আঃ! এতক্ষণ আকাশটা বেরোবার একটু ফঁক পেয়েছে।
রাশি রাশি জল-ভরা মেঘের ফাঁকে একটু একটু নীল আশমান দেখা যাচ্ছে। সে কত সুন্দর! ঠিক যেন অশ্রুভরা চোখের ঈষৎ একটু সুনীল রেখা!
থাক গে, এখন অন্য সময় বাকি কথাগুলো লেখা যাবে। মরা বন্ধুর আত্মা হয়তো আমার উপর চটে উঠেছে এতক্ষণ। কি বন্ধু, একটু জল দেব নাকি মুখে? – ইস, হাঁ করে তাকাচ্ছেন দেখ! না বন্ধু – না, তোমার পরপারের প্রিয়তমা হয়তো তোমার জন্যে শরবতের গেলাস-হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে! আহা, সে বেচারিকে বঞ্চিত করব না তার সেবার আনন্দ হতে!
আজ কত কথাই মনে হচ্ছে, – না – না, কিছু মনে হচ্ছে না, সব ঝুটা! – ফের লুইস গানটায় গুলি চালানো যাক! – আমার সাহায্যকারী কয়জন বেশ তোয়াজ করে ঘুমিয়ে নিলে তো দেখছি!
ওই – ওই, পাশে কাদের তালে তালে পা মিলিয়ে চলার শব্দ পাচ্ছি! ঝপ ঝপ ঝপ – লেফট রাইট লেফট! ওই মিলিয়ে চলার শব্দটা কী মধুর! ও বুঝি আমাদের ‘রিলিভ’ করতে আসছে অন্য পলটন।
উঃ! এতটুকু অসাবধানতার জন্যে হাতের এক টুকরো মাংস ছিঁড়ে নিয়ে গেল দেখছি একটি গুলিতে!
ব্যান্ডেজটা বেঁধে নিই নিজের। নার্সগুলোকে আমি দুচোখে দেখতে পারিনে। নারী যদি ভালো না বেসে সেবা করে আমার, তবে সে সেবা আমি নেব কেন?
আঃ যুদ্ধের এই খুনোখুনির কী মাদকতা-শক্তি! মানুষ মারার কেমন একটা গাঢ় নেশা!
পাশে আমার চেয়ে অত বড়ো জোয়ানটা এলিয়ে পড়েছে দেখছি! আমি দেখছি শরীরের বলের চেয়ে মনের বলের শক্তি অনেক বেশি।
লুইস গানে এক মিনিটে প্রায় ছয়-সাতশো করে গুলি ছাড়ছি। যদি জানতে পারতুম, ওতে কত মানুষ মরছে! – তা হোক এই দু-কোণের দুটো লুইস গানই শত্রুদের জোর আটকিয়ে রেখেছে কিন্তু।
কী চিৎকার করে মরছে শত্রুগুলো দলে দলে! কী ভীষণ সুন্দর এই তরুণের মৃত্যুমাধুরী!
সিঁন নদীর ধারে তাম্বু, ফ্রান্স
এই দুটো দিনের ৪৮ ঘন্টা খালি লম্বা ঘুম দিয়ে কাটিয়ে দেওয়া গেল। এখন আবার ধড়া-চুড়ো পরে বেরোতে হবে খোদার সৃষ্টি নাশ করতে। এই মানুষ-মারা বিদ্যে লড়াইটা ঠিক আমার মতো পাথর-বুকো কাঠখোট্টা লোকেরই মনের মতো জিনিস।
আজ সেই বিদেশিনি কিশোরী আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। কী পরিষ্কার সুন্দর ফিটফাট বাড়িগুলো এদের! – মেয়েটা আমাকে খুব ভালোবেসেছে। আমিও বেসেছি। আমাদের দেশ হলে বলত মেয়েটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে! কুড়ি একুশ বছরের একজন যুবকের সঙ্গে একটা কুমারী কিশোরীর মেলা-মেশা আদৌ পছন্দ করত না!
ভালোবাসাটাকে কী কুৎসিত চক্ষে দেখেছে আজকাল লোকেরা! মানুষ তো নয়, যেন শকুনি! – দুনিয়ায় এত পাপ! মানুষ এত ছোটো হল কী করে? – তাদের মাথার উপর অমন উদার অসীম নীল আকাশ, আর তার নীচে মানুষ কী সংকীর্ণ, কী ছোটো!
আগুন, তুমি ঝরো – ঝম ঝম ঝম! খোদার অভিশাপ, তুমি নেমে এসো ওই নদীর বুকে জমাট বরফের মতো হয়ে – ঝুপ ঝুপ ঝুপ! ইসারাফিলের শিঙ্গা, তুমি বাজো সবকে নিঃসাড় করে দিয়ে – ওম ওম ওম! প্রলয়ের বজ্র, তুমি কামানের গোলা আর বোমার মধ্যে দিয়ে ফাটো ঠিক মানুষের মগজের উপর – দ্রুম-দ্রুম-দ্রুম! আর সমস্ত দুনিয়াটা – সমস্ত আকাশ উলটে ভেঙে পড়ো তাদের মাথায়, যারা ভালোবাসায় কলঙ্ক আনে, ফুলকে অপবিত্র করে।
এখন যে সাজে সেজেছি, ঠিক এই রকম সাজে যদি আমাদের দেশের একটা লোককে সাজিয়ে উলটে ফেলে দিই, তাহলে হাজার ধ্বস্তাধ্বস্তি করেও সে আর উঠতে পারবে না। আমার নিজেরই হাসি পাচ্ছে আমার এখনকার এই গদাই-লশকরি চেহারা দেখে!
আমার এক ‘ফাজিল’ বন্ধু বলেছেন – ‘কী নিমকিন চেহারা!’ – আহা কী উপমার ছিরি! কে নাকি বলেছিল, – ‘ষাঁড়টা দেখতে যেন ঠিক কাতলা মাছ!’
ফ্রান্স
প্যারিসের পাশের ঘন বন
কাল হঠাৎ এই মস্ত জঙ্গলটায় আসতে হল। কেন এ রকম পিছিয়ে আসতে হল তার এতটুকুও জানতে পারলুম না! এ মিলিটারি লাইনের ওইটুকু সৌন্দর্য! তোমার উপর হুকুম হল, ‘ওই কাজটা করো!’ ‘কেন ও-রকম করব?’ তার কৈফিয়ত চাইবার কোনো অধিকার নেই তোমার। বাস – হুকুম! যদি বলি, ‘মৃত্যু যে ঘনিয়ে আসছে!’ অমনি বজ্রগম্ভীর স্বরে তার কড়া জবাব আসবে, – ‘যতক্ষণ তোমার নিশ্বাস আছে, ততক্ষণ কাজ করে যাও; যদি চলতে চলতে তোমার ডান পায়ের উপর মৃত্যু হয়, তবে বাম পা পর্যন্ত চলো!’
আঃ এই হুকুম মানায়, এই জীবন-পণ আনুগত্যে কত সে নিবিড় মাধুরী! বাজের মাঝে এ কী কোমলতা! যদি সমস্ত দুনিয়াটা এমনই একটা (এবং কেবল একটা) সামরিক শক্তির অধীন হয়ে যেত, তা হলে এই মাটির জমিনই এমন একটা সুন্দর স্থান হয়ে দাঁড়াত যাকে ‘জিন্নাতুল বাকিয়া’ (শ্রেষ্ঠতম স্বর্গ) বললেও লোক তৃপ্ত হত না!
কী শৃঙ্খলা এই ব্রিটিশ জাতিটার কাজে-কর্মে কায়দা-কানুনে, তাই তারা আজ এত বড়ো। উপর দিকে চাইতে গিয়ে আমাদের মাথার পাগড়ি পড়ে গেলেও তাদের মাথাটা দেখতে পাব না! মোটামুটি বলতে গেলে তাদের এই দুনিয়া-জোড়া রাজত্বিটা একটা মস্তো বড়ো ঘড়ি, আর সেটা খুবই ঠিক চলছে, কেননা তার সেকেন্ডের কাঁটা থেকে ঘন্টার কাঁটা পর্যন্ত সব তাতে বড্ডো কড়া বাঁধাবাঁধি একটা নিয়ম। সেটা আবার রোজই ‘অয়েল্ড’ হচ্ছে তার কোথাও একটু জং ধরে না।
আমরাই নিয়ে গেলুম জার্মানদের ‘হিন্ডেনবার্গ লাইন’ পর্যন্ত খেদিয়ে, আবার আমাদেরই এতটা পিছিয়ে যেতে হল! – ঘড়িটা যে তৈরি করেছে, সে জানে কোন্ কাঁটার কোন্খানে কী কাজ, কিন্তু কাঁটা কিছু বুঝতে পারে না। তবু তাকে কাজ করে যেতে হবে, কেননা, একটা স্প্রিং অনবরত তার পেছন থেকে তাকে গুঁতো মারছে!