‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কখন কে ধরা পড়ে কে জানে।
সকল গরব হায়, নিমেষে টুটে যায়, সলিল বয়ে যায় নয়ানে।’
তা না হলে এতো বড়ো দুর্দান্ত দুর্বার আমাকেও তুমি আজ শিশুর মতোন করে কাঁদাচ্ছ! তুমি আর-সকলের কাছে এত সরল, আর আমার কাছেই কেন এত দুর্বোধ হয়ে পড়েছ, বলতে পারো লক্ষ্মীমণি? – হাঁ, একটি কথা নিবেদন করে রাখি এর মধ্যে, – যখন জীবনে বড্ডো ক্লান্ত হয়ে পড়বে তোমার ভালোবাসার অবমাননা দেখে, যখন দেখবে তোমার বুক-ভরা অভিমান পদাহত হয়ে ধুলোয় পড়ে লুটাচ্ছে, যখন নিরাশায় বুক ভেঙে যেতে চাইবে (ভগবান না করুন), সেদিন এই ভেবে সান্ত্বনা পেয়ো প্রিয় আমার, যে, এই দুঃখের সংসারেও অন্তত একজন ছিল, যে তোমায় বড়ো প্রাণ ভরে ভালোবেসেছিল। বিনিময়ে তার এক কণাও ভালোবাসা সে পায়নি, তবু সে এতটুকু ব্যথা রেখে যায়নি তোমার জন্যে, এমনকী কোনোদিন তোমার কাছে তা নিয়ে অনুযোগও করেনি। সে তোমায় পেলে মাথার মণি করে রাখত। তোমাকে রাজরাজেন্দ্রাণী করবার সকল ক্ষমতা, সকল সাধ তার ছিল। তোমার এত ভালোবাসা এত অভিমানের অধিকারী হলে সে এমন করে তার বিপুল আশা-আকাঙ্ক্ষা-ভরা উদ্দাম তরুণ জীবনকে এত অল্প দিনে ব্যর্থ করে এমন করে বিদায় নিত না। অনেক-অনেক বড়ো কিছু বিশ্বের বিস্ময় হতে পারত। বড়ো ব্যথায় তার সারা জীবনটা বিদ্রোহ আর স্বেচ্ছাচারিতা করেই কেটে গেল। আরও মনে করো যে, পরপারে গিয়েও সে শান্ত হতে পারেনি, চিরদিনের মতো এবারেও সে সেখানে তোমারই তরে মালা হাতে করে তার অশান্ত জীবন বয়ে বেড়াচ্ছে পথে পথে ঘুরে। তোমায় বুকে করে তুলে নেবার জন্যে সে সকল সময় তোমার পানে তার সকল প্রাণ-মন নিয়োজিত করে রেখেছে। সে যে তোমায় সত্যিই ভালোবাসে, তাই প্রমাণ করতে সে তার নিজের গর্দানে নিজে খড়্গ হেনে মরেছে! আরও মনে করো সেই দিন, যাকে তুমি একদিন মনে মনে তোমার সুখের পথের কাঁটা, তোমার জীবনের অভিশাপ মনে করেছিলে, সে-ই তোমার সকল অকল্যাণ সকল অমঙ্গল থেকে বাঁচাবার জন্যেই চিরদিনের মতো তোমার পথ হতে সরে গিয়েছে। মনে করো, যাকে তুমি অনাদর করেছ, তার এককণা ভালোবাসা পাবার জন্যে বহু হতভাগিনি বহুদিন ধরে সাধনা করেছিল, কিন্তু সে কোনোদিন তার মানসী-প্রিয়া – তোমায় ছাড়া আর কারুর পানে একটু হেসেও চাইতে পারেনি, পাছে তোমার অভিমান হয়, পাছে তুমি ব্যথা পাও ভেবে।
আর একটা ছোটো কথা এইখানেই মনে পড়ে গেল। শুনে তুমি হয়তো আমায় কী ভাববে, জানি না। তোমার বিরুদ্ধে যে-যে কারণে আজ এত বড়ো বুক-জোড়া অভিমান নিয়ে যাচ্ছি, এটাও তারই একটা। সেটা আর কিছু নয়, কাল চিঠিগুলো তোমার পড়তে পড়তে হঠাৎ ও-কথাটা মনে পড়ে গেল। তুমি জান, আমি বড্ড হিংসুটে। তোমায় অন্যে ভালোবাসবে, এ-চিন্তাটাও সইতে পারিনে, দেখতে পারা তো দূরের কথা। সকলে তোমার খুব প্রশংসা করুক, তোমায় ভালো বলুক, তাতে খুবই আনন্দ আর গৌরব অনুভব করব, কিন্তু তাই বলে অন্যকে তোমায় ভালোবাসতে তো দিতে পারিনে। আমি চাই, তুমি একা আমার – শুধু আমার – ভিতরে বাইরে পরিপূর্ণরূপে আমার হও, আর আমিও পূর্ণরূপে তোমার হাতে নিজেকে সমর্পণ করে সুখী হই। আমি ছাড়া তোমাকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না – কখনই না, কিছুতেই না। তাই যখনই দেখেছি যে, অন্যে তোমার দিকে একটু চেয়ে দেখেছে আর তুমিও তার পানে হেসে চেয়েছ, অমনি মনে হয়েছে এক্ষুণি গিয়ে তার বুকে ছোরা বসিয়ে দিই। কিন্তু ভগবান তোমাকে রূপ আর গুণ এত অপর্যাপ্ত পরিমাণে দিয়েছেন যে, তোমায় দেখেই লোকে ভালোবেসে ফেলে। তোমাকে ভালোবাসা-পিয়াসী তৃষাতুর মানুষের মন যে ভালো না বেসেই পারে না। তাই কতদিন মনে হয়েছে যে, তোমাকে নিয়ে এমন বিজন বনে পালাই, যেখানে তুমি আর আমি ছাড়া কেউ থাকবে না। চোখ মেললেই আমি তোমাকে দেখব, তুমি আমাকে দেখবে। আমার এ যেন রাহুর প্রেম। নয়? আমায় ছেড়ে অন্যকে তুমি ভালোবাসবে, আমার এই ব্যথাটাই সব চেয়ে মর্মন্তুদ। তাই তো এমন করে তোমার কাছে যাচ্ঞা করে এসেছি যে, আমার চেয়ে বেশি ভালো কাউকে ভালোবাসতে পারবে না – পারবে না। কিন্তু তুমি আমার অত সকরুণ মিনতি শুনেও কোনোদিন কথা কয়ে তা জানাওনি, একটু মিথ্যা করে মাথা দুলিয়েও বলনি, যে, হাঁ গো হাঁ। … শুধু নিস্তব্ধ মৌন হয়ে গেছ। তোমার তখনকার ভাবের মানেটা আজও বুঝতে পারছিনে বলেই আমার এত প্রাণপোড়ানি আর ছটফটানি। আজ আমি বড়ো সুখে মরতে পারতাম, যদি আমার এই চিরদিনের জন্যে ছাড়াছাড়ির ক্ষণেও জানতে পারতাম তোমার সত্যিকার মনের কথা। এখন জানাতে চাইলেও হয়তো আর জানাতে পারবে না। যদিই পারতে, তাহলে হয়তো চির-হতভাগ্য বলে একটু করুণা করে আমায় অনেক কিছু সিক্ত সান্ত্বনা দিয়ে আমায় প্রবোধ দিতে, কিন্তু হায় প্রিয় আমার, এ মৃত্যুপথের পথিককে আর ভুলাতে পারতে না, সে সুযোগ তাই আমি ইচ্ছে করেই দিলাম না তোমায়। যখন তুমি আমার এই চিঠি পড়বে, তখন আমি তোমার নাগালের বাইরে গিয়ে পড়ব। দেখো, আমার আজ মনে হচ্ছে পুরুষদের মতোন বোকা ভ্যাবাকান্ত আর নেই, অন্তত মেয়েদের কাছে। পুরুষ যেমন করে ভালোবাসা পাবার জন্যে হা-হা করে উন্মাদের মতোন ছুটে যায়, তা দেখে মনে হয়, এর এ বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা বুঝি স্বয়ং ভগবানও মেটাতে পারবে না, কিন্তু তাকে একটি ছোট্ট মিষ্টি কথা দিয়ে তোমরা এমনই ভুলিয়ে দিতে পার যে, তা দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়। এত বড়ো দুর্দান্ত দুর্বিনীতকে ওই একটু মিষ্টি করে ‘লক্ষ্মীটি’ বলে একটু কপালে গিয়ে হাতটি রাখলে, বা গিয়ে তার হাতটি ধরলেই সে যত দূর হতে-পারা-সম্ভব সুশীল সুবোধ বালকটির মতোন শান্ত হয়ে পড়ে। তোমার মনে কী আছে তা ভেবে দেখতে চায় না, ওই একটু পেয়েই ভালোবাসার কাঙাল পুরুষ এত বেশি বিভোর হয়ে পড়ে। তবু তোমরা এই বেচারা হতভাগা পুরুষদের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ধরা দাও না। কিছুতেই তোমাদের মনের কথাটি পাওয়া যায় না, সব ভালোবাসাটুকু পাওয়ার আশা তো মরীচিকার পেছনে ছোটার মতোই। কোথায় যেন তোমাদের মনের সীমারেখা, কোথায় যেন তোমাদের ভালোবাসার তল, কোথায় যেন তার শেষ! আমি তাই অবাক হয়ে অনেক সময় ভাবি আর ভাবি! মনে কোরো না যে, এগুলো সকলেরই মনের ভাব। আমি আমার এখনকার মনের ভাবগুলো সোজাসুজি জানাচ্ছি। তোমার সঙ্গে তা না মিলতেও পারে। এমনি করে পুরুষ নারীর কাছে চিরদিন প্রতারিত হয়ে আসছে। কারণ, তারা বাইরে যতো বড়ো কর্মী বিদ্বান আর বীর হোক না কেন, তোমাদের কাছে তারা একের নম্বর বোকা, একেবারে ভেড়া বনে যায় বললেও অত্যুক্তি হয় না। তোমাদের কাছে থেকেও তোমাদের মন বুঝতে স্বয়ং ভগবান পারবে না, এ আমি আজ জোর গলায় বলছি। তোমরা নারী, তোমাদের স্বভাবই হচ্ছে স্নেহ করা, সেবা করা, যে কেউ হোক না কেন, তার দুঃখ দেখলে তোমাদের প্রাণ কেঁদে ওঠে, একটু সেবা করতে ইচ্ছা হয়। ওতে তোমাদের গভীর আত্মপ্রসাদ, নিবিড় তৃপ্তি। এইখানে তোমরা দেবী, সন্ন্যাসিনী। এই ব্যথিতের ব্যথা মুছাতে তোমরা সকল রকম ত্যাগ স্বীকার করতে পার, কিন্তু তাই বলে সবাইকে ভালোবাসতে পার না, আর ভালোবাসও না। এইখানে পুরুষ সাংঘাতিক ভুল করে বসে। তোমাদের ওই সেবা আর করুণাটুকু সে ভালোবাসা বলে ভুল করে দেখে, অবশ্য যদি সে তোমায় ভালোবেসে ফেলে। আর যাকে জান যে, সে সত্যি-সত্যিই তোমাকে বড়ো প্রাণ দিয়েই ভালোবাসে, অথচ তুমি কিছুতেই তাকে ভালোবাসতে পারছ না; তা হলে তার জন্যেও তুমি সকল রকম বাইরের ত্যাগ স্বীকার করতে পার, তার সেবা কর, শুশ্রূষা কর, তার ব্যথায় সান্ত্বনা দাও, কত চোখের জল ফেল করুণায়, – তবু কিন্তু ভালোবাসতে পার না। বাইরের সব সুখে জলাঞ্জলি দিতে পার তার জন্যে, কিন্তু মনের সিংহাসনে রাজা করে কিছুতেই তাকে বসাতে পার না।