হ্যাঁ, সেদিন তোমার ওই একটু উষ্ণ ছোঁয়ার আনন্দেই বিভোর হয়ে রইলুম। তার পরের দিন মনে হতে লাগল, তোমায় আড়ালে ডেকে বলি, কেন আমার এ বুকভরা ব্যথার সৃষ্টি। সারা দিন তোমার পানে উৎসুক হয়ে চেয়ে রইলুম, যদি আবার এসে জিজ্ঞেস কর তেমনই করে, কী করলে তুমি ভালো হবে?
হায়রে দুর্ভাগার আশা! তুমি ভুলেও আর সে-কথাটি আর একবার শুধালে না এসে! সারাদিন আকুল উৎকণ্ঠা নিয়ে বেলা-শেষের সাথে সাথে আমারও প্রাণ যেন কেমন নেতিয়ে পড়তে লাগল। আমার কাঙাল আত্মার এক নির্লজ্জ বেদনা ভুলবার জন্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় গানটা বড়ো দুঃখে বড়ো প্রাণ ভরেই গাইতে লাগলুম, –
‘তুমি জান ওগো অন্তর্যামী
পথে পথেই মন ফিরালেম আমি।
ভাবনা আমার বাঁধলনাকো বাসা।
কেবল তাদের স্রোতের পরেই ভাসা,
তবু আমার মনে আছে আশা,
তোমার পায়ে ঠেকবে তারা স্বামী॥
টেনেছিল কতই কান্না হাসি,
বারে বারেই ছিন্ন হল ফাঁসি!
শুধোয় সবাই হতভাগ্য বলে –
‘মাথা কোথায় রাখবি সন্ধ্যা হলে?’
জানি জানি, নামব তোমার কোলে
আপনি যেথায় পড়বে মাথা নামি।’
আমার কণ্ঠ আমার আঁখি আমারই ব্যথায় ভিজে ভারী হয়ে উঠল! আমার গানের সময় আমি আর বাহিরকে ফাঁকি দিতে পারিনে। সে সুর তখন আমার স্বরে কেঁপে কেঁপে ক্রন্দন করে, সে-সুর সে-কান্না আমার কণ্ঠের নয়, আমার প্রাণের ক্রন্দসীর। গান গেয়ে মনে হল, যেন এই বিশ্বে আমার মতোন ছন্ন-ছাড়ারও অন্তত একজন বন্ধু আছেন, যিনি আমার প্রাণের জ্বালা, মর্ম-ব্যথা বোঝেন, আমার গান শুনে যাঁর চোখের পাতা ভিজে ওঠে। তিনি আমার অন্তর্যামী। অমনি এ-কথাটিও মনে হয়েছিল যে, যদি সত্যিই আমার কেউ প্রিয়া থাকত, তাহলে সে আমার ওই ‘শুধোয় সবাই হতভাগ্য বলে, মাথা কোথায় রাখবি সন্ধ্যা হলে?’ – ওইটুকু শুনবার পরই আর দূরে থাকত পারত না, তার কোলে আমার মাথাটি থুয়ে সজল কণ্ঠে বলত, – ‘ওগো, আমার কোলে প্রিয়, আমার কোলে।’ তার তরুণ কণ্ঠে করুণ মিনতি ব্যথায়-অভিমানে কেঁপে কেঁপে উঠত, – ‘ছি লক্ষ্মী! এ গান গাইতে পারবে না তুমি।
কী বিশ্রী লোভী আমি, দেখেছ? তুমি হয়তো এতক্ষণ হেসে লুটিয়ে পড়েছ আমার এই ছেলেমান্ষী আর কাতরতা দেখে! তুমি হয়তো ভাবছো, কি করে এত বড়ো দুর্জয় অভিমানী, দুরন্ত বাঁধন-হারা এমন করে নেতিয়ে পায়ে লুটিয়ে পড়তে পারে, কেমন করে এক বিশ্বজয়ীর এত অল্পে এমন আশ্চর্য এত বড়ো পরাজয় হতে পারে! তা ভাব, কোনো দুঃখ নেই। আমিও নিজেই তাই ভাবছি। কিন্তু ভয় হয় প্রিয়, কখন তোমার এত গরব না-জানি এক নিমেষে টুটে গিয়ে সলিল বয়ে যাবে নয়ানে। সেই দিন হয়তো আমার এ ভালোবাসার ব্যথা বুঝবে। আমার এই পরাজয়ের মানেও বুঝবে সেদিন।
যাক, যা বলছিলাম তাই বলি। – গান গেয়ে কেন আমার মনে হল, আমার অন্তর্যামী বুঝি আমার আঁখির আগে এসে নীরবে জল-ছল-ছল চোখে দাঁড়িয়ে। চোখের জল মুছে সামনে চাইতেই, – ও হরি! কে তুমি দাঁড়িয়ে অমন করুণ চোখে আমার পানে চেয়ে? আহা, চটুল চোখের কালো তারা দুটি তাদের দুষ্টুমি চঞ্চলতা ভুলে গিয়ে ব্যথায় যেন নিথর হয়ে গেছে! সে পাগল-চোখের কাজল আঁখি-পাতা যেন জলভারাতুর। ওগো আমার অন্তর্যামী! তুমি কি সত্য-সত্যই এই সাঁঝের তিমিরে আমার আঁখির আগে এসে দাঁড়ালে? হে আমার দেবতা! তবে কি আমার আজিকার সন্ধ্যা-আরতি বিফলে যায়নি? আমি আমার সব কিছু ভুলে কেমন যেন আত্মবিস্মৃতের মতো বলে উঠলুম – ‘তুমি আমার চেয়ে কাউকে বেশি ভালোবাসতে পাবে না? কেমন?’
কোনো কথা না বলে তুমি আমার কোলের উপরকার বালিশটিতে এসে মুখ লুকালে। কেন? লজ্জায়? না সুখে? না ব্যথায়? জানি না, কেন। তাই তো আজ আমার এত দুঃখ আর এত প্রাণপোড়ানি। তোমার প্রাণের কথা তুমি কোনো দিনই একটি কথাতেও জানাওনি, তাই তো আজ আমার বুক জুড়ে এত না জানার ব্যথা! অনেক সাধ্য-সাধনায় তুমি মুখ তুলে চাইলে, কিন্তু বললে না, কেন অমন করে মুখ লুকালে। সেদিন একটিবার যদি মিথ্যা করেও বলতে, – ‘হে আমার চির-জনমের প্রিয়! যে, …।’ না, না, যাক সেকথা।
এইখানে একটা মজার খবর দিই তোমাকে। এই হাজত-ঘরে বসেও আমার এমন অসময়ে মনে হচ্ছে, যেন আমি একজন কবি। রোসো, এখনই হেসে লুটিয়ে পড়ো না! তোমার চেয়ে আমি ভালো করেই জানি যে আমার কবি না হওয়ার জন্যে যা-কিছু চেষ্টা-চরিত্তির করার প্রয়োজন, তার কোনোটাই বাদ দেননি ভগবান। তাই আমার বাহির-ভিতর সব কিছুই যেন খোট্টাই মুল্লুকের চোট্টাই ভেইয়্যার মতোই কাঠখোট্টা! তবু যদি আমি কবি হতুম, তাহলে আমার এই ভাবটাকে কী সুন্দর করেই না বলতুম, –
শুধু অনাদর শুধু অবহেলা শুধু অপমান!
ভালোবাসা? – সে শুধু কথার কথা রে!
অপমান কেনা শুধু! প্রাণ দিলে পায়ে দলে যাবে তোর প্রাণ!
শুধু অনাদর, শুধু অবহেলা, শুধু অপমান!
যাক, যা হইনি, কপাল ঠুকলেও আর তা হচ্ছি নে। এখন যা আছি, তাই নিয়েই আলোচনা করা যাক।
দাঁড়াও, – অভিমান করে চেঁচিয়ে হয়তো ও কথাটার অপমানই করছি আমি। নয় কি? আমার মতোন হয়তো তুমিও ভাবছ, কার উপর এ অভিমান আমার? কে আমায় এ অধিকার দিয়েছে এত অভিমান দেখাবার? একবিন্দু ভালোবাসা পেলাম না, অথচ এক সিন্ধু অভিমান নিয়ে বসে আছি! তবু শুনে আশ্চর্য হবে তুমি যে, সত্যি-সত্যিই আমার বড্ড অভিমান হয়। যার উপর অভিমান করি, সে আমার এ অভিমান দেখে হাসবে, না দুপায়ে মাড়িয়ে চলে যাবে, সে দিকে ভ্রূক্ষেপও করি না। চেয়েও দেখি না, আমার এত ভালোবাসার সম্মান সে রাখবে কিনা, শুধু নিজের ভালোবাসার গরবে আজ অন্ধতায় মনে করি, সেও আমায় ভালোবাসে। তাই তো আর আমার এত লাঞ্ছনা ঘরে-বাইরে!