আঃ – মা, কী অসহ্য বেদনা এই সারা বুকের পাঁজরে পাঁজরে!…উঃ… হাঁ কীসব ভুল বকছিলাম এতক্ষণ? ঠিক যেন খোওয়াব দেখছিলাম, না? … পাপ ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু নদীর বান-ভাসির পর যেমন বান রেখে যায় একটা পলির আবরণ সারা নদীটার বুকে, তেমনই পাপ রেখে যায় সংকোচের পুরু একটা পর্দা; সেটা কিন্তু ক্ষণস্থায়ী নয়, সেটা হয়তো অনেকেরই সারা জীবন ধরে থাকে। পাপী নিজেকে সামলে নিয়ে হাজার ভালো করে চললেও ভাবে, আমার এ দুর্নাম তো সারাজীবন কাদা-লেপটা হয়ে লেগেই থাকবে! চাঁদের কলঙ্ক পূর্ণিমার জ্যোৎস্নাও যে ঢাকতে পারে না! এই পাপে অনুশোচনাটা কত বিষাক্ত – তীক্ষ্ম! ঠিক যেন একসঙ্গে হাজার হাজার ছুঁচ বিঁধছে বুকের প্রতি কোমল জায়গায়। …
আবার আমার মনে পড়ছে সেই আমার বিপথে-টেনে-নেওয়া শয়তান সয়ফুল-মুলকের কথা। সে-ই তো যত ‘নষ্টগুড়ের খাজা’। এখন তাকে পেলে নখ দিয়ে ছিঁড়ে ফেলতাম!
আমারা নারী – মনে করি, এতটুকুতেই আমাদের হৃদয় অপবিত্র হয়ে গেল, আর অনুশোচনায় মনে মনে পুড়ে মরি। আমরা আরও ভাবি যে, হয়তো পুরুষদের অত সামান্যতে পাপ স্পর্শে না। আর তাদের মনে এত তীব্র অনুশোচনাও জাগে না। কিন্তু সেই যে সেদিন, যেদিন আমার বাসনার পিয়াস শুকিয়ে গিয়েছে, আর মধু ভেবে আকণ্ঠ হলাহল পানের তীব্র জ্বালায় ছটফট করচি, আর ঠিক সেই সময় সহসা বিরাট বিপুল হয়ে আমার ভিতরের প্রেমের পবিত্রতা অপ্রতিহত তেজে জেগে উঠেছে – সে-তেজ চোখ দিয়ে ঠিকরে বেরুচ্চে, – সেদিন – ঠিক সেইদিন – সয়ফুল-মুলক সহসা কীরকম ছোটো হয়ে গেল! একটা দুর্বার ঘৃণামিশ্রিত লজ্জার কালিমা তার মুখটাকে কেমন বিকৃত করে দিলে! সে দূর থেকে কেমন আমার দিকে একটা ভীত-চকিত দৃষ্টি ফেলে উপর দিকে দুহাত তুলে আর্তনাদ করে উঠল, – ‘খোদা! আমি জীবন দিয়ে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করব। তবে যেন সে-জীবন মঙ্গলার্থেই দিতে পারি, শুধু এইটুকু করো খোদা।’ তারপর কেমন সে উন্মাদের মতো ছুটে এসে আমার পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে বললে, – ‘দেবী, ক্ষমা করো এ শয়তানকে! দেবীর দেবীত্ব চিরকালই অটুট থাকে, বাইরের কলঙ্কে তা কলঙ্কিত হয় না, বরং সংঘর্ষের ফলে তা আরও মহান উজ্জ্বল হয়ে যায়! কিন্তু আমি? – আমি? – ওঃ, ওঃ, ওঃ!’ সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল। তার সে-ছোটা থেমেছে কিনা জানিনে।
কিন্তু এ কী? আবার আমার মনটা কেন আমাকে যেন ভাঙানি দিচ্ছে শুধু একবার দেখে আসতে যে, তিনি তেমনি করে সেই খেজুর-কাঁটার ঝোপে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছেন কি না। … না, না, – এ প্রাণ-পোড়ানি আর সইতে পারিনে গো – আর সইতে পারিনে! হাঁ, তাঁর সঙ্গে দেখা করবই করব, একবার শেষ দেখা; তার পর বলব তাঁকে, – ‘ওগো, তোমার সে বেদৌরা আর নেই, – সে মরেছে, মরেছে। তার প্রাণ তোমারই সন্ধানে বেরিয়ে গিয়েছে! – তুমি তাকে বৃথা এমন করে খুঁজে বেড়াচ্ছ! বেদৌরা নেই – নেই – নেই।’
তার পর – তার পর? তার পরেও যদি তিনি আমায় চান, তা হলে কী বলব তাঁকে, কী করব তখন? – না, তখনও এমনই শক্ত কাঠ হয়ে বলব, – ‘ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না গো দেবতা, ছুঁয়ো না। আমার এ অপবিত্র দেহ ছুঁয়ে তোমার পবিত্রতার অবমাননা কোরো না!’
আঃ! মা গো! কী ব্যথা! বুকের ভিতরটা কে যেন ছুরি হেনে খান খান করে কেটে দিচ্ছে। …
০৩. দারার কথা
গোলেস্তান
তুমি কি সেই গোলেস্তান? তবে আজ তুমি এত বিশ্রী কেন? তোমার ফুলে সে সৌন্দর্য নেই, শুধু তাতে নরকের নাড়ি-উঠে আসা পূতিগন্ধ! তোমার আকাশ আর তেমন উদার নয়, কে যেন তাকে পঙ্কিল ঘোলাটে করে দিয়েছে! তোমার মলয় বাতাসে যেন লক্ষ হাজার কাচের টুকরো লুকিয়ে রয়েছে! তোমার সারা গায়ে যেন বেদনা! …
কী করলে বেদৌরা তুমি? – বেদৌরা! – নাঃ, এই যে ব্যথা দিলে তুমি, – এই যে প্রাণ-প্রিয়তমের কাছ থেকে পাওয়া নিদারুণ আঘাত, এতেও নিশ্চয়ই খোদার মঙ্গলেচ্ছা নিহিত আছে! আমি কখনই ভুলব না খোদা, যে, ‘তুমি নিশ্চয় মহান আর তোমার-দেওয়া সুখ-দুঃখ সব সমান ও মঙ্গলময়! তোমার কাজে অমঙ্গল থাকতে পারে না, আর তুমি ছাড়া ভবিষ্যতের খবর কেউ জানে না!’ ব্যথিতের বুকে এই সান্ত্বনা কী শান্তিময়! …
আচ্ছা, তবু মন মানছে কই? কেন ভাবছি, এ নিশ্চয়ই আঘাত? – তৃষাতুর চাতক যখন ‘ফটিক জল ফটিক জল’ করে কেঁদে কেঁদে মেঘের কাছে এসে পৌঁছে, আর নিদারুণ মেঘ তার বুকে বজ্র হেনে দিয়ে বিদ্যুৎ-হাসি হাসে, তখন কেন মনে করি, এ মেঘের বড়োই নিষ্ঠুরতা? – কেন?
কিন্তু এত দিনেও নিজের স্বরূপ জানতে পারলুম না! আগে মনে করতুম, আমি কতো বড়ো – কতো উচ্চ! আজ দেখছি, সাধারণ মানুষের চেয়ে আমি এক রত্তিও বড়ো নই! আমারও মন তাদের মতো অমনই সংকীর্ণতা আর নীচতায় ভরা। নইলে আমি বেদৌরার এ দোষ সরল মনে ক্ষমা করতে পারলুম না কেন? হোক না কেন যতই বড়ো সে দোষ! বাহিরটা তার নষ্ট হয়েছে বটে, কিন্তু ভিতরটা যে তেমনই পবিত্র আর শুভ্র রয়েছে! অনেকে যে ভিতরটা অপবিত্র করে বাহিরটা পবিত্র রাখবার চেষ্টা করে, সেইটাই হচ্ছে বড়ো দোষ। কিন্তু এই যে বেদৌরার সহজ সরলতায় তার ভিতরটা পবিত্র রয়েছে জেনেও তাকে প্রাণ খুলে ক্ষমা করতে পারলুম না, সে দোষ তো আমারই; কেননা আমি এখনও অনেক ছোটো। জোর করে বড়ো হওয়ার জন্যে একবার ক্ষমা করতে ইচ্ছে হয়েছিল বটে, কিন্তু তা তো হতে পারে না। সে যে হৃদয় হতে নয়! নাঃ, আমাকে পুড়ে খাঁটি হতে হবে। খুব দূরে থেকে যদি মনটাকে ঠিক করতে পারি, তবেই আবার ফিরব, নইলে নয়। – ওঃ কী নীচ আমি! প্রথমে বেদৌরার মুখ থেকে তার এই পতনের কথা শুনে আমিও তো একেবারে নরক-কুণ্ডে গিয়ে পৌঁছেছিলুম। মনে করেছিলুম আমিও এমনি করে আমার সুপ্ত কামনায় ঘৃতাহুতি দিয়ে বেদৌরার উপর শোধ নেব। তারপর নরকের দ্বার থেকে কেমন করে হাত ধরে অশ্রু মুছিয়ে আমায় কে যেন ফিরিয়ে আনলে! সে বেশ শান্ত স্বরেই বললে, – ‘এ প্রতিশোধ তো বেদৌরার উপর নয় ভাই, এ প্রতিশোধ তোমার নিজের উপর!’ ভাবলুম, তাই তো, অভিমানের ব্যথায় ব্যথিত হয়ে এ কী, আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলুম! আমি আবার ফিরলুম। তার পর বেদৌরাকে বলে এলুম, – ‘বেদৌরা! যদি কোনো দিন হৃদয় হতে ক্ষমা করবার ক্ষমতা হয়, তবেই আবার দেখা হবে, নইলে এই আমাদের চির-বিদায়! মুখে জোর করে ক্ষমা করলুম বলে তোমায় গ্রহণ করে আমি তো একটা মিথ্যাকে বরণ করে নিতে পারিনে। আমি চাই, প্রেমের অঞ্জন আমার এই মনের কালিমা মুছিয়ে দিক।’ বেদৌরা অশ্রু-ভরা হাসি হেসে বললে, – ‘ফিরতেই হবে প্রিয়তম, ফিরতেই যে হবে তোমায়! এ সংশয় দু-দিনেই কেটে যাবে। তখন দেখবে, আমাদের সেই ভালোবাসা কেমন ধৌত শুভ্র বেশে আরও গাঢ় পূত হয়ে দেখা দিয়েছে! আমি তোমারই প্রতীক্ষায় গোলেস্তানের এই ক্ষীণ ঝরনাটার ধারে বসে গান আর মালা গাঁথব। আর তা যে তোমায় পরতেই হবে। ব্যথার পূজা ব্যর্থ হওয়ার নয় প্রিয়! … কোথায় যাই এখন, আর সে কোন্ পথে? ওগো আমার পথের চিরসাথি, কোথায় তুমি? –
০৪. সয়ফুল-মুলকের কথা
আমি সেই শয়তান, আমি সেই পাপী, যে এক দেবীকে বিপথে চালিয়েছিল। – ভাবলুম, এই ভুবনব্যাপী যুদ্ধে যে-কোনো দিকে যোগ দিয়ে যত শিগগির পারি এই পাপ-জীবনের অবসান করে দিই। তারপর? তারপর আর কী? যা সব পাপীদের হয়, আমারও হবে।