দুর্নিবার লজ্জা আর অপমানের কথা আর কী থাকতে পারে? কথাও কইতে পারছিলুম না, ভয় হচ্ছিল এখনই আর্দ্র গলার স্বরে তুমি আমার কান্না ধরে ফেলবে। যাক, ভগবান আমায় রক্ষা করলেন সে বিপদ হতে। তুমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবতে লাগলে। তার পর আস্তে আস্তে চলে গেলে। তুমি বোধ হয় আজ পড়ে হাসবে, যদি বলি, যে, আমার তখন মনে হল, যেন তুমি যাবার বেলায় ছোট্ট একটি শ্বাস ফেলে গিয়েছিলে। – হায় রে অন্ধ বধির ভিখিরি মন আমার! যদি তাই হত, তবে অন্তত কেন আমি অমন করে শুয়ে পড়লুম, তা একটু মুখের কথায় শুধাতেও তো পারতে।

তুমি চলে যাবার পরেই ব্যথায় অভিমানে আমার বুক যেন একেবারে ভেঙে পড়ল। নিষ্ফল আক্রোশে আর ব্যর্থ বেদনার জ্বালায় আমি হুঁকরে হুঁকরে কাঁদতে লাগলুম। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। তার পর ডাক্তার এল, আত্মীয়-স্বজন এল, বন্ধু-বান্ধব এল। সবাই বললে, – হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বড়ো অস্বাভাবিক। গতিক…ডাক্তার বললে, – ‘রোগী হঠাৎ কোনো – ইয়ে – কোনো বিশেষ কারণে এমন অভিভূত হয়ে পড়েছে। এ কিন্তু বড্ডো খারাপ। এতে এমনও হতে পারে যে …।’

বাকিটুকু ডাক্তার আমতা আমতা করে না বললেও আমি সেটার পূরণ করে দিলুম, – ‘একেবারে নির্বাণ দীপ গৃহ অন্ধকার। না ডাক্তার বাবু?’ – বলেই হাসতে গিয়ে কিন্তু এত কান্না পেল আমার যে, তা অনেকেরই চোখ এড়াল না। সত্যিই তখন আমার কণ্ঠ বড়ো কেঁপে উঠেছিল, অধর কুঞ্চিত হয়ে উঠেছিল, চোখের পাতা সিক্ত হয়ে উঠেছিল। আমি আবার উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লুম। অনেক সাধ্য-সাধনা করেও কেউ আর আমায় তুলতে পারলে না। আমার গোঁয়ার্তুমির অনেকক্ষণ ধরে নিন্দে করে বন্ধু-বান্ধবরা বিদায় নিলে। আমিও মনে মনে ভগবানকে ধন্যবাদ দিলুম।

হায়, এই নিষ্ঠুর লোকগুলো কি আমায় একটু নিরিবিলি কেঁদে শান্তি পেতেও দেবে না?… তখনও তোমরা সবাই আমার পাশে, কেউ বা আমার শিয়রে বসেছিলে। হঠাৎ মনে হল, তুমি এসে আমার হাত ধরেছ। এক নিমেষে আমার সকল ব্যথা যেন জুড়িয়ে জল হয়ে গেল। এবারেও কান্না এল, কিন্তু সে যেন কেমন এক সুখের কান্না! তবে এ কান্নাতেও যে অভিমান ছিল না, তা নয়। তবু তোমার ওই ছোঁয়াটুকুর আনন্দেই আমি আমার সকল জ্বালা সকল ব্যথা-বেদনা মান-অপমানের কথা ভুলে গেলুম। মনে হল, তুমি আমার – তুমি আমার – একা আমার! হায় রে শাশ্বত ভিখিরি! চির তৃষাতুর দীন অন্তর আমার! কত অল্প নিয়েই না তুই তোর আপন বুকের পূর্ণতা দিয়ে তাকে ভরিয়ে তুলতে চাস, তবু তোর আপন জনকে আর পেলিনে। খানিক পরেই আমি আবার সকলের সঙ্গে দিব্যি প্রাণ খুলে হাসি-গল্প জুড়ে দিলুম দেখে সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলে। কেউ বুঝলে না, হয়তো তুমিও বোঝনি, কেমন করে অত অধীর বেদনা আমার এক পলকে শান্ত স্থির হয়ে গেল। সে সুখ সে ব্যথা শুধু আমি জানলুম আর আমার অন্তর্যামী জানলেন। হাঁ, সত্যি বলব কি? আরও মনে হয়েছিল, সে ব্যথা যেন তুমিও একটু বুঝতে পেরেছিলে? দেখছ? কী ভিখিরি মন আমার! তুমি না জানি আমায় কতই ছোটো মনে করছ! – আহা একবার যদি মিথ্যা করেও বলতে লক্ষ্মী যে, আমার ব্যথার কারণ অন্তত তুমি মনে মনে জেনেছ, তা হলে আমি আজ অমন করে হয়তো ফুটতে না ফুটতেই ঝরে পড়তুম না! আমার জীবন এমন ছন্ন-ছাড়া ‘দেবদাস’-এর জীবন হয়ে পড়ত না! – যাঃ, খেই হারিয়ে বসেছি আমার কথার! –

হ্যাঁ, সেদিন তোমার ওই একটু উষ্ণ ছোঁয়ার আনন্দেই বিভোর হয়ে রইলুম। তার পরের দিন মনে হতে লাগল, তোমায় আড়ালে ডেকে বলি, কেন আমার এ বুকভরা ব্যথার সৃষ্টি। সারা দিন তোমার পানে উৎসুক হয়ে চেয়ে রইলুম, যদি আবার এসে জিজ্ঞেস কর তেমনই করে, কী করলে তুমি ভালো হবে?

হায়রে দুর্ভাগার আশা! তুমি ভুলেও আর সে-কথাটি আর একবার শুধালে না এসে! সারাদিন আকুল উৎকণ্ঠা নিয়ে বেলা-শেষের সাথে সাথে আমারও প্রাণ যেন কেমন নেতিয়ে পড়তে লাগল। আমার কাঙাল আত্মার এক নির্লজ্জ বেদনা ভুলবার জন্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় গানটা বড়ো দুঃখে বড়ো প্রাণ ভরেই গাইতে লাগলুম, –

‘তুমি জান ওগো অন্তর্যামী
পথে পথেই মন ফিরালেম আমি।
ভাবনা আমার বাঁধলনাকো বাসা।
কেবল তাদের স্রোতের পরেই ভাসা,
তবু আমার মনে আছে আশা,
তোমার পায়ে ঠেকবে তারা স্বামী॥

টেনেছিল কতই কান্না হাসি,
বারে বারেই ছিন্ন হল ফাঁসি!
শুধোয় সবাই হতভাগ্য বলে –
‘মাথা কোথায় রাখবি সন্ধ্যা হলে?’
জানি জানি, নামব তোমার কোলে
আপনি যেথায় পড়বে মাথা নামি।’

আমার কণ্ঠ আমার আঁখি আমারই ব্যথায় ভিজে ভারী হয়ে উঠল! আমার গানের সময় আমি আর বাহিরকে ফাঁকি দিতে পারিনে। সে সুর তখন আমার স্বরে কেঁপে কেঁপে ক্রন্দন করে, সে-সুর সে-কান্না আমার কণ্ঠের নয়, আমার প্রাণের ক্রন্দসীর। গান গেয়ে মনে হল, যেন এই বিশ্বে আমার মতোন ছন্ন-ছাড়ারও অন্তত একজন বন্ধু আছেন, যিনি আমার প্রাণের জ্বালা, মর্ম-ব্যথা বোঝেন, আমার গান শুনে যাঁর চোখের পাতা ভিজে ওঠে। তিনি আমার অন্তর্যামী। অমনি এ-কথাটিও মনে হয়েছিল যে, যদি সত্যিই আমার কেউ প্রিয়া থাকত, তাহলে সে আমার ওই ‘শুধোয় সবাই হতভাগ্য বলে, মাথা কোথায় রাখবি সন্ধ্যা হলে?’ – ওইটুকু শুনবার পরই আর দূরে থাকত পারত না, তার কোলে আমার মাথাটি থুয়ে সজল কণ্ঠে বলত, – ‘ওগো, আমার কোলে প্রিয়, আমার কোলে।’ তার তরুণ কণ্ঠে করুণ মিনতি ব্যথায়-অভিমানে কেঁপে কেঁপে উঠত, – ‘ছি লক্ষ্মী! এ গান গাইতে পারবে না তুমি।

কী বিশ্রী লোভী আমি, দেখেছ? তুমি হয়তো এতক্ষণ হেসে লুটিয়ে পড়েছ আমার এই ছেলেমান্‌ষী আর কাতরতা দেখে! তুমি হয়তো ভাবছো, কি করে এত বড়ো দুর্জয় অভিমানী, দুরন্ত বাঁধন-হারা এমন করে নেতিয়ে পায়ে লুটিয়ে পড়তে পারে, কেমন করে এক বিশ্বজয়ীর এত অল্পে এমন আশ্চর্য এত বড়ো পরাজয় হতে পারে! তা ভাব, কোনো দুঃখ নেই। আমিও নিজেই তাই ভাবছি। কিন্তু ভয় হয় প্রিয়, কখন তোমার এত গরব না-জানি এক নিমেষে টুটে গিয়ে সলিল বয়ে যাবে নয়ানে। সেই দিন হয়তো আমার এ ভালোবাসার ব্যথা বুঝবে। আমার এই পরাজয়ের মানেও বুঝবে সেদিন।

যাক, যা বলছিলাম তাই বলি। – গান গেয়ে কেন আমার মনে হল, আমার অন্তর্যামী বুঝি আমার আঁখির আগে এসে নীরবে জল-ছল-ছল চোখে দাঁড়িয়ে। চোখের জল মুছে সামনে চাইতেই, – ও হরি! কে তুমি দাঁড়িয়ে অমন করুণ চোখে আমার পানে চেয়ে? আহা, চটুল চোখের কালো তারা দুটি তাদের দুষ্টুমি চঞ্চলতা ভুলে গিয়ে ব্যথায় যেন নিথর হয়ে গেছে! সে পাগল-চোখের কাজল আঁখি-পাতা যেন জলভারাতুর। ওগো আমার অন্তর্যামী! তুমি কি সত্য-সত্যই এই সাঁঝের তিমিরে আমার আঁখির আগে এসে দাঁড়ালে? হে আমার দেবতা! তবে কি আমার আজিকার সন্ধ্যা-আরতি বিফলে যায়নি? আমি আমার সব কিছু ভুলে কেমন যেন আত্মবিস্মৃতের মতো বলে উঠলুম – ‘তুমি আমার চেয়ে কাউকে বেশি ভালোবাসতে পাবে না? কেমন?’

কোনো কথা না বলে তুমি আমার কোলের উপরকার বালিশটিতে এসে মুখ লুকালে। কেন? লজ্জায়? না সুখে? না ব্যথায়? জানি না, কেন। তাই তো আজ আমার এত দুঃখ আর এত প্রাণপোড়ানি। তোমার প্রাণের কথা তুমি কোনো দিনই একটি কথাতেও জানাওনি, তাই তো আজ আমার বুক জুড়ে এত না জানার ব্যথা! অনেক সাধ্য-সাধনায় তুমি মুখ তুলে চাইলে, কিন্তু বললে না, কেন অমন করে মুখ লুকালে। সেদিন একটিবার যদি মিথ্যা করেও বলতে, – ‘হে আমার চির-জনমের প্রিয়! যে, …।’ না, না, যাক সেকথা।

এইখানে একটা মজার খবর দিই তোমাকে। এই হাজত-ঘরে বসেও আমার এমন অসময়ে মনে হচ্ছে, যেন আমি একজন কবি। রোসো, এখনই হেসে লুটিয়ে পড়ো না! তোমার চেয়ে আমি ভালো করেই জানি যে আমার কবি না হওয়ার জন্যে যা-কিছু চেষ্টা-চরিত্তির করার প্রয়োজন, তার কোনোটাই বাদ দেননি ভগবান। তাই আমার বাহির-ভিতর সব কিছুই যেন খোট্টাই মুল্লুকের চোট্টাই ভেইয়্যার মতোই কাঠখোট্টা! তবু যদি আমি কবি হতুম, তাহলে আমার এই ভাবটাকে কী সুন্দর করেই না বলতুম, –

শুধু অনাদর শুধু অবহেলা শুধু অপমান!
ভালোবাসা? – সে শুধু কথার কথা রে!

অপমান কেনা শুধু! প্রাণ দিলে পায়ে দলে যাবে তোর প্রাণ!

শুধু অনাদর, শুধু অবহেলা, শুধু অপমান!

যাক, যা হইনি, কপাল ঠুকলেও আর তা হচ্ছি নে। এখন যা আছি, তাই নিয়েই আলোচনা করা যাক।

দাঁড়াও, – অভিমান করে চেঁচিয়ে হয়তো ও কথাটার অপমানই করছি আমি। নয় কি? আমার মতোন হয়তো তুমিও ভাবছ, কার উপর এ অভিমান আমার? কে আমায় এ অধিকার দিয়েছে এত অভিমান দেখাবার? একবিন্দু ভালোবাসা পেলাম না, অথচ এক সিন্ধু অভিমান নিয়ে বসে আছি! তবু শুনে আশ্চর্য হবে তুমি যে, সত্যি-সত্যিই আমার বড্ড অভিমান হয়। যার উপর অভিমান করি, সে আমার এ অভিমান দেখে হাসবে, না দুপায়ে মাড়িয়ে চলে যাবে, সে দিকে ভ্রূক্ষেপও করি না। চেয়েও দেখি না, আমার এত ভালোবাসার সম্মান সে রাখবে কিনা, শুধু নিজের ভালোবাসার গরবে আজ অন্ধতায় মনে করি, সেও আমায় ভালোবাসে। তাই তো আর আমার এত লাঞ্ছনা ঘরে-বাইরে!

অনেক পথিক-বালা এ পথিকের পথের ব্যথা মুছিয়ে দিতে চেয়েছিল, হয়তো ভালোও বেসেছিল (শুনে হেসো না), আমি কিন্তু ফিরেও চাইনি তাদের পানে। ওর মধ্যে আমার কতকটা গরবও ছিল। মনে হত, এ বালিকা তো আমার সাথে পা মিলিয়ে চলতে পারবে না, অনর্থক কেন তার জীবনটাকে ব্যর্থ করে দেব? যে-সে এসে আমার মতোন বাঁধন-হারা বিদ্রোহীর মনটাকে এত অল্প সাধনায় জয় করে নেবে, এও যেন সইতে পারতুম না। তাই কোনো হতভাগীর মনে আমার ছাপ লেগেছে বুঝতে পারলেই আমি অমনই দূরে – অনেক দূরে সরে যেতুম; আর দেখতুম, তার এ আকর্ষণের জোর কত – সে সত্যি আমায় ভালোবাসে, না একটু করুণা করে না ওটা মোহ? ওই দূরে সরে যাবার আর একটা কারণ ছিল যে, আমাদের কাউকে যেন কোনো দিন অনুতাপ করতে না হয় শেষে কোনো ভুলের জন্যে।

আমার এক জায়গায় বড়ো দুর্বলতা আছে। স্নেহের হাতে আমার মতো এমন করে কেউ বুঝি আত্মসমর্পণ করতে পারে না। তাই কেউ স্নেহ করছে বুঝলেই অমনি বাঁধা পড়বার ভয়ে আমি পালিয়ে যেতুম। ওই দূরে গিয়ে কিন্তু অনেকেরই ভুল ধরা পড়ে গেছে। অনেকেই নাকি আমায় ভালোবেসেছিল, কিন্তু তাদের সকলেরই মনের মিথ্যেটা আমি দেখতে পেয়েছিলুম ওই দূরে সরে গিয়েই। তাদের কেউ আমায় তার জীবন ভরে পেতে চায়নি। আমি পথিক, তাই পথের মাঝে আমায় একটু ক্ষণের জন্যে পেতে চেয়েছিল মাত্র। তাই কেউ আমায় কোনদিনই তার হাতের নাগালের মধ্যেও পেলে না। অনেকে বলে হয়তো এটাও আমার অভিমান। জানি না। কিন্তু দু-এক জায়গায় একটু আত্মবিস্মৃত হয়ে যেই নিকটে আসতে চেয়েছি, অমনি সে আমার দেবতার – আমার ভালোবাসার বুকে জোর পদাঘাত করেছে। তবু কি তুমি বলবে, ও আমার অহেতুক অভিমান?

এইখানে একটা কথা মনে রেখো কিন্তু যে, এই যে যারা আমায় পেতে চেয়েছিল, তাদের সকলেই আগে আমায় ভালোবেসেছিল, আমি কখনও তাদের ভালোবাসিনি। অত পেয়েও আমার মন চিরদিন বলে এসেছে , – এ নহে, এ নহে।

হায় আমার অতৃপ্ত হিয়া! কাকে চাস তুই? কে সে তোর প্রিয়তমা? কে সে গরবিনী, কোথায় কোন্ আঙিনা-তলে তোর তরে মালা-হাতে দাঁড়িয়ে রে?…আমার মনের যে মানসী প্রিয়া, তাকে না পেয়েই তো কাউকে ভালোবাসতে পারলুম না এ জীবনে। কতগুলো কচি বুকই না দলে গেলুম আমার এই জীবনের আরম্ভ হতে না হতেই, তা ভেবে আজ আর আমার কষ্টের অন্ত নেই। তবে আমার এইটুকু সান্ত্বনা যে, আমি কারুর ভালোবাসার অপমান করিনি। কাউকে ভালোবেসেছি বলে প্রলোভন দেখিয়ে শেষে পথে ফেলে চলে যাইনি। উলটো তাদের কাছে দু-হাত জুড়ে ক্ষমাই চেয়েছি, অমনি করে সুদূর থেকেই। আমায় ভালো না বাসতে অনুরোধ করে তার পথ হতে চিরদিনের মতো সরে গিয়েছি। পাছে কোনোদিন কোনো কাজে তার বাধা পড়ে, সেই ভয়ে আর কোনোদিন তার পথের পাশ দিয়েও চলিনি। অনেকে আমায় অভিশাপও দিয়েছে আমার এই নির্মমতার জন্যে, অনেকে আবার অহংকারী দর্পী বলে গালও দিয়েছে।

এমনই করে বিজয়ী বীরের মতো আপন মনে পথে-বিপথে আমার রথ চালিয়ে বেড়াচ্ছিলুম। এমন সময় একদিন সকালে তোমায় আমায় দেখা। হঠাৎ আমার রথ থেমে গেল! আমার মন কী এক বিপুল সুখে আনন্দ-ধ্বনি করে উঠল, – পেয়েছি, পেয়েছি। আমার মনের পথিক-বন্ধু হঠাৎ ম্লান মুখে আমার সামনে এসে বললে – বন্ধু বিদায়! আর তুমি আমার নও; এখন তুমি তোমার মানসীর! তোমার পথের শেষ হয়েছে! দেখলুম, সে পথের শেষে দিগন্তের আঁধারে মিলিয়ে গেল।

এতদিন আমায় শত সাধ্য-সাধনা করেও পথিক-বালারা আমার রথ থামাতে পারেনি, কতজন রথের চাকার সামনে বুক পেতে শুয়ে পড়েছে, আমি হাসতে হাসতে তাদের বুকের উপর দিয়ে রথ চালিয়ে নিয়ে গিয়েছি, কিন্তু হায়, আজ আমার এ কী হল? রথ যে আর চলে না! তুমি শুধু আমার পানে চোখ তুলে চাইলে মাত্র, একটু সাধলেও না যে, পথিক! আমার দ্বারে একটু থামো!

তবু আমার দুঃখ হল না, মান-অপমান জ্ঞান রইল না, আমি মালা-হাতে রথ থেকে নেমে পড়লুম। তোমার গলায় আমার জন্ম-জন্মের সাধের গাঁথা মালা পরিয়ে দিলুম। তুমি নীরবে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলে। তোমার ওই মৌন বুকের ভাষা বুঝতে পারলুম না। প্রাণ যেন কেমন করে উঠল। তুমি সুখী হলে, না ব্যথা পেলে, কিছুই বোঝা গেল না। অমনি চির-অভিমানী আমার বুকে বড়োই বাজল। ভগবান কেন অন্যের মনটি দেখবার শক্তি দেননি মানুষকে? কিন্তু তোমার প্রতি অভিমান আমার যতই হোক, তোমাকে নালিশ করবার কিছুই ছিল না আমার (আজও নেই)। আমি যে তোমার মনটি না জেনেই তোমায় ভালোবেসেছি। চিরদিন জয় করে ফিরে তোমার গলায় যে হার-মানা হার পরিয়েছি – তুমি যে আমার মানসী প্রিয়া। আমার মনে-মনে জন্ম-জন্মান্তর ধরে যে ছবি আঁকা ছিল, যাকে খুঁজতে এমন করে আমার এমন চিরন্তন-পথিক বেশ, সে-মানসীকে দেখেই চিনে নিয়েছি। তাই আমি একটুক্ষণের জন্যেও ভেবে দেখিনি, তুমিও এ পরাজিত বিদ্রোহীর নৈবেদ্য-মালা হেসে গ্রহণ করবে, না পায়ে ঠেলে চলে যাবে। তুমি আমায় ভালো না বাসতে পার, তার জন্যে তো তোমায় দোষ দিতে পারিনে। আমি জানি,খুব জানি প্রিয়, যে কোনো মানুষেরই মন তার অধীন নয়। সে যাকে ভালোবাসতে চায়, যাকে ভালোবাসা কর্তব্য মনে করে, মন তাকে কিছুতেই ভালোবাসবে না। মন তার মনের মানুষের জন্যে নিরন্তর কেঁদে মরছে, সে অন্যকে ভালোবাসতে পারে না। কত জন্ম ধরে তোমায় খুঁজে বেড়িয়েছি এমনই করে, তুমি কিন্তু ধরা দাওনি। এবারেও ধরা দিলে না। কখন কোন্ জন্মে কোন্ নাম-হারা গাঁয়ের পাশে তোমায় আমায় ঘর বাঁধব, কখন তুমি আমায় ভালোবাসবে জানি নে। তবু আমি তোমায় ভালোবাসি, তাই আমার এত বিপুল অভিমান তোমার উপর।

ধরো, আমার এ-অভিমান যদি মিথ্যে হয়, যদি সত্যিই তুমি আমায় ভালোবাস, তা হলে হয়তো মনে করবে যে, আমি কেন তোমায় ভুল বুঝে এমন করে কষ্ট পাচ্ছি। কেন তোমাকে এমন করে ব্যথা দিচ্ছি। সেই কথাটি জানবার জন্যেই কাল সারা রাত্তির ধরে তোমার দয়ার দান চিঠিকটি নিয়ে হাজার বার করে পড়েছি, কিন্তু হায়, তাতেও এমন কিছু পেলুম না, যাতে করে আমার এ নির্মম ধারণা, কঠোর বিশ্বাস দূর হয়ে যেতে পারে। আমার দুঃখে, আমার বেদনায় করুণা-বিগলিত হৃদয়ে অনেক সান্ত্বনা দিয়েছ, অনেক কিছু লিখেছ, অনেক জায়গায় পড়তে পড়তে চোখের জলও বাধা মানে না, কিন্তু ‘তোমায় আমি ভালোবাসি’ এই কথাটি কোথাও লেখনি – ভুলেও না। ওই কথাটি ঢাকবার জন্যে যে সলজ্জ কুণ্ঠা বা আকুলতা, তাও নেই কোনো চিঠির কোনোখানটিতেই। হায় রে অন্ধ বিশ্বাস আমার! তবু এতদিন কত অধিকার নিয়ে কত অভিমান করেই না তোমায় চিঠি দিয়ে এসেছি। সেই লজ্জায় সেই অপমানে আজ আমার বুকের বেদনা শতগুণে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছে, তবু কিন্তু আর তোমায় ছেড়ে দূরে চলে যেতে পারছিনে। এবার যে আমি আগে ভালোবেসেছি! যে আগে ভালোবাসে , প্রায়ই তার এই দুর্দশা এই লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়। তাই বড়ো দুঃখে আজ অবিশ্বাসী নাস্তিকের মতো এই বলে মরতে যাচ্ছি যে, পৃথিবীতে ভালোবাসা বলে কোনো জিনিস নেই। ভালোবেসে ভালোবাসা পাওয়া যায় না এই অবহেলার মাটির ধরায়। মানুষ যে কত বড়ো ঘা খেয়ে অবিশ্বাসী নাস্তিক হয়, তা যে নাস্তিক হয়, সেই বোঝে। জানি যে ভালোবেসে আত্মদানেই তৃপ্তি। বিশ্বাসও করি যে, যাকে সত্যিকার ভালোবাসা যায়, সে অপমান আঘাত করলে হাজার ব্যথা দিলেও তাকে ভোলা যায় না। প্রিয়ের দেওয়া সেই ব্যথাও যেন সুখের মতোই প্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু তাই বলে এত প্রাণ-ঢালা ভালোবাসার বিনিময়ে একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্যে প্রাণটা হা-হা করে কেঁদে ওঠে না, এ যে বলে, সে সত্যি কথা বলে না।

পুরুষ জন্ম-জন্ম সাধনা করেও নারীর মন পায় না। নারীর অন্তরের রহস্য বড়ো জটিল, বড়ো গোপন। নারী সব দিতে পারে, কিন্তু তার মনের গোপন মঞ্জুষার কুঞ্জিকাটি যেন কিছুতেও দিতে চায় না। শুনেছি, কাউকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসলে তবে তার হাতে ওই চাবিকাঠিটি নাকি সমর্পণ করে। তোমার উপর আজ আমার এত অভিমান কেন জান? তুমি আমার সকল আদর সকল সোহাগ আমার দুরন্ত ভালোবাসার সকল বাড়াবাড়ি নীরবে সয়ে গেছ। কখনো এতটুকু প্রতিবাদ করনি। তোমার মুখ দেখে কোনোদিন বুঝতে পারিনি, তুমি আমার সে আদর-সোহাগে ব্যথা পেয়েছ, না সুখী হয়েছ। তোমার মুখে কোনোদিন এক রেখা হাসিও ফুটে উঠতে দেখিনি সে সময়। তাই আজ এই কথাটি ভাবতে বুক আমার ভেঙে পড়ছে যে, হয়তো তুমি দায়ে পড়েই আমার অত বাড়াবাড়ি নীরবে সয়েছ, হয়তো ওতে কত ব্যথাই পেয়েছ মনে মনে। কোনো চিঠিতে ও-কথাটির ভুলেও উল্লেখ করনি। তাই মনে হয়, ওটাকে কোনোরকমে চাপা দেওয়াই তোমার ইচ্ছা। আচ্ছা, তাই হোক! এইবার সকল ভুল সকল যাতনা চিরতরেই চাপা পড়বে, ফিরলেও আর সে-কথা কখনও তুলব না, না ফিরলে তো নয়ই। তাতে প্রাণ যত বেশিই ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাক না কেন। যদি ফিরি, তবে আর একবার আত্মবিদ্রোহী হবার শেষ চেষ্টা করব। কিন্তু হায়! কার কাছে এ-কথা বলছি! কোন্ পাষাণ মৌন-নির্বাক দেবতা আমার এ তিক্ত ক্রন্দন শুনছে? যা বলছিলাম, তাই বলি।

আমি কেন সুখী হতে পারছিনে, জান? সাধারণ লোকের মতোন সহজ ভালোবাসায় তুষ্ট হতে পারছিনে বলে। আমারই চারি পাশে আর সক্কলে কেমন খাচ্ছে-দাচ্ছে, স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করছে আবার তখনই মিল হয়ে যাচ্ছে, – এমনই করে তাদের সুখে-দুঃখে বেশ চলে যাচ্ছে। কিন্তু এই সাধারণের পথ ধরে চলতে পারি নে বলেই ওদের একজন হয়ে সুখী হওয়া তো দূরের কথা, অমনই অসুখীও হতে পারলুম না। ওরা বিয়ে করে , ছেলে-পিলে হয়, বড়ো হলে বে দেয়, জামাই-বউ ঘরে আসে, – ব্যাস, আর কী চাই? ওরই মধ্যে হাসে, কাঁদে, সব করে। ওরা ওতেই সুখী। ওরা যা পেয়েছে তাতেই তুষ্ট। কিন্তু আমার মনে হয়, বেচারাদের শতকরা নব্বই জনই যেন জানে না আর জানতে চায় না যে, যে-মানুষটিকে নিয়ে এতদিন ঘরকন্না করছে, সেই মানুষটির মনটিই তার নয়। দুইজনাই দুই জনের মন কোনোদিন বোঝেনি, বুঝবার দরকারও হয়নি। এত কাছাকাছি থেকেও তাই – মনের দেশে দুইজন দুইজনের সম্পূর্ণ অপরিচিত। এই ফাঁকি আমার চোখে যে-দিন ধরা পড়েছে, সেই দিন থেকে আমি আর কাউকে সাথি করে ঘর বাঁধতে সাহস পাচ্ছিনে। সদা ভয় হয় আর ব্যথাও বাজে এই কথাটি ভাবতে যে, আমারই বুকে মাথা রেখে আমারই জীবন-সঙ্গিনী অন্যের কথা ভাববে, তার ব্যর্থ জীবনের জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলবে, আর আমি তারই কাছে আমার ভালোবাসার অভিনয় করে যাব, সেও দায়ে পড়ে দিব্যি সয়ে যাবে, – উঃ! এ-কথা ভাবতেও আমার গা শিউরে ওঠে! আমি যাকে নিয়ে বাসা বাঁধব, আগে দেখে নেব তার মনের মানুষটি আমার মনের মানুষটিকে চিনেছে কিনা। তা যত জন্ম না হবে, তত জন্ম আমি হয় মায়ের লক্ষ্মী ছেলেটি হয়ে মায়ের কোলেই থাকব, নতুবা লোটা কম্‌লি নিয়ে এমনই বোম্-বোম্ করেই বেড়িয়ে বেড়াব।

আমি মানুষ দেখেই তার মনের কথা ধরে দিতে পারি বলে বড্ডো গর্ব করে এসেছি এতদিন, আর অনেক জায়গাতেই চিনেওছি ঠিক। কিন্তু তোমার কাছে যে এমন করে আমার সকল অহঙ্কার চোখের জলে ডুবে যাবে, তা কে জানত। সত্যই,

‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কখন কে ধরা পড়ে কে জানে।
সকল গরব হায়, নিমেষে টুটে যায়, সলিল বয়ে যায় নয়ানে।’

তা না হলে এতো বড়ো দুর্দান্ত দুর্বার আমাকেও তুমি আজ শিশুর মতোন করে কাঁদাচ্ছ! তুমি আর-সকলের কাছে এত সরল, আর আমার কাছেই কেন এত দুর্বোধ হয়ে পড়েছ, বলতে পারো লক্ষ্মীমণি? – হাঁ, একটি কথা নিবেদন করে রাখি এর মধ্যে, – যখন জীবনে বড্ডো ক্লান্ত হয়ে পড়বে তোমার ভালোবাসার অবমাননা দেখে, যখন দেখবে তোমার বুক-ভরা অভিমান পদাহত হয়ে ধুলোয় পড়ে লুটাচ্ছে, যখন নিরাশায় বুক ভেঙে যেতে চাইবে (ভগবান না করুন), সেদিন এই ভেবে সান্ত্বনা পেয়ো প্রিয় আমার, যে, এই দুঃখের সংসারেও অন্তত একজন ছিল, যে তোমায় বড়ো প্রাণ ভরে ভালোবেসেছিল। বিনিময়ে তার এক কণাও ভালোবাসা সে পায়নি, তবু সে এতটুকু ব্যথা রেখে যায়নি তোমার জন্যে, এমনকী কোনোদিন তোমার কাছে তা নিয়ে অনুযোগও করেনি। সে তোমায় পেলে মাথার মণি করে রাখত। তোমাকে রাজরাজেন্দ্রাণী করবার সকল ক্ষমতা, সকল সাধ তার ছিল। তোমার এত ভালোবাসা এত অভিমানের অধিকারী হলে সে এমন করে তার বিপুল আশা-আকাঙ্ক্ষা-ভরা উদ্দাম তরুণ জীবনকে এত অল্প দিনে ব্যর্থ করে এমন করে বিদায় নিত না। অনেক-অনেক বড়ো কিছু বিশ্বের বিস্ময় হতে পারত। বড়ো ব্যথায় তার সারা জীবনটা বিদ্রোহ আর স্বেচ্ছাচারিতা করেই কেটে গেল। আরও মনে করো যে, পরপারে গিয়েও সে শান্ত হতে পারেনি, চিরদিনের মতো এবারেও সে সেখানে তোমারই তরে মালা হাতে করে তার অশান্ত জীবন বয়ে বেড়াচ্ছে পথে পথে ঘুরে। তোমায় বুকে করে তুলে নেবার জন্যে সে সকল সময় তোমার পানে তার সকল প্রাণ-মন নিয়োজিত করে রেখেছে। সে যে তোমায় সত্যিই ভালোবাসে, তাই প্রমাণ করতে সে তার নিজের গর্দানে নিজে খড়্গ হেনে মরেছে! আরও মনে করো সেই দিন, যাকে তুমি একদিন মনে মনে তোমার সুখের পথের কাঁটা, তোমার জীবনের অভিশাপ মনে করেছিলে, সে-ই তোমার সকল অকল্যাণ সকল অমঙ্গল থেকে বাঁচাবার জন্যেই চিরদিনের মতো তোমার পথ হতে সরে গিয়েছে। মনে করো, যাকে তুমি অনাদর করেছ, তার এককণা ভালোবাসা পাবার জন্যে বহু হতভাগিনি বহুদিন ধরে সাধনা করেছিল, কিন্তু সে কোনোদিন তার মানসী-প্রিয়া – তোমায় ছাড়া আর কারুর পানে একটু হেসেও চাইতে পারেনি, পাছে তোমার অভিমান হয়, পাছে তুমি ব্যথা পাও ভেবে।

আর একটা ছোটো কথা এইখানেই মনে পড়ে গেল। শুনে তুমি হয়তো আমায় কী ভাববে, জানি না। তোমার বিরুদ্ধে যে-যে কারণে আজ এত বড়ো বুক-জোড়া অভিমান নিয়ে যাচ্ছি, এটাও তারই একটা। সেটা আর কিছু নয়, কাল চিঠিগুলো তোমার পড়তে পড়তে হঠাৎ ও-কথাটা মনে পড়ে গেল। তুমি জান, আমি বড্ড হিংসুটে। তোমায় অন্যে ভালোবাসবে, এ-চিন্তাটাও সইতে পারিনে, দেখতে পারা তো দূরের কথা। সকলে তোমার খুব প্রশংসা করুক, তোমায় ভালো বলুক, তাতে খুবই আনন্দ আর গৌরব অনুভব করব, কিন্তু তাই বলে অন্যকে তোমায় ভালোবাসতে তো দিতে পারিনে। আমি চাই, তুমি একা আমার – শুধু আমার – ভিতরে বাইরে পরিপূর্ণরূপে আমার হও, আর আমিও পূর্ণরূপে তোমার হাতে নিজেকে সমর্পণ করে সুখী হই। আমি ছাড়া তোমাকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না – কখনই না, কিছুতেই না। তাই যখনই দেখেছি যে, অন্যে তোমার দিকে একটু চেয়ে দেখেছে আর তুমিও তার পানে হেসে চেয়েছ, অমনি মনে হয়েছে এক্ষুণি গিয়ে তার বুকে ছোরা বসিয়ে দিই। কিন্তু ভগবান তোমাকে রূপ আর গুণ এত অপর্যাপ্ত পরিমাণে দিয়েছেন যে, তোমায় দেখেই লোকে ভালোবেসে ফেলে। তোমাকে ভালোবাসা-পিয়াসী তৃষাতুর মানুষের মন যে ভালো না বেসেই পারে না। তাই কতদিন মনে হয়েছে যে, তোমাকে নিয়ে এমন বিজন বনে পালাই, যেখানে তুমি আর আমি ছাড়া কেউ থাকবে না। চোখ মেললেই আমি তোমাকে দেখব, তুমি আমাকে দেখবে। আমার এ যেন রাহুর প্রেম। নয়? আমায় ছেড়ে অন্যকে তুমি ভালোবাসবে, আমার এই ব্যথাটাই সব চেয়ে মর্মন্তুদ। তাই তো এমন করে তোমার কাছে যাচ্ঞা করে এসেছি যে, আমার চেয়ে বেশি ভালো কাউকে ভালোবাসতে পারবে না – পারবে না। কিন্তু তুমি আমার অত সকরুণ মিনতি শুনেও কোনোদিন কথা কয়ে তা জানাওনি, একটু মিথ্যা করে মাথা দুলিয়েও বলনি, যে, হাঁ গো হাঁ। … শুধু নিস্তব্ধ মৌন হয়ে গেছ। তোমার তখনকার ভাবের মানেটা আজও বুঝতে পারছিনে বলেই আমার এত প্রাণপোড়ানি আর ছটফটানি। আজ আমি বড়ো সুখে মরতে পারতাম, যদি আমার এই চিরদিনের জন্যে ছাড়াছাড়ির ক্ষণেও জানতে পারতাম তোমার সত্যিকার মনের কথা। এখন জানাতে চাইলেও হয়তো আর জানাতে পারবে না। যদিই পারতে, তাহলে হয়তো চির-হতভাগ্য বলে একটু করুণা করে আমায় অনেক কিছু সিক্ত সান্ত্বনা দিয়ে আমায় প্রবোধ দিতে, কিন্তু হায় প্রিয় আমার, এ মৃত্যুপথের পথিককে আর ভুলাতে পারতে না, সে সুযোগ তাই আমি ইচ্ছে করেই দিলাম না তোমায়। যখন তুমি আমার এই চিঠি পড়বে, তখন আমি তোমার নাগালের বাইরে গিয়ে পড়ব। দেখো, আমার আজ মনে হচ্ছে পুরুষদের মতোন বোকা ভ্যাবাকান্ত আর নেই, অন্তত মেয়েদের কাছে। পুরুষ যেমন করে ভালোবাসা পাবার জন্যে হা-হা করে উন্মাদের মতোন ছুটে যায়, তা দেখে মনে হয়, এর এ বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা বুঝি স্বয়ং ভগবানও মেটাতে পারবে না, কিন্তু তাকে একটি ছোট্ট মিষ্টি কথা দিয়ে তোমরা এমনই ভুলিয়ে দিতে পার যে, তা দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়। এত বড়ো দুর্দান্ত দুর্বিনীতকে ওই একটু মিষ্টি করে ‘লক্ষ্মীটি’ বলে একটু কপালে গিয়ে হাতটি রাখলে, বা গিয়ে তার হাতটি ধরলেই সে যত দূর হতে-পারা-সম্ভব সুশীল সুবোধ বালকটির মতোন শান্ত হয়ে পড়ে। তোমার মনে কী আছে তা ভেবে দেখতে চায় না, ওই একটু পেয়েই ভালোবাসার কাঙাল পুরুষ এত বেশি বিভোর হয়ে পড়ে। তবু তোমরা এই বেচারা হতভাগা পুরুষদের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ধরা দাও না। কিছুতেই তোমাদের মনের কথাটি পাওয়া যায় না, সব ভালোবাসাটুকু পাওয়ার আশা তো মরীচিকার পেছনে ছোটার মতোই। কোথায় যেন তোমাদের মনের সীমারেখা, কোথায় যেন তোমাদের ভালোবাসার তল, কোথায় যেন তার শেষ! আমি তাই অবাক হয়ে অনেক সময় ভাবি আর ভাবি! মনে কোরো না যে, এগুলো সকলেরই মনের ভাব। আমি আমার এখনকার মনের ভাবগুলো সোজাসুজি জানাচ্ছি। তোমার সঙ্গে তা না মিলতেও পারে। এমনি করে পুরুষ নারীর কাছে চিরদিন প্রতারিত হয়ে আসছে। কারণ, তারা বাইরে যতো বড়ো কর্মী বিদ্বান আর বীর হোক না কেন, তোমাদের কাছে তারা একের নম্বর বোকা, একেবারে ভেড়া বনে যায় বললেও অত্যুক্তি হয় না। তোমাদের কাছে থেকেও তোমাদের মন বুঝতে স্বয়ং ভগবান পারবে না, এ আমি আজ জোর গলায় বলছি। তোমরা নারী, তোমাদের স্বভাবই হচ্ছে স্নেহ করা, সেবা করা, যে কেউ হোক না কেন, তার দুঃখ দেখলে তোমাদের প্রাণ কেঁদে ওঠে, একটু সেবা করতে ইচ্ছা হয়। ওতে তোমাদের গভীর আত্মপ্রসাদ, নিবিড় তৃপ্তি। এইখানে তোমরা দেবী, সন্ন্যাসিনী। এই ব্যথিতের ব্যথা মুছাতে তোমরা সকল রকম ত্যাগ স্বীকার করতে পার, কিন্তু তাই বলে সবাইকে ভালোবাসতে পার না, আর ভালোবাসও না। এইখানে পুরুষ সাংঘাতিক ভুল করে বসে। তোমাদের ওই সেবা আর করুণাটুকু সে ভালোবাসা বলে ভুল করে দেখে, অবশ্য যদি সে তোমায় ভালোবেসে ফেলে। আর যাকে জান যে, সে সত্যি-সত্যিই তোমাকে বড়ো প্রাণ দিয়েই ভালোবাসে, অথচ তুমি কিছুতেই তাকে ভালোবাসতে পারছ না; তা হলে তার জন্যেও তুমি সকল রকম বাইরের ত্যাগ স্বীকার করতে পার, তার সেবা কর, শুশ্রূষা কর, তার ব্যথায় সান্ত্বনা দাও, কত চোখের জল ফেল করুণায়, – তবু কিন্তু ভালোবাসতে পার না। বাইরের সব সুখে জলাঞ্জলি দিতে পার তার জন্যে, কিন্তু মনের সিংহাসনে রাজা করে কিছুতেই তাকে বসাতে পার না।

কিন্তু অন্ধ অবোধ পুরুষ তোমাদের ওই স্বভাবজাত করুণাকেই ভালোবাসা মনে করে বড়ো বেশি আনন্দ পায়, সুখ অনুভব করে। হায় রে অভাগা! তাকে পরে তার জন্যে আবার দুঃখও পেতে হয় অনেক গুণ বেশি। কারণ, মিথ্যা যা, তা একদিন-না একদিন ধরে পড়েই। হঠাৎ একদিন নিশীথে বুকে জড়িয়ে ধরেও সে ধরে ফেলে যে, আমার এই নিকটতম মানুষটি আমার সব চেয়ে সুদূরতম। আমার বুকে থেকেও এ আমার নয়। একে হারিয়েছি, হারিয়েছি এ জনমের মতো। সে যাতনা যে কী নিদারুণ, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। এ ভুল-ভাঙার সাথে সাথে অনেকেরই বুক নিষ্করুণভাবে ভেঙে যায়, তার জীবন চিরতরে নিষ্ফল ব্যর্থ হয়ে যায়! সে তখন নির্মম আক্রোশে নিজের উপর নির্দয়তম ব্যবহার করে নিজের সে ভুলের শোধ নেয়। সে আত্মহত্যা করে, এক নিমেষে নয়, একটু একটু করে কচলিয়ে কচলিয়ে। তোমাদের নারী জাতিকে আমি খুব বেশি শ্রদ্ধা করি, প্রাণ হতে তাদের মঙ্গল কামনা করি, কিন্তু তাদের উপর এই অভিযোগ চিরদিন রয়ে গেল যে, তারা পুরুষের ভালোবাসার বড়ো অনাদর করে, বড়ো অবহেলা অপমান করে। তারা নিজেও জীবনে সুখে হয় না, অন্যকেও সুখী করতে পারে না। আমাদের সমাজের বেদনার সৃষ্টি এইখানেই। যে তাকে সকল রকমে সুখী করে তার বাহিরে ভিতরে রানি করে দেবী করে রাখতে পারত, রূপ-যৌবন-গরবিনি নারী তাকে পায়ে মাড়িয়ে চলে যায়। সে হতভাগার রক্তঝরা প্রাণের উপর দিয়ে পায়ে আলতা পরে। পরে তাকে এর জন্যে অনুতাপ করতে হয় সারাটা জীবন ধরে, তা জানি। ভালোবাসাকে অবমাননা করে সে-ও জীবনে আর ভালোবাসা পায় না, তখন তার জীবন বড়ো দুর্বিষহ হয়ে পড়ে, বিষিয়ে ওঠে! তখন হয়তো তার বেশি করে তাকেই মনে পড়ে, যে তার এক কণা ভালোবাসা পেলে আজ তাকে মাথায় নিয়ে নাচত। তোমরা হয়তো ভুরু কুঁচকে বলবে, এ আমার মিথ্যা ধারণা। তা বলো, আমি যা দেখছি, তাই বলছি। তোমরা একটা কথা বলবে – ‘নারী বড়ো ভালোবাসার কাঙালিনি। একটু আদর পেলে তাকে সে মনে প্রাণে ভালোবেসে ফেলে।’

শুনে হাসি পায় আমার! একটু আদর তো ছোটো কথা, জন্ম-জন্ম ধরে পাখিটির মতো করে বুকে রেখে, আদর-সোহাগ করে ভালোবেসেও তোমার মন পাইনি, শুধু এই একটা উদাহরণ দেখিয়েই ক্ষান্ত হলুম। আমার মতোন হতভাগা দু-দশটা প্রায়ই দেখতে পাবে পথে ঘাটে টো-টো কোম্পানির দলে। নেহাৎ চোখের মাথা না খেলে তোমরা তা অস্বীকার করতে পারবে না।

যাক, হিংসার কথা বলতে গিয়ে কী সব বকলুম। আমি বলতে চাই যে, আমি তোমায় দেখিয়ে-দেখিয়ে তোমারই চোখের সামনে একে ওকে কত আদর করেছি, কিন্তু কোনোদিন তোমার তাতে হিংসে হয়নি। তুমি কোনোদিন বাইরে ভিতরে এতটুকু চঞ্চল বা বিচলিত হওনি। তুমি মনে মনে জান যে, তুমি আমার নও, তুমি আমায় ভালোবাসতে পার না, অতএব আমি যাকেই যত আদর ভালোবাসা দেখাই, তাতে তোমার কিছুই আসে যায় না। আমার উপর যখন তুমি কোনো দাবিই রাখ না, তখন আমায় যে-কেউ ভালোবাসুক বা আমি যাকেই ভালোবাসি, তাতে তোমার কী আসে যায়?

আমার এখন মনে হচ্ছে কী জান? আমি যদি তোমার চেয়েও সুন্দরী মেয়ে হতে পারতুম, তাহলে তোমার ভালোবাসার মানুষটিকে ভালোবেসে দেখতুম তোমার বুকে কেমন ব্যথা বাজে, কত বেদনা লাগে!

এত কথা কেন জানালুম, জান? আমি আজ রাজবন্দি। প্রেসিডেন্সি জেলের হাজতে বসে তোমায় এই চিঠি দিচ্ছি। কাল আমার বিচার হবে। বিচারে দুটি বছরের সশ্রম কারাদন্ড তো হবেই। জেলের এক কর্মচারী দৈবক্রমে আমারই এক বন্ধু – শৈশব কালের। আমাদের আজ আশ্চর্য রকমের দেখাশোনা। স্কুলে আমাদের দুইজনের মধ্যে বরাবর ক্লাসে ফার্স্ট কে হবে এই নিয়ে জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলত। ওরই কৃপায় এত বড়ো চিঠি এমন করে লেখবার অবসর আর সাজ-সরঞ্জাম পেয়েছি, তা না হলে কারুকখে কোনো কিছু জানিয়ে যেতে পারতুম না। ভগবান বন্ধুর আমার মঙ্গল করুন!

তুমি মনে করবে, মাত্র দু-বছরের জেল হবে হয়তো, তার জন্যে এমন বিদায়-কান্না কেন? আবার তো ফিরে আসব। কিন্তু আমি জানি, আমি আর ফিরব না। তোমায় এতদিন বলিনি, লুকিয়ে রেখেছিলুম, কিন্তু আজ যাবার দিনে কষ্ট পাবে জেনেও জানিয়ে যাচ্ছি। আমার যক্ষ্মা হয়েছে – যাকে আমাদের দেশে শিবের অসাধ্য রোগ বলে। ডাক্তার কতবার আমায় পরিশ্রম করতে মানা করেছে, আমার কত বন্ধু আমায় কত মিনতি করে হাতে-পায়ে ধরে এখন কিছু দিনের জন্যে বিশ্রাম করতে বলেছে, আর আমি ততই দ্বিগুণ বেগে কাজ করেছি। সে সময় তুমি যদি আমায় একটিবার মানা করতে! করুণা করে নয় – ভালোবেসে, তাহলে কী করতুম, জানি না। কিন্তু তুমি তো আর আমার এ ভীষণ রোগের খবর জানতে না! তাহলে দয়া করে হয়তো আমায় মিনতি করে লিখতে ভালো হবার জন্যে। …

তবু কিন্তু তোমার সকল শাসন মেনে চলছি আমি আমার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। এমন করে আর কেউ আমায় কথা শোনাতে পারেনি, এ-বিশ্বে এত বড়ো স্পর্ধা তুমি ছাড়া আর কারুর হয়নি যে, আমায় শাসন করে, হুকুম শোনায়! – যদি কোনো অপরাধ করে থাকি তোমার কাছে কোনোদিন, তবে তা ভুলে যেও না, ক্ষমা করো এই ভেবে যে, তুমি যাকে কিছুতেই ভালোবাসতে পারনি, সেই তোমার সকল কথা তার শেষ দিন পর্যন্ত খোদার পবিত্র বাণীর চেয়েও পবিত্রতর মনে করে মেনে চলেছে। এইটুকু ভেবে পার তো একটু আনন্দ অনুভব করো। আমার মতোন দুর্জয় বাঁধন-হারাকে তুমি জয় করেছিলে, এই ভেবেও একটু গৌরব করো।

দু-বছর না হয়ে যদি মাত্র ছয় মাসেরও সশ্রম কারাদন্ড হয় আমার, তাহলেও আমার ফিরবার কোনো আশা নেই। যক্ষ্মায় আমার শরীরটাকে খেয়ে ফেলেছে, আর ব্যথায় আমার বুকে ঘুণ ধরিয়ে দিয়েছে। এর উপর জেলের খাটুনি। কখন যে আমার হৃদক্রিয়া হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাবে, তা বলতে পারি নে। এখনই একটু পরিশ্রম করলেই আমার নাকে মুখে অজস্র ধারে রক্ত নির্গত হয়। হয়তো ইচ্ছা করলে বাঁচতেও পারতুম, কেননা আমার ইচ্ছাশক্তির ও প্রাণ-শক্তির উপর আমার গভীর বিশ্বাস আছে। কিন্তু আর সে ইচ্ছা নেই লক্ষ্মী। এখন ফিরাতে এলেও হয়তো আমি ফিরতে পারতুম না। বড়ো দুঃখেই বলতে হত, – ‘অবেলায় প্রিয়তম , এ যে অবেলায়!’ তাছাড়া, বাঁচতে পারতুম যদি জীবনটাকে অন্য কোনো বড়ো দিক দিয়ে সার্থক করে তুলতে পারতুম, তাও পারলুম না। অনেক চেষ্টা-চরিত্তির করে দেখা গেল। আর পারবও না। তাই আজ হাল ছেড়ে দিয়ে বলছি, – ‘সন্ধে হল গো, এবার আমায় বুকে ধরো।’ এত শীঘ্র এমন করে ধরা পড়ব, তা আমি দু-দিন আগে স্বপ্নেও ভাবিনি। কেননা আমার আশা ছিল, এর চেয়েও অনেক বড়ো কাজ করে মরণ-বরণ করা। কিন্তু তা আর ঘটে উঠল না। কারণগুলো জেনে আর কী হবে বল!

তবে বিদায় হই। বিদায়-বেলায় অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছি, যেন তুমি জীবনে একটি দিন সত্যিকার ভালোবেসে দুঃখ পেয়ে আমার ব্যথা বোঝো! তোমার জীবনের অভিশাপ আজ এ পৃথিবী ছেড়ে চলল! আর ভয় নেই!

হাঁ, যদি পার আশীর্বাদ করো, যেন এবার জন্ম নিলে তুমি যাকে ভালোবাস, সে-ই হয়ে জন্মগ্রহণ করি! – ইস্! কী অন্ধকার! … ইতি –

তোমার চির-জীবন-জোড়া অভিশাপ আর অমঙ্গল –
শ্রীধূমকেতু

Exit mobile version