পাপী যদি সাজা পায়, তা হলে সে এই বলে শান্তি পায় যে তার উপর অবিচার করা হচ্ছে না, এই শাস্তিই যে তার প্রাপ্য। কিন্তু শাস্তি না পেলে ভিতরের বিবেকের যে দংশন, তা নরক-যন্ত্রণার চেয়ে অনেক বেশি ভয়ানক।
যা ভাবলুম, তা আর হল কই! ঘুরতে ঘুরতে শেষে এই মুক্তিসেবক সৈন্যদলের দলে যোগ দিলুম। এ পরদেশিকে তাদের দলে আসতে দেখে এই সৈন্যদল খুব উৎফুল্ল হয়েছে। এরা মনে করছে, এদের এই মহান নিঃস্বার্থ ইচ্ছা বিশ্বের অন্তরে অন্তরে শক্তি সঞ্চয় করছে। আমায় আদর করে এদের দলে নিয়ে এরা বুঝিয়ে দিলে যে কত মহাপ্রাণতা আর পবিত্র নিঃস্বার্থপরতা-প্রণোদিত হয়ে তারা উৎপীড়িত বিশ্ববাসীর পক্ষ নিয়ে অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, – এবং আমিও সেই মহান ব্যক্তিসংঘের একজন। আমার কালো বুকে অনেকটা তৃপ্তির আলোক পেলুম! –
খোদা, আজ আমি বুঝতে পারলুম, পাপীকেও তুমি ঘৃণা কর না, দয়া কর। তার জন্যেও সব পথই খোলা রেখে দিয়েছ। পাপীর জীবনেরও দরকার আছে। তা দিয়েও মঙ্গলের সলতে জ্বালানো যায়। সে ঘৃণ্য অস্পৃশ্য নয়!
কিন্তু সহসা এ কী দেখলুম? দারা কোথা থেকে এখানে এল? সেদিন তাকে অনেক জিজ্ঞেস করায় সে বললে, – ‘এর চেয়ে ভালো কাজ আর দুনিয়ায় খুঁজে পেলুম না, তাই এ-দলে এসেছি।’ আঘাত খেয়ে খেয়ে কত বিরাট গম্ভীর হয়ে গিয়েছে সে! আমাকে ক্ষমা চাইতেই হবে যে এই বেদনাতুর যুবকের কাছে; নইলে আমার কোথাও ক্ষমা নেই। এর প্রাণে এই ব্যথার আগুন জ্বালিয়েছি তো আমিই, একে গৃহহীন করেছি তো আমিই।
কী অচিন্ত্য অপূর্ব অসমসাহসিকতা নিয়ে যুদ্ধ করছে দারা। সবাই ভাবছে, এত অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রাণের প্রতি ভ্রুক্ষেপও না করে বিশ্ববাসীর মঙ্গলের জন্যে হাসতে হাসতে যে এমন করে বুকের রক্ত দিচ্ছে, সে বাস্তবিকই বীর, আর তাদের জাতিও বীরের জাতি! এমন দিন নেই, যেদিন একটা-না-একটা আঘাত আর চোট খেয়েছে সে। সেদিকে কিন্তু দৃষ্টিই নেই তার। সে যেন অগাধ অসীম এক যুদ্ধ-পিপাসা নিয়ে প্রচণ্ড বেগে মৃত্যুর মতো কঠোর হয়ে অন্যায়কে আক্রমণ করছে। যতক্ষণ এতটুকুও জ্ঞান থাকে তার, ততক্ষণ কার সাধ্য তাকে যুদ্ধস্থল থেকে ফেরায়! – কী একরোখা জেদ! আমি কিন্তু বুঝতে পারছি, এ সংগ্রাম তার বাইরের জন্যে নয়, এ যে ভিতরের ব্যথার বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভিযান। আমি জানি, হয় এর ফল অতি বিষময়, নতুবা খুবই শান্তসুন্দর!
কদিন থেকে বোমা আর উড়োজাহাজ হয়েছে এর সঙ্গী। বাইরে ভিতরে এত আঘাত এত বেদনা অম্লান বদনে সহ্য করে কী করে একাদিক্রমে যুদ্ধ জয় করছে এই উন্মাদ যুবক! ভয়টাকে যেন এ আরব সাগরে বিসর্জন দিয়ে এসেছে! আজ সে একজন সেনাপতি। কিন্তু এ কী অতৃপ্তি এখনও তার মুখে বুকে জাগছে! রোজই জখম হচ্ছে, কিন্তু তাকে হাসপাতালে পাঠায় কার সাধ্য? গোলন্দাজ সৈনিককে ঘুমাবার ছুটি দিয়ে ভাঙা-হাতেই সে কামান দাগছে। সেনাপতি হলেও সাধারণ সৈনিকের মতো তার হাতে গ্রিনেডের আর বোমার থলি, পিঠে তরল আগুনের ভালোতি, আর হাতে রিভলভার তো আছেই। রক্ত বইয়ে, লোককে হত্যা করে তার যে কী আনন্দ, সে আর কী বলব! সে বলছে, – পরাধীন লোক যত কমে ততই মঙ্গল।
আমি অবাক হচ্ছি, এ সত্যি-সত্যিই পাগল হয়ে যায়নি তো!
* * *
এ কী করলে খোদা? এ কী করলে? এত আঘাতের পরেও হতভাগা দারাকে অন্ধ আর বধির করে দিলে? এই পৈশাচিক যুদ্ধ-তৃষ্ণার ফলে যে এই রকমই একটা কিছু হবে, তা আমি অনেক আগে থেকেই ভয় করছিলাম! আচ্ছা করুণাময়, তোমার লীলা আমরা বুঝতে পারিনে বটে, কিন্তু এই যে নিরাপরাধ যুবকের চোখ দুটো বোমার আগুনে অন্ধ আর কান দুটো বধির করে দিলে, আর আমার মতো পাপী শয়তানের গায়ে এতটুকু আঁচড় লাগল না, এতেও কি বলব যে, তোমার মঙ্গল-ইচ্ছা লুকানো রয়েছে? কী সে মঙ্গল, এ অন্ধকে দেখাও প্রভু, দেখাও! এ অন্ধের দাঁড়াবার যষ্টিও যে ভেঙে দিয়েছি আমি। তবে কি আমার বাহিরটা অক্ষত রেখে ভিতরটাকে এমনই ছিন্ন-ভিন্ন আর ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকবে? ওগো ন্যায়ের কর্তা! এই কি আমার দণ্ড, এই বিশ্বব্যাপী অশান্তি? …
* * *
আজ আমাদের ঈপ্সিত এই প্রধান জয়োল্লাসের দিনেও আমাদের জয়-পতাকাটা রাজ-অট্টালিকার শিরে থর থর করে কাঁপছে! বিজয়-ভেরিতে জয়নাদের পরিবর্তে যেন জান-মোচড়ানো শ্রান্ত ‘ওয়ালটজ’-রাগিণীর আর্ত সুর হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বেরোচ্ছে! তূর্য-বাদকের স্বর ঘন ঘন ভেঙে যাচ্ছে! – আজ অন্ধ সেনানী দারার বিদায়ের দিন। অন্ধ-বধির আহত দারা যখন আমার কাঁধে ভর করে সৈনিকদের সামনে দাঁড়াল, তখন সমস্ত মুক্তি সেবক সেনার নয়ন দিয়ে হু হু করে অশ্রুর বন্যা ছুটেছে! আমাদের কঠোর সৈনিকদের কান্না যে কত মর্মন্তুদ, তা বোঝাবার ভাষা নেই। মুক্তিসেবক-সৈন্যাধ্যক্ষ বললেন, – তাঁর স্বর বারংবার অশ্রুজড়িত হয়ে যাচ্ছিল, – ‘ভাই দারাবি! আমাদের মধ্যে ‘ভিক্টোরিয়া ক্রস’ ‘মিলিটারি ক্রস’ প্রভৃতি পুরস্কার দেওয়া হয় না, কেননা আমরা নিজে নিজেই তো আমাদের কাজকে পুরস্কৃত করতে পারিনে। আমাদের বীরত্বের, ত্যাগের পুরস্কার বিশ্ববাসীর কল্যাণ; কিন্তু যারা তোমার মতো এই রকম বীরত্ব আর পবিত্র নিঃস্বার্থ ত্যাগ দেখায়, আমরা শুধু তাদেরই বীর বলি! সৈন্যাধ্যক্ষ পুনরায় ঢোক গিলে আর কোটের আস্তিনে তাঁর অবাধ্য অশ্রু-ফোঁটা কটি মুছে নিয়ে বললেন – ‘তুমি অন্ধ হয়েছ, তুমি বধির হয়েছ, তোমার সারা অঙ্গে জখমের কঠোর চিহ্ন, – আমরা বলব, এই তোমার বীরত্বের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার! অনাহূত তুমি বিশ্বের মঙ্গল-কামনায় প্রাণ দিতে এসেছিলে, তার বিনিময়ে খোদা নিজ হাতে যা দিয়েছেন, – হোক না কেন তা বাইরের চোখে নির্মম – তার বড়ো পুরস্কার মানুষ আমরা কী দেব ভাই? ‘খোদা নিশ্চয়ই মহান এবং তিনি ভালো কাজের জন্যে লোকদের পুরস্কৃত করেন!’ – এ যে তোমাদেরই পবিত্র কোরানের বাণী! অতএব হে বীর সেনানী, হয়তো তোমার এই অন্ধত্ব আর বধিরতার বুকেই সব শান্তি সব সুখ সুপ্ত রয়েছে! খোদা তোমায় শান্তি দিন!’ দারা তার দৃষ্টিহীন চোখ দুটি দিয়ে যতদূর সাধ্য সৈনিকগণকে দেখবার ব্যর্থ চেষ্টা করে অশ্রুচাপা কণ্ঠে শুধু বলতে পেরেছিল, –‘বিদায়, পবিত্র বীর ভাইরা আমার!’