আমার মনের সেই চিরকেলে অক্লান্ত বিরহী শ্রোতা তাড়া দিয়ে কয়ে উঠল, – ও সব পরে ভেবোখন, তার পর কী হল, বলো!…
তখন গাঁয়ের মাথায় মায়ের নত-আঁখির স্নেহ-চাওয়ার মতো নিবিড় শান্তি নেমে এসেছে। করুণ বেদনার সাথে পবিত্র স্নিগ্ধতা মিশে আমার নয়ন-পল্লব সিক্ত করে আনলে।
জল-ভরা চোখে আমার বাকি কথাটুকু মনে পড়ল।…
তার বিয়ের দিন কতক আগের এক রাতে তাতে আমাতে প্রথম ও শেষ গোপন দেখা শোনা। সে বললে – ‘এ বিয়েতে কী হবে ভাই?’
আমি বললাম, ‘তুমি সুখী হবে।’
সে আমার সহজ কণ্ঠ শুনে তার বয়সের কথা, আমার বয়সের কথা – আমাদের ব্যবধানের কথা সব যেন ভুলে গেল। মাথার উপর আকাশ ভরা তারা মুখ টিপে হেসে উঠল। সে আবার তেমনই করে সেই ছেলেবেলার মতো আমার হাতের আঙুলগুলো ফুটিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘তা কী করে হবে? তোমাকে যে ছেড়ে যেতে হবে, তোমাকে যে আর দেখতে পাব না।’
এত দিনে তার এই নতুন রকমের আর্দ্র কণ্ঠের বাণী শুনলাম! তার টানা টানা চোখের ঘন দীর্ঘ পাতায় তারার ক্ষীণ আলো প্রতিফলিত হয়ে জানিয়ে দিল, সে কাঁদছে!
আমি বললাম, – ‘তোমার কথা বুঝতে পেরেছি মোতি। কিন্তু তুমি যার কাছে যাবে, সে আমার চেয়েও তোমায় বেশি ভালোবাসবে; সেখানে গেলে আমাদের সব কথা ভুলে যাবে।’
অন্যে আমার প্রিয়কে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসবে, এই চিন্তাটাও যেন অসহ্য। তার স্বামী আমার চেয়ে ধনী হোক, সুন্দর হোক, শিক্ষিত হোক, কিন্তু আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসবে আমার ভালোবাসার মানুষটিকে, বড়ো অভিমানেই ওই কথাটা আমি বললাম, কিন্তু এ-কথাটা বলেই এবার আমারও যেন বিপুল কান্না কণ্ঠে ফেটে বেরিয়ে আসতে লাগল। সে কান্না রুধবার শক্তি নেই – শক্তি নেই। মূর্ছাতুরার মতো সে আমার হাতটা নিয়ে জোরে তার চোখের উপর চেপে ধরে আর্ত কণ্ঠে কয়ে উঠল, ‘না–না– না।’ কীসের এ ‘না’?
আমি তীব্র কণ্ঠে কয়ে উঠলাম, – ‘ এ হতেই হবে মোতি, এ হতেই হবে। আমায় ছাড়তেই হবে।’
তখন এক অজানা দেবতার বিরুদ্ধে আমার মন অভিমানে আর তিক্ততায় ভরে উঠেছে। সে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে কয়ে উঠল, – ‘ওগো, চিরদিন তো আমায় মেরে এসেছ, এখনও কি তোমার মেরে সাধ মেটেনি? তবে মারো, আরও মারো – যত সাধ মারো।’
কত দিনের কত কথা কত ব্যথা আমার বুকের মাঝে ভরে উঠল! তার পরেই তীব্র তীক্ষ্ণ একটা অভিমানের কঠোরতা আমায় ক্রমেই শক্ত করে তুলতে লাগল। মন বললে – জয়ী হতেই হবে।
আমি ক্রূর হাসি হেসে মোতিকে বললাম, ‘হুঁ! কিছুতেই মানবে না তো, তবে সত্যি কথাটাই বলি, – মোতি, তোমায় যে আমি ভালোবাসি না।’
কথাটা তার চেয়ে আমার বুকেই বেশি বাজল। সে তীরবিদ্ধা হরিণীর মতো চমকে উঠে বললে, – ‘কী?’
আমি বললাম, – ‘তোমায় এতদিন শুধু মিথ্যা দিয়ে প্রতারিত করে এসেছি মোতি, কোনোদিন সত্যিকার ভালোবাসিনি।’
আমার কণ্ঠ যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। আহত ফণিনীর মতো প্রদীপ্ত তেজে দাঁড়িয়ে সে গর্জন করে উঠল, – ‘যাও চলে যাও – তোমায় আমি চাইনে, সরে যাও। তুমি জল্লাদের চেয়েও নিষ্ঠুর, বে-দিল ! – যাও, সরে যাও।… তোমার পায়ে পড়ি চলে যাও, আর আমার ভালোবাসার অপমান কোরো না।’
দু-চোখ হাত দিয়ে টিপে কালবৈশাখীর উড়ো ঝঞ্ঝার মতো উন্মাদ বেগে সে ছুটে গেল। আমি টাল খেয়ে মাথা ঘুরে পড়তে পড়তে শুনতে পেলাম আর্ত-গভীর আর্তনাদের সঙ্গে বিয়ে-বাড়ির ছালনা-বাঁধা আঙিনায় কে দড়াম করে আছড়ে পড়ে গোঙিয়ে উঠল, – ‘মা–গো।’
ওই যে অনেক দূরের খেয়া-পারে ক্লান্ত মাঝির মুখে পরিশ্রান্ত ক্লান্ত মনের চিরন্তন কান্নাটি ফুটে উঠেছে, ও যেন আমারই মনের কথা, –
মন-মাঝি তোর বইঠা নে রে,
আমি আর বাইতে পারলাম না।’
ওগো আমার মনের মাঝি, আমারও এ-ক্লান্তি-ভরা জীবন-তরি আর যে বাইতে পারি নে ভাই! এখন আমায় কূল দাও, না হয় কোল দাও! –
আমার মনে বড়ো ব্যথা রয়ে গেল, সে হয়তো আমার ব্যথা বুঝলে না। যাকে ভালোবাসি, তাকে ব্যথা দিতে গিয়ে আমার নিজের বুক যে ব্যথার আঘাতে, বেদনার কাঁটায় কত ছিন্ন-ভিন্ন কীরকম ঝাঁঝরা হয়ে গেছে, হায়, তা যদি সে জানত – তা যদি মোতি বুঝতে পারত। ওঃ যাকে ভালোবাসি সেও যদি আমাকে ভুল বোঝে, তবে আমি বাঁচি কী নিয়ে? আমার এ রিক্ত জীবনের সার্থকতা কী? হায়, দুনিয়ায় এর মতো বড়ো বেদনা বুঝি আর নেই।
এই তো আমার গাঁয়ের আমবাগানে এসে ঢুকেছি। ওই তো আমার বন্ধ-করা আঁধার ঘর। চার পাশে দীপ-জ্বালানো কোলাহল-মুখরিত স্নেহনিকেতন, আর তারই মাঝে আমার বিজন আঁধার কুটির যেন একটা বিষমাখা অভিশাপ শেলের মতো জেগে রয়েছে। দিনের কাজ শেষ করে বিনা-কাজের সেবা হতে ফিরে ঘরে ঢুকবার সময় রোজ যে-কথাটি মনে হয়, বন্ধ দুয়ারের তালা খুলতে খুলতে আজও সেই কথাটিই আমার মনের চির ব্যথার বনে দাবানল জ্বালিয়ে যাচ্ছে।
একে একে সব ঘরেই প্রদীপ জ্বলবে, শুধু আমার একা ঘরেই আর কোনো দিন সন্ধ্যা-দীপ জ্বলবে না। সেই ম্লান দীপ-শিখাটির পাশে আমার আসার আশায় কোনো কালোচোখের করুণ-কামনা ব্যাকুল হয়ে জাগবে না!
বাইরে আমার ভাঙা দরজায় উতল হাওয়ার শুধু একরোখা বুকচাপড়ানি আর কারবালা-মাতম রণিয়ে উঠল, –
‘হায় গৃহহীন, হায় পথবাসী, হায় গতি-হারা!’
আমার হিয়ার চিতার চিরন্তনী ক্রন্দসীও সাথে সাথে কেঁদে উঠল, –
‘হায় গৃহহীন, হায় পথবাসী, হায় গতি-হারা!’
১১. রাজবন্দীর চিঠি
প্রেসিডেন্সি জেল, কলিকাতা
মুক্তি-বার, বেলা-শেষ