সেই পাগলটা আবার এসে জানিয়ে দিলে গেল যে, তুমি চমনে ফুটে শুকিয়ে যাচ্ছ।…
আমি এসেই তোমায় দূর হতে দেখে চিনেছি। তবে তুমি আমায় দেখে অমন করে ছুটে পালালে কেন? সে কী মাতালের মতো টলতে টলতে দৌড়ে লুকিয়ে পড়লে ওই খোর্মা গাছগুলোর আড়ালে! সে কী অসংবৃত অশ্রু ঝরে পড়ছিল তোমার! আর কতই যে ব্যথিত অনুযোগ ভরে উঠেছিল সে করুণ দৃষ্টিতে!
কিন্তু কোথা গেলে তুমি? – বেদৌরা, তুমি কোথায়?…
কেন আমি মূর্ছিত হয়ে পড়লুম?
– ওঃ!
০২. বেদৌরার কথা
বোস্তান
আঃ মাগো কী ব্যথিত পাণ্ডুর আকাশ! এই যে এত বৃষ্টি হয়ে গেল, ও অসীম আকাশের কান্না নয় তো? – না, না, এত উদার যে, সে কাঁদবে কেন? আর কাঁদলেও তার অশ্রু আমাদের সংকীর্ণ পাপ-পঙ্কিল চোখের জলের মতো বিস্বাদ আর উষ্ণ নয় তো! দেখছ, সে কত ঠান্ডা! …
ওঃ কিন্তু আমি কী স্বপ্ন দেখছি? একেবারে এক দৌড়ে চমন থেকে এই বোস্তানে এসেছি! তা হোক, এতক্ষণে যেন জানটা ধড়ে এল। – আ মলো! এত হুঁকরে হুঁকরে বুক ফেটে কান্না আসছে কীসের? – মানুষের মনের মতো আর বালাই নেই। ওই জ্বালাতেই তো আমায় জ্বালিয়ে খেলে গো! – কী? তার দেখা পেয়েছি বলে এ-কান্না? – তাতে আর হয়েছে কী?
তিনি যে ফিরে আসবেনই, সে তো জানা কথা। কিন্তু এত দিনে কেন? এ অসময়ে কেন নাথ? এখন যে আমার মালতীর লতা রিক্তকুসুম! ওগো, এ মরণের তটে এ দুর্দিনে কী দিয়ে বাসর সাজাব? যদি এলেই তবে কেন দুদিন আগেই এলে না? তা হলে তো তোমায় এমন করে এড়িয়ে চলতে হত না !সেই দিনই – যেদিন আবার ওই চমনের শুকনো বাগানের ধারে তোমায় দেখতে পেয়েছিলাম – সেই দিনই তোমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতাম, – ‘এসো প্রিয়, ফিরে এসো!’ ওগো! হতভাগিনি – আমি যে হৃদয়ের সে পবিত্রতা রক্ষা করতে পারিনি! ওই শোনো দূরে আমার সমবেদনায় কী একটা জানোয়ার কাতরে উঠেছে – উঃ উঃ উঃ।
আমরা নারী, একটুতেই যত কেঁদে ভাসিয়ে দিতে পারি, পুরুষরা তা তো পারে না। তাদের বুকে যেন সব সময়েই কীসের পাথর চাপা। তাই যখন অনেক বেদনায় এই সংযমী পুরুষদের দুটি ফোঁটা অসংবরণীয় অশ্রু গড়িয়ে পড়ে, তখন তা দেখে না কেঁদে থাকতে পারে, এমন নারী তো আমি দেখি না! –
সেদিন যখন কত বছর পরে আমাদের চোখাচোখি হল, তখন কত মিনতি-অনুযোগ আর অভিমান মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছিল আমাদের চারটি চোখেরই সজল চাউনিতে! – হাঁ, আর কেমন ‘বেদৌরা’ বলে মাথা ঘুরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে সে ওই খেজুরের কাঁটা-ঝোপটায় পড়ে গেল! আঃ আঃ, তা দেখে পাষাণী-আমি কী করেই সে চোখ দুটো জোর করে দুই হাত দিয়ে চেপে এত দূর যেন কোনো অন্ধ অমানুষিক শক্তির বলে ছুটে এলাম?
পুরোনো কত স্মৃতিই আজ আমার বুকে ছেপে উঠছে! সেই গোলেস্তানে এক জোড়া বুলবুলেরই মতো মিলনেই অভিমান, মিলনেই বিচ্ছেদ-ব্যথা আর তারই প্রগাঢ় আনন্দে অজস্র অশ্রুপাত! তার চিন্তাটাও কত ব্যথিত-বিধুর! – তারপর সেই জুয়াচোরের জোর করে আমায় ছিনিয়ে নেওয়া দয়িতের বুক থেকে, – অনেক কষ্টে তার হাত এড়িয়ে প্রিয়ের অন্বেষণ! – ওঃ কি-ই না করেছি তাকে আবার পেতে! কই তখনও তো তিনি এলেন না!
তার পর ভিতরে-বাইরে সে কী দ্বন্দ্ব লেগে গেল! ভিতরে ওই এক তুসের আগুন ধিকিধিকি জ্বলতে লাগল, আর বাইরে? – বাইরে ফাগুনের উদাস বাতাস প্রাণে কামনার তীব্র আগুন জ্বালিয়ে দিলে! ঠিক সেই সময় কোথা থেকে ধূমকেতুর মতো সয়ফুল-মুলক এসে আমায় কান-ভাঙানি দিলে। – ভালোবাসায় কী বিরাট শান্ত স্নিগ্ধতা আর করুণ গাম্ভীর্য, ঠিক ভৈরবী রাগিণীর কড়ি-মধ্যমের মতো! আর এই বিশ্রী কামনাটা কত তীব্র – তীক্ষ্ণ – নির্মম! এই বাসনার ভোগে যে সুখ, সে হচ্ছে পৈশাচিক সুখ। এতে শুধু দীপক রাগিণীর মতো পুড়িয়েই দিয়ে যায় আমাদের! অথচ এই দীপকের আগুন একবার জ্বলে উঠবেই আমাদের জীবনের নব-ফাল্গুনে। সেই সময় স্নিগ্ধ মেঘ-মল্লারের মতো সান্ত্বনার একটা-কিছু পাশে না থাকলে সে যে জ্বলবেই – দীপক যে তাকে জ্বালাবেই!
তাই তো যেদিন পুষ্পিত যৌবনের ভারে আমি ঢলে পড়ছিলাম, আর একজন এসে আমায় যাচ্ঞা করলে, তখন আমার এই বাহিরের প্রবৃত্তিটা দমন করবার ক্ষমতাই যে রইল না! তখন যে আমি অন্ধ। – ওগো দেবতা, সেদিন তুমি কোথায় ছিলে? কেউ যে এল না শাসন করতে তখন! হায়, সেই দিনই আমার মৃত্যু হল। সেই দিনই আমি ভিখারিনি হয়ে পথে বসলাম। ওগো, আমার সেই অধঃপতনের দিনে চোখে যে পুঞ্জীভূত অন্ধকারের নিবিড় কালিমা একেবারে ঘন-জমাট হয়ে বসেছিল, তখন, এখনকার মতো এতটুকুও আলোক যে সে-অন্ধকারটাকে তাড়াতে চেষ্টা করেনি। হয়তো একটি রশ্মিরেখার ঈষৎপাতে সব অন্ধকার সেদিন ছুটে পালাত। তা হলে দেখতে গো, কে আমার সমস্ত হৃদয়-আসন জুড়ে রাজাধিরাজ একচ্ছত্র সম্রাটের মতো বসে আছে।
তবু যে আমার এ অধঃপতন হল? তা সেদিনও বুঝতে পারিনি, আজও বুঝতে পারছিনে, কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে! – কিন্তু আমি যদি বলি, আমার প্রেম – বক্ষের গভীর গোপন-তলে-নিহিত মহান প্রেম, যা সর্বদাই পবিত্র, তা তেমনই পূত অনবদ্য আছে আর চিরকালই থাকবে, তার গায়ে আঁচড় কাটে বাইরের কোনো অত্যাচার-অনাচারের এমন ক্ষমতা নেই, – তা হলে কে বুঝবে? কেই বা আমায় ক্ষমা করবে? – তবু আমি বলব, প্রেম চিরকালই পবিত্র, দুর্জয়, অমর; পাপ চিরকালই কলুষ, দুর্বল আর ক্ষণস্থায়ী।