এমনি করেই আমাদের দিন যাচ্ছিল। সে যখন এগারোর কাছাকাছি, তখন তাকে জোর করে অন্দর-মহলের আঁধার কোণে ঠেসে দেওয়া হল। সে কী ছটফটানি তখন তার আর আমার! মনে হল, এই বুঝি আমার জীবন-স্রোতের ঢেউ থেমে গেল! স্রোত যদি তার তরঙ্গ হারায়, তবে তার ব্যথা সে নিজেই বোঝে, বাঁধ-দেওয়া প্রশান্ত দিঘির জল তার সে বেদন বুঝবে না। মুক্তকে যখন বন্ধনে আনবার চেষ্টা করা হয়, তখনই তার তরঙ্গের কল্লোলে মধুর চল-চপলতার কলহ-বাণী ফুটে ওঠে! তাই এ-রকমে চলার পথে বাধা পেয়েই আমাদের সহজ ঢেউ বিদ্রোহী হয়ে মাথা তুলে সামনের সকল বাধাকে ডিঙিয়ে যেতে চাইলে। চির-চঞ্চলের প্রাণের ধারা এই চপল গতিকে থামাবে কে? পথের সাথি আমার হঠাৎ তার চলায় বাধা পেয়ে বক্র-কুটিল গতি নিয়ে তার সাথিকে খুঁজতে ছুটল। এতদিনে যেন সে তার প্রাণের ঢেউ-এর খবর পেলে!
সর্বক্ষণ কাছে পেয়ে যাকে সে পেতে চেষ্টা করেনি, সে দূরে সরে এই দূরত্বের ব্যথা, ছাড়াছাড়ির বেদনা তার বুকে প্রথম জেগে উঠতেই সে তাকে চিনল এবং বলে উঠল, – ‘যাকে চাই তাকে পেতেই হবে।’
বঞ্চিত স্নেহের হাহাকার, ছিন্ন বাসনার আকুল কামনা তার বুকে উদ্দাম উন্মাদনা জাগিয়ে দিয়ে গেল! তখন সে তার এই আকাঙ্ক্ষিত আশ্রয়কে নতুন পথে নতুন করে খুঁজতে লাগল। সে অন্তরে বুঝলে, এ সাথি না হলে আমি আমার গতি হারাব! এই রকম মুক্তি আর বন্ধনের যুঝাযুঝির মাঝে পড়ে সে কাহিল হয়ে উঠল! সমাজ বললে, – রাখ তোর এ মুক্তি – আমি এই দেওয়াল দিলাম!
সেই দেওয়ালে মাথা খুঁড়ে রক্ত-গঙ্গা বহালে, পাষাণের দেওয়াল – ভাঙতে পারলে না!
এ-দিকে আমাকে কেউ রাখতে পারলে না! লোকের চলার উলটো পথে উজান বেয়ে চলাই হল আমার কাজ! অনেক মারামারি করেও যখন আমাকে স্কুলের খাঁচায় পুরতে পারলে না, তখন সবাই বললে, – এ ছেলের যদি লেখাপড়া হয় তবে সুগ্রীব-সহচর দগ্ধমুখ হনুবংশ কী দোষ করেছিল? তারাও হাল ছেড়ে দিলে, আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে দেখলাম এই বাধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে যত তাকে ভুলে রয়েছি, ততই যেন সে আমার একান্ত আপনার হয়ে আমার নিকটতম কাছে এসে আমার উপর তার সব নির্ভরতা সঁপে গেছে! –
যমুনা আসছিল সাগরের পানে, ওই সাগরও তার দিগন্ত-ছোঁয়া ঢেউ-এর আকুলতা লক্ষ বাহুর ব্যগ্রতা নিয়ে তার দিকে ছুটে যেতে চাইল! দুজনেই অধীর হয়ে পড়েছিল এই ভেবে – হায়! কবে কোন্ মোহানায় তাদের চুমোচুমি হবে, তারা এক হয়ে যাবে!…
আর আমাদের দেখা-শোনা হত না। কথা যা হত, তা কখনও সবাইকে লুকিয়ে ওই একটি চোরা-চাওয়ায়, নয়তো বাতায়নের ফাঁক দিয়ে দুটি তৃষিত অতৃপ্ত দৃষ্টির বিনিময়ে। ওই এক পলকের চাওয়াতেই যে আমাদের কত কথা শুধানো হয়ে যেত, কত ব্যথা-পুলক শিউরে উঠত, তা ঠিক বোঝানো যায় না!
* * *
আরও পাঁচ বছর পরের কথা! –
একদিন শুনলাম তার বিয়ে হবে, মস্ত বড়ো জমিদারের ছেলে বি-এ পাস এক যুবকের সাথে। বিয়ে হবার পর সে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে, তার সাথে আমার এই চোখের চাওয়াটুকুও ফুরাবে, এই ব্যথাটুকুই বড়ো গভীর হয়ে মর্মে আমার দাগ কেটে বসে গেল! এ ব্যথার প্রগাঢ় বেদনা আমার বুকের ভিতর যেন পিষে পিষে দিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু যখন মেঘ-ছাড়া দীপ্ত মধ্যাহ্ন-সূর্যের মতো সহসা এই কথাটি আমার মনে উদয় হল যে, সে সুখী হবে, তখন যেন আমি আমার নতুন পথ দেখতে পেলাম। বললাম, – না, আমি জন্মে কারুর কাছে মাথা নত করিনি, আজও আমাকে জয়ী হতে হবে। আর দুঃখই বা কীসের? সে ধনী শিক্ষিত সুন্দর যুবকের অঙ্কলক্ষ্মী হবে, অভাগি মেয়েদের সুখী হবার জন্যে যা-কিছু চাওয়া যায় তার সব পাবে; কিন্তু হায়, তবু অবুঝ মন মানে না! মনে হয়, আমার মতোন এত ভালোবাসা তো সে পাবে না!
এই কথা ক-টি ভাবতে গিয়ে আমার বুক কান্নায় ভরে এল, – আমার যে বাইরের দীনতা তাই মনে পড়ে তখন আমাকে আমার অন্তরের সত্য-প্রেমের গৌরবের জোরে খাড়া হতে হল। এক অজানার উপর তীব্র অভিমানের আক্রোশে বললাম, নিজের সুখ বিলিয়ে দিয়ে এর প্রতিহিংসা নেব। ত্যাগ দিয়ে আমার দীনতাকে ভরে তুলব।
এত দ্বন্দ্বের মাঝে’ আমার প্রিয় সুখী হবে’ এই কথাটির গভীর তত্ত্ব প্রাণে আমার ক্রমেই কেটে কেটে বসতে লাগল, তার পর হঠাৎ এক সময় আমার বুকের সব ঝঞ্ঝা ঝড় বেদনা তরঙ্গ ধীর শান্ত স্তব্ধ হয়ে গেল! বিপুল পবিত্র সান্ত্বনায় তিক্ত মন আমার যেন সুধাসিক্ত হয়ে গেল! আঃ! কোথায় ছিলে এতদিন ওগো বেদনার আরাম আমার? এতদিন পরে নিশ্চিন্ততার কান্না কেঁদে শান্ত হলাম!
এ কোন্ অর্ফিয়াসের বাঁশির মায়া-তান, এমন করে আমার মনের দুরন্ত সিন্ধুকে ঘুম পাড়িয়ে গেল? … হায়, এতদিন বাঁশির এই জাদু-করা সুর কোথায় ছিল? –
সে দিন নিশীথ রাতে তার বাতায়নের পানে চেয়ে তাই গেয়েছিলাম, –
‘আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই
বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে!
এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর
জীবন ভরে?’
বাঃ, এরই মধ্যেই দেখচি মাঠের সারা পথটা পেরিয়ে গাঁয়ের সীমা-রেখার কাছাকাছি এসে পড়েছি! দূর হতে ঘরে ঘরে মাটির আর কেরোসিনের যে ধোঁয়া-ভরা দীপের আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তাতেই আমার মন কেমন ওই প্রদীপ-জ্বালা ঘরের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে! মনে হচ্ছে, ওই দীপের পাশে ঘোমটা-পরা একটি ছোটো মুখ হয়তো তার দু-চোখ-ভরা আকুল প্রতীক্ষা নিয়ে পথের পানে চেয়ে আছে। দখিন হাওয়ায় গাছের একটি পাতা ঝরে পড়লে অমনি সে চমকে উঠছে, – ওই গো বুঝি তার প্রতীক্ষার ধন এল! তার বুকে এই রকম আশা-নিরাশার যে একটা নিবিড় আনন্দ ঘুরপাক খাচ্ছে, তারই নেশায় সে মাতাল!