আমি অন্ধ দারার সঙ্গে আবার এই গোলেস্তানেই এলাম! আর এই তো আমার ব্যর্থ জীবনের সান্ত্বনা, এই নির্বিকার বীরের সেবা! দারা আমায় ক্ষমা করেছে, আমায় সখা বলে কোল দিয়েছে! এতদিনে না এই হতভাগ্য যুবকের রিক্ত জীবন সার্থকতার পুষ্পে পুষ্পিত হয়ে উঠল! এতদিনে না সত্যিকার ভালোবাসায় তাকে ওই অসীম আকাশের মতোই অনন্ত উদার করে দিলে! রাস্তায় আসতে আসতে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, – ‘আচ্ছা ভাই, তুমি বেদৌরাকে ক্ষমা করেছ?’ সে কান্না-ভরা হাসি হেসে সাধকশ্রেষ্ঠ প্রেমিক রুমীর এই গজলটা গাইলে – ‘ওগো প্রিয়তম! তুমি যত বেদনার শিলা দিয়ে আমার বুকে আঘাত করেছ, আমি তাই দিয়ে যে প্রেমের মহান-মসজিদ তৈরি করেছি!’
আমার বিশ্বাস, শিশুদের চেয়ে সরল আর কিছু নেই দুনিয়ায়। দারাও প্রেমের মহিমায় যেন অমনই সরল শিশু হয়ে পড়েছে। তার মুখে কেমন সহজ হাসি, আবার কেমন অসংকোচ কান্না! তা কিন্তু অতি বড়ো পাষাণকেও কাঁদায়! আমি সেদিন হাসতে হাসতে বললাম, – ‘হাঁ ভাই, এই যে অন্ধ আর বধির হলে, এতে মঙ্গলময়ের কোনো মঙ্গলের আভাস পাচ্ছ কি?’ সে বললে, – ‘ওরে বোকা, এই যে তোদের আজ ক্ষমা করতে পেরেছি – এই যে আমার মনের সব গ্লানি সব ক্লেদ ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে গিয়েছে, সে এই অন্ধ হয়েছি বলেই তো, – এই বাইরের চোখ দুটোকে কানা করে আর শ্রবণ দুটোকে বধির করেই তো! অন্ধেরও একটা দৃষ্টি আছে, সে হচ্ছে অর্ন্তদৃষ্টি যা অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি। এখন আমি দেখছি দুনিয়া-ভরা শুধু প্রিয়ার রূপ আর তারই হাসির অনন্ত আলো! আর এই কালা কান দুটো দিয়ে কী শুনছি, জানিস? শুধু তার কানে-কানে-বলা গোপন-প্রেমালাপের মঞ্জু গুঞ্জন আর চরণ-ভরা মঞ্জীরের রুনু-ঝুনু বোল! – আমি যে এই নিয়েই মশগুল!’ বলেই অভিভূত হয়ে সে গান ধরলে, –
‘যদি আর কারে ভালোবাস, যদি আর ফিরে নাহি আস,
তবে তুমি যাহা চাও, তাই যেন পাও, আমি যত দুখ পাই গো!
আমার পরান যাহা চায়, তুমি তাই তুমি তাই গো,
তোমা ছাড়া মোর এ জগতে আর কেহ নাই কিছু নাই গো!’ –
কানাড়া রাগিণীর কোমল গান্ধারে আর নিখাদে যেন তার সমস্ত আবিষ্ট বেদনা মূর্তি ধরে মোচড় খেয়ে খেয়ে কেঁদে যাচ্ছিল! – কিন্তু কত শান্ত স্নিগ্ধ বিরাট নির্ভরতা আর ত্যাগ এই গানে!
সবচেয়ে আমার বেশি আশ্চর্য বোধ হচ্ছে যে, বেদৌরাও আমাকে ক্ষমা করেছে, অথচ তার এ-বলায় এতটুকু কৃত্রিমতা বা অস্বাভাবিকতা নেই। এ যেন প্রাণ হতে ক্ষমা করে বলা!
খোদা, তুমি মহান! ‘যার কেউ নেই তুমি তার আছ।’ এই প্রেমিকদের সোনার কাঠির স্পর্শে আমি যে আমি, তারও আর কোনো গ্লানি নেই, সংকোচ নেই।
আজ এই বিনা কাজের আনন্দ, – ওঃ তা কত মধুর আর সুন্দর!
০৫. বেদৌরার কথা
গোলেস্তান
(নির্ঝরের অপর পার)
তিনি আমায় ক্ষমা করেছেন একেবারে প্রাণ খুলে হৃদয় হতে! এবার এ-ক্ষমায় এতটুকু দীনতা নেই। এ যে হবেই, তাতো আমি জানতামই, আর তাই যে এমন করে আমার প্রতীক্ষার সকাল-সাঁঝগুলি আনন্দেই কেটে গিয়েছে! আমার এই আশায় বসে-থাকা দিনগুলির, বিরলে-গাঁথা ফুলহারগুলি আর বেদনাবারিসিক্ত বিরহ-গানগুলি তাঁরই পায়ে ঢেলে দিয়েছি। তিনি তা গলায় তুলে তার বিনিময়ে যা দিয়েছেন, সেই তো গো তাঁর আমায়-দেওয়া ব্যথার দান!
তিনি বললেন, – ‘বেদৌরা! কামনা আর প্রেম, এ দুটো হচ্ছে সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। কামনা একটা প্রবল সাময়িক উত্তেজনা আর প্রেম হচ্ছে ধীর, প্রশান্ত ও চিরন্তন। কামনার প্রবৃত্তি বা তার নিবৃত্তিতে হৃদয়ের দাগ-কাটা ভালোবাসাকে যে ঢাকতেই পারে না, এ হচ্ছে ধ্রুব সত্য। এই রকম বিড়ম্বিত যে বেচারারা এই কথাটা একটু তলিয়ে দেখে ধীরভাবে বিশ্বাস করে না, তারা মস্ত ভুল করে, আর তাদের মতো হতভাগ্য অশান্তির জীবনও আর কারুর নেই। – বাদলার দিনে কালো মেঘগুলো সূর্যকে গ্রাস করতে যতই চেষ্টা করুক, তা কিন্তু পারে না। তবে তাকে খানিকক্ষণের জন্যে আড়াল করে থাকে মাত্র। কেননা সূর্য থাকে মেঘের নাগাল পাওয়ার সে অনেক দূরে। কোন্ ফাঁকে আর সে কেমন করে যে অত মেঘের পুরু স্তর ছিঁড়ে রবির কিরণ দুনিয়ার বুকে প্রতিফলিত হয়, তা মেঘও ভেবে পায় না, আর আমরাও জানতে চেষ্টা করিনে। তার পর মেঘ কেটে গেলেই সূর্য হাসতে থাকে আরও উজ্জ্বল হয়ে। কারণ তাতে তো সূর্যের কোনো অনিষ্টই হয় না, – সে জানে, সে যেমন আছে তেমনই অটুট থাকবেই; ক্ষতি যা তোমার আমার – এ দুনিয়ার। তাই বলে কি বাদলের মেঘ আসবে না? সে এসে আকাশ ছাইবে না? সে আসবেই, ও যে স্বভাব; তাকে কেউ রুখতে পারবে না। তবে অত বাদলেও সূর্যকিরণ পেতে হলে মেঘ ছাড়িয়ে উঠতে হয়। সেটা তেমন সোজা নয়, আর তা দরকারও করে না – কামনাটা হচ্ছে ঠিক এই বাদলের মতো; আর প্রেম জ্বলছে হৃদয়ে ওই রবিরই মতো একইভাবে সমান ঔজ্জ্বল্যে!
‘কামনায় হয়তো তোমার বাহিরটা নষ্ট করেছে, কিন্তু ভিতরটা নষ্ট তো করতে পারেনি। তাছাড়া, ও না হলে যে তুমি আমাকে এত বেশি করে চিনতে না, এত বড়ো করে পেতে না। বাইরের বাতাস প্রেমের শিখা নিবাতে পারে না, আরও উজ্জ্বল করে দেয়। আর আমার অন্ধত্ব ও বধিরতা? ওর জন্যে কেঁদো না বেদৌরা, এগুলো থাকলে তো আমি তোমায় আর পেতাম না!’
পুষ্পিত সেব গাছ থেকে অশ্রুচাপা কণ্ঠে ‘পিয়া পিয়া’ করে বুলবুলগুলো উড়ে গেল।