কিন্তু অন্ধ অবোধ পুরুষ তোমাদের ওই স্বভাবজাত করুণাকেই ভালোবাসা মনে করে বড়ো বেশি আনন্দ পায়, সুখ অনুভব করে। হায় রে অভাগা! তাকে পরে তার জন্যে আবার দুঃখও পেতে হয় অনেক গুণ বেশি। কারণ, মিথ্যা যা, তা একদিন-না একদিন ধরে পড়েই। হঠাৎ একদিন নিশীথে বুকে জড়িয়ে ধরেও সে ধরে ফেলে যে, আমার এই নিকটতম মানুষটি আমার সব চেয়ে সুদূরতম। আমার বুকে থেকেও এ আমার নয়। একে হারিয়েছি, হারিয়েছি এ জনমের মতো। সে যাতনা যে কী নিদারুণ, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। এ ভুল-ভাঙার সাথে সাথে অনেকেরই বুক নিষ্করুণভাবে ভেঙে যায়, তার জীবন চিরতরে নিষ্ফল ব্যর্থ হয়ে যায়! সে তখন নির্মম আক্রোশে নিজের উপর নির্দয়তম ব্যবহার করে নিজের সে ভুলের শোধ নেয়। সে আত্মহত্যা করে, এক নিমেষে নয়, একটু একটু করে কচলিয়ে কচলিয়ে। তোমাদের নারী জাতিকে আমি খুব বেশি শ্রদ্ধা করি, প্রাণ হতে তাদের মঙ্গল কামনা করি, কিন্তু তাদের উপর এই অভিযোগ চিরদিন রয়ে গেল যে, তারা পুরুষের ভালোবাসার বড়ো অনাদর করে, বড়ো অবহেলা অপমান করে। তারা নিজেও জীবনে সুখে হয় না, অন্যকেও সুখী করতে পারে না। আমাদের সমাজের বেদনার সৃষ্টি এইখানেই। যে তাকে সকল রকমে সুখী করে তার বাহিরে ভিতরে রানি করে দেবী করে রাখতে পারত, রূপ-যৌবন-গরবিনি নারী তাকে পায়ে মাড়িয়ে চলে যায়। সে হতভাগার রক্তঝরা প্রাণের উপর দিয়ে পায়ে আলতা পরে। পরে তাকে এর জন্যে অনুতাপ করতে হয় সারাটা জীবন ধরে, তা জানি। ভালোবাসাকে অবমাননা করে সে-ও জীবনে আর ভালোবাসা পায় না, তখন তার জীবন বড়ো দুর্বিষহ হয়ে পড়ে, বিষিয়ে ওঠে! তখন হয়তো তার বেশি করে তাকেই মনে পড়ে, যে তার এক কণা ভালোবাসা পেলে আজ তাকে মাথায় নিয়ে নাচত। তোমরা হয়তো ভুরু কুঁচকে বলবে, এ আমার মিথ্যা ধারণা। তা বলো, আমি যা দেখছি, তাই বলছি। তোমরা একটা কথা বলবে – ‘নারী বড়ো ভালোবাসার কাঙালিনি। একটু আদর পেলে তাকে সে মনে প্রাণে ভালোবেসে ফেলে।’
শুনে হাসি পায় আমার! একটু আদর তো ছোটো কথা, জন্ম-জন্ম ধরে পাখিটির মতো করে বুকে রেখে, আদর-সোহাগ করে ভালোবেসেও তোমার মন পাইনি, শুধু এই একটা উদাহরণ দেখিয়েই ক্ষান্ত হলুম। আমার মতোন হতভাগা দু-দশটা প্রায়ই দেখতে পাবে পথে ঘাটে টো-টো কোম্পানির দলে। নেহাৎ চোখের মাথা না খেলে তোমরা তা অস্বীকার করতে পারবে না।
যাক, হিংসার কথা বলতে গিয়ে কী সব বকলুম। আমি বলতে চাই যে, আমি তোমায় দেখিয়ে-দেখিয়ে তোমারই চোখের সামনে একে ওকে কত আদর করেছি, কিন্তু কোনোদিন তোমার তাতে হিংসে হয়নি। তুমি কোনোদিন বাইরে ভিতরে এতটুকু চঞ্চল বা বিচলিত হওনি। তুমি মনে মনে জান যে, তুমি আমার নও, তুমি আমায় ভালোবাসতে পার না, অতএব আমি যাকেই যত আদর ভালোবাসা দেখাই, তাতে তোমার কিছুই আসে যায় না। আমার উপর যখন তুমি কোনো দাবিই রাখ না, তখন আমায় যে-কেউ ভালোবাসুক বা আমি যাকেই ভালোবাসি, তাতে তোমার কী আসে যায়?
আমার এখন মনে হচ্ছে কী জান? আমি যদি তোমার চেয়েও সুন্দরী মেয়ে হতে পারতুম, তাহলে তোমার ভালোবাসার মানুষটিকে ভালোবেসে দেখতুম তোমার বুকে কেমন ব্যথা বাজে, কত বেদনা লাগে!
এত কথা কেন জানালুম, জান? আমি আজ রাজবন্দি। প্রেসিডেন্সি জেলের হাজতে বসে তোমায় এই চিঠি দিচ্ছি। কাল আমার বিচার হবে। বিচারে দুটি বছরের সশ্রম কারাদন্ড তো হবেই। জেলের এক কর্মচারী দৈবক্রমে আমারই এক বন্ধু – শৈশব কালের। আমাদের আজ আশ্চর্য রকমের দেখাশোনা। স্কুলে আমাদের দুইজনের মধ্যে বরাবর ক্লাসে ফার্স্ট কে হবে এই নিয়ে জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলত। ওরই কৃপায় এত বড়ো চিঠি এমন করে লেখবার অবসর আর সাজ-সরঞ্জাম পেয়েছি, তা না হলে কারুকখে কোনো কিছু জানিয়ে যেতে পারতুম না। ভগবান বন্ধুর আমার মঙ্গল করুন!
তুমি মনে করবে, মাত্র দু-বছরের জেল হবে হয়তো, তার জন্যে এমন বিদায়-কান্না কেন? আবার তো ফিরে আসব। কিন্তু আমি জানি, আমি আর ফিরব না। তোমায় এতদিন বলিনি, লুকিয়ে রেখেছিলুম, কিন্তু আজ যাবার দিনে কষ্ট পাবে জেনেও জানিয়ে যাচ্ছি। আমার যক্ষ্মা হয়েছে – যাকে আমাদের দেশে শিবের অসাধ্য রোগ বলে। ডাক্তার কতবার আমায় পরিশ্রম করতে মানা করেছে, আমার কত বন্ধু আমায় কত মিনতি করে হাতে-পায়ে ধরে এখন কিছু দিনের জন্যে বিশ্রাম করতে বলেছে, আর আমি ততই দ্বিগুণ বেগে কাজ করেছি। সে সময় তুমি যদি আমায় একটিবার মানা করতে! করুণা করে নয় – ভালোবেসে, তাহলে কী করতুম, জানি না। কিন্তু তুমি তো আর আমার এ ভীষণ রোগের খবর জানতে না! তাহলে দয়া করে হয়তো আমায় মিনতি করে লিখতে ভালো হবার জন্যে। …
তবু কিন্তু তোমার সকল শাসন মেনে চলছি আমি আমার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। এমন করে আর কেউ আমায় কথা শোনাতে পারেনি, এ-বিশ্বে এত বড়ো স্পর্ধা তুমি ছাড়া আর কারুর হয়নি যে, আমায় শাসন করে, হুকুম শোনায়! – যদি কোনো অপরাধ করে থাকি তোমার কাছে কোনোদিন, তবে তা ভুলে যেও না, ক্ষমা করো এই ভেবে যে, তুমি যাকে কিছুতেই ভালোবাসতে পারনি, সেই তোমার সকল কথা তার শেষ দিন পর্যন্ত খোদার পবিত্র বাণীর চেয়েও পবিত্রতর মনে করে মেনে চলেছে। এইটুকু ভেবে পার তো একটু আনন্দ অনুভব করো। আমার মতোন দুর্জয় বাঁধন-হারাকে তুমি জয় করেছিলে, এই ভেবেও একটু গৌরব করো।